বাংলাদেশের রক ব্যান্ড চিরকুটের লিড ভোকাল শারমিন সুলতানা সুমি । বাংলাদেশের জনপ্রিয় ৭টি ব্যান্ডের যৌথ উদ্যোগ নদী রক্সের অন্যতম একজন সংগঠক। “নদী রক্স” এর মধ্য দিয়ে সুমি এবং তার সহযোগি ব্যান্ডের সদস্যরা এবার গানে গানে দেশের বিপন্ন নদীগুলোকে সুরক্ষায় তরুণদের অনুপ্রানিত করতে কাজ করছেন।
নদী বাংলাদেশের সংস্কৃতি ও অর্থনীতির সাথে অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত। অথচ সময়ের আবর্তে এই নদীগুলো আজ মারাত্বক হুমকির মুখে। বাংলাদেশের নদীগুলোকে বাঁচাতে আইনী সুরক্ষা নিশ্চিত করার সম্পর্কিত এক রায় প্রদান করতে গিয়ে সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতি আশরাফুল কামাল উল্লেখ বলেছিলেন, “বাংলাদেশে একসময় ১,৩০০ টির বেশি নদী প্রবাহমান ছিল। কিন্তু বর্তমানে, সরকারিভাবে মাত্র ৪০৫টি নদী তালিকাভুক্ত রয়েছে।”
ব্যান্ড সঙ্গীতের মধ্য দিয়ে নদী রক্স মূলত দেশের নদীগুলােকে বিপন্নতার পর্যায় থেকে ফিরিয়ে আনতে চাইছে। এই উদ্যোগের মাধ্যমে মূলত আবহমান বাংলাদেশের নদ-নদীর অপার সৌন্দর্য্য যা গানে-গল্পে ফুটে উঠেছে, পাশাপাশি এই দেশের কৃষ্টি ও সংস্কৃতির সাথে নদীর যে দার্শনিক এবং সামাজিক তাৎপর্য রয়েছে, সে বিষয়গুলোকেই তুলে ধরার চেষ্টা করা হয়েছে।
গানের ভিতরে পরিবেশগত বিষয়গুলোকে সম্পৃক্ত করে নদী সংরক্ষণে এই উদ্যোগটি একটি ভিন্ন মাত্রা যোগ করেছে। নদী সংরক্ষণে প্রথাগত প্রক্রিয়াগুলোর মধ্যে ইঞ্জিনিয়ারিং এবং কূটনৈতিক প্রচেষ্টা অন্যতম। তবে ব্যান্ড সঙ্গীতের মাধ্যমে নদী সংরক্ষণের এই উদ্যােগকে একেবারেই অভিনব একটি প্রচেষ্টা হিসেবে মনে করা হচ্ছে।
এই উদ্যোগের মূলত কোন কোন বিষয়গুলো অনুপ্রেরণা হিসেবে কাজ করেছে এবং নদী সম্পর্কে সচেতনতা বৃদ্ধির ক্ষেত্রে ব্যান্ড সঙ্গীত কীভাবে একটি শক্তিশালী হাতিয়ার হিসেবে কাজ করতে পারে সে সম্পর্কে জানতে ঢাকায় নিজের স্টুডিওতে দ্য থার্ড পোলের সাথে কথা বলেন পুরস্কার বিজয়ী সুরকার ও গীতিকার এবং নদী রক্সের অন্যতম সংগঠক শারমিন সুলতানা সুমি।
বাংলাদেশের ভৌগলিক যেসব বৈশিষ্ট্য রয়েছে তার মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ এবং উল্লেখযোগ্য একটি অংশ হচ্ছে এখানকার নদ-নদী সমূহ। জলবায়ু সংকট গভীর হওয়ার সাথে সাথে বাড়ছে তাপমাত্রা। ফলে মারাত্বকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে নদীর বাস্তুতন্ত্র। জলবায়ু এবং প্রাকৃতিক এই সমস্যা ছাড়াও দিনের পর দিন দখল আর দূষণের মতো মানবসৃষ্ট সমস্যার কারনে নদীগুলো আরো ভয়াবহতার সম্মখীন হয়ে হারিয়ে যেতে বসেছে।
নদী রক্সের মাধ্যমে চিরকূটখ্যাত সুমির অন্যতম ইচ্ছা বাংলাদেশের প্রতিটি নদীর জন্য অন্তত একটি করে স্বতন্ত্র্য গান। এর ফলে প্রতিটি নদীর গুরুত্ব বা তার বিশেষ বৈশিষ্ট্যকে তুলে ধরার পাশাপাশি ভবিষ্যত প্রজন্মের কাছ থেকে যেন এই নদীগুলো আর হারিয়ে যেতে না পারে সেটিও নিশ্চিত করা যাবে। সুমির ভাষায়, এই গানের মধ্য দিয়ে দেশের সকল নদীর আত্মাগুলো বেঁচে থাকবে।
এই প্রকল্পের প্রথম পর্যায়ে মূলত দেশের সাতটি নদী নিয়ে সাতটি অনন্য গান তৈরি করা হয়েছে। এই নদীগুলো হচ্ছে – পদ্মা, কুশিয়ারা, সাঙ্গু, চিত্রা, পশুর, বুড়িগঙ্গা এবং ডাহুক। নদী রক্সের সাথে যুক্ত সাতটি ব্যান্ড এই সাতটি গান পরিবেশন করেছে। উদ্যেগের সাথে যুক্ত এই ব্যান্ডগুলো হচ্ছে ক্রিপ্টিক ফেইট, আরবোভাইরাস, স্মুচেস, বাংলা ফাইভ, এফ মাইনর, অ্যাশেস এবং সুমির নিজস্ব ব্যান্ড চিরকুট। সুমি দ্য থার্ড পোলকে বলেন, এই প্রথম বাংলাদেশের এতগুলো জনপ্রিয় ব্যান্ড নদীর কল্যাণে গান গাইতে একাট্টা হয়েছে।
নদী সম্পর্কে আমাদের এই ভালােবাসা আরো ছড়িয়ে দিতে হবে কারন এই নদী কেবল এই পৃথিবীর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বাস্তুতন্ত্রই নয়, বরং এটি সামাজিক সম্পর্কের চালকও বটে ৷শারমিন সুলতানা সুমি
সুমি বলেন, “নদী নিয়ে আমাদের অবশ্যই মানুষকে উৎসাহিত করতে হবে, বিশেষ করে নদী সম্পর্কে তরুণদের আরো বেশি বেশি জানতে হবে কারন তারাই আমাদের এই বিশ্বের উত্তরসূরি। নদী সম্পর্কে আমাদের এই ভালােবাসা আরো ছড়িয়ে দিতে হবে কারন এই নদী কেবল এই পৃথিবীর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বাস্তুতন্ত্রই নয়, বরং এটি সামাজিক সম্পর্কের চালকও বটে ৷ আর বাংলাদেশের ক্ষেত্রে এটি আরো অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ কারন নদীমাতৃক এই দেশটির সাংস্কৃতিক যে ঐতিহ্য রয়েছে তা অনেক গভীর।
আর এই সমস্যাগুলোই আরো স্পষ্টভাবে শ্রোতাদের কাছে তুলে ধরতে নদী রক্স তার স্লোগানে যুক্ত যে বক্তব্যটি তুলে ধরেছে তা হচ্ছে “জলবায়ু বাঁচাতে, আসুন নদীর কাছে যাই।”
এছাড়াও সুমি চান নদী রক্সের এই গানগুলো যেন তুুরণদের মধ্যে একটা মানসিক সংযোগ ঘটাতে পারে। তিনি বলেন, “তরুণ প্রজন্মকে অবশ্যই নদীর আনন্দ-বেদনাগুলোকে উপলদ্ধি করতে হবে। পাশাপাশি আমাদের যাপিত জীবনের সাথে নদী যে কতটা গভীরভাবে জড়িয়ে আছে সেটি আরো দৃঢ়ভাবে অনুধাবন করতে হবে।”
শৈশবের অম্লান স্মৃতি
দ্য থার্ড পোলকে সুমি বলেন, আমি বিশ্বাস করি যে নদীর সাথে সুর ও সঙ্গীতের একটি মেলবন্ধন রয়েছে। যেখানেই উৎপত্তি হোক না কেন নদী যেমন কেবল বয়ে যায়, ঠিক তেমনি সুরের ও একটি চলন আছে যা নদীর মেতাই প্রবাহমান। আর এই প্রবাহ থামবার নয়।
বাংলাদেশের ঝিনাইদহ জেলার শৈলকুপা উপজেলার পাঁচ পাখিয়া গ্রামে জন্মগ্রহণকারী সুমি খুলনা জেলার ছোট শহর খালিসপুরে বড় হয়েছেন। তার মনে আছে শৈশবে কিভাবে তার বাবা বছরের শেষে স্কুলের বার্ষিক পরীক্ষার পর বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে প্রবাহিত রূপসা নদীতেপরিবারের সবাই মিলে ভ্রমনে বের হতেন।
শৈশবের নদী স্মৃতির কথা বলতে গিয়ে সুমি বলেন, “সেসময় নৌকায় বসে আমি নীরবে নদীর চারপাশের জীবনগুলোকে অবলোকন করতাম। আমার কাছে কথন মনে হতো নদীর দুই তীর উচ্ছ্বল জীবন এবং উৎসবে পরিপূর্ণ, যেমন আমি দেখতাম নদীর তীরে স্থানীয় নারীরা স্নান করছে। সেসময় আমি দেখতাম নদীর জলে মাছের চলাচল, গোধূলি বেলায় গ্রামের কিশোর নদীল তীর ধরে চলছে নিজেদের গবাদি পশুগুলো নিয়ে বাড়ির পথে। আবার চোখে পড়তো ছোট ছোট দূরন্ত শিশুরা গাছের ডাল থেকে নদীর জলে ঝাপ দিচ্ছে। আমি দেখতাম নদী পাড়ের মানুষ স্থানীয় বাজারে কেনা-বেচায় ব্যস্ত। কিংবা শ্মশান ঘাটে কারো শেষকৃত্য পালনের জন্য জড়ো হচ্ছে স্থানিয়রা। এই সামগ্রীক পরিবেশটা ছিল ভীষণ মায়াবী, একেবারে রূপকথার গল্পের মতো।”
সে দৃশ্য আর চোখে পড়ে না। নদীর এখনকার অবস্থা বর্ণনা করতে গিয়ে মায়াবী সেই দৃশ্যপটের কথার পরিবর্তে সুমির কন্ঠে একটি শব্দই প্রতিধ্বনিত হয়, আর সেটি হচ্ছে “ভয়ংকর”।
দ্য থার্ড পোলকে সুমি বলেন, “নদীগুলো যেন নোংরা, আবর্জনাযুক্ত খালে পরিণত হয়েছে। এসব নদীর দূষিত পানি এখন দূর্গন্ধময়।” বেশ ক্ষোভের সঙ্গে তিনি বলেন, আমাদের নদীগুলো দখল করে অবৈধভাবে বিভিন্ন ধরনের অবকাঠামো নির্মাণ করে নদীগুলোকে যেন গলাটিপে শ্বাসরোধ করা হচ্ছে প্রতিনিয়ত।
এ কারণেই আগের প্রজন্মের মতো কেবল নদীর সৌন্দর্য নিয়ে গান না লিখে সুমি বলেন, “আমরা এখন নদী বাঁচাতে, জলবায়ু বাঁচাতে, আমাদের এই পৃথিবীকে বাঁচাতে গান করছি”।
সঙ্গীতের রয়েছে অসাম্রান্য ক্ষমতা
দ্য থার্ড পোলকে সুমি বলেন, আমি বিশ্বাস করি যে নদীর সাথে সুর ও সঙ্গীতের একটি মেলবন্ধন রয়েছে। যেখানেই উৎপত্তি হোক না কেন নদী যেমন কেবল বয়ে যায়, ঠিক তেমনি সুরের ও একটি চলন আছে যা নদীর মেতাই প্রবাহমান। আর এই প্রবাহ থামবার নয়।
বাংলাদেশের ঝিনাইদহ জেলার শৈলকুপা উপজেলার পাঁচ পাখিয়া গ্রামে জন্মগ্রহণকারী সুমি খুলনা জেলার ছোট শহর খালিসপুরে বড় হয়েছেন। তার মনে আছে শৈশবে কিভাবে তার বাবা বছরের শেষে স্কুলের বার্ষিক পরীক্ষার পর বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে প্রবাহিত রূপসা নদীতেপরিবারের সবাই মিলে ভ্রমনে বের হতেন।
শৈশবের নদী স্মৃতির কথা বলতে গিয়ে সুমি বলেন, “সেসময় নৌকায় বসে আমি নীরবে নদীর চারপাশের জীবনগুলোকে অবলোকন করতাম। আমার কাছে কথন মনে হতো নদীর দুই তীর উচ্ছ্বল জীবন এবং উৎসবে পরিপূর্ণ, যেমন আমি দেখতাম নদীর তীরে স্থানীয় নারীরা স্নান করছে। সেসময় আমি দেখতাম নদীর জলে মাছের চলাচল, গোধূলি বেলায় গ্রামের কিশোর নদীল তীর ধরে চলছে নিজেদের গবাদি পশুগুলো নিয়ে বাড়ির পথে। আবার চোখে পড়তো ছোট ছোট দূরন্ত শিশুরা গাছের ডাল থেকে নদীর জলে ঝাপ দিচ্ছে। আমি দেখতাম নদী পাড়ের মানুষ স্থানীয় বাজারে কেনা-বেচায় ব্যস্ত। কিংবা শ্মশান ঘাটে কারো শেষকৃত্য পালনের জন্য জড়ো হচ্ছে স্থানিয়রা। এই সামগ্রীক পরিবেশটা ছিল ভীষণ মায়াবী, একেবারে রূপকথার গল্পের মতো।”
সে দৃশ্য আর চোখে পড়ে না। নদীর এখনকার অবস্থা বর্ণনা করতে গিয়ে মায়াবী সেই দৃশ্যপটের কথার পরিবর্তে সুমির কন্ঠে একটি শব্দই প্রতিধ্বনিত হয়, আর সেটি হচ্ছে “ভয়ংকর”।
দ্য থার্ড পোলকে সুমি বলেন, “নদীগুলো যেন নোংরা, আবর্জনাযুক্ত খালে পরিণত হয়েছে। এসব নদীর দূষিত পানি এখন দূর্গন্ধময়।” বেশ ক্ষোভের সঙ্গে তিনি বলেন, আমাদের নদীগুলো দখল করে অবৈধভাবে বিভিন্ন ধরনের অবকাঠামো নির্মাণ করে নদীগুলোকে যেন গলাটিপে শ্বাসরোধ করা হচ্ছে প্রতিনিয়ত।
এ কারণেই আগের প্রজন্মের মতো কেবল নদীর সৌন্দর্য নিয়ে গান না লিখে সুমি বলেন, “আমরা এখন নদী বাঁচাতে, জলবায়ু বাঁচাতে, আমাদের এই পৃথিবীকে বাঁচাতে গান করছি”।
সময় কাটুক নদীর সাথে
সুমি মনে করেন আজকের দিনের তরুণরা একটি বিভ্রান্তিকর সময়ের মধ্য বসবাস করছে এবং তারা প্রকৃতি থেকে যেন একেবারেই বিচ্ছিন্ন। “তরুণ জীবনের গ্লানী আর হতাশা দূর করতে, তাদের নদীর কাছে ফিরে যেতে হবে এবং নীরবে নদীর কাছে বসে তার সৌন্দর্য ও রঙের সাক্ষী হতে হবে। আমি নিশ্চিত যে নদীগুলো তাদের খালি হাতে ফিরিয়ে দেবে না,” সুমি বলেন।
নদী রক্স এপর্যন্ত বাংলাদেশে সুইজারল্যান্ডের দূতাবাস, স্থানীয় এনজিও মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন এবং বিজ্ঞাপনী সংস্থা সল্ট ক্রিয়েটিভ থেকে অর্থায়ন পেয়েছে। সুমি বলেন, এই উদ্যোগটি সরকারের কয়েকটি মন্ত্রণালয় এবং ঢাকার মেয়রের কাছ থেকেও সহযোগিতা পেয়েছে। এছাড়াও, জাতিসংঘ উন্নয়ণ কর্মসুচি, স্কয়ার গ্রুপ এবং বেসরকারী সংস্থা ফ্রেন্ডশিপ সুমির এই উদ্যোগের সাথে সংহতি প্রকাশ করেছে।