বাংলাদেশের ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগ ভারত, নেপাল ও ভুটানের সঙ্গে সহযোগিতা এবং ন্যায়সঙ্গত পানি বণ্টন নিশ্চিত করার প্রতিশ্রুতি দিয়ে এ বছর টানা চতুর্থবারের মতো সরকার পরিচালনার জন্য দায়িত্ব নিয়েছে। ২০২৩ সালের শেষের দিকে প্রকাশিত একটি নির্বাচনী ইশতেহারে, দলের সভাপতি ও বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, তার সরকার আন্তঃসীমান্ত যোগাযোগ, ট্রানজিট, জ্বালানি অংশীদারিত্ব এবং ন্যায়সঙ্গত পানি বণ্টনের বিষয়গুলিসহ প্রতিবেশী দেশগুলির সাথে সহযোগিতা প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখবে।
তবে বিশেষজ্ঞরা আশঙ্কা, আন্তঃসীমান্ত নদী ঘিরে বহু সমস্যা বাংলাদেশ ও ভারত উভয়ের মধ্যেই অমীমাংসিত থেকে যাবে। এর মধ্যে সবার প্রথমে রয়েছে তিস্তা নদীর পানি বণ্টন নিয়ে বহুল আলোচিত চুক্তি। উভয় সরকারের জন্য আরেকটি বড় চ্যালেঞ্জ হচ্ছে গঙ্গার পানিবন্টন চুক্তির নবায়ন যা ২০২৬ সালে শেষ হবার কথা।
আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন সরকার ২০০৯ সাল থেকে ক্ষমতায় থাকলেও ভারতের সাথে আন্তঃসীমান্ত নদীগুলো নিয়ে সহযোগিতার বিষয়ে কোন উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি হয়নি। বাংলাদেশ নদী কর্মী এবং ঢাকাভিত্তিক থিঙ্ক ট্যাঙ্ক ‘রিভারাইন পিপল-এর সাধারণ সম্পাদক শেখ রোকন বলেন, “গত এক দশকে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি অন্তত ছয়বার বিভিন্ন পর্যায়ে দেখা করে যৌথ বিবৃতি দিয়েছেন। এর মধ্যে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তিনবার দিল্লি এবং নরেন্দ্র মোদি দুইবার ঢাকা সফর করেছেন। কোভিড -১৯ মহামারীর সময়, দুই প্রধানমন্ত্রীর মধ্যে একটি ভার্চুয়াল বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। কিন্তু গঙ্গার পানি বণ্টন চুক্তির বিষয়টি এরমধ্যে একবারের জন্যেও আলোচনার মূল এজেন্ডায় ছিল না।”
জেআরসির এর জন্ম এবং এর ৫০ বছরের ‘প্রাপ্তি’
যৌথ নদী ব্যবস্থাপনায় আনুষ্ঠানিক প্রক্রিয়া শুরু করতে ১৯৭২ সালে যৌথ নদী কমিশন (জেআরসি) গঠন করে প্রতিবেশী দুটি দেশ। সেচ, বন্যা এবং ঘূর্ণিঝড় নিয়ন্ত্রণের পাশাপাশি পানি সম্পদ ভাগাভাগির মতো বিষয়গুলো নিয়ে কারিগরী পর্যায়ে আলোচনাই ছিল এটির মূল উদ্দেশ্য। ১৯৭২ সালের মার্চে ভারত-বাংলাদেশ মৈত্রী, সহযোগিতা এবং শান্তি চুক্তির অংশ হিসাবে গঠিত হয় জেআরসি।
জেআরসির কার্যপদ্ধতি (রুলস অব প্রসিজার) অনুসারে, বছরে চারটি সভা করার কথা এই সংস্থাটির। অর্থাৎ গত ৫২ বছরে ২০৮টি জেআরসির বৈঠক অনুষ্ঠানের কথা ছিল। কিন্তু বাস্তবে দু’দেশের কারিগরী এই কমিশর সর্বোচ্চ ৩৮টি সভা অনুষ্ঠিত করতে সক্ষম হয়েছে। জেআরসিরমন্ত্রী পর্যায়ের সর্বশেষ ৩৮তম বৈঠকটি প্রায় ১২ বছর পর ২০২২ সালের আগস্টে অনুষ্ঠিত হয়।
অর্ধ শতাব্দীরও বেশি পুরোনো এই কমিশনের সাফল্যের ঝুড়িতে প্রাপ্তি নিতান্তই সামান্য। কয়েক দশকের আলোচনার পর ১৯৯৬ সালে প্রথমবারের মতো দুই দেশ একটি সফল চুক্তি স্বাক্ষর করতে সক্ষম হয়। ১৯৯৬ সালের ডিসেম্বরে স্বাক্ষরিত গঙ্গা পানি বন্টন চুক্তিটি দু’দেশের জন্য একটি বিরাট মাইলফলক হয়ে আছে। এই চুক্তি সইয়ের পর প্রতিবেশী দুই দেশের মধ্যে পানি নিয়ে উত্তেজনা কিছুটা প্রশমিত হয়। অনেকের মতে এই চুক্তির ফলে আন্তঃসীমান্ত নদী ব্যবস্থাপনা নিয়ে উভয় দেশের মধ্যে সহযোগিতার পথ প্রশস্ত হয়। তবে আশংকার বিষয় হচ্ছে যুগান্তকারী এই চুক্তিটির মেয়াদ আগামী দুই বছরের মধ্যে শেষ হতে চলেছে।
তিস্তা নদীর পানি বণ্টন নিয়ে আলোচনা শুরু হয় ১৯৮৩ সালে একটি স্বল্পমেয়াদী চুক্তির মাধ্যমে। এরপর ২০১১ সালে ১৫ বছরের জন্য তিস্তা নিয়ে একটি অন্তর্বর্তীকালীন চুক্তি সইয়ের ব্যাপারে প্রস্তুত হয় দুই দেশ। কিন্তু পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জর বিরোধিতা জেরে চুক্তিটি স্থগিত হয়ে যায়।
জানতে চাইলে জেআরসি সদস্য মোহাম্মদ আবুল হোসেন বলেন, যদিও কমিটি একটি কারিগরি কমিটি হিসেবে তার ভূমিকা পালন করেছে এবং উভয় দেশের পানি সচিবদের পর্যালোচনার জন্য চুক্তির খসড়া তৈরি করে, কিন্তু তিস্তা নিয়ে উভয় পক্ষের মধ্যে ঐকমত্যের অভাবে চুক্তিটি আনুষ্ঠানিকভাবে সইয়ের প্রচেষ্টা ধারাবাহিকভারে ব্যর্থ হয় ১৯৯৭, ১৯৯৯ এবং ২০০৩ সালে।
গঙ্গার পানি বণ্টন চুক্তি স্বাক্ষরের সময় তৎকালীন জেআরসি সদস্য বিশিষ্ট পানি বিশেষজ্ঞ আইনুন নিশাত বলেন, রাজনৈতিক ঐকমত্য না থাকলে জেআরসি-এর উদ্যোগ ও সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করা সম্ভব নয়। ২০১১ সালে মমতা ব্যানার্জীর বিরোধিতার জেরে ভেস্তে যাওয়া তিস্তা চুক্তির দিকটি উল্লেখ করে তিনি বলেন, “এরপর থেকে জেআরসি বাংলাদেশ অধ্যায় চুক্তি স্বাক্ষরের জন্য ভারতীয় পক্ষের সাথে আলোচনা চালিয়ে গেছে। কিন্তু এখন পর্যন্ত কিছুই হয়নি।”
পানি বণ্টন নিয়ে প্রয়োজন রাজনৈতিক ঐকমত্য
বাংলাদেশ সরকার ভারতের সাথে অমিমাংসিত নদী সমস্যা সমাধানে আন্তরিক বলে মনে হচ্ছে। নির্বাচনের পর, ঢাকায় ভারতীয় হাইকমিশনার প্রণয় ভার্মা ছিলেন প্রথম বিদেশী রাষ্ট্রদূত যিনি নতুন পররাষ্ট্রমন্ত্রী হাছান মাহমুদের সাথে দেখা করেন। বৈঠকের পরে, পররাষ্ট্রমন্ত্রী সাংবাদিকদের বলেন যে বৈঠকে গঙ্গার পানি-বন্টন চুক্তির পাশাপাশি তিস্তা নিয়ে ও আলোচনা হয়, তবে আমার মনে হচ্ছে পরবর্তীতে যে কোনও অগ্রগতির জন্য ভারতের চলমান সাধারণ নির্বাচনের ফলাফলের জন্য অপেক্ষা করতে হবে।
দ্য থার্ড পোলের সাথে কথা বলার সময় সাউথ এশিয়া নেটওয়ার্ক ফর ড্যামস, রিভারস অ্যান্ড পিপলের প্রতিনিধি হিমাংশু থাক্কার মনে করেন যে বেশ কিছু কারনে এই বিষয়ক আলোচনাগুলো জটিল হয়ে যায়। তিনি বলেন, “যেকোনো পানি চুক্তিতে, একটি নদীর উজান এবং ভাটির বিষয়টি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। উজানের দেশটি প্রায়শই একটি চুক্তিতে প্রবেশ করার সরাসরি কোন কারণ দেখতে পায় না, কারণ অন্যান্য কারণের দ্বারা বাধ্য না হলে এটি অবিলম্বে পরিণতির মুখোমুখি হয় না। উদাহরণস্বরূপ, যদি দুটি দেশ বাণিজ্য এবং অন্যান্য উদ্যোগের মাধ্যমে অর্থনৈতিকভাবে ঘনিষ্ঠভাবে আবদ্ধ থাকে, তাহলে চুক্তির জন্য আলোচনা করা সহজ।”
তিনি ভুটানের উদাহরণ দিয়ে বলেন যে দেশটি ভারতের উজানে অবস্থিত এবং এখনও তাই তাদের ঘনিষ্ঠ সম্পর্কের কারণে পানি পরিচালনা করা সহজ হয়েছে।
“সাংস্কৃতিক নৈকট্য এবং ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট বিবেচনা করে [ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যেও], একটি চুক্তি এখনই প্রতিষ্ঠিত হওয়া উচিত ছিল,” থাক্কার উল্লেখ করে বলেন আমরা দেখতে পাচ্ছি এক্ষেত্রে আলোচনার গতি বাড়েনি। “এমনকি ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের জন্মের পর গঙ্গা চুক্তিটি বাস্তবায়িত হতে ২৫ বছর লেগেছিল।”
তবে মোদ্দাকথা হচ্ছে বাংলাদেশের সাথে ভাগ করে নেয়া ৫৪টি নদীর বেশিরভাগের ক্ষেত্রেই উজানের দেশ হিসাবে ভারতের অবস্থান। এর অর্থ হল এই ধরনের চুক্তিতে প্রবেশের ক্ষেত্রে ভারতের অভ্যন্তরে চাপের অভাব রয়েছে।
তবে থাক্কারের মতে এক্ষেত্রে সহযোগিতা বৃদ্ধির একটি উপায় হতে পারে বড় নদীগুলোর ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে একটি অববাহিকাভিত্তিক দৃষ্টিভঙ্গি। তিনি বলেন, “যখন ব্রহ্মপুত্রের উপর বাঁধের মতো চীনের অবকাঠামো প্রকল্পগুলি এই অঞ্চলকে প্রভাবিত করে… ভারত এই ধরনের উন্নয়নের প্রতিবাদ করলেও, ভাটির দেশ হিসেবে বাংলাদেশ [চীনের সাথে ব্রহ্মপুত্রে] প্রায়শই এনিয়ে উদ্বেগ দেখায় না, সম্ভবত ভূ-রাজনৈতিক কারণের কারণে।”
মমতা ব্যানার্জির আপত্তির বিষয়ে তিনি বলেন, “পশ্চিমবঙ্গ যদি এই ধরনের চুক্তিতে জড়িত হলে সেখানে ব্যাপক রাজনৈতিক প্রতিক্রিয়ার তৈরি হতে পারে। তাই তিস্তা চুক্তিতে সম্মত হওয়ার জন্য পশ্চিমবঙ্গের জন্য সঠিক পরিবেশ তৈরি করতে বাংলাদেশকে কাজ করতে হবে।”
“পশ্চিমবঙ্গ ও বাংলাদেশের মধ্যে শক্তিশালী সম্পর্ক থাকা সত্ত্বেও, রাজনৈতিক রাজনৈতিক বিভেদগুলো বেশ চ্যালেঞ্জিং। এই ধরনের চুক্তিতে অগ্রগতির জন্য সময় এবং পরিস্থিতি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।”
আইনুন নিশাত গঙ্গা ও সিন্ধু (দ্য ইন্দাস ওয়াটারস ট্রিটি) চুক্তির খসড়া তৈরির সাফল্যের বিষয়ে বলেন, “আমাদের এই উপমহাদেশে দুটি সফল পানি-বন্টন চুক্তি হয়েছে, কিন্তু উভয় ক্ষেত্রেই দৃশ্যপট ভিন্ন। সিন্ধু চুক্তির ক্ষেত্রে বিশ্বব্যাংক একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে এবং একটি সালিশ প্রক্রিয়ার ফলে দুই দেশ চুক্তিতে স্বাক্ষর করে। কিন্তু জেআরসির ক্ষেত্রে বিশ্বব্যাংকের মতো মাঝখানে কিছুই নেই। এটা সম্পূর্ণ রাজনৈতিক ঐকমত্যের উপর নির্ভরশীল। সুতরাং, আমাদের রাজনৈতিক ঐকমত্য না হলে জেআরসি তার ম্যান্ডেট পূরণ করতে সক্ষম হবে না।”