পানি

বাংলাদেশে তামাক চাষ থেকে কৃষকেরা মুখ ফিরিয়ে নেয়ায় বাঁচছে জীবন ও পানি

সেচের জন্য পর্যাপ্ত পানির অভাবে বাংলাদেশের উত্তরবঙ্গের কৃষকরা তামাক ছেড়ে চা, সূর্যমুখী এবং সরিষা চাষে উৎসাহী হচ্ছে কারন এসব ফসল উৎপাদনে পানির ব্যবহার কম আর মুনাফাও বেশি
বাংলা
<p>বাংলাদেশের উত্তরবঙ্গের জেলা রংপুরের কৃষক শাহিন হোসেন তামাক থেকে সূর্যমুখী চাষে ঝুঁকেছেন। (ছবিঃ স্মিতা কুন্ডু)</p>

বাংলাদেশের উত্তরবঙ্গের জেলা রংপুরের কৃষক শাহিন হোসেন তামাক থেকে সূর্যমুখী চাষে ঝুঁকেছেন। (ছবিঃ স্মিতা কুন্ডু)

পাঁচ বছর আগেও মন্টু বর্মণের আয়ের প্রধান উৎস ছিল ধান ও তামাক চাষ। পেশায় কৃষক মন্টুর বাড়ি বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলের জেলা রংপুরের তারাগঞ্জ গ্রামে। উপজেলা সদর থেকে ১০ কিলোমিটার দূরে  পড়েছে গ্রামটি। ধান, তামাক চাষ করে তেমন একটা লাভের মুখ দেখতে পাননি কখনও। তবে সেই দিন গত হয়েছে তাঁর। এখন এই কৃষকের ভাগ্যের চাকা ঘুরিয়ে দিয়েছে চায়ের চাষ।

“এর আগে আমি ধান এবং তামাক চাষ করে এতটা লাভ পাইনি,” দ্য থার্ড পোলকে বলেন মনটু বর্মন। তিনি বলেন, ” চা চাষের মধ্য দিয়ে আমার আয় অনেকখানি বেড়েছে।”

বর্মনের চা বাগান এখন ০.৬ হেক্টর জুড়ে বিস্তৃত। বাংলাদেশে বা অন্য কোথাও বাণিজ্যিক চা বাগানের মান অনুসারে এটি একটি খুব ছোট প্লট। কিন্তু ১৯৯০-এর দশকের শেষের দিক থেকে, বর্মনের মতো আরও কৃষক ছোট প্লটে চা চাষ শুরু করে এবং তাদের উৎপাদিত পণ্যগুলি বড় কোম্পানির কাছে বিক্রি করতে শুরু করে। রংপুর, লালমনিরহাট, নীলফামারী ও গাইবান্ধা জেলায় তামাক চাষের পরিবর্তে চা, ভুট্টা, সূর্যমুখী ও সরিষার চাষ হচ্ছে – সবই তিস্তা অববাহিকায়।

বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের মৃত্তিকা বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক তাহসিনা শারমিন হক দ্য থার্ড পোলকে বলেন, গুরুত্বপূর্ণভাবে, এই ফসলগুলিতে তামাকের চেয়ে কম জলের প্রয়োজন।

তিস্তা একটি আন্ত:রাষ্ট্রীয় নদী যা ভারত থেকে বাংলাদেশে প্রবাহিত হয়েছে। ভাটির দেশ হিসেবে বাংলাদেশ দীর্ঘদিন ধরেই তিস্তার পানি বণ্টন চুক্তি নিয়ে ভারতের সঙ্গে আলােচনা চালিয়ে গেলেও এনিয়ে দুদেশের মধ্যে ইতিবাচক সমঝোতার কোনো পথ তৈরি হয়নি।  নদীর উজানে ভারতে জলবিদ্যুতের জন্য নির্মিত বাঁধগুলোর কারনে আট মাস জুড়ে থাকা বছরের শুষ্ক মৌসুমে নদীতে পানির অত্যধিক স্বল্পতা থাকে। এ অবস্থায় দেশটির কৃষক এবং কৃষি বিশেষজ্ঞরা তামাক ছেড়ে স্বল্প সেচে ফলানো যায় এমন ফসল চাষের বিষয়টি বিবেচনায় রাখছিলেন।

আর তাই চা ছাড়াও বাংলাদেশ সরকার এই অঞ্চলে সূর্যমুখী, সরিষা ও ভুট্টা চাষে এখানকার কৃষকদের উৎসাহ প্রদান করে আসছে।

কৃষকের মুনাফা বাড়িয়ে দিয়েছে বিকল্প ফসলের চাষ

মন্টু বর্মনের সাথে কথা হয় তার বাগানে। তিনি জানান ২০২১ সালে চারা, শ্রমিক আর সারের জন্য তার খরচ হয়েছিল প্রায় ১২০,০০০ টাকা (১,৩৯৪.২১ মার্কিন ডলার)। তিনি বছরে চারবার বিক্রির জন্য চা পাতা বাছাই করেন৷ গত বছর বাগান থেকে সব খরচ বাদ দিয়ে তার লাভের পরিমান ছিল ৩০০,০০০ টাকা (৩,৪৮৫ মার্কিন ডলার)। এ অবস্থায় তিনি এখন তার চায়ের বাগানের জমির পরিমান আরো বৃদ্ধির কথা ভাবছেন। তিনি বলেন, “আমি তামাকের চাষে ফিরছি না। “

man harvesting tea plants
মন্টু বর্মণ রংপুর জেলার ডাঙ্গাপাড়া গ্রামে তার চা বাগান দেখাশোনা করছেন। (ছবিঃ স্মিতা কুন্ডু)

মন্টু বর্মনের বাড়ি তারাগঞ্জ উপজেলায়। উপ-জেলার কৃষি নস্প্রসারণ অধিদপ্তরের একজন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন যে প্রায় পাঁচ বছর আগে পর্যন্ত এলাকার কৃষকরা সম্পূর্ণরূপে তামাক চাষের উপরেই নির্ভরশীল ছিল। কিন্তু ধীরে ধীরে এই অবস্থার পরিবর্তন হতে শুরু করে। যেখানে ২০২০ সালে ৯৫০  হেক্টর জমিতে তামাক চাষ হয়েছিল সেখানে ২০২১  সালে তা কমে ৬৫০ হেক্টরে নেমে এসেছে।  ওই কর্মকর্তা আরো বলছেন, ২০২০-২১ সালে তারাগঞ্জে ১৪১ হেক্টর জমিতে সুর্য্যমুখী , সরিষা ৭৫ হেক্টরে এবং চা চাষ হয় ৪ হেক্টর জমিতে। ২০২১-২২ সালের এই শীত মৌসুমে সরিষার আবাদ হয়েছে ২৫০ হেক্টর জমিতে।

এই উপজেলার জগদীশপুর গ্রামের বাসিন্দা মাহাবুব আলম। তিনি বলেন, ‘তামাকের জমিত খাটুনি খুব। এ্যালা নয়া জাতের সরিষার ফলন ভালো। খরচও কম। তেমন খাটুনিও নাই, খেতের রোগবালাইও নাই। ওই জন্যে তামাকের বদলে এবার দেড় বিঘা জমিত সরিষা নাগাছি। তিনি হিসেব করে দেখেছেন যে তার তামাকের জমিতে সেচের জন্য যে পরিমান পানি ব্যয় হতো তার অর্ধেক পরিমান পানি প্রয়োজন হয় শর্ষের জমিতে। অথচ দুই ক্ষেত্রেই জমির পরিমান সমান।

একই জেলার মহিপুর গ্রামের বাসিন্দা শাহিন হোসেন তামাক ছেড়ে সূর্যমুখী চাষের দিকে ঝুঁকছেন। তিনি এবার ৫০,০০০ টাকা (৫৮০.৯২ মার্কিন ডলার) ব্যয় করেছেন সুর্যমুখীর চারা এবং সার কিনতে। এবার সুর্যমুখীর ফলন থেকে বেশ ভালো একটি লাভের মুখ দেখতে পাবেন বলে দ্য থার্ড পোলের কাছে আশাবাদ ব্যক্ত করেন।

তামাক চাষের ভবিষ্যৎ সুখকর নয়

বাংলাদেশে তিস্তা নদীর অববাহিকায় প্রথম তামাক চাষ শুরু হয় ১৯৭০-এর দশকে। সেসময় কৃষকরা তামাক কোম্পানির কাছে ফসল বিক্রি করে মোটা মুনাফা পেত। কিন্তু তামাক চাষে প্রচুর পরিমানে সেচের প্রয়োজন হয়।

ধীরে ধীরে এটি একটি ব্যয়বহুল চাষাবাদে পরিণত হতে শুরু করে কারন এই অঞ্চলে সেচের অন্যতম উৎস তিস্তা নদী। এর পানির স্তর মারাত্বকভাবে নিচে নামতে শুরু করে। একইসাথে ভূগর্ভস্থ পানির স্তরও নিচে নেমে যায়। মুনাফা ওয়ায় তামাক চাষের লাভ বাষ্পীভূত হয়ে যায়। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর সর্বশেষ প্রতিবেদন অনুযায়ী, রংপুর দেশের অন্যতম দরিদ্র অঞ্চল। দেশের এই অঞ্চলে কৃষি উন্নয়নের স্বার্থে তিস্তা সেচ প্রকল্প চালু করা হয়েছিল। কিন্তু এখন আর এই প্রকল্পটি খুব একটা কাজে আসছে না যার অন্যতম প্রধান কারণ তিস্তায় পানির স্বল্পতা। এছাড়া এই অঞ্চলটি অত্যন্ত নদী ভাঙ্গন প্রবন এলাকা, যা সম্প্রতি এশিয়া  উন্নয়ন ব্যাংকের করা বাংলাদেশের দুর্যোগ মানচিত্রেও স্পষ্টভাবে উঠে এসেছে।

উত্তরবঙ্গের কৃষকদের এমন ফসল চাষ করা উচিত যাতে স্বল্প পানির প্রয়োজন হয়। নদী ভাঙন রোধে মাটির আর্দ্রতা বজায় রাখার বিষয়টি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
চৌধুরী সারোয়ার জাহান,রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূতত্ত্ব ও খনিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক চৌধুরী সারোয়ার জাহান মনে করেন নদী ভাঙন রোধে মাটির আর্দ্রতা বজায় রাখার বিষয়টি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ । এ অঞ্চলের কৃষকদের তাই স্বল্প পানি সহিঞ্চু ফসল উৎপাদনের দিকে অগ্রসর হওয়া উচিত বলে দ্য থার্ড পোলের কাছে মন্তব্য করেন তিনি।

অধ্যাপক সারোয়ার জাহান বলেন, ‘বৃহত্তর রংপুরে সরকারের কৃষি বিভাগের সহায়তায় তামাক ছেড়ে কৃষকেরা যে অন্য ফসলে ঝুঁকছেন তা প্রকৃতি ও মানুষের জন্য ভালো খবর। এতে এ অঞ্চলের নাজুক ভূগর্ভস্থ পানির যে অবস্থা রয়েছে তার একটি ইতিবাচক পরিবর্তন আসতে পারে। আর এতে লাভবান হবে এখানকার অধিবাসীরা।’ 

১৬১,০০০

মানুষের বাংলাদেশে মৃত্যু হয় তামাক ব্যবহার করে

বাংলাদেশে পার্বত্য অঞ্চল ছাড়া রংপুর বিভাগ তামাক চাষের আওতাধীন এলাকা – যার মধ্যে রংপুর, গাইবান্ধা, লালমনিরহাট এবং নীলফামারী জেলা রয়েছে – সাম্প্রতিক বছরগুলিতে এসব জেলায় তামাক চাষ উল্লেখযোগ্যভাবে হ্রাস পেয়েছে। তামাকের বিকল্প চাষাবাদে ফল মিলছে। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের পরিচালক ডাঃ মেহেদী মাসুদ দ্য থার্ড পোলকে বলেন, ২০১৬-১৭ সালে বৃহত্তর রংপুরে (রংপুর, গাইবান্ধা, লালমনিরহাট ও নীলফামারী) ১৪ হাজার হেক্টর জমিতে তামাক চাষ হতো। উৎপাদন হত ৩০ হাজার মেট্রিক টন তামাক। ২০২০-২১ সালে তামাকের জমির পরিমাণ কেমে দাঁড়ায় ১১ হাজার হেক্টর। তামাকের উৎপাদনও কমে গেছে সাড়ে ১৪ হাজার মেট্রিক টনে। চার জেলার মধ্যে গাইবন্ধায় পাঁচ বছর আগে ১০০ হেক্টর জমিতে তামাকের চাষ হত। ২০২০-২১ সালে এ জেলায় আর তামাকের চাষই হয় না।

অত্যধিক পানির ব্যবহার ছাড়াও তামাক অন্য যে কোনো ফসলের তুলনায় মাটির পুস্টি উপাদান দ্রুত ভেঙে ফেলে। ২০১৭ সালে প্রকাশিত বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার এক গবেষণায় বলা হয় তামাকের পরিবেশগত প্রভাব অনেক বেশি। যেমন এটি ভুট্টার তুলনায় আড়াইগুণ বেশি নাইট্রোজেন, সাত গুণ বেশি ফসফরাস এবং ৮ গুণ বেশি পটাসিয়াম গ্রহণ করে।

আগামী তামাকমুক্ত বাংলাদেশের প্রত্যয়

২০১৬ সালের জানুয়ারি মাসে দক্ষিণ এশিয়ার স্পিকার সম্মেলনে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী ২০৪০ সালের মধ্যে দেশকে তামাকমুক্ত করার প্রত্যয় ব্যক্ত করেছেন। আর এ ঘোষণার পর  সরকার তামাক নিয়ন্ত্রণে শক্ত আইনও করেছে। কিন্তু তা স্বত্বেও, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ২০১৯ সালের তথ্য মতে, বর্তমানে বাংলাদেশের মোট জনসংখ্যার ৩৫ শতাংশ তামাক ব্যবহার করে এবং বছরে এর ফলে বাংলাদেশে ১৬১,০০০ মানুষের মৃত্যু হয় এবং রোগের চিকিৎসাজনিত খরচ বাবদ ৩০,০০০ কোট টাকা অর্থনৈতিক ক্ষতি হয়। ২০১৫ সালে প্রকাশিত অপর এক গবেষণায়  বলা হয়েছে তামাক চাষীদের প্রায় সকলেই ৩৩ শতাংশ কাশি এবং ২৯ শতাংশ হাঁপানি রোগে ভোগেন।

বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ এবং স্থানীয় থিঙ্ক ট্যাঙ্ক পাওয়ার অ্যান্ড পার্টিসিপেশন রিসার্চ সেন্টারের (পিপিআরসি) নির্বাহী চেয়ারম্যান হোসেন জিল্লুর রহমান দ্য থার্ড পোলকে বলেন, বাংলাদেশে আগে তামাক চাষ এত ব্যাপক ছিল কারণ সরকারের রাজস্ব বিভাগ এটিকে উৎসাহিত করত। পরিস্থিতির পরিবর্তন হওয়ায় তিনি খুশি। তিনি বলেন, “এখন সময় এসেছে নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে তামাকের বিকল্পের বিষয়ে দৃঢ় অবস্থান নেয়ার।”

Privacy Overview

This website uses cookies so that we can provide you with the best user experience possible. Cookie information is stored in your browser and performs functions such as recognising you when you return to our website and helping our team to understand which sections of the website you find most interesting and useful.

Strictly Necessary Cookies

Strictly Necessary Cookie should be enabled at all times so that we can save your preferences for cookie settings.

Analytics

This website uses Google Analytics to collect anonymous information such as the number of visitors to the site, and the most popular pages.

Keeping this cookie enabled helps us to improve our website.

Marketing

This website uses the following additional cookies:

(List the cookies that you are using on the website here.)