শক্তি

তিব্বতে আরো বাঁধ ও অবকাঠামো নির্মানের কথা ভাবছে চীন

১৩তম পাঁচ বছর মেয়াদী পরিকল্পনায় মরুকরণ ও জলবায়ু পরিবর্তনের ক্ষতির মুখোমুখি তিব্বত উপত্যকায় আরো ব্যাপক ভিত্তিক জলবিদ্যুত প্রকল্প ও অন্যান্য বড় অবকাঠামো নির্মানের কথা ভাবছে চীন
<p>A train in Tibet [Image by Tibet Review]</p>

A train in Tibet [Image by Tibet Review]

সম্প্রতি চীনের ১৩তম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা প্রকাশ করেছে দেশটির সরকার। এই পরিকল্পনাটিকে দেশটির অর্থনৈতিক ও সামাজিক উন্নয়নের ‘প্রতিচিত্র’ (ব্লুপ্রিন্ট) হিসেবে দেখা হচ্ছে। এর মাধ্যমে দেশটির বিশাল অর্থনৈতিক ধারায় এক ধরনের পরিবর্তনের আভাস পাওয়া যাচ্ছে যার মাধ্যমে দেশটির নেতৃত্ব জীবাশ্ম জ্বালানী (ফসিল ফুয়েল) ও ভারি শিল্প থেকে অধিকতর নবায়নযোগ্য জ্বালানী ও সবুজ উন্নয়নের পথে অগ্রসর হওয়ার কথা ভাবছে।

কিন্তু চিন্তার বিষয় হচ্ছে এই পরিবর্তনের পথে হাটা চীন সরকার এখন তিব্বতে ব্যাপক ভিত্তিক জলবিদ্যুত প্রকল্প ও অবকাঠামো নির্মান করার পরিকল্পনাকে ‘সবুজ সংকেত’ প্রদান করেছে। তিব্বত এশিয়ার বড় বড় নদীর উৎসস্থল হিসেবে পরিচিত। এই সবুজ সংকেত আসলে জীববৈচিত্র্যের দিক থেকে হুমকিতে থাকা তিব্বতে শিল্পায়নের নতুন যুগের সূচনা করবে। যদিও নতুন এই পরিকল্পনায় কোনো নদীর নাম সুস্পষ্টভাবে উল্লেখ করা হয়নি তবে ধারণা করা হচ্ছে যে ব্রক্ষ্মপুত্র (ইয়ারলুং যাংপো), মেকং (ল্যাংসাং) এবং স্যালউইনের (নু) মতো যৌথ নদীগুলোতে প্রস্তাবিত বাঁধগুলো (ড্যাম) নির্মান করা হবে। এর ফলে দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার নদীগুলোতে জলপ্রবাহের ক্ষেত্রে ব্যাপক নেতিবাচক প্রভাব পড়বে।

[চীনের গ্রিন টার্গেট সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে এখানে ক্লিক করুন]

নতুন এই নীতির ফলে তিব্বত মালভূমি ও হিন্দুকূশ হিমালয় অঞ্চলে নেতিবাচক প্রভাব সৃষ্টি হতে পারে।

জলবিদ্যুত

নবায়নযোগ্য জ্বালানী লক্ষ্যমাত্রা বিশ্লেষন করে মনে করা হচ্ছে যে বিশ্বের অন্যতম বাঁধ নির্মানকারী দেশ হিসেবে চীন জলবিদ্যুত প্রকল্প পরিকল্পনা আরো জোরদার করবে।

দেশটির দক্ষিণ-পূর্ব প্রদেশ যেমন ইউনান, সিচুয়ান এবং তিব্বতের কিংঘাই প্রদেশে ব্যাপক ভিত্তিতে জলবিদদ্যুত প্রকল্প বর্ধিত করা হবে।

অতীতে এই অঞ্চলের তিনটি নদীতে জলবিদদ্যুত প্রকল্প বাস্তবায়নের জন্য চিহ্নিত করা হয়েছিল যেগুলো আসলে যৌথ নদী এবং সবগুলোর উৎস তিব্বতে। নদীগুলো হচ্ছে ব্রক্ষ্মপুত্র (ইয়ারলুং যাংপো), মেকং (ল্যাংসাং) এবং সালউইন (নু)। ব্রক্ষ্মপুত্র নদীটি ভারতের ভিতর দিয়ে প্রবাহিত হয়ে পরে বাংলাদেশে প্রবেশ করে গঙ্গার সাথে মিলিত হয়েছে। এই নদীটিতে কোনো ধরনের বাঁধ নির্মান করা হলে তা ভাটির দেশগুলোতে (ভারত ও বাংলাদেশ) উত্তেজনা সৃষ্টি করতে পারে।

বিষয়টি অনুধাবন করে চীন উন্নত প্রযুক্তি ও বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি অনুসরণ করে এবং একইসাথে প্রতিবেশী দেশগুলোর সাথে সহযোগিতার মাধ্যমে এসব পরিকল্পনা বাস্তবায়নের কথা চিন্তা করছে।

চীন অবশ্য সম্প্রতি মেকং অববাহিকার বিভিন্ন দেশের সাথে একযোগে কাজ করার প্রক্রিয়া শুরু করেছে। তবে ভারতের সাথে ব্রক্ষ্মপুত্র নদী নিয়ে সহযোগিতার ক্ষেত্রে তেমন কোনো উন্নতি হয়নি। এক্ষেত্রে কেবলমাত্র বন্যা মৌসুমে জলপ্রবাহ সংক্রান্ত ডেটা ও বন্যা পূর্বাভাস প্রদান করে চীন। এই লক্ষ্যে চীনের বিভিন্ন সংস্থা ও সরকারী বিভাগ এসব কার্যক্রম আরো জোরদার করেছে।

আন্তর্জাতিক এসব নদীতে যে প্রকল্পগুলো নেয়া হচ্ছে তার প্রায় সবই ল্যাংসাং নদীর মাধ্যমে ইয়ারলুং যাংপোতে সংযুক্ত হবে। গত ফেব্রুয়ারিতে ইউনান পদেশের সরকার নু নদীতে বিতর্কিত ‘ক্যাসকেড ড্যাম’ এর যাবতীয় কার্যক্রম ১০ বছরের জন্য স্থগিত করেছে এক ঘোষনার মাধ্যমে। যদিও কতদিন এই স্থগিতাদেশ বহাল থাকবে তা নিয়ে শংকিত বিভিন্ন পর্যবেক্ষক মহল। নূ নদীটি চীনের সর্বশেষ নদী যেটি মিয়ানমারে পবেশ করেছে এবং সুশীল সমাজের একটি অংশ এই নদীতে বাঁধ নির্মানের বিপক্ষে প্রতিবাদ জানিয়ে আসছে।

এসব প্রকল্প সম্পর্কে আরো বিস্তারিত জানা যাবে এবছরের শেষে প্রকাশিতব্য জ্বালানী বিষয়ক ব্লুপ্রিন্ট প্রতিবেদনের মাধ্যমে।

আরো পড়তে চাইলে ক্লিক  করুন (ইংরেজীতে)

নদীর গতিপ্রবাহ পরিবর্তন

পঞ্চবার্ষিকী  পরিকল্পনায় ব্যাপক ভিত্তিতে বিভিন্ন নদীর গতিপ্রবাহ পরিবর্তন ও স্টোরেজ ড্যাম বাস্তবায়নকে উৎসাহিত করা হবে। এর উদ্দেশ্য হচ্ছে জলের ব্যবহার হ্রাস করার মধ্য দিয়ে জলের সংকট কমিয়ে আনা। চীন সরকার দেশের মধ্য ও পূর্ব রুটে দক্ষিণ-উত্তর ওয়াটার ডাইভারশন প্রকল্পেও এই ধরনের কর্মসূচি বাস্তবায়নের কথা ভাবছে, তবে তিব্বতের পশ্চিমাঞ্চলে এই কর্মসূচি বাস্তবায়ন করা হবে কি না সে সম্পর্কে পরিকল্পনায় কোনো ধরনের উল্লেখ নেই।

আরো পড়তে চাইলে ক্লিক  করুন (ইংরেজীতে)

তিব্বতে অবকাঠামো উন্নয়ন

তিব্বত অববাহিকা হচ্ছে এশিয়ার নদীগুলোর অন্যতম উৎসস্থল। এখানকার পরিবশেগত অবস্থার উপরে নি¤œাঞ্চলে চীনের বড় একটি অংশ, দক্ষিণ এশিয়া, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া ও মধ্য এশিয়ার ১.৩ বিলিয়ন মানুষের ভাগ্য নির্ভরশীল। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে এখানকার তাপমাত্রা বৈশ্বিক গড় তাপমাত্রার চেয়ে তিনগুন বেশি বৃদ্ধি পাচ্ছে। এরইমধ্যে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে বিশ্বের অন্যতম জীববৈচিত্র্যপূর্ন অঞ্চল হিসেবে এখানে নানা ধরনের ক্ষয়ক্ষতি লক্ষ্য করা যাচ্ছে।

আরো পড়তে চাইলে ক্লিক  করুন (ইংরেজীতে)

গত মার্চের দ্বিতীয় সপ্তাহে, বেইজিংয়ে ন্যাশনাল পিপলস কংগ্রেসে (এনপিসি) তিব্বতের পরিবেশবান্ধব উন্নয়ন পরিকল্পনার বিষয়টি আলোচনার কেন্দ্রে ছিল। এসময় এনপিসি তিব্বতের পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনার অনুমোদন দেয়। যদিও দেশটির সার্বিক উন্নয়নের ধারা কিছুটা মন্থর, স্বায়ত্বশাসিত তিব্বত অঞ্চলের প্রবৃদ্ধির ১১ শতাংশ অব্যাহত রয়েছে যা আসলে দেশের জাতীয় প্রবৃদ্ধির হারের চেয়ে বেশি।

তিব্বতের রাজধানী লাসার সাথে দেশটির দক্ষিন-পশ্চিমাঞ্চলের শহর চেংডুর দ্বিতীয় রেল সংযোগের জন্য প্রয়োজনীয় অর্থ বরাদ্ধ সম্পন্ন হয়েছে। এই অর্থ বরাদ্দের বিষয়টি পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনার অংশ হিসেবেই করা হয়েছে। তবে এনিয়ে দেশটিতে শুরু হয়েছে ব্যাপক আলোচনা।

সম্প্রতি অনুষ্ঠিত একটি সভায় সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে তিব্বতের পার্টির উপ সচিব পদ্ম চোলিং বলেন, ‘এই প্রকল্পের ফলে তিব্বতে পরিবশেগত কোনো প্রভাব পড়বে না।’ সূউূচ্চ পর্বতবেষ্টিত এই অঞ্চলে এ ধরনের প্রকল্প বাস্তবায়নে ব্যাপক সময়ের প্রয়োজন হবে।

লাসার প্রথম রেলপথ নির্মানের কারনে সৃষ্ট পরিবেশগত প্রভাব নিয়ে যথেষ্ট উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়েছে। প্রায় পাঁচ হাজার মিটার উচ্চতায় স্থাপিত এই রেলপথটি হচ্ছে বিশ্বের সবচেয়ে উঁচু স্থানে নির্মিত রেলপথ যা ২০০৬ সালে খুলে দেয়া হয়। সম্প্রতি বেইজিংয়স্থ চাইনিজ একাডেমি অব সাইন্সেস (সিএএস) পরিচালিত এক গবেষনায় বলা হয়, জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে তাপমাত্রা নূন্যতম দুই ডিগ্রি বৃদ্ধি পায় তাহলে তিব্বতে নির্মিত বড় ধরনের অবকাঠামোর প্রায় ৬০% ভেঙ্গে পড়বে। কারন তাপমাত্রা বৃদ্ধির ফলে এখানকার ভূমি অত্যন্ত নরম হয়ে যাবে যা আসলে বড় বড় অবকাঠামোকে ধরে রাখতে ব্যর্থ হতে পারে।

তবে সার্বিকভাবে মনে করা হচ্ছে চীনের ১৩তম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনার মধ্য দিয়ে দেশটির উন্নয়নের মূল ধারার সাথে তিব্বত সংযুক্ত হবে। পাশাপাশি দেশটির মূল ভূখন্ডের সাথে রেল ও সড়ক যোগাযোগের মধ্য দিয়ে তিব্বতে শিল্পায়ন ও পর্যটন শিল্পের বিকাশ হবে এবং সীমান্তের কাছাকাছি দূর্গম পাবর্ত্য গ্রামগুলোতে যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়ন হবে।

সামনে রয়েছে পরিবেশগত নানা চ্যালেঞ্জ

স্বায়ত্বশাসিত তিব্বত অঞ্চলের (টিএআর) চেয়ারম্যান লোসাং জ্যামকান এখানকার উন্নয়ন সম্পর্কে বলেন, ‘তিব্বতের উন্নয়নের মূলে পরিবেশগত নিরাপত্তার কথা সাবার আগে বিবেচনা করা হবে’। তিনি মনে করেন পরিবেশের ক্ষতি যাতে না হয় সেজন্য প্রয়োজনে এখানকার উন্নয়নে ধীরে চলো নীতি মেনে চলা উচিত।

কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে এরইমধ্যে পরিবেশগত সমস্যা একটি বড় চ্যালেঞ্জ হিসেবে দেখা দিয়েছে। সিএএস’র সাম্প্রতিক প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে তিব্বতের একটি বড় অংশ মরুকরনের সম্মুখীন। এটি চীনের সবচেয়ে বড় বিজ্ঞানভিত্তিক সংস্থা। সিএএস মনে করছে এই পরিস্থিতি ভবিষ্যতে আরো ভয়াবহ আকার ধারন করবে। এর ফলে চীনের অন্যান্য অংশসহ গোটা দক্ষিণ এশিয়ায় জলপ্রবাহ হ্রাস পাবে।

এ প্রসঙ্গে জ্যামকান বলেন, তিব্বতে (টিএআর) যে কোনো ধরনের খনি সংক্রান্ত প্রকল্প অনুমোদনের ক্ষেত্রে কড়া বিধিবিধান চালু করা হবে। একই সাথে তিনি মনে করেন চীন সরকার এখানে দূষণ হতে পারে এমন কোনো প্রকল্প অনুমোদনে শক্ত অবস্থান গ্রহন করবে।

এদিকে স্থানীয় সরকারের কর্মকর্তারা তিব্বতে রাজস্ব বৃদ্ধির লক্ষ্যে খণি, পর্যটন ও বোতলজাত জলের শিল্প স্থাপনে আগ্রহী অনেক আগে থেকেই। যেগুলো আসলে কেন্দ্রীয় সরকারের উন্নয়ন প্রকল্পের মতোই ক্ষতিকর।

এর পাশাপাশি লাসার অদূরে বিশ্বের সবচেয়ে উঁচু স্কি ষ্টেশন স্থাপনের পরিকল্পনাও পরিবেশের জন্য একটি মারাত্বক ক্ষতিকর একটি প্রকল্প হতে পারে বলে অনেকে মনে করছেন।

ওয়ান বেল্ট ওয়ান রোড

চীনের নতুন উন্নয়ন পরিকল্পনার একটি বড় অংশ হচ্ছে ‘ওয়ান বেল্ট, ওয়ান রোড’ প্রকল্প। ১৩তম উন্নয়ন পরিকল্পনায় এ বিষয়ে অবশ্য যথেষ্ট দিক নির্দেশনা নেই। তবে এই প্রকল্পের মাধ্যমে মঙ্গোলিয়া, রাশিয়া, মধ্য এশিয়া পাকিস্তান, বাংলাদেশ, ভারত এবং মিয়ানমারকে সংযুক্ত করার মধ্য দিয়ে ব্যাপক অর্থনৈতিক উন্নয়ন হবে বলে মনে করছে বিশেষজ্ঞরা।

এদিকে চীনের এই পরিকল্পনাকে দেশের বাইরে অন্যান্য দেশে দূষণ ছড়িয়ে দেয়ার এক ধরনের মনোভাব হিসেবে দেখা হচ্ছে। তবে দেশটির প্রধানমন্ত্রী একে চীনের পরিবেশ সংক্রান্ত সেবামূলক সংস্থার জন্য একটি অন্যতম সুযোগ হিসেবে বর্ণনা করেন।

নতুন ইয়াংসি ক্যাম্পেইন

চীনের অন্যান্য স্থানে ইয়াংসি নদীকে রক্ষার লক্ষ্যে ব্যাপক প্রচরণা শুরু হয়েছে। এটি বিশ্বে তৃতীয় দীর্ঘ নদী এবং চীনে এই নদীটিকে জীবনের জন্য নদী হিসেবে অভিহিত করা হয়। এই প্রচরনার মাধ্যমে দূষণকারী কারখানা, জলাভূমি সুরক্ষা এবং মৎসসম্পদ রক্ষার আহ্বান জানানো হচ্ছে।

Privacy Overview

This website uses cookies so that we can provide you with the best user experience possible. Cookie information is stored in your browser and performs functions such as recognising you when you return to our website and helping our team to understand which sections of the website you find most interesting and useful.

Strictly Necessary Cookies

Strictly Necessary Cookie should be enabled at all times so that we can save your preferences for cookie settings.

Analytics

This website uses Google Analytics to collect anonymous information such as the number of visitors to the site, and the most popular pages.

Keeping this cookie enabled helps us to improve our website.

Marketing

This website uses the following additional cookies:

(List the cookies that you are using on the website here.)