বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে অভিন্ন নদীগুলোর ব্যবস্থাপনায় কাজ করে থাকে যৌথ নদী কমিশন (জয়েন্ট রিভার কমিশন – জেআরসি)। কমিশনটির বাংলাদেশ অংশ সম্প্রতি নতুন করে ১০টি নদীকে দু’দেশের অভিন্ন নদী হিসেবে চিহ্নিত করেছে। আশা করা হচ্ছে আনুষ্ঠানিকভাবে তালিকাভুক্তির মাধ্যমে উভয় দেশ এই নদীগুলোর যৌথ ব্যবস্থাপনায় একসঙ্গে কাজ করতে পারবে। তালিকায় যুক্ত হওয়ার অপেক্ষায় থাকা এই নদীগুলো হচ্ছে মহারশি, উদ্দাখালি, সনকোশ, মহাদেও, হাড়িভাঙ্গা, চেলা, লূভা, লোহা, কামঝরা ও খাসিমারা। এই নদীগুলোর বেশিরভাগই ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের রাজ্য মেঘালায় ও আসামে সৃষ্টি হয়ে আন্তর্জাতিক সীমানা অতিক্রম করে বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে।
প্রতিবেশী এই দু’টি দেশ এখন পর্যন্ত ৫৪টি নদীকে অভিন্ন নদী হিসেবে তালিকাভূক্ত করে যৌথভাবে ব্যবস্থাপনার লক্ষ্যে কাজ করে যাচ্ছে। বাংলাদেশ সদ্য চিহ্নিত এই ১০টি নদীকে আনুষ্ঠানিকভাবে জেআরসির তালিকায় অন্তর্ভূক্ত করার মাধ্যমে এদেরকেও যৌথ ব্যবস্থাপনার আওতায় আনার ব্যাপারে কাজ শুরু করেছে।
দক্ষিণ এশিয়ার প্রতিবেশী দেশ ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে থাকা অন্যতম প্রধান অভিন্ন নদীগুলোর কয়েকটি হচ্ছে গঙ্গা, ব্রক্ষ্মপুত্র, তিস্তা ও সুরমা-কুশিয়ারা। এই প্রত্যেকটি নদীর জন্যই বাংলাদেশ হচ্ছে ভাটি অঞ্চল। এই নদীগুলোর অববাহিকায় থাকা উজানের দেশগুলো হচ্ছে ভারত, চীন, ভূটান ও নেপাল। জেআরসির তথ্য অনুযায়ি এসব নদীর ১.৭২ বর্গ কিলোমিটার অববাহিকার মধ্যে বাংলাদেশের হিস্যা ৭ শতাংশ এবং প্রতিবছর এই নদীগুলোর মাধ্যমে কমপক্ষে ১.৫ বিলিয়ন মেট্রিক টন বাহিত হয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করে।
বেসরকারী সংস্থা সেন্টার ফর এনভায়রনমেন্ট অ্যান্ড জিওগ্রাফিক ইনফরমেশন সার্ভিসেস (সিইজিআইএস)– এর উপ নির্বাহী পরিচালক মালিক ফিদা আব্দুল্লাহ খান বলেন, আমরা এরই মধ্যে এই নদীগুলোর একটি তালিকা জেআরসিকে (বাংলাদেশ) হস্তান্তর করেছি। সরকারের পক্ষ থেকে সিইজিআইএস আন্তর্জাতিক ও অভিন্ন নদীগুলোর উপরে একটি সমীক্ষা পরিচালনা করছে। এরই অংশ হিসেবে আমরা নতুন এই ১০টি অভিন্ন নদীকে চিহ্নিত করেছি।
যৌথ নদী কমিশনের বাংলাদেশের পরিচালক মোহাম্মদ মোফাজ্জল হোসাইন বলেন, এই মুহুর্তে আমরা নদীগুলোর সার্বিক দিক বিশ্লেষণ করে দেখছি। এরপর আমরা এদেরকে অভিন্ন নদী হিসেবে অনুমোদনের জন্য তালিকাটি পানি সম্পদ মন্ত্রণালয়ের কাছে পাঠাবো। সরকারের পক্ষ থেকে অনুমোদন পাওয়ার পরেই আমরা ভারত-বাংলাদেশ জেআরসির যৌথ বৈঠকে এই নামগুলো প্রস্তাব করবো যাতে আনুষ্ঠানিক তালিকায় এদেও যুক্ত করা হয়।
তিনি বলেন, এটি একটি দীর্ঘ প্রক্রিয়া। উভয় পক্ষ একমত হওয়ার পরেই কেবল এবিষয়ে আনুষ্ঠানিক সিন্ধান্তের ঘোষণা আসতে পারে।
অভিন্ন নদী চিহ্নিত করার গুরুত্ব
জেআরসির (বাংলাদেশ) সাবেক সদস্য অধ্যাপক আইনুন নিশাত বলেন, দু’টি দেশের মধ্যে প্রবাহিত অভিন্ন নদীগুলো চিহ্নিত করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি কাজ। এর মধ্য দিয়ে এক দেশ অপর দেশের সঙ্গে নদী ভাঙ্গন, দূষণ অথবা নাব্যতা ছাড়াও অন্যান্য অনেক বিষয়ে তথ্য বিনিময় করতে পারে। অববাহিকা ভিত্তিক নদী ব্যবস্থাপনার জন্য এটি বেশ গুরুত্বপূর্ণ।
বিষয়টি আরো পরিস্কার করতে গিয়ে অধ্যাপক নিশাত হাওরা নদীর একটি উদাহরণ তুলে ধরেন। তিনি বলেন, হাওরা নদীটি ভারতের ত্রিপুরা রাজ্য হয়ে বাংলাদেশের ব্রাক্ষ্মণবাড়িয়া জেলায় প্রবেশ করেছে। নদীটির ভাটিতে (বাংলাদেশ) ব্যাপক পলি জমে যাওয়ার কারনে ভারতের অংশে বর্ষা মৌসুমে প্রচন্ড জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হয়। উভয় পক্ষের মধ্যে তথ্য আদান প্রদান শুরু হওয়ার পর এই সমস্যা সমাধান করতে সক্ষম হয় দু’টি দেশ।
এছাড়াও ইছামতি নদীর খননের বিষয়েও যৌথ নদী কমিশন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। এই নদীটি বাংলাদেশ ও ভারতের সীমান্ত দিয়ে প্রবাহিত হয়ে থাকে। তিনি বলেন, আসলে একটি নদীর অববাহিকাভিত্তিক ব্যবস্থাপনা ভালোভাবে করতে হলে সেই নদীর সব অংশেরই তথ্য প্রয়োজন। আর তাই অভিন্ন নদীগুলোকে চিহ্নিত করে স্বীকৃতি দেয়াটাও জরুরী।
এদিকে ভারতের সহায়তায় বাংলাদেশ বন্যা পূর্বাভাস ব্যবস্থাকে অনেকটাই ঢেলে সাজিয়েছে। ভারতের দেয়া তথ্য দিয়ে বাংলাদেশ এখন ১০ দিনের বন্যা পূর্বাভাস প্রদানে সক্ষমতা অর্জন করেছে। এর আগে বাংলাদেশ সর্বোচ্চ ৫ দিনের বন্যা পূর্বাভাস প্রদান করতে পারতো। যদিও এখনও পর্যন্ত ঢেলে সাজানো এই ব্যবস্থাকে পরীক্ষামূলক হিসেবেই দেখছেন বাংলাদেশের কর্মকর্তারা। বর্তমানে বর্ষা মৌসুমে ভারত ব্রক্ষ্মপুত্র, তিস্তা, গঙ্গা ও বরাক নদীর উজানে থাকা ৮টি পয়েন্টের তথ্য বাংলাদেশকে আনুষ্ঠানিকভাবে প্রদান করে যাচ্ছে। এর মধ্যে গঙ্গার দ’ুটি, তিস্তার একটি, ব্রক্ষ্মপুত্রের চারটি ও বরাক নদীর একটি জল প্রবাহ পরিমাপক স্টেশন থেকে প্রাপ্ত তথ্য বাংলাদেশকে প্রদান করছে। এই সবক’টি ষ্টেশনই আন্তর্জাতিক সীমান্তের ২০০ কিলোটিারের মধ্যে অবস্থিত।
জেআরসির ইতিহাস ও যৌথ নদী
১৯৫১ সালে ভারত ও পূর্ব পাকিস্তানের (বর্তমানে বাংলাদেশ যা ১৯৭১ সালে স্বাধীনতা অর্জন করে) মধ্যে তিস্তা ও গঙ্গা নদী নিয়ে সরকারী পর্যায়ে আলোচনা শুরু হয়। ১৯৫১ সালে এই তালিকায় যুক্ত হয় ব্রক্ষ্মপুত্র নদ। ১৯৭১ সালে পাকিস্তানের কাছ থেকে স্বাধীন হওয়ার এক বছর পরে ভারত ও বাংলাদেশ মিলে যৌথ নদী কমিশন গঠন করে। অভিন্ন নদীর তথ্য বিনিময়ের মাধ্যমে এই অঞ্চলে একটি অববাহিকা ভিত্তিক নদী ব্যবস্থাপনা গড়ে তোলাকে এই কমিশনের উদ্দেশ্য হিসেবে নির্ধারণ করা হয়। ১৯৮০ সাল পর্যন্ত এই তিনটি নদীকেই দু’দেশের মধ্যে অভিন্ন ও আন্তর্জাতিক নদী হিসেবে বিবেচনা করা হতো। ১৯৮২ সালে এদের নামের পাশে যুক্ত হয় আরো ৬টি নদী। এরা হচ্ছে সাঙ্গু, মুহুরি, খোয়াই, গোমতি, ধরলা এবং দুধকুমার। এরপর ধীরে ধীরে দীর্ঘ হতে থাকে এই তালিকা। এই মুহুর্তে আনুষ্ঠানিকভাবে দু’দেশের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত যৌথ নদীর সংখ্যা ৫৪।
গঙ্গা-ব্রক্ষ্মপুত্র-মেঘনা অববাহিকার একেবারেই ভাটির দেশ হওয়ায় এই নদীগুলো থেকে সবচেয়ে বেশি পরিমানে পলি এসে জমা হয় বাংলাদেশে। মাটির উর্বরা শক্তি বাড়াতে পলি ইতিবাচক ভূমিকা রাখলেও এর একটি নেতিবাচক দিকও রয়েছে, আর তা হচ্ছে বর্ষা মৌসুমে এখানে বন্যা আর শুষ্ক মৌসুমে ব্যাপক খরা হয়ে থাকে এই পলি জমার কারনে। এছাড়াও নদী ভাঙ্গন ও উজানের দেশগুলোতে দূষণের কারনেও ক্ষতিগ্রস্ত হয় বাংলাদেশ।
অববাহিকা ভিত্তিক নদী ব্যবস্থাপনা প্রকৃতপক্ষে গড়ে তুলতে বাংলাদেশের জন্য সবগুলো যৌথ বা অভিন্ন নদীকে চিহ্নিত করে ভারতের সাথে একসঙ্গে কাজ করাটা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। উজান থেকে আসা এই নদীগুলোর কারনে সৃষ্ট নানা সমস্যার উৎসে থাকা দেশগুলো অনেক ক্ষেত্রেই সরাসরি ভূমিকা না রাখলেও বাংলাদেশের নদী কেন্দ্রীক সমস্যা সমাধানে তাদের মধ্যে এক ধরনের আগ্রহের মনোভাব সৃষ্টি করা প্রয়োজন। প্রতিবেশি দেশগুলোকে এক্ষেত্রে একই অবস্থানে নিয়ে আসার কাজটিকে জটিল হলেও এক্ষেত্রে একটি ইতিবাচক পরিবেশ সৃষ্টি করে এই সমস্যাগুলো সমাধান করা সম্ভব বলে মনে করেন মালিক ফিদা।
আবু বকর সিদ্দিক বাংলাদেশে কর্মরত একজন সাংবাদিক। তার সঙ্গে যোগাযোগ করতে চাইলে ই-মেইল করুন – [email protected]