১.জলের গুনগত মান নিরীক্ষায় ড্রোনের ব্যবহার:
জল দূষন নিরীক্ষায় খুব শিঘ্রই ড্রোন আর রিমোট সেন্সিং প্রযুক্তির (দুর নিয়ন্ত্রণ প্রযুক্তি) ব্যবহার বড় আকারে শুরু করতে যাচ্ছে চীন। নতুন এই প্রযুক্তির আবিষ্কারক চীনের এক ছাত্র কী শুয়েই, যিনি এরই মধ্যে দেশটির দক্ষিন-পূর্বের প্রদেশ হুবেইয়ের ইউহানে এই প্রযুক্তির পরীক্ষামূলক ব্যবহার সম্পন্ন করেছেন। ইউহানের অবস্থান চীনের অন্যতম বৃহৎ ওয়াটার ডাইভারশন প্রল্পের (জল অপসারন প্রকল্প) মধ্যবর্তী অংশের উৎসের কাছাকাছি – এই প্রকল্পের মাধ্যমে বেইজিং ও অন্যান্য জল সংকটপূর্ণ এলাকায় জল সরবরাহ করা হয়। কী’র এই গবেষণায় দেশটির পরিবেশ সুরক্ষা মন্ত্রণালয় সহায়তা দিয়েছে। মন্ত্রণালয়ে কর্মকর্তাদের আশা, নতুন এই প্রযুক্তির মাধ্যমে দেশটির জলের গুনাগুন নিরীক্ষন করা যাবে ব্যাপক ভিত্তিতে।
২.রটারডামের ভাসমান সম্প্রদায়
রটারডাম বিশ্বের এমন একটি স্থান যেখানে শতকরা ৮০ শতাংশ নগর এলাকার অবস্থান সমুদ্র সীমার নীচে। এখানে রয়েছে বিশ্বের সবচেয়ে বড় বন্দরগুলোর মধ্যে একটি। এমন একটি অবস্থার ভিতর থেকে রটারডাম তার সমুদ্র উপকূলে তৈরি করেছে এক ভাসমান সম্প্রদায়ের জন্য আবাসস্থল যা সমুদ্রের অবস্থান পরিবর্তনের সাথে সাথে নিজের অবস্থানও পরিবর্তন করতে সক্ষম। নেদারল্যান্ডসের এই শহর বন্যা নিয়ন্ত্রণেও গ্রহন করেছে সবুজ সমাধান (গ্রীন সলিউশন)। এই প্রক্রিয়ায় দেশটিতে চালু করা হয়েছে প্রকৃতির জন্য লেভ্যি বা ট্যাক্স। একই সাথে শহরে তৈরি করা হয়েছে প্লাবন ভূমি, জল প্লাজাসহ বাড়ির ছাদে বাগান তৈরি করা। এই প্রকল্পের মাধ্যমে শহরে বসবাসকারীদের জন্য ব্যবস্থা করা করা হয়েছে খোলা স্থানের। এশিয়ায় এমন অনেক নিচু জায়গায় এ ধরনের স্কিম চালু করা যেতে পাওে যেখানে জলবায়ু পরিবর্তনের কারনে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বেড়ে গিয়ে ব্যাপক বন্যার সম্ভাবনা রয়েছে।
৩. চীনে বর্জ্য থেকে জ্বালানী
চীনের বিভিন্ন শহরের ধারে গড়ে ওঠা অগণিত বর্জ্য ব্যবস্থাপনা প্রকল্প থেকে প্রতিদিনই যেসব উপজাত তৈরি হচ্ছে তা মূলত ভয়াবহ মাত্রার দূষণ তৈরি করছে যা সেখানকার সুষ্ঠূ জল সরবরাহ ব্যবস্থায় এক প্রকার হুমকি। আশার কথা হচ্ছে যে দেশটির হুবেই প্রদেশের ঝিয়াংজিয়াংয়ের একটি কারখানা এক ধরনের প্ল্যান্ট স্থাপন করেছে যেখানে এসব বিষাক্ত বর্জ্যকে বায়ো-ফুয়েলে (জৈব জ্বালানী) রুপান্তর করা হচ্ছে। এ প্রতিষ্ঠানটি একটি শহরের বর্জ্য ব্যবস্থাপনা প্ল্যান্টের বর্জ্যকে মিথেনে রুপান্তর করে যার মাধ্যমে ওই শহরের এক তৃতীয়াংশ ট্যাক্সির জন্য জ্বালানীর যোগান দেয়া হয়। এভাবে বর্জ্যকে মিথেনে পরিণত না করা হলে অদূর ভবিষ্যতে ভয়াবহ ক্ষতির আশংকা থেকে যেতে পারে। কারণ কার্বন ডাই অক্সাইডের চেয়ে ২৫ গুন বেশি দাহ্য হচ্ছে মিথেন। এই গ্যাসকে সঠিক মাত্রায় ব্যবহার করা না গেলে তা আমাদের পরিবেশে ছড়িয়ে পড়তে পারে ব্যাপক মাত্রায়। এছাড়া জৈব জ্বালানী ব্যবস্থা প্রচলনের মাধ্যমে হাজার হাজার গ্যালন জ্বালানী তেল সাশ্রয় করা গেছে যা আসলে শহরের যানবাহনে ব্যবহৃত হতো। এছাড়া বর্জ্য ব্যবস্থাপনা প্ল্যান্টের উচ্ছ্বিষ্টগুলোকে একটি উন্নত কম্পোস্ট হিসেবে আশেপাশের কৃষিজমিতে সার হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে। চীনের হুবেইতে গড়ে ওঠা এই মডেল বিশ্বের অনেক স্থানেই ব্যবহার করা যেতে পারে। কারন বিশ্বের অনেক শহরই এখন তীব্র জল সংকটে ভূগছে। পাশাপাশি অনেক শহরের জল এখন ৯০ শতাংশেরও বেশি দূষিত।
৪. ইলেকট্রনিক বর্জ্য পরিশোধনে নবায়নযোগ্য ফিল্টার
যুক্তরাষ্ট্রের এক কিশোর এবার আবিস্কার করেছে অভিনব একটি ওয়াটার ফিল্টার বা জলশোধন যন্ত্র যা ইলেকট্রনিক বর্জ্য পরিশোধন করতে সক্ষম। এই ফিল্টার আবিষ্কার করে ওই কিশোর জিতে নিয়েছেন ২০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার মূল্যামানের পুরস্কার। মাত্র ১৮ বছরের ওই কিশোরের নাম পেরি আলাগাপ্পান।
মোবাইল ফোনসহ অন্যান্য অনেক ইলেকট্রনিক যন্ত্র থেকে ব্যাপক ভিত্তিক বর্জ্য উৎপাদন করে চলেছে ভারত ও চীন। এই দু’টি দেশের বিভিন্ন কারখানা হচ্ছে এ ধরনের ইলেকট্রনিক বর্জ্যরে উৎস। বর্জ্য পূনর্ব্যবহারের মাধ্যমে এসব কারখানা স্থানীয় জলের সরাবরাহে প্রচুর পরিমানে রাসায়নিক ও নানা ধরনের ধাতু ছড়িয়ে দিচ্ছে। টেক্সাসের আলাগাপ্পানের উদ্ভাবিত এই ফিল্টার ন্যানোটেকনলজির মাধ্যমে জলের ভিতরে থাকা ৯৯ শতাংশ ধাতু পরিশোধন করতে সক্ষম। সবচেয়ে বড় কথা হচ্ছে আলাগাপ্পান জানিয়েছেন, তিনি তার এই প্রযুক্তিকে মুক্ত অবস্থায় (ওপেন সোর্স) রাখতে চান যাতে যে কেউই এই প্রযুক্তিকে ব্যবহার করতে পাওে কোনো রকম প্যাটেন্ট মূল্য ছাড়াই। নিজের পিতামহের বাড়ি ভারতে বেড়াতে গিয়ে তিনি এই প্রযুক্তি উদ্ভাবনে ধারনা পান। ভারতে ইলেকট্রনিক বর্জ্যে জল দূষনের ঘটনা দেখে এ ধরনের প্রযুক্তি উদ্ভাবনে আগ্রহী হয়ে ওঠেন আলাগাপ্পান।
৫. বিশালাকৃতির চুম্বকের মাধ্যমে ভূ-পৃষ্ঠের ৪০০ মিটার গভীরের জলের অবস্থান নির্ণয়
ভূ-গর্ভস্থ্য জলের সঠিক অবস্থান ও ব্যবহার সম্পর্কে জানার লক্ষ্যে এক কার্যকর পদ্ধতি আবিস্কার করেছে ডেনমার্কের একদল গবেষক। এই পদ্ধতিতে সংকটপূর্ণ উত্তর চীন কিংবা ইন্দাস বেসিনে জলের অভাব মেটানো যেতে পারে। সারাবিশ্বেই ভূ-গর্ভস্থ্য জলের তথ্যের ঘাটতি রয়েছে। এর অন্যতম কারন ম্যাপিংয়ের মাধ্যমে জলের সঠিক অবস্থান নির্ণয় অত্যন্ত দূরহ। অথচ ভূ-উপরিভাগে নদী ও হৃদের জলে দূষন ও মাত্রাতিরিক্ত ব্যবহারের ফলে জল সংকট দিন দিন বেড়েই চলেছে। এজন্য সারাবিশ্বে সবাই ভূ-গর্ভস্থ্য জলের উপরে নির্ভরশীল হয়ে পড়ছে। সদ্য আবিস্কৃত ডেনিশ এই প্রযুক্তি স্কাইটিএম নামে পরিচিত। এ পদ্ধতিতে অত্যন্ত নিচু উচ্চতায় উড়ে যাওয়া হেলিকপ্টার ও শক্তিশালী বৈদ্যুতিক-চুম্বক ব্যবহার করা হয়। এর মাধ্যমে ৩০০-৪০০ মিটার ভূ-গর্ভস্থ্য জলের অবস্থান নির্ণয় করা হয়। এর মাধ্যমে পলি, বালু ও কাঁদার অবস্থান, স্থানভেদে জলের গুনাগুনও নির্ণয় করা সম্ভব। এই প্রক্রিয়ায় বিজ্ঞানীরা একদিকে যেমন জানতে পারবেন কোথায় জলের ঘাটতি রয়েছে, অন্যদিকে ভূ-গর্ভস্থ্য জলপথের পূনর্জাগরনও এই প্রক্রিয়ায় করা সম্ভব। এই প্রযুক্তিটি উদ্ভাবন করেছে জিওলজিকাল সার্ভে অব ডেনমার্ক অ্যান্ড গ্রিনল্যান্ড এবং এর সফল ব্যবহার করা হয়েছে অষ্ট্রেলিয়ায়। তারা এখন ভারত ও চীনে এ প্রযুক্তি ব্যবহারের ইচ্ছা প্রকাশ করেছে। যদিও অনেকে মনে করছেন এটি উন্নয়নশীল দেশগুলোর জন্য কিছুটা ব্যয়বহুল হতে পারে।
৬.আগামী দিনের শাওয়ার
সুইডেনের একদল গবেষক এবার আবিস্কার করেছেন পৃথিবীর সবচেয়ে আধুনীক এবং কার্যকর শাওয়ার (¯œানকার্যে ব্যবহৃত ঝর্ণা কল) যা মূলে রয়েছে নবায়নযোগ্য প্রযুক্তি, অনেকটাই যেমন ব্যবহার করেন মহাকাশচারীরা। এই প্রযুক্তির সাহায্যে গৃহস্থালী কাজে ব্যবহৃত শাওয়ারে ব্যবহার্য্য জল বিশুদ্ধ করা হয় যা আসলে ব্যবহারের পরে নালায় চলে যেত। একই সাথে ওই ব্যবহার্য জল আবার বিশুদ্ধীকরণের পরে শাওয়াওে ফেরত নিয়ে আসা হয় যার মাধ্যমে ৯০ শতাংশ জল ও ৮০ শতাংশ শক্তি সংরক্ষন করা সম্ভব। ইউরোপে বিশাল একটি জনগোষ্ঠী ব্যক্তিগত পরিচ্ছন্নতার কাজে প্রচুর পরিমানে জলের ব্যবহার করে থাকে। ধারণা করা হচ্ছে যে এই প্রযুক্তির মূল্য পাঁচ হাজার মার্কিন ডলারের বেশি হতে পারে যদিও সদ্য আবিস্কৃত এই প্রযুক্তির মূল্য সম্পর্কে কোম্পানিটির ওয়েবসাইটে তেমন কোনো তথ্য পাওয়া যায়নি। আপাতদৃষ্টিতে এর মূল্য একটু বেশি মনে হলেও গৃহস্থালী কাজে ব্যবহৃত হলে এর মাধ্যমে বছরে একশ’ ডলারের বেশি অর্থ সাশ্রয় করা যাবে বলে ধারনা করা হচ্ছে।
এদিকে বাংলাদেশের একদল শিক্ষার্থী বাসা-বাড়িতে ব্যবহারের জন্য নবায়নযোগ্য জল প্রযুক্তি আবিস্কার করেছে। এর মাধ্যমে বাড়ির সিংক, শাওয়ার ও বৃষ্টির পানি পূনর্ব্যবহার করা সম্ভব হবে। বাড়ির বেসমেন্টে এ পদ্ধতি স্থাপন করে ভূ-গর্ভস্থ্য জলের উপরে নির্ভরশীলতা অর্ধেকে নামিয়ে নিয়ে আসা যাবে বলে মনে করা হচ্ছে। বাংলাদেশে গৃহস্থালী কাজে বেশিরভাগক্ষেত্রে ভূ-গর্ভস্থ্য জল ব্যবহার করা হয়। অথচ এই জল প্রায়শই প্রাকৃতিকভাবে আর্সেনিক দ্বারা দূষিত অবস্থায় থাকে যার ফলে বিশাল জনসংখ্যার এই দেশে মারাত্বক ধরনের স্বাস্থ্যগত সমস্যা দেখা যায়।
অনুবাদ: নুসরাত জাহান