পানি

দূর্গা পুজার পর বিরল সবুজ বিসর্জন

প্রতিবছরের মতো এবারও প্রায় সব জায়গাতেই দুর্গোৎসবের কারনে সৃষ্টি হয় মারাত্বক জল দূষণ
বাংলা

দুর্গোৎসবের পর প্রতিমা বিসর্জনের মধ্য দিয়ে কোলকাতায় এবারো গঙ্গা নদীর জল দূষণ অব্যাহত ছিল। বার্ষিক এই উৎসবের কেন্দ্রস্থলই হচ্ছে কোলকাতা। কোভিড-১৯ এর জন্য সামাজিক দুরত্ব, ন্যাশনাল গ্রিন ট্রাইব্যুনালের যাবতীয় নির্দেশনা আর পশ্চিমবঙ্গ সরকারের প্রজ্ঞাপন – এর সবই ভেস্তে যাওয়ার জোগাড়। এর মাঝেই শহরের হাজার হাজার উৎসব আয়োজনকারীদের মধ্য থেকে একটি দল এগিয়ে এলো সবুজ বিসর্জনের মতো অভাবনীয় এক ধারনা নিয়ে।

পশ্চিমবঙ্গের সবচেয়ে বড় বার্ষিক এই উৎসবে পুরো রাজ্য জুড়ে প্রতিবছর কমপক্ষে ৩৭,০০০ দুর্গাপুজা অনুষ্ঠিত হয়, এর মধ্যে অধিকাংশেরও বেশি পালিত হয় রাজ্যের রাজধানী কোলকাতায়। প্রত্যেক বছর গঙ্গা নদীর সর্ব পশ্চিমের ধারা হুগলি নদীতে প্রতিমা বিসর্জনের ফলে সৃষ্ট মারাত্বক জল দূষনের কথা পরিবেশবাদীরা বরাবরই বলে আসছিলেন। কাঁদা মাটির গড়া দেবী প্রতিমার গাঁয়ে থাকে বিষাক্ত রঙ। এছাড়াও প্রতিমার শরীরে থাকে প্লাস্টিক দিয়ে তৈরি নানা অলংকার ও অন্যান্য সামগ্রী। বারবার দূষনের কথা বলা হলেও পরিবেশবাদীদের এই আঁকুতি একপ্রকার অবজ্ঞা করা হয়।

কোলকাতা মিউনিসিপাল কর্পোরেশন – কেএমসি’র একজন কর্মকর্তা জানান এই বছর নদীর পাড়ে প্রস্তুত করা ১৭টি বিসর্জন পয়েন্টের মধ্যে তিনটি স্থানে ক্রেন রাখা হয়। এর উদ্দেশ্য ছিল বিসর্জনের পরপরই প্রতিমা নদীর জলে ডুবে যাওয়ার আগেই তা অপসারণ করা। এবছর বিসর্জন করা প্রায় ১৫০০০ প্রতিমার প্রায় দুই-তৃতিয়াংশই এই ব্যবস্থার বাইরে ছিল।

কেএমসির ঘাটগুলোতে বিশেষ করে উত্তর কোলকাতার ঘাটগুলোতে দেবী প্রতিমা বিসর্জনের ক্ষেত্রে এনএমসিজি-র (ন্যাশনাল মিশন ফর ক্লিন গঙ্গা) নির্দেশনাটি অপর্যাপ্ত। গত ১৯ অক্টোবর বিসর্জনের সময় রাজ্য দূষণ নিয়ন্ত্রন বোর্ডের এক কর্মকর্তা একথা জানান।

নিজেদের অসহায়ত্ব প্রকাশ করে রাজ্য সরকারের এক কর্মকর্তা বলেন, আসলে এই বিষয়টির সাথে সাধারণ মানুষের ব্যাপক অনুভুতি জড়িত। এজন্য প্রয়োজন ব্যাপক সচেতনতা ও সামাজিক গ্রহনযোগ্যতা। শুধুমাত্র পুলিশি ব্যবস্থা গ্রহনের মাধ্যমে এর কোনো উন্নতি সম্ভব নয়।

দুর্গা পুজায় পাঁচটি দেবপ্রতিমা  থাকে – দেবী দুর্গা ও তার চার সন্তান। শুভাষ দত্ত একজন পরিবেশকর্মী। পরিবেশবান্ধব সবুজ বিসর্জনের প্রচেষ্টায় তিনি বেশ কয়েকবার আদালতের কাছে গিয়েছেন। তিনি বলেন, ধারনা করা যায় কী পরিমান প্রতিমা হুগলী ও অন্যান্য নদীতে এই সময় বিসর্জন করা হয় এবং এর ফলে কী ভয়াবহ পরিমান দূষণ সৃষ্টি হচ্ছে প্রতিবছর? আমরা নিজ হাতে বিপর্যয় ডেকে আনছি।

একটি উজ্জ্বল আকুস্থল

উত্তর কোলকাতার ত্রিধারা সম্মিলনী বরাবরই দুর্দান্ত উদযাপনের জন্য বিশেষ পরিচিত। এবারের চমকটি তারাই দেখালেন। এবছর পুজার সময় প্রতিমা বিসর্জনের জন্য তারা প্লাস্টিক শিট দিয়ে একটি কৃত্রিম পুকুর তৈরি করে। এই পুকুরটি পুজার প্যান্ডেলের পাশেই রাখা ছিল।

ত্রিধারা সম্মিলনীর সবুজ বিসর্জন, কোলকাতা [ ছবি: জয়ন্ত বসু]
ত্রিধারা সম্মিলনীর সবুজ বিসর্জন, কোলকাতা [ ছবি: জয়ন্ত বসু]
একটি ক্রেনের মাধ্যমে কৃত্রিম ওই পুকুরে একেকটি প্রতিমা নিয়ে যাওয়া হয়। রঙ ধুয়ে গেলে এবং জলে কাঁদা মিশে গেলে ওই একই জলে পরবর্তী প্রতিমার জন্য একই জল ব্যবহার করা হয়। দুই ঘন্টার এই প্রক্রিয়ায় ২৫,০০০ লিটার জল ব্যবহৃত হয়।

ডত্রধারা সম্মিলনী ক্লাব ও কেএমসি বোর্ড অব অ্যাডমিনিষ্ট্রেটর্স এর সদস্য দেবাশীষ কুমার বলেন, কোভিড সৃষ্ট মহামারীর কারনে নানা ধরনের প্রতিবন্ধকতা এবং প্রথাগত পহ্নায় গঙ্গায় বিসর্জনের যে ঝুঁকি রয়েছে তা বিবেচনা করে আমরা এই অসাধারণ পদ্ধতি অনুসরনের সিদ্ধান্ত নেই।

কেএমসির কর্মকর্তা হিসেবে দেবাশীষ সমগ্র কোলকাতায় বিসর্জন ব্যবস্থাপনার দায়িত্বে নিয়োজিত। ভবিষ্যতে এই ক্লাবটির মতো শহরের আরো অনেক ক্লাব এ ধরনের পরিবেশবান্ধব বিসর্জনে আগ্রহী হওয়ার ব্যাপারে তিনি বেশ আশাবাদী।

রোল মডেল

আগের বছরগুলোতে অন্যান্য অনেক পুজা উদযাপন কমিটি এই ধরনের পথ দেখিয়েছে। কোলকাতার উত্তরে নৈহাটি কালি পুজা আয়োজকবৃন্দ পরিচিতি পেয়েছে তাদের পরিস্কার ও গলা (ওয়াশ অ্যান্ড মেল্ট) পদ্ধতির জন্য।

নদীতে বিসর্জনের পক্ষে সমর্থনকারী অনেকেই মনে করেন এটি পুজার একটি অংশ। কিন্তু এর সাথে দ্বিমত রয়েছে ধর্ম পুরোহিতদের। গত দুই দশক ধরে দুর্গা পুজা পরিচালনা করছেন পুরোহিত রামনাথ ভট্টাচার্য্য। তিনি বলেন, সবুজ বিসর্জনের ক্ষেত্রে ধর্মীয় কোনো বাঁধা নেই। আসলে দর্পন বিসর্জনের পরেই (যার মাধ্যমে দেবীকে বিদায় জানানো হয়) মূলত বিসর্জন হয়ে যায়। সংস্কৃতি কলেজের সাবেক শিক্ষক হিমাংশু প-িত বিষয়টিকে পঞ্জিকা ঘেটে পুজার দিনক্ষণ বিচার করে দেখেন। তার মতেও সবুজ বিসর্জন মডেলে ধর্মীয়ভাবে কোনো ত্রুটি হওয়ার কথা নয়।

আরো কিছু প্রচেষ্টা

চলতি বছর পশ্চিমবঙ্গে আরো বেশ কয়েকটি সবুজ বিসর্জন প্রচেষ্টা লক্ষ্য করা গেছে। পশ্চিমবঙ্গ দূষণ নিয়ন্ত্রন বোর্ডের চেয়ারম্যান কল্যান রুদ্র দ্যথার্ডপোলকে বলেন, এনএমসিজির নির্দেশনা মেনে আমরা দক্ষিণ দমদম মিউনিসিপ্যালিটি কাছে ব্যরিকেড দিয়ে পৃথক করে দুটি বড় জলাধারকে প্রতিমা বিসর্জনের জন্য সুনির্দিষ্ট করে দিয়েছি। এটি কোলকাতা মিউনিসিপ্যাল কর্পোরেশনের কাছেই। আমাদের মূল উদ্দেশ্য ছিল পরিবেশবান্ধব প্রতিমা বিসর্জন নিশ্চিত করা। তিনি বারো জানান যে এই দুটি জলবাধারের নিচের দিকে সিনথেটিক দিয়ে তৈরি একটি বেস তৈরি করা হয় যাতে বিসর্জনের পরে সব ধরনের দূষিত পদার্থগুলো আটকে রাখা যায়।

দূষণ নিয়ন্ত্রন বোর্ড এই ধারণাটি নতুন কোলাকাতা উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (এনকেডিএ) কাছ থেকে পেয়েছে। এনকেডিএ গত কয়েক বছর যাবত এই মডেলটি কোলকাতার উত্তর দিকে এলাকাগুলোতে ব্যবহার করছে। এনকেডিএ’র চেয়ারম্যান দেবাশীষ সেন বলেন, বিশেষভাবে প্রস্তুতকৃত র‌্যাম্পের মাধ্যমে (যার দু’পাশে রয়েছে সিড়ি) প্রতিমা বিসর্জনের ব্যবস্থা করা হয়। বিসর্জনের পরে ক্রেনের মাধ্যমে আবার উঠিয়ে নিয়ে আসা হয়।

কোলকাতার পাশেই চিনসুরার মিউনিসিপ্যাল কর্তৃপক্ষ রেলের লাইনের মতো ব্যবস্থা কওে যার মাধ্যমে প্রতিমাগুলো খুব দ্রুত গড়িয়ে হুগলী নদীর নিচে চলে যায় এবং এরপরই দ্রুত ক্রেনের মাধ্যমে তা সরিয়ে নেয়া হয়।

সবুজ ভবিষ্যতের স্বপ্ন

এনএমসিজি’র নির্দেশনা আর আদালতের রায়ের কারনে আগামী কয়েক বছরের মধ্যেই সবুজ বিসর্জন একটি স্বাভাবিক অবস্থায় পরিনত হবে বলে আশা করছেন পরিবেশবাদীরা।

কল্যান রুদ্র বলেন, এটি বেশ ভালো একটি উদ্যোগ এবং কোলকাতা মিউনিসিপ্যাল কর্পোরেশন চাইলে আমরা এই পদ্ধতি ছড়িয়ে দিতে সঞায়তা করতে পারি।

কেএমসির বোর্ড অব অ্যাডমিনিস্ট্রেটর্স এর চেয়ারম্যান ও সাবেক মেয়র ফিরহাদ হাকিম বলেন, কেএমসি সামনের দিনে ওয়াশ অ্যান্ড মেল্ট মডেলকে আরো জনপ্রিয় করে তোলার ক্ষেত্রে কাজ করবে।

বেশিরভাগ মানুষেরই আগ্রহ দূষনে

কোলকাতার হুগলি নদীতে প্রতিমা বিসর্জনের চিত্র [ছবি: জয়ন্ত বসু]
কোলকাতার হুগলি নদীতে প্রতিমা বিসর্জনের চিত্র [ছবি: জয়ন্ত বসু]
রাজ্যের পরিবেশ বিভাগের মূখ্য আইন কর্মকর্তা বিশ্বজিত মুখার্জি বলেন, কিন্তু পরিতাপের বিষয় হচ্ছে পরিবেশবান্ধব এই বিসর্জন প্রক্রিয়অর প্রতি আগ্রহ রয়েছে মুষ্টিমেয় কিছু ব্যক্তির। রাজ্যের অন্যান্য স্থানে এই চিত্র আরো ভয়াবহ, সেসব জায়গায় পরিবেশবান্ধব প্রতিমা বিসর্জনের কোনো ব্যবস্থাই নেই।

জলের উপরে এর প্রভাব

মালয়েশিয়ার পেতালিং জায়ার লিংকন ইউনিভার্সিটি কলেজের অধ্যাপক কৃঞ্চজ্যোতি গোস্বামী বলেন, আগের বছরগুলিতে আমরা দেখেছি বিসর্জনের ফলে জলে সীসার মতো বিষাক্ত ভারী ধাতব পদার্থের ঘনত্ব চারগুণ বৃদ্ধি পায়, অথচ বিশ^ স্বাস্থ্য সংস্থার নিরাপত্তা সীমার চেয়ে যা ১৭ গুন বেশি। তিনি ২০১৫ থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত হুগলী নদীর কোলকাতা অংশে বিসর্জনের ফলে জল দূষনের মাত্রা নিয়ে গবেষণা করেন।

২০১৫ সালে করা পশ্চিমবঙ্গ দূষণ নিয়ন্ত্রণ বোর্ডের অভ্যন্তরীন এক গবেষণা দেখতে পায় এই প্রতিবেদক। ওই গবেষনায় বলা হয় জলে বিসর্জনের পরে প্রচন্ড বিষাক্ত ভারী ধাতব পদার্থের ঘনত্ব ১৪৮ শতাংশের বেশি বৃদ্ধি পায়। কোলকাতার একটি বিসর্জন এলাকায় দেখা গেঝে সেখানে সীসার ঘনত্ব প্রায় ৫১ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে।

অল ইন্ডিয়া ইন্সটিটিউট অব হাইজিন অ্যান্ড পাবলিক হেলথ এর পরিবেশ ও স্যানিটেশনের সাবেক প্রদান অরণাভ মুজমদার বলেন, মনে রাখতে হবে এই জলই আবার আমাদের বাড়িতে ফিরে আসে খাবার জল হয়ে। আমাদের জল পরিশোধন পদ্ধতি এতটা উন্নত নয় যে জল থেকে ভারী এসব ধাতব পদার্থ খুব সহজেই দুর করতে পারবে।

গাইডলাইনে ‘হ্যাঁ’, বাস্তবায়নে ‘না’

যে কোনো নদীর উন্মুক্ত স্থানে প্রতিমা বিসর্জন বন্ধে কাজ করে যাচ্ছে ভারতের ন্যাশনাল গ্রিন ট্রাইব্যুনাল। ট্রাইব্যুনালের অক্টোবর ৬, ২০১৭ এর এক আদেশে বলা হয়েছে প্রতিমা বিসর্জনের স্থান অবশ্যই ঘেরা দেওয়া এবং ব্যরিকেডযুক্ত হতে হবে।

ওই আদেশে আরো বলা হয় যে প্রতিমা অবশ্যই প্রাকৃতিক পদার্থ দ্বারা তৈরি করতে হবে। কোনোভাবেই পোড়া কাঁদামাটি বা প্লাষ্টার অব প্যারিস দ্বারা করা যাবে না। প্রতিমার গায়ে রঙ লাগানো পুরোপুরি নিরুৎসাহিত করা। তবে জলে মিশে যেতে পারে বা বিষাক্ত নয় এমন প্রাকৃতিক রঙ লাগানো যেতে পারে। এতে আরো বলা হয় যে বিসর্জনের আগে অবশ্যই প্রতিমার দেহ থেকে ফুল, কাপড়, অলংকার জাতীয় বস্তু সরিয়ে নিতে হবে।

এনজিটির নির্দেশনার পুনরাবৃত্তি করে ২০১৮ সালে পশ্চিমবঙ্গ সরকারের পরিবেশ বিভাগ একটি আদেশ জারি করে।  কিন্তু পরিস্কার বোঝা যাচ্ছে যে এর প্রতি কারো কোনো ভ্রুক্ষেপ নেই। গত অক্টোবর ১৯ তারিখে বিসর্জনের সময় দায়িত্ব পালনরত রাজ্যের দূষণ নিয়ন্ত্রন বোর্ডের এক কর্মকর্তা বলেন, আমরা দেখলাম কেবল ফুল ছাড়া অন্যান্য বস্তু যেমন রঙ্গীন অলংকার বা অন্য কিছুই প্রতিমা থেকে সরানো হয় না।

অনুবাদ: আরিক গিফার

Privacy Overview

This website uses cookies so that we can provide you with the best user experience possible. Cookie information is stored in your browser and performs functions such as recognising you when you return to our website and helping our team to understand which sections of the website you find most interesting and useful.

Strictly Necessary Cookies

Strictly Necessary Cookie should be enabled at all times so that we can save your preferences for cookie settings.

Analytics

This website uses Google Analytics to collect anonymous information such as the number of visitors to the site, and the most popular pages.

Keeping this cookie enabled helps us to improve our website.

Marketing

This website uses the following additional cookies:

(List the cookies that you are using on the website here.)