পানি

চাহিদার মাত্র ১৬ ভাগের একভাগ জল রয়েছে তিস্তায়

গত সপ্তাহে বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে তিস্তা চুক্তির ব্যর্থতা নিয়ে বহু আলোচনা হলেও নদীটিতে যে জল নেই তা নিয়ে আলোচনা হয়েছে একেবারেই যতসামান্য
<p>Drying Teesta in northern West Bengal , India [image by Ajoy Roy]</p>

Drying Teesta in northern West Bengal , India [image by Ajoy Roy]

তিস্তা নিয়ে প্রতিবেশী দু’টি দেশ একটি গ্রহনযোগ্য সমাধানে পৌছাতে না পারাটা ছিল বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সাম্প্রতিক ভারত সফরে সবচেয়ে বড় হতাশার বিষয়। দ্যথার্ডপোল.নেট এর সংগ্রহে থাকা তথ্য বিশ্লেষন করে দেখা গেছে শুষ্ক মৌসুমে অর্থাৎ ফেব্রুয়ারি থেকে মে মাস পর্যন্ত সময়ে এই দুটি দেশে কৃষি জমিতে চাহিদার মাত্র ১৬ ভাগের এক ভাগ জল প্রবাহিত হয় তিস্তায়। এ নিয়ে তাই পশ্চিমবঙ্গের মূখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জীর বিরোধীতা ছিল অনেকটাই প্রত্যাশিত।

জল নেই তিস্তায়

তিস্তা নিয়ে সম্প্রতি করা একটি গোপনীয় প্রতিবেদন দ্যথার্ডপোল.নেট এর হাতে আসে। এতে দেখা যায় তিস্তা নিয়ে পশ্চিমবঙ্গ সরকার বলছে, ‘বাংলাদেশ ও ভারত উভয়েরই প্রায় ১০০ কিলোমিটার উজানে দুটি ব্যারেজের পরিকল্পনা করা হয়েছিল যা থেকে উভয় দেশই ১৬ লাখ (১.৬ মিলিয়ন) হেক্টর জমিতে সেচের ব্যবস্থা রাখা হয় – এর মধ্যে ভারতের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যে সেচ এলাকার পরিমান ৯.২ লাখ (৯২০,০০০) হেক্টর ও বাংলাদেশে ৭.৫ লাখ (৭৫০,০০০) হেক্টর জমিতে সেচের পরিকল্পনা করা হয়। প্রাথমিক এক হিসাবে দেখা গেছে এই বিশাল এলাকায় বোরো ধানের (শুষ্ক মৌসুমে) আবাদের জন্য প্রতি সেকেন্ডে প্রয়োজন ১৬০০ কিউমেক জল। অথচ শুষ্ক মৌসুমে এই নদীতে জলের পরিমান থাকে মাত্র ১০০ কিউমেক – অর্থাৎ দুই দেশ মিলিয়ে তিস্তা থেকে মোট চাহিদার মাত্র ১৬ ভাগের এক ভাগ জল পাওয়া যায়।

ভারতের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের জলপাইগুড়ির গজালডোবায় একটি ব্যারেজ রয়েছে। বাংলাদেশের যে অংশ দিয়ে নদীটি প্রবেশ করেছে তা থেকে সামান্য উজানে এই ব্যারেজটির অবস্থান। অন্যদিকে লালমনিরহাট জেলার দোয়ানিতে একটি ব্যারেজ স্থাপন করেছে বাংলাদেশ। এই ব্যারেজটি ব্রক্ষ্মপুত্র নদের সাথে তিস্তার মিলিত হওয়ার স্থান থেকে সামান্য উজানে অবস্থিত।

সাম্প্রতিক সময়গুলোতে দেখা গেছে এপ্রিল ও মে মাসের শুষ্ক মৌসুমে তিস্তায় জলের পরিমান ১০০ কিউমেক পরিমানে নেমে আসে।

তিস্তায় জলের প্রভাব অস্বাভাবিকভাবে হ্রাস পাওয়ার বিষয়টি বিবেচানায় নিয়ে করনীয় ঠিক করতে পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য সরকার রাজ্যের গণপূর্ত অধিদপ্তরের মূখ্য সচিব ইন্দেভার পান্ডের নেতৃত্বে একটি কমিটি গঠন করে। এই কমিটি সম্প্রতি তিস্তার জল ব্যবহারের ক্ষেত্রে একটি কঠোর সিদ্ধান্ত গ্রহন করেছে। কমিটি সিন্ধান্ত নিয়েছে যে এখন থেকে সেচ এলাকার পরিমান ৯০ শতাংশে কমিয়ে এনে ৫২,০০০ হেক্টর জমিতে বহাল রাখা হবে।

এই তথ্য বিশ্লেষণ করলে প্রধানমন্ত্রীর দিক থেকে চাপ থাকার পরেও তিস্তা নিয়ে রাজ্যের মূখ্যমন্ত্রীর অনঢ় অবস্থান কারণের বিষয়টি পরিস্কার হয়ে ওঠে। তাই বাংলাদেশের সঙ্গে সমতার ভিত্তিতে তিস্তার জল বন্টন নিয়ে কোনো প্রশ্ন করা হলে মূখ্য মন্ত্রীর পাল্টা প্রশ্ন – তিস্তার কি আসলেই জল আছে?

মূল কারণ  – ভ্রান্ত পরিকল্পনা

শুষ্ক মৌসুমে জল ধরে রাখার জন্যই আসলে ব্যারেজ নির্মান করা হয়। পশ্চিমবঙ্গ সরকারের একটি প্রতিবেদনে বলা হয়েছে ব্যারেজে কোনো জলই নেই কারণ ভারত ও বাংলাদেশ উভয়ই ভুল সময়ে জল ছেড়ে দিয়েছে।

প্রতিবেদনটিতে আরো বলা হয়, মূলত ব্যারেজটি নির্মান করা হয়েছিল বর্ষা মৌসুমে আমন ধান চাষে সেচের জল সরাবরাহের জন্য। কিন্তু পরবর্তীতে দেখা যায় যে শুষ্ক মৌসুমে বোরো ধানের চাষের জন্যও এই ব্যারেজের জল ব্যবহার করা হচ্ছে।

একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হচ্ছে এই ব্যারেজগুলোর আসলে জল আটকে রাখার কোনো বন্দোবস্ত নেই। ফলে কর্তৃপক্ষ অনেকটা বাধ্য হয়েই বর্ষা মৌসুমে জল ছেড়ে দেয়।

এসব মিলেই ভারতের সাথে বাংলাদেশের তিস্তার জল বন্টন চুক্তিটি কিছুটা জটিল আকার ধারণ করেছে। যদিও বাংলাদেশ সাম্যতার ভিত্তিতে তিস্তার জল বন্টনের দাবী জানিয়ে আসছে মুরু থেকেই (৫০:৫০)।

সম্প্রতি বাংলাদেশে ইন্টারন্যাশনাল ফুড পলিসি রিসার্চ ইন্সটিটিউট (আইএফপিআরআই) এবং সেন্টার ফর এগ্রি-রিসার্চ এন্ড সাসটেইনেবল এনভায়রনমেন্ট এন্টারপ্রেনারসিপ ডেভেলপমেন্ট (সিএএসইইডি) পরিচালিত এক গবেষণায়ও একই চিত্র উঠে আসে।  এই গবেষণার সাথে জড়িত একজন বিশেষজ্ঞ বলেন, কিছু বছর আগেও এখানে ৮০ শতাংশ জমিতে আমন ধানের চাষ করা হতো। কিন্তু এখন এই চিত্র পাল্টে গেছে।

সিকিমের প্রভাব

ভারতের নদী বিশেষজ্ঞ কল্যাণ রুদ্র আরো একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় তুলে ধরেছেন – সেটি হচ্ছে পশ্চিমবঙ্গে তিস্তার উজানে সিকিমে অসংখ্য জল বিদ্যুত প্রকল্প স্থাপন করা হয়েছে এবং আরো অনেকগুলো প্রকল্পের কাজ অব্যাহত আছে। এই প্রকল্পগুলোতে জল আটকে রাখার কথা নয়। তবে কল্যান রুদ্র বলেন, যদিও এই প্রকল্পগুলো থেকে জল ছেড়ে দেয়া হয়, তবে তা কখন ছাড়া হয় সেটি একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। ভাটির সাথে সমন্বয় না করে, চাষীদের প্রয়োজনের বিষয়টি মাথায় না রেখেই এসব প্রকল্প থেকে জল ছেড়ে দেয়া হয়। নদীর একটি বড় অংশই কিন্তু দেখা যাচ্ছে দূর্বল ব্যবস্থাপনার জন্য মূল প্রবাহ থেকে আলাদা থেকে যাচ্ছে।

এতকিছুর পরেই বাংলাদেশে জলের প্রয়োজন

বাংলাদেশের বিশেষজ্ঞরা উজানের এই সমস্যা সম্পর্কে ওয়াকিবহাল। তারপরেও তারা শুষ্ক মৌসুমে তিস্তা থেকে জল পাওয়ার দাবী জানিয়ে আসছে। বাংলাদেশের স্বনামখ্যাত জল বিশেষজ্ঞ ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক আইনুন নিশাত বলেন, ভাঁটিতে থাকা প্রত্যেক দেশেরই উজানে থাকা নদী থেকে জল পাওয়ার অধিকার রয়েছে। তিস্তার প্রবাহ কমে গেলেও পশ্চিমবঙ্গের উচিত শুষ্ক মৌসুমে বাংলাদেশের জন্য কিছুটা জল ছেড়ে দেয়া। এ বিষয়ে তাদের আপত্তি থাকা ঠিক নয়।

তিনি বলেন, ২০১১ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশ সারাবছরই তিস্তায় ভারতে থেকে জল পেতো। কিন্তু এখন কেবলমাত্র শুষ্ক মৌসুমে ২০ কিউমেক জল পাওয়া যায় উজান থেকে। আর এই জলটি আসে ধরলা নদীর মাধ্যমে যেটি আসলে গজালডোবায় ব্যারেজের নি¤œাঞ্চলে তিস্তার সাথে মিলিত হয়েছে।

চাই সহযোগিতা

তিস্তা নিয়ে মমতার অনঢ় অবস্থানের কারনে ভারতের সাথে বাংলাদেশের সম্পর্ক কিছুটা শ্লথ হওয়ার কারনে পশ্চিমবঙ্গ সরকারের শীর্ষ পর্যায়ও কিছুটা অস্বস্তিতে পড়েছে।

তারা বলছেন, একটি আন্ত:দেশীয় নদীর ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক সীমানার ঠিক উপরেই নদীটির জল শুকিয়ে যাওয়ার বিষয়টি আন্তর্জাতিক প্রেক্ষিতে অস্বাভাবিক। পশ্চিমবঙ্গ সরকারের একজন শীর্ষ কর্মকর্তা বলেন, ‘ একবার ভাবুন যদি ভূটান বা নেপাল যদি ঠিক একই পরিস্থিতির সৃষ্টি করে সেক্ষেত্রে কী হতে পারে?

চুক্তির ইতিহাস

১৯৮৩ সালে বাংলাদেশের সাথে ভারতের একটি অস্থায়ি চুক্তি হয়। সেই চুক্তি অনুযায়ি নদীর জলের ৩৯ শতাংশ পেত ভারত আর বাংলাদেশ পেত ৩৬ শতাংশ। বাকি জল নির্ধারিত ছিল নদীর জন্য। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে এটি ছির কেবল দু’বছর মেয়াদী একটি চুক্তি। এরপর নদীতে ক্রমাগত জলের প্রবাহ কমে যাওয়ার ফলে পরিস্থিতি জটিল আকার ধারণ করে। পরবর্তী পর্যায়ে নানা সময়ে চুক্তির চেষ্টা করা হয় এবং সবগুলোতেই মোটামুটি একই ধরনের জল বন্টন প্রক্রিয়া অনুসরণ করা হয়। কিন্তু দু:খের বিষয় হচ্ছে এই চুক্তিরগুলোর কোনোটিই খসড়া থেকে চুড়ান্ত অবস্থায় পৌছাতে পারেনি।

বরাবরই আলোচনায় তিস্তা

তিস্তা নিয়ে অবধারিতভাবেই প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর ভারতীয় জনতা পার্টি (বিজেপি) ও পশ্চিমবঙ্গের মূখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যাণার্জীর তৃণমূল কংগ্রেসের সাথে রাজনৈতিক টানাপোড়েন সৃষ্টি হয়েছে। এ বিষয়ে জানতে চাইলে রাজ্যের সেচ বিষয়ক মন্ত্রী রাজিব ব্যাণার্জী বলেন, ‘এনিয়ে আমি কিছুই বলতে পারছি না কারন মূখ্যমন্ত্রী নিজেই বিষয়টির দেখভাল করছেন।

এই টানাপোড়েন কিন্তু প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর ক্ষমতায় আসার অনেক আগে থেকেই শুরু হয়েছে। মূলত তিস্তা নিয়ে ২০১১ সালে ভারতের প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংয়ের বাংলাদেশ সফরের সময় থেকে একধরনের অনিশ্চয়তা শুরু হয়। মনমোহন সিংয়ের ওই সফরের সময় তিস্তা চুক্তি সইয়ের বিষয়ে চুড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেয় দুদেশের সরকার। সেসময় তিনি তার সফরসঙ্গী হিসেবে মমতা ব্যাণার্জীকেও ঢাকায় নিয়ে আসতে চেয়েছিলেন। কিন্তু মমতা ব্যাণার্জী শেষ মুহুর্তে ওই সফরে অংশ না নেয়ার সিদ্ধান্ত নেন এবং চুক্তিটি তখন থেকেই চাপা পড়ে যায়।

২০১৫ সালে মমতা ব্যাণার্জী প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর সাথে ঢাকা সফরে আসেন এবং বলেন তিস্তা চুক্তি সইয়ের ব্যাপারে অনেকখানি পথ অগ্রসর হওয়া গেছে। কিন্তু এ মুহুর্তে বিজেপি-তৃণমূল সম্পর্ক অত্যন্ত নাজুক এবং তা সুষ্পষ্ট হয়ে ওঠে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ভারত সফরের সময়ে।

অন্য নদীর জল?

এদিকে মমতা ব্যাণার্জী জানেন খুব বেশি দিন তিনি বাংলাদেশকে জল না দেয়ার বিষয়টি চালিয়ে যেতে পারবেন না। কারণ বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের ৫৭টি নদী নিয়ে সীমানা ভাগাভাগি রয়েছে। মমতা বলেন, ‘দেখুন বাংলাদেশের সাথে জল ভাগাভাগির ব্যাপারে আমার কোনো নেতিবাচক অবস্থান নেই। তবে তিস্তার জল ভাগাভাগি করা সম্ভব নয়। এটি উত্তর বাংলার জন্য প্রধানতম নদী। আর নদীটিতে এতটা পানি নেই যে তা আমরা বঅংলাদেশের সঙ্গে ভাগাভাগি করতে পারবো। তাই আমি বাংলাদেশ সরকারকে প্রস্তাব দিয়েছি যাতে দুই সরকার মিলে যৌথ সমীক্ষা চালিয়ে দেখা যেতে পারে যে অন্য কোন নদী থেকে বাংলাদেশের সাথে জল ভাগাভাগি করা যায় কি না। এক্ষেত্রে তিনি তোর্সা, জলঢাকা ও রাইডাক নদীর নাম উল্লেখ করেন।

তবে মমতার এই প্রস্তাব ঢাকা ও দিল্লির কাছে গুরত্ব পায়নি। নদী গবেষকরাও বিষয়টি নিয়ে বিভ্রান্ত। তারা বলেন, ‘এই নদীগুলো ব্রক্ষ্মপুত্র নদীর শাখানদী। এসব নদীর প্রবাহ তিস্তা অববাহিকায় নিয়ে যাওয়া একটি বিশাল ও ব্যয়বহুল কাজ।

তবে এতকিছুর পরেও দুই দেশের প্রধনমন্ত্রী তিস্তা চুক্তি নিয়ে এখনও আশাবাদী। বিশেষজ্ঞরা বলছেন ভারতের আন্ত:নদী সংযোগ প্রকল্পের কিছু অংশের একটি ইতিবাচক ফল পাওয়া যেতে পারে। ভারতের অবজারভার রিসার্চ ফাউ-েশনের পরিবেশ অর্থনীতিবিদ নিলাঞ্জন ঘোষ বলেন, মানস নদী থেকে গঙ্গায় জল নিয়ে যাওয়া সংক্রান্ত প্রকল্পটি এক্ষেত্রে ভূমিকা রাখতে পারে। এই প্রকল্পের মাধ্যমে মানসের জল সংকোশ ও তিস্তার মধ্য দিয়ে গঙ্গায় নেয়া হবে। এখান থেকে শুষ্ক মৌসুমে বাংলাদেশকে জল দেয়া সম্ভব।

তবে এই ধরনের একটি প্রকল্প আসলে পরিবেশের জন্য মারাত্বক ক্ষতিকর এবং নদীর স্বাভাবিক প্রবাহ ও অববাহিকায় থাকা জনগোষ্ঠীর জন্য হুমকিস্বরুপ। এবিষয়ে কল্যান রুদ্র বলেন, এই প্রকল্প বাস্তবায়ন করতে গেলে বন-জঙ্গলের ভিতর দিয়ে গাছ-পালা কেটে খাল িৈতর করতে হবে যা আসলে পরিবেশের জন্য ভয়াবহ ক্ষতির কারণ হতে পারে।