জলবায়ু

আইপিসিসি কি এবং এর পরবর্তী প্রতিবেদনে কী থাকছে?

জলবায়ু পরিবর্তন সম্পর্কিত আন্তঃসরকারি প্যানেল কী এবং এটি কীভাবে কোনো কার্যকর বা অকার্যকর পদক্ষেপের মাধ্যমে জলবায়ু পরিবর্তনের সাথে খাপ খাইয়ে নেয়া ও এ সংক্রান্ত সম্ভাব্য প্রতিবন্ধকতাকে প্রভাবিত করতে পারে সে বিষয়গুলো নিয়ে আমরা এই নিবন্ধে ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করেছি।
<p>২০১৯ সালে পরিবর্তনশীল জলবায়ু প্রসঙ্গে মহাসাগর এবং ক্রায়োস্ফিয়ারের একটি প্রতিবেদনের উপর একটি সংবাদ সম্মেলনে আইপিসিসি সদস্যদের সাথে আইপিসিসির চেয়ার হোয়েসুং লি এবং মোনাকোর প্রিন্স আলবার্ট দ্বিতীয় (চিত্র: রয়টার্স / এলামি)</p>

২০১৯ সালে পরিবর্তনশীল জলবায়ু প্রসঙ্গে মহাসাগর এবং ক্রায়োস্ফিয়ারের একটি প্রতিবেদনের উপর একটি সংবাদ সম্মেলনে আইপিসিসি সদস্যদের সাথে আইপিসিসির চেয়ার হোয়েসুং লি এবং মোনাকোর প্রিন্স আলবার্ট দ্বিতীয় (চিত্র: রয়টার্স / এলামি)

জলবায়ু পরিবর্তন সংক্রান্ত আন্তঃসরকার প্যানেল, বা আইপিসিসি, একটি বৈজ্ঞানিক সংস্থা যা ১৯৮৮ সালে বিশ্ব আবহাওয়া সংস্থা (ডব্লিউও) এবং জাতিসংঘের পরিবেশ কর্মসূচির উদ্যোগে সৃষ্টি হয়। এর মূখ্য উদ্দেশ্য হল বিশ্বের বিভন্ন দেশের সরকারগুলোকে সর্বশেষ জলবায়ু বিজ্ঞান সম্পর্কে অবহিত করা এবং আগামী দশকগুলিতে বিশ্বে জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে কী ধরনের প্রভাব সৃষ্টি হতে পারে তার বিষয়ে ধারণা প্রদান করা।

বর্তমানে, বিশ্বের ১৯৫টি দেশ আইপিসিসির সদস্য। এটি সারা বিশ্বের পরিবেশ/জলবায়ু বিজ্ঞানীদের একত্রিত করে যারা স্বেচ্ছায় এর কার্যক্রমের সঙ্গে যুক্ত হয়। আইপিসিসি কোনো মৌলিক গবেষণার কাজ করে না। বরং চলমান বিশ্বে শত শত বিজ্ঞান উপলব্ধ গবেষণাগুলো পর্যালোচনা করে একটি ব্যাপকভিত্তিক মূল্যায়ন প্রতিবেদনসমূহ প্রকাশ করে। এই প্রতিবেদনগুলো মূলত জলবায়ু পরিবর্তন কেন হচ্ছে, দেশে দেশে এর কী ধরনের প্রভাব পড়তে পারে এবং কীভাবে প্রশমন (জলবায়ু পরিবর্তন সীমিত করা) এবং অভিযোজনের মধ্য দিয়ে জনগণ এর ভয়াবহ প্রভাব থেকে রক্ষা পেতে পারে তা নিয়ে সুনির্দিষ্ট আলোচনা করে থাকে।

সর্বশেষ আইপিসিসি প্রতিবেদনে যা বলা হয়েছে?

আইপিসিসি সর্বশেষ প্রতিবেদনগুলোতে তিনটি কার্যকরী গ্রুপের ষষ্ঠ মূল্যায়ন চক্রের প্রতিনিধিত্ব করে। এই ষষ্ঠ মূল্যায়ন প্রতিবেদন (এআর৬ নামে পরিচিত), যা আজকের সবচেয়ে উন্নত জলবায়ু গবেষণা এবং পরিশীলিত জলবায়ু মডেলগুলি পরীক্ষা করে, প্রতিটি কার্যকারী গোষ্ঠী দ্বারা সংকলিত যা তিনটি কিস্তিতে প্রকাশিত হবে। ওয়ার্কিং গ্রুপ-১ কিস্তিটি ২০২১ সালের আগস্টে প্রকাশিত হয়েছিল। একটি সার-সংক্ষেপ ২০২২ সালের অক্টোবর মাসে প্রকাশিত হবে বলে আশা করা হচ্ছে।

এআর৬ প্রতিবেদনের দ্বিতীয় অধ্যায়টি ২৮ ফেব্রুয়ারি ২০২২ সালে প্রকাশিত হবে যার মাধ্যমে জলবায়ু পরিবর্তন দ্বারা প্রভাবিত সম্প্রদায় এবং বাস্তুতন্ত্রের জন্য অভিযোজন বিকল্পগুলো তুলে ধরা হবে। এটি স্থলজগত, মিঠাপানি, মহাসাগরীয় এবং উপকূলীয় বাস্তুতন্ত্রের পাশাপাশি শহর, অবকাঠামো, বিশ্ব স্বাস্থ্য এবং জীবিকা সহ বিস্তৃত ব্যবস্থাগুলো তুলে ধরবে।প্রতিবেদনের দ্বিতীয় অধ্যায়টি আঞ্চলিক এবং উপ-আঞ্চলিক জলবায়ুর বিষয়গুলো নিয়ে পর্যালোচনা করবে যা মূলত এ সংক্রান্ত দুর্বলতা এবং অভিযোজন সুযোগগুলি চিহ্নিত করবে। আর প্রতিবেদনের শেষ অংশটি উন্নয়ন কৌশলগুলো তুলে ধরবে যা অভিযোজন এবং প্রশমনকে আমলে নিয়ে অর্থ ব্যবস্থাপনা এবং আন্তর্জাতিক সহযোগিতার বিষয়গুলো বিশ্লষন করবে।

নতুন প্রতিবেদনটির রুপরেখা যেভাবে তৈরি করা হয়েছে তা বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় যে এবারের প্রতিবদনটিতে অর্থনীতি ও সমাজ বিজ্ঞান সংক্রান্ত বিষয়গুলো আগেরবারের প্রতিবেদনগুলাের থেকে অধিক প্রধান্য পাবে। ধাণা করা হচ্ছে যে এই প্রতিবেদনটিতে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবেলায় অভিযোজনের ক্ষেত্রে সামাজিক ন্যায় বিচারের বিষয়টি তুলনামূলকভাবে প্রধান্য পাবে।

মার্চ মাসে আইপিসিসির এআর৬ প্রতিবদনের তৃতীয় অংশ প্রকাশিত হবে যা ওয়ার্কিং গ্রুপ-৩ দ্বারা সংকলিত। এই প্রতিবেদনে মূলত বিশ্বব্যাপী নির্গমনের মাত্রা এবং তা হ্রাস করার সম্ভাব্য উপায়গুলির তুলনামূলক বিশ্লষন উপস্থাপিত হবে।

আইপিসিসি ওয়ার্কিং গ্রুপগুলো কি কি?

আইপিসিসির তিনটি ওয়ার্কিং গ্রুপ রয়েছে যা জলবায়ু বিজ্ঞান এবং জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবের বিভিন্ন বিষয় নিয়ে কাজ করে থাকে। প্রথম ওয়ার্কিং গ্রুপটি  জলবায়ু পরিবর্তনের পদার্থবিদ্যা সংক্রান্ত বিষয়গুলো নিয়ে কাজ করে; দ্বিতীয়  ওয়ার্কিং গ্রুপটি জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব এবং অভিযোজনের বিভিন্ন বিষয় নিয়ে কাজ করে এবং তৃতীয় ওয়ার্কিং গ্রুপটি জলবায়ু পরিবর্তন প্রশমন নিয়ে কাজ করে। এই তিনটি ওয়ার্কিং গ্রুপ পৃথকভাবে তাদের প্রতিবেদন প্রকাশ করে যার একটি সার-সংক্ষেপ সংকলিত অবস্থায় প্রকাশ করা হয়।

আইপিসিসি কী সরকারের করণীয় সম্পর্কে সিদ্ধান্ত দিতে পারে?

প্রকাশিত প্রতিবেদনের প্রেক্ষিতে সদস্য দেশগুলোর সরকার কীভাবে কাজ করবে সে ব্যাপারে আইপিসিসি কোনো ধরনের প্রভাব তৈরি করে না। এর মূল্যায়নগুলো ‘নীতি-প্রাসঙ্গিক’ কিন্তু ‘পলিসি দর্শানুপাত’ নয়। এর অর্থ হচ্ছে তারা নীতিনির্ধারকদের নির্দিষ্ট প্রশমন এবং অভিযোজন কর্মের সম্ভাব্য ফলাফল সম্পর্কে অবহিত করে, কিন্তু তাদের কী করতে হবে সে বিষয়ে কোনো বাধ্যবাধকতা বেঁধে দেয়া হয় না।

আইপিসির মূল্যায়নের বিভিন্ন পর্যায়গুলো কী কী?

আইপিসিসি প্রতিবেদন কেবলমাত্র একটি সম্ভাব্য ঘটনার বিশ্লষণ নয়। বরং এটি নিকট ভবিষ্যতের একাধিক সম্ভাব্য ‘পরিস্থিতি’ প্রতিনিধিত্ব করে, যার মধ্য দিয়ে জলবায়ু পরিবর্তনের নানা ধরনের প্রভাব কি কি বিষয়ের উপরে বিশেষ করে মানুষের কর্মকাণ্ডের কারনে পরিবর্তিত হতে পারে তার উপরে আলোকপাত করে।

এই কাল্পনিক পরিস্থিতিগুলো একটি নির্দিষ্ট ফলাফলের সম্ভাবনার পূর্বাভাস দেয় না। বরং এগুলো জলবায়ু পরিবর্তনের নানা ধরনের মডেলকে ব্যবহার করে কীভাবে নির্দিষ্ট কিছু কারণের পরিবর্তন, যেমন বায়ুমণ্ডলে গ্রিনহাউস গ্যাসের ঘনত্ব, স্বল্প বা দীর্ঘমেয়াদে বিভিন্ন পরিবেশগত এবং সামাজিক প্রভাবের দিকে নিয়ে যেতে পারে তা নিয়ে আলোকপাত করে।

আইপিসিসির কতগুলো পর্যায়ের পর্যালোচনা রয়েছে?  কিভাবে তারা সময়ের সাথে পরিবর্তিত হয়? 

২০১৪ সালে আইপিসিসি তার পঞ্চম মূল্যায়ন প্রতিবেদনে (এআর৫) সবচেয়ে জনপ্রিয় পর্যালোচনা রিপ্রেজেন্টিটিভ কনসেন্ট্রেশন পাথওয়েজ (আরপিসি) প্রকাশ করে। চারটি আরপিসি এমন একটি পরিস্থিতির অবতারণা করে যেখানে গ্রীনহাউস গ্যাসের বিভিন্ন ঘনত্ব বায়ুমণ্ডলে উপস্থিতি পাওয়া রয়েছে। আইপিসিসি পরিস্থিতিগুলি সময়ের সাথে সাথে বৈশ্বিক অর্থনীতি এবং মানব ক্রিয়াকলাপের পরিবর্তনগুলিকে প্রতিফলিত করার জন্য বিকশিত হয়েছে, যার ফলে বায়ুমণ্ডলে গ্রীনহাউস গ্যাসের পরিমাণ এবং প্রকারগুলি নির্গত হয়।

আইপিসিসি পরিস্থিতি একটি অনুমানমূলক ভবিষ্যত (আরসিপি২.৬ নামে পরিচিত) থেকে শুরু করে যেখানে সময়োপযোগী প্রশমন কৌশলগুলি বাস্তবায়িত হয় ২১০০  সালের মধ্যে বৈশ্বিক উষ্ণতাকে প্রাক-শিল্প স্তরের দুই ডিগ্রি সেলসিয়াসের মধ্যে রেখার প্রচেষ্টার মধ্য দিয়ে, যেখানে গ্রিনহাউস গ্যাস নির্গমন নিরবচ্ছিন্নভাবে বাড়তে থাকে, ফলে তাপমাত্রা বৃদ্ধির মাত্রা ৩.৩ ডিগ্রি সেলসিয়াস থেকে ৫.৪ ডিগ্রি সেলসিয়াসের মধ্যে থাকে। বিজ্ঞানীরা সতর্ক করে বলছেন যে আরসিপি ৮.৫ নামে পরিচিত পরবর্তী দৃশ্যকল্পটি  নির্গমনের ‘স্বাভাবিক পরিস্থিতি’ হিসেবে পরিগণিত নয়, যেমনটি প্রায়শই দাবি করা হয়। অথচ এটি এমন একটি ভবিষ্যতের বর্ণনা দেয় যেখানে মানুষের জীবাশ্ম জ্বালানী পোড়ানোর পরিবর্তে বরং বাড়িয়ে দেয়অর প্রবণতা লক্ষ্য করা যায়।এরপর থেকে তিনটি অতিরিক্ত RCP পরিস্থিতি তৈরি করা হয়েছে, যার মধ্যে একটি ০ আরসিপি ১.৯ যা ১.৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসের এর মধ্যে উষ্ণতা বজায় রাখার প্যারিস চুক্তির লক্ষ্যের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ পরিস্থিতির প্রতিনিধিত্ব করে।

এই পরিস্থিতিগুলো ২১০০ সাল পর্যন্ত ক্রমবর্ধমান তাপমাত্রা এবং অন্যান্য পরিবেশগত পরিণতির ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট প্রভাবগুলি পরিকল্পনা করতে বিজ্ঞানীদের সাহায্য করে৷

সমান্তরালভাবে, আইপিসিসি বিজ্ঞানীরা দ্য শেয়ারড সোশিও-ইকোনোমিক পাথওয়েজ (এসএসপি) শীর্ষক আরো পাঁচটি পরিপূরক পরিস্থিতি নিয়েও কাজ করেছে যা ষষ্ঠ আইপিসিসি মূল্যায়ন প্রতিবেদনে অন্তর্ভূক্ত (আইপিসিসি বর্তমানে যে মূল্যায়ন প্রতিবেদন নিয়ে কাজ করছে)। একদিকে আরপিসি গ্রিনহাউস গ্যাস এবং অন্যান্য তাপমাত্রা-পরিবর্তনকারী বস্তুগত এবং রাসায়নিক পরিবর্তনগুলি দেখে আর অন্যদিকে, এসএসপিসমূহ পাঁচটি ভিন্ন অর্থনৈতিক, সামাজিক এবং রাজনৈতিক বর্ণনা তৈরি করে। প্রথমবারের মতো এবার তারা বৈষম্য, জাতীয়তাবাদের উত্থান, শিক্ষায় বিনিয়োগ এবং প্রযুক্তির উন্নয়নের মতো কারণগুলির দিকে নজর দিচ্ছে যা জলবায়ু পরিবর্তনের ভবিষ্যতের পদক্ষেপে ভূমিকা রাখছে এমন কারণগুলির আরও বিশদ এবং শক্তিশালী মূল্যায়ন তৈরি করতে সহায়ক হবে।

জলবায়ু অনুমান এবং পূর্বাভাসের মধ্যে পার্থক্য কি?

আবহাওয়াবিদ্যায়, একটি পূর্বাভাস হল বর্তমান তথ্যের উপর ভিত্তি করে কয়েক মাস বা বছরের মধ্যে আবহাওয়া এবং জলবায়ু পরিস্থিতি কীভাবে পরিবর্তিত হবে তার একটি স্বল্পমেয়াদী বার্তা। বিজ্ঞানীরা এক্ষেত্রে আবহাওয়া স্টেশন, রাডার এবং উপগ্রহ থেকে উপলব্ধ তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণ করতে কম্পিউটার ব্যবহার করেন।

অন্যদিকে জলবায়ু অনুমানগুলোর মাধ্যমে এটি নিশ্চিত করা যায় না যে একটি সুনির্দিষ্ট পরিবেশগত পরিবর্তন ঘটতে যাচ্ছে কি না, তবে জলবায়ুর বিভিন্ন অনুসঙ্গগুলো কীভাবে প্রতিক্রিয়া জানাবে তা নির্ধারণ করতে কম্পিউটার মডেলগুলি ব্যবহার করা হয়, যাকে ফোর্সিং বলা হয়। উদাহরণস্বরূপ, এর মধ্য দিয়ে বিজ্ঞানীরা অনুমান করতে পারে যে মানুষ যদি বায়ুমণ্ডলে নির্দিষ্ট পরিমাণ গ্রিনহাউস গ্যাস যোগ করে তবে সমুদ্রের পৃষ্ঠের তাপমাত্রা কতটা বাড়তে পারে। এর সার-সংক্ষেপ হচ্ছে বিজ্ঞানীরা এখন পর্যন্ত মানুষের কর্মকাণ্ডের  প্রভাবগুলির পূর্বাভাস দেয়ার পরিবর্তে ভবিষ্যতের মানব কর্মকাণ্ডের প্রভাবগুলো কী হতে পারে তা অনুমান করে থাকে।

অনুবাদ: মোর্শেদা আক্তার পরী

Privacy Overview

This website uses cookies so that we can provide you with the best user experience possible. Cookie information is stored in your browser and performs functions such as recognising you when you return to our website and helping our team to understand which sections of the website you find most interesting and useful.

Strictly Necessary Cookies

Strictly Necessary Cookie should be enabled at all times so that we can save your preferences for cookie settings.

Analytics

This website uses Google Analytics to collect anonymous information such as the number of visitors to the site, and the most popular pages.

Keeping this cookie enabled helps us to improve our website.

Marketing

This website uses the following additional cookies:

(List the cookies that you are using on the website here.)