শুষ্ক মৌসুমে তিস্তার ধারাবাহিক জল সংকটের বিষয়টি এখন বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে বিরাজমান বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্কের মাঝে একটি কাঁটা হয়ে দাঁড়িয়েছে – এ পরিস্থিতিতে একটি প্রশ্নই কেবল ঘুরপাক খাচ্ছে – কেন তিস্তায় জল নেই ?
ধারাবাহিক এই অনুসন্ধানী প্রতিবেদনের প্রথম অংশে তিস্তা নদীর জলের প্রবাহ হ্রাস পাওয়ার পিছনে অন্যতম প্রধান নিয়ামক হিসেবে নদীর উজানে জলবিদ্যুত প্রকল্পকে চিহ্নিত করা হয়েছে এবং তার স্বপক্ষে বেশ কিছু তথ্য-উপাত্তের বিশ্লেষন উপস্থাপন করা হয়েছে।
বিস্তারিত জানতে দেখুন – কোথায় যায় তিস্তার জল?
কিন্তু তিস্তা নদীর প্রবাহ হ্রাস পাওয়ার পিছনে কি শুধুমাত্র জলবিদ্যুত প্রকল্পগুলোই কি দায়ী? আসলে এভাবে একটি সিদ্ধান্তে পৌছানো সমীচিন হবে না। দ্যথার্ডপোল.নেট এর অনুসন্ধানে এর পাশাপাশি আরো বেশ কিছু বিষয়ও উঠে এসেছে।
সংযোগ খালের নেতিবাচক প্রভাব
প্রাপ্ত তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, তিস্তা নদীতে জলের পরিমান বা স্বাভাবিক প্রবাহ হ্রাস পেতে শুরু করে মূলত ৭০ দশকের শেষের দিক থেকে। ১৯৭৯ থেকে ১৯৯৯, এই সময়কালে তিস্তায় জলের প্রবাহ কমপক্ষে ৬৩ শতাংশ হ্রাস পায়। ১৯৭৯ সালে যেখানে তিস্তায় প্রতি সেকেন্ডে জলের প্রবাহ ছিল ৫৪১ ঘনমিটার (কিউমেক), সেটি কমে গিয়ে ১৯৯৯ সালে প্রতি সেকেন্ডে মাত্র ২০০ কিউমেকে গিয়ে পৌছায়। গ্রীষ্ম মৌসুমে মাঝে মাঝে ন্যূনতম প্রবাহ ৯০ শতাংশেরও নিচে গিয়ে পৌছে। এর অর্থ হচ্ছে ১৯৭৯-৮০ সালের দিকে তিস্তা তার স্বাভাবিক জলের প্রবাহ হারাতে শুরু করে। এসময় পূর্ববর্তী বছরের ন্যূনতম প্রবাহ ৩৬১ কিউমেক থেকে কমে গিয়ে মাত্র ১৯৫ কিউমেকে নেমে আসে।
পরবর্তীতে ১৯৯০ সালের মাঝামাঝি সময় থেকে গজালডোবার নি¤œাঞ্চলে এই প্রবাহ আরো অনেক পরিমানে হ্রাস পেতে শুরু করে।
অথচ ওই সময়েরও আরো অনেক পরে তিস্তার উজানে জলবিদ্যুত প্রকল্প স্থাপনের কাজ শুরু হয়। সুতরাং তিস্তার এই সংকটময় পরিস্থিতির পিছনে বিদ্যুত প্রকল্পগুলোকে একমাত্র কার্যকারণ হিসেবে চিহ্নিত করা সর্বাংশে সঠিক নয়। পশ্চিমবঙ্গের উত্তরাঞ্চলে অব্যাহত জলের সংকট মোকাবেলায় রাজ্য সরকার গজালডোবা ব্যারাজ থেকে একটি সংযোগ খাল খনন করে মহানন্দা নদীর সাথে যুক্ত করে। এই খালটির মাধ্যমে তিস্তার জল অপসারণ করে নির্দিষ্ট এলাকায় কৃষি জমিতে সেচ দেয়া হচ্ছে। পাশাপাশি এর মাধ্যমে মহানন্দা নদীটিকেও বাঁচিয়ে রাখার প্রচেষ্টা করা হয়। তিস্তার আজকের এই পরিস্থিতির জন্য অনেকেই এই বিষয়টিকেও একটি বড় কারণ হিসেবে মনে করেন।
পশ্চিমবঙ্গ সরকারের সাবেক সেচ প্রকৌশলী পি কে বসু গজালডোবা ব্যারাজ চালুর গোড়ার দিকে ওই প্রকল্পে বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করেন। এ বিষয়ে দ্যথার্ডপোলকে.নেট-কে তিনি বলেন, ৯০ দশকের মাঝামাঝিতে শুষ্ক মৌসুমে নদীর ন্যূনতম প্রবাহ ১০০ থেকে ১১০ কিউমেকের মধ্যে ওঠা-নামা করতো। আমরা তখন ৮০ শতাংশ জল অপসারণের জন্য রেখে বাকি ২০ শতাংশ জল নিচের দিকে অর্থাৎ ভাঁটির জন্য ছেড়ে দিতাম।
বিশিষ্ট ভূগোলবিদ কৌশিক ঘোষ বলেন, গত ১৫ বছরের তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষন করে দেখা যায় তিস্তা নদীর বার্ষিক জল প্রবাহের পরিমান হ্রাস পাওয়ার প্রবণতা লক্ষ্য করা যায়। এর ফলে ব্যাপক চাহিদা ও হ্রাসকৃত জোগানের কারনে শুকনো মৌসুমে জলের তীব্র সংকট সৃষ্টি হয়। এই পরিস্থিতি ধীরে ধীরে আরো জটিল আকার ধারণ করে। গজালডোবা ব্যারাজের পর নদীর দিকে তাকালেই এর করুণ পরিস্থিতির চোখে পড়ে। সেখানে গেলে দেখা যাবে নদীর বিশাল অংশ জুড়ে জল নেই, সরু জলের ধারা আর সেই সাথে শুধুই শুকনো চর।
২০১০ সালের তথ্য অনুযায়ি, পশ্চিমবঙ্গ সরকার তিস্তা – মহানন্দা সংযোগ খালের মাধ্যমে তিস্তার ১০ শতাংশ জল অপসারণ করতে শুরু করে। এ ব্যাপারে পি কে বসু বলেন, সেচ ব্যবস্থা সার্বিকভাবে চালু হলে পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য হয়ত আরো বেশি জল তিস্তা থেকে অপসারণ করতে সক্ষম হতো। জল অপসারণের জন্যই এই চ্যানেল বা খালটি খনন করা হয়েছিল। তবে বর্তমান সরকারের ভূমি অধিগ্রহন নীতির কারনে নতুন করে সেচের জন্য খাল বা চ্যানেল খনন সম্ভব নয়। ফলে তিস্তা-মহানন্দা সংযোগ খালের ধারণ ক্ষমতা ৩৩০ কিউমেক থাকলেও ভরা মৌসুমে ১৯০ কিউমেকের বেশি জল অপসারণ করা সম্ভব নয়। আর শুষ্ক মৌসুমে জল অপসারণের পরিমান স্বাভাবিকভাবেই আরো কমে আসে।
বিশিষ্ট পরিবেশ অর্থনীতিবিদ নিলাঞ্জন ঘোষ বলেন, শুকনো মৌসুমে সবচেয়ে শুষ্ক মাসগুলোতে পশ্চিমবঙ্গ বেশিরভাগ জল আটকে রেখে সংযোগ খাল দিয়ে তা অপসারণ করে দেয়। এটি করা না হলে রাজ্যের বিরাট একটি অংশ কেবল যে সেচ ব্যবস্থার বাইরেই থাকবে শুধু তাই নয় বরং শিলিগুড়ির জনগণ তীব্র পাণীয় জলের সংকটে পড়বে। কারণ শিলিগুড়ির পানীয় জলের অন্যতম উৎস হচ্ছে এই খাল। উল্লেখ্য, শিলিগুড়ি পশ্চিমবঙ্গের দ্বিতীয় বৃহত্তম নগরী ।
দ্যথার্ডপোল.নেট এর অনুসন্ধানে দেখা গেছে এ বছর জুন মাসের গোড়ার দিকে গজালডোবা ব্যারাজের ৪৫টি গেটের মধ্যে মাত্র দু’টি গেট খোলা ছিল!
জলবায়ু পরিবর্তনের নেতিবাচক প্রভাব
জলবিদ্যুত প্রকল্প ও সংযোগ খাল দিয়ে মহানন্দায় জল অপসারণ ছাড়াও তিস্তার জলের প্রবাহ হ্রাস পাওয়ার পিছনে আরো কিছু কারণ রয়েছে। শুষ্ক মৌসুমে এই নদীতে জলের আধিক্য এমনিতেই কম থাকে। পি কে বসুর মতে, কেন্দ্রীয় সরকারের সঙ্গে যুক্ত কয়েকজন গবেষক ও সিকিম সরকার পরিচালিত গবেষণায় দেখা গেছে তিস্তায় জলের প্রবাহ হ্রাস পাওয়ার অন্যতম কারণগুলোর মধ্যে একটি হচ্ছে – যেসব হিমবাহ তিস্তায় জলের প্রবাহ সৃষ্টি করে আসছিল সেই উৎসগুলো থেকে জলের প্রাপ্তি ধীরে ধীরে কমে আসছে।
জলবায়ু পরিবর্তনের নেতিবাচক প্রভাবের কারনে হিমবাহগুলো স্বাভাবিক বৈশিষ্ট্য হারাতে শুরু করেছে।
‘হিমালয়ান নেচার অ্যান্ড অ্যাডভেঞ্চার ফাউন্ডেশন’-এর সদস্য অমিতাভ বোস এক্ষেত্রে ২০০৭-০৮ সালে পরিচালিত একটি গবেষণা প্রতিবেদনের তথ্য তুলে ধরেন। তিনি হিমালয় নিয়ে ভারতে বহুদিন ধরে কাজ করে আসছেন। ভারত সরকারের পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন বিষয়ক মন্ত্রণালয় পরিচালিত ওই গবেষণায় বলা হয়, তিস্তার প্রাকৃতিক জল প্রবাহ সৃষ্টিতে ভূমিকা রাখে মূলত ৩৪টি হিমবাহ। এগুলোর মধ্যে কমপক্ষে ২৩টি হিমবাহ অনেকদিক থেকেই তিস্তা নদীর জলের উৎস হিসেবে আর সক্রিয় নয়। এছাড়া আরো ৮টি হিমবাহ অবস্থান পরিবর্তন করে এগিয়ে আসতে শুরু করেছে, আর বাকি তিনটি মোটামুটি অপিরবর্তিত রয়েছে। ১৯৯০ সালে ৩৪টি হিমবাহের অবস্থান ছিল ৩০৫ বর্গকিলোমিটার এলাকা জুড়ে, সেখানে ২০০৪ সালের চিত্র হচ্ছে তিস্তা অববাহিকার জন্য ওই হিমবাহের পরিধী চার বর্গকিলোমিটার পর্যন্ত হ্রাস পেয়েছে।
ফলে সিকিম থেকে পশ্চিমবঙ্গে যে পরিমান জল প্রবাহিত হওয়ার কথা ছিল তা আর অব্যাহত থাকতে পারছে না। পশ্চিমবঙ্গ সেচ ও নৌ-চলাচল বিভাগের তথ্যমতে, ২০০১ সালে তিস্তা-মহানন্দা সংযোগ খালটি মূল নদী থেকে (তিস্তা) গড়ে ১২০ কিউমেক জল পেত। সেটি এখন কমে গিয়ে ২০১০ সালে মাত্র ৫০ কিউমেকে পৌছেছে।
সার্বিক প্রভাব পড়ছে ভাটি অঞ্চলে
নিলাঞ্জন ঘোষ তার একটি গবেষণায় বলেছেন, গজালডোবা ব্যারাজে বার্ষিক জল প্রবাহের পরিমান ১৯৯৩ থেকে ২০১০ সালের মধ্যে কমপক্ষে তিন ভাগের এক ভাগে নেমে এসেছে। ১৯৯৩ সালে গজালডোবা ব্যারাজের মাধ্যমে বার্ষিক ৭২৫ কিউমেক জল অপসারণ করা হতো। পরিস্থিতির অবনতির হতে হতে ২০১০ সালে বার্ষিক অপসারণের পরিমান ৪৮০ কিউমেকে এসে পৌছায়। ‘ইন্ডিয়ান জার্ণাল অব জিওগ্রাফি অ্যান্ড এনভায়রণমেন্ট’ ২০১৪ সালে ওই গবেষণার উপরে একটি প্রতিবেদণ প্রকাশ করে। এ প্রসঙ্গে দ্যথার্ডপোল.নেট’কে নিলাঞ্জন ঘোষ বলেন, নদীটি সাম্প্রতিক সময়ে অস্বাভাবিক শুকিয়ে একটি বিনুনি নদীতে (ব্রেইডেড রিভার) রুপান্তরিত হয়ে গেছে। নদীর প্রধান ধারা থেকে প্রচুর পরিমানে শাখা-প্রশাখা ছড়িয়ে যাচ্ছে। এর অর্থ হচ্ছে নদীর উজানে জলের প্রবাহের পরিমান হ্রাস পাচ্ছে ফলে প্রচুর পলি জমে নদীটি একটি ব্রেইডেড নদীতে পরিণত হচ্ছে।
এই প্রতিবেদনটি তৈরির আগে তিস্তার উজান ও ভাঁটিতে নদীর তীরে বসবাসকারী অনেকের সাথে কথা বলে জানা গেছে তিস্তার এই পরিবর্তন তারা সাম্প্রতিক সময়ে বেশ ভালোভাবেই লক্ষ্য করছেন।
এদিকে অপর একটি গবেষণায় কোলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূগোল বিভাগের বৈশালি মুখার্জী ও উজ্জ্বল দীপ সাহাও নিলাঞ্জন ঘোষের গবেষণার সাথে একমত পোষণ করেছেন। ২০১৬ সালে ‘ইন্টারন্যাশনাল জার্ণাল অব সাইন্স অ্যান্ড রিসার্স’ ওই গবেষনার উপরে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে। তাতে বলা হয় তিস্তা অববাহিকায় জলের চাহিদা বেড়েই চলেছে। অথচ সেই তুলনায় নদীতে জলই নেই। ১৯৯০ থেকে ২০১০ সাল সময়ের মধ্যে নদীতে কমপক্ষে ৩২ শতাংশ জলের প্রবাহ হ্রাস পেয়েছে। এই সময়ের মধ্যে জলের জোগান ৬৯ বিলিয়ন ঘনমিটার থেকে ৪৭ বিলিয়ন কিউবিক মিটারে নেমে আসে।
শিলিগুড়ির নর্থ বেঙ্গল বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের প্রধান জেতা সাংকৃত্তায়ন বলেন, স্বাভাবিক দৃষ্টিতে বিশ্লেষণ করলে খুব স্পষ্টভাবেই প্রতীয়মান হয় যে সাম্প্রতিক সময়ে তিস্তার জল অস্বাভাবিকভাবে হ্রাস পেয়েছে।
পি কে বোস বলেন, যেহেতু নদীতে জল কমেছে ব্যাপকভাবে, তাই পশ্চিমবঙ্গে জলের চাহিদাও বাড়ছে দিনকে দিন। রাজ্যের উত্তরাঞ্চলের মানুষের কাছে তিস্তাই হচ্ছে জলের প্রধান উৎস। তিস্তা-মহানন্দা সংযোগ খালের মাধ্যমে পাওয়া তিস্তা নদীর জল এই অঞ্চলের ধানসহ অন্যান্য ফসলের জমিতে সেচ ও চা বাগানে জলের চাহিদা পূরণ করে থাকে। পাশাপাশি শিলিগুড়ির পাণীয় জলের জন্য এই নদীটির উপরেই নির্ভর করতে হয়।
রাজ্য সরকারের একজন জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা বলেন, যত দিন যাচ্ছে, কৃষিজমিতে সেচের চাহিদা বৃদ্ধি ততই পাচ্ছে। অথচ সংযোগ খালে চাহিদা অনুযায়ি জল নেই। বিষয়টির গুরুত্ব মাথায় রেখে করণীয় ঠিক করতে রাজ্য সরকার একটি উচ্চক্ষমতা সম্পন্ন কমিটি গঠন করে। ওই কমিটির সিদ্ধান্ত অনুযায়ি এই মুহুর্তে প্রায় ৫২ হাজার হেক্টর জমিতে সেচ দেয়া সম্পূর্ণরুপে বন্ধ রাখা হয়। এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন যে সেচের জন্য রাজ্য সরকারের মূল যে পরিকল্পনা রয়েছে সেটি অনুযায়ি এই ৫২ হাজার হেক্টর জমি মোট সেচ এলাকার মাত্র ২০ ভাগের এক ভাগ!
এ অবস্থায় সংশ্লিষ্ট সব পক্ষকে নিয়ে একসাথে করণীয় ঠিক করা না গেলে তিস্তা সংকট মোকাবেলা করা দূরহ বলেই মনে করা হচ্ছে।