পানি

আসামে একের পর এক প্রাকৃতিক বিপর্যয় সত্ত্বেও অভিবাসনে আগ্রহ নেই অনেকের

জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে সৃষ্ট প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের শিকার বহু মানুষই নিজেদের বাড়িঘর আর সমাজ ছেড়ে অন্যত্র যেতে চায় না, আবার অনেকেই বেঁচে থাকার তাগিদে বেছে নেয় নতুন নতুন জীবিকার উপায় আর দুর্যোগ মেকাবেলায় নিত্য অভিযোজন কৌশল - অথচ নিত্য নতুন এসব কৌশল রাষ্ট্রের অভিযোজন নীতিতে থাকে উপেক্ষিত
<p>আসামের রূপকুচি গ্রামের বাসিন্দা ইনাওয়ারা খাতুন (মাঝে)  তার তার পরিবার বন্যার কারণে আর্থিক সংকট এবং মানসিক যন্ত্রণা সত্ত্বেও নিজ গ্রামে থাকতেই স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেন। তিনি বলেন, অভিবাসন মানে সামাজিক সম্পর্ক এবং আত্মীয়তার সম্পর্কগুলো থেকে দুরে চলে যাওয়া। অথচ এই সম্পর্কগুলোই তাকে দুর্যোগের পরে বেঁচে থাকতে সাহায্য করে। (ছবি: আত্রেয়ী ধর)</p>

আসামের রূপকুচি গ্রামের বাসিন্দা ইনাওয়ারা খাতুন (মাঝে) তার তার পরিবার বন্যার কারণে আর্থিক সংকট এবং মানসিক যন্ত্রণা সত্ত্বেও নিজ গ্রামে থাকতেই স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেন। তিনি বলেন, অভিবাসন মানে সামাজিক সম্পর্ক এবং আত্মীয়তার সম্পর্কগুলো থেকে দুরে চলে যাওয়া। অথচ এই সম্পর্কগুলোই তাকে দুর্যোগের পরে বেঁচে থাকতে সাহায্য করে। (ছবি: আত্রেয়ী ধর)

হাবিদুল ইসলাম যে গ্রামটিতে বড় হয়েছেন সেখান থেকে আর কখনোই অন্যত্র চলে যাওয়ার কথা ভাবতে পারেন না। পরিবার নিয়ে তিনি বসবাস করেন আসামের রূপকুচি গ্রামে, সেখানে  ব্রহ্মপুত্রের উপনদী চাউলখোয়া নদীর ধারে একটি অস্থায়ী টিনের বাড়িতে তিনি বেড়ে উঠেছেন।

এটি আসামের চরাঞ্চলের একেবারেই মাঝামাঝি, ব্রহ্মপুত্রের বুকে গড়ে ওঠা একধরনের ভাসমান দ্বীপ (চর) যা বেশ নিচু, বন্যা-প্রবণ এলাকা। উত্তর-পূর্ব ভারতের এই রাজ্যটি জলবায়ু-পরিবর্তনের প্রভাবে সৃষ্ট প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের কারনে মারাত্বকভাবে ঝুঁকিপূর্ণ, বিশেষ করে বন্যার মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগ যা প্রাণহানী এবং ব্যাপক অভিবাসনের কারন। কিন্তু মৌসুমী বন্যার প্রকোপ থেকে চিরতরে বাঁচার পরিবর্তে  ২০২০ সালে এখানে ফিরে আসেন হাবিদুল।

A man stands in front a structure covered with netting
২০২০ সালের জুলাই মাসে আসামের নিজ গ্রামে ফিরে আসার সময় নিজের স্থাপিত জলজ  ট্যাংকের সামনে হাবিদুল (ছবি: আত্রেয়ী ধর)

আসামে নিজ গ্রামে ফিরে আসার খুব একটা ইচ্ছে ছিল না হাবিদুলের, কিন্তু কোভিড-১৯ মহামারীর সময় ভারত যখন বিশ্বের সবচেয়ে বড় লকডাউন ঘোষনা করে তখন আসলে তার কাছে বাড়ি ফিরে আসা ছাড়া অন্য কোনো বিকল্প ছিল না। সে সময় তিনি ১৬৭ কিলোমিটার দূরে প্রতিবেশী রাজ্য মেঘালয়ে কার মেকানিক হিসেবে কাজ করছিলেন। তিনি মাসে ১৫,০০০ টাকা (২০০মার্কিন ডলার) উপার্জন করতেন, গ্রামে ফিরে তার স্ত্রীর জন্য একটি অংশ সঞ্চয় করতেন, যাকে তিনি ছুটিতে এবং ছুটির দিনে ফিরে আসার সময় দেখতে পেতেন।

২০২০ সালের জুলাই মাসে ভারত সরকার দেশব্যাপী লকডাউন ঘোষণা করার তিন মাস পরে, হাবিদুল মেঘালয়ের মেকানিকের দোকানে যে চাকুরীটি করছিল তা চলে যায়। বাড়ি ফিরে,কেবল বেঁচে থাকার জন্য কােনো আয়ের কথা ভাবছিলেন না, বরং এর বাইরেও কিছু একটা যে করা সম্ভব তা নিয়ে চিন্তা করছিলেন তিনি। তিনি ইউটিউব ভিডিওর মাধ্যমে জলজ চাষ নিয়ে গবেষণা করতে ঘণ্টার পর ঘণ্টা ব্যয় করেন এবং বায়োফ্লক চাষে আগ্রহী হন।


বায়োফ্লক পদ্ধতির চাষ কী?

বায়োফ্লোক পদ্ধতিতে চাষাবাদ মূলত ১৯৯০ দশকে প্রচলন হওয়া একটি বিশেষ ধরনের জলজ চাষ। এর সাথে সিম্বিওসিসে বিদ্যমান ক্ষুদ্র অনুজীব এবং জলজ প্রজাতি সম্পর্কিত। এ পদ্ধতিতে ব্যাকটেরিয়াগুলো মাছের সৃষ্ট বর্জ্য খায় এবং ফলস্বরূপ মাছও তা খেয়ে ফেলে।এক্ষেত্রে ভারসাম্য বজায় রাখার জন্য সবসময়ই ব্যবস্থাপনা প্রয়োজন।

তিনি একটি বায়ুচলাচল করতে পারে ভিতর দিয়ে এমন একটি  নয় মিটার দীর্ঘ কংক্রিট ট্যাঙ্ক স্থাপন করেন। তারপর তিনি জীবাণু এবং কার্প, তেলাপিয়া এবং ক্যাটফিশ যোগ করেন এবং মাছের ফলন পাবার জন্য অপেক্ষা করতে থাকেন।

তিন থেকে চার মাসের মধ্যে হাবিদুল প্রায় ৫০০ থেকে ৬০০ কিলােগ্রাম মাছ বিক্রি করেন ১০০,০০০ টাকার (১৩০০ মার্কিন ডলার)। তিনি বলেন, মাছের পোনা আর মাছের খাবারের খরচ বাদ দিয়ে লাভ হয় ভারতীয় মুদ্রায় ৬০,০০০ টাকা।  এমনকি বর্ষায় বন্যার সময়ও তার মাছের খামারটি অক্ষত থাকে। লাভের অংশটি বাদ দিলে হাবিদুলের মূল খরচ ছিল  ৩০,০০০ – ৪০,০০০ টাকা। তবে কিছু খরচ কেবল এককালীন হওয়ায় ভবিষ্যতে তার লাভের পরিমান আরো বাড়বে বলে বিশ্বাস করেন হাবিদুল।

কয়েক মাস পরে যখন লকডাউন শিথিল হয়, তখন তিনি একজন মেকানিক হিসাবে কাজ খুঁজে পান। দিনে তার আয় ছিল ২০০০ থেকে ৫০০০ টাকা (২৬ – ৬৫ মার্কিন ডলার)।

আবার দেশান্তর হওয়ার ইচ্ছে নেই

বন্যার কারনে আবারো অভিবাসন বা অন্যত্র চলে যাওয়ার ইচ্ছে আছে কি না চানতে চাইলে হাবিদুল এক্ষেত্রে নিজের কঠোর অবস্থানের কথা জানান। তিনি বলেন, আমি কােনা শহরে পাকাপাকিভাবে থাকার কথা চিন্তা করার সময় ভাবি সেখানে তাে আমার খুব বেশি উপার্জন নেই। বরং বাড়িতে, আমার মাছের ব্যবসা শুরু হওয়ার পর আজ আয়ের সম্ভাবনা বেশি দেখতে পাচ্ছি।

বন্যার কথা উঠতেই তিনি জোর দিয়ে বলেন যে ৩০ বছরেরও বেশি সময় ধরে বন্যা মোকাবেলা করতে করতে এ নিয় সে বন্যায় অভ্যস্ত হয়ে উঠেছে।

চাউলখোয়া নদীর তীব্র স্রোতের কারণে তার গ্রামে নদী ভাঙনের প্রবনতা অনেক বেশি। সেখানে নদী ভাঙনের মুখে নিজেদের আশ্রয় বাঁচাতে একটু উচু ভূমিতে তিনি টিন-পাতার নিজের বাড়ি বানিয়েছেন।  গ্রীষ্মকালে যদি অপ্রত্যাশিতভাবে পানির স্তর বেড়ে যায়, তখন তিনি অতিরিক্ত টিন, তারপুলিন এবং মৌলিক জিনিসপত্র নিয়ে পাশের উঁচু রাস্তায় নিয়ে যান, যেখানে বন্যার পানি সাধারনত পৌছায় না।

তিনি বলেন, আমি আমার গ্রাম, এখানকার পরিবেশকে খুব ভালোবাসি, এই গ্রাম ফেলে বাইরে থাকা অনেক কঠিন।

Two boats moored on a riverbank
ব্রহ্মপুত্রের অন্যতম শাখানদী চাউলখোয়া নদীটি রূপকুচি গ্রামের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হয় এবং প্রায়শই বন্যার সময় আশেপাশের এলাকা প্লাবিত করে (ছবি: আত্রেয়ী ধর)

হাবিদুলের গ্রামের অনেকেই এখন উপার্জনের উদ্দেশ্যে অন্যত্র অভিবাসনে আগ্রহী নন মোটেই। সেখানকার একাধিক পরিবার ২০২২ সালের ফেব্রুয়ারিতে কথা বলেছেন দ্য থার্ড পোল-এর সাথে। তারা বলেন, কােনা নতুন শহরে স্থানান্তরিত হওয়ার চেয়ে নদীর পলি দ্বারা পরিপুষ্ট জমিতে ফসল ফলিয়ে তারা নিজেদের খাদ্য উৎপাদনে এখন অনেক বেশি আগ্রহী।  আর যাদের নিজেদের জমি নেই তারা শহরে গিয়ে অন্যদের জন্য কাজ করা এড়াতে এবং সম্ভাব্য কম বেতনের আশংকা ভুলে গিয়ে শাকসবজি বিক্রি বা মৎস্য ও হাঁস-মুরগির খামার স্থাপনের মতো অন্যান্য উদ্যোগের প্রতিই আগ্রহী।

২০১১ সালের আদমশুমারি অনুসারে, রূপকুচিতে ৩৫৮টি পরিবার বাস করত। সেখানকার যেসব বাসিন্দা দ্য থার্ড পোলের সাথে কথা বলেছেন তারা জীবিকার তাগিদে অন্যত্র স্থানান্তরের কথা ভাবেন না যে সেটি ঠিক নয়, তারা বিষয়টি অস্বীকারও করেননি যে এর প্রয়োজন আছে, তবে তারা বলেছেন যে তাদের বেশিরভাগই এখন নিজ গ্রাম ছেড়ে যেতে চান না।.

রকিবুল ইসলাম নামে গ্রামের আরেক বাসিন্দা (যিনি হাবিদুলের কোনো আত্মীয় নন) বলেন, “কেউ কেউ হয়ত ভয় পায় যে নদীটি তাদের জীবন থেকে দূরে সরে যাচ্ছে এবং হয়ত উন্নত জীবনের জন্য নিজেদের জমি বিক্রি করে শহরে চলে যেতে হতে পারে। কিন্তু এই গ্রামের ১০টি পরিবারের মধ্যে, এমন চিন্তাভাবনা পোষণ করার মতাে পরিবারের সংখ্যা একেবারেই কম, হয়ত একটি।”

ভারতে, জলবায়ু পরিবর্তনের কারনে সৃষ্ট নানা ধরেনর  প্রতিবন্ধকতা এবং বিপর্যয়ের মুখে অভিবাসন বা স্থানান্তরিত হয়ে নিজ বাসস্থান ছেড়ে অন্যত্র চলে যেতে আগ্রহী নয় এমন মানুষের সংখ্যা কত হতে পারে সে ব্যাপারে সঠিক কোনো তথ্য নেই। তবে এই মুহুর্তে যে তথ্য সামনে আসছে তাতে ধারনা করা যায় যে বিদ্যমান কষ্টের মুখেও অন্যত্র স্থানান্তরিত হওয়ার চেয়ে নিজ গ্রামেই বসবাসে আগ্রহী মানুষের সংখ্যঅ নেহায়েত কম নয়। উপকূলীয় বাংলাদেশে বসবাসকারী পরিবারগুলোর উপর ২০২১ সালে পরিচালিত একটি সমীক্ষায় দেখা গেছে যে ৮৮ শতাংশ জলবায়ু ঝুঁকি-প্রবণ এলাকায় বসবাস করেও তারা অভিবাসন বা অন্যত্র না যাবার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। বিশ্বব্যাপী ২০০৮ থেকে ২০১৬ সালের মধ্যে, প্রাকৃতিক দুর্যোগের জন্য হুমকির মুখে থাকা প্রায় ৮৫ শতাংশ মানুষ অভিবাসন করেনি, আন্তর্জাতিক অভিবাসন সংস্থা এবং দুর্যোগের মহামারী সংক্রান্ত গবেষণা কেন্দ্রের তথ্য অনুসারে একথা জানা গেছে। (এর মধ্যে যাদের অভিভাসন করার উপায় নেই এবং সেইসাথে যারা না যাওয়া বেছে নিয়েছে তারা অন্তর্ভুক্ত) ।

জার্মানির টিইউ ড্রেসডেন বিশ্ববিদ্যালয়ের চেয়ার অব এনভায়রনমেন্টাল ডেভেলপমেন্ট অ্যান্ড রিস্ক ম্যানেজমেন্টের গবেষক বিশ্বজিৎ মল্লিক বলেছেন, দুর্যোগপ্রবণ এলাকার মানুষের জন্য অভিবাসন কােনো ধরনের বাধ্যতামূলক সিদ্ধান্ত নয়।

আমি আমার গ্রাম, এখানকার পরিবেশকে খুব ভালোবাসি, এই গ্রাম ফেলে বাইরে থাকা অনেক কঠিন
হাবিদুল ইসলাম

মল্লিক বলেন, “যদি জলবায়ু-সম্পর্কিত বিপর্যয়ের মুখে, তারা তাদের জীবিকার কৌশলগুলিকে বৈচিত্র্যময় করতে পারে এবং তাদের মঙ্গল নিশ্চিত করতে সক্ষম হয়, তাহলে তারা অবশ্যই  দীর্ঘ সময়ের জন্য স্বেচ্ছায় অভিবাসন এড়িয়ে চলতে পারবে। তিনি ব্যক্তিগত আকাঙ্খার উপর ভিত্তি করে যারা দুর্যোগের পরিপ্রেক্ষিতে স্থানান্তর করেন তাদের দুটি দলে বিভক্ত করেন: একিট স্বেচ্ছায় এবং অপরটি  অনিচ্ছায় অভিবাসন। যদি তাদের কাছে স্থানান্তর করার জন্য সম্পদ থাকে কিন্তু ইচ্ছা না থাকে তবে তারা প্রথম বিভাগে পড়ে। যদি তারা অভিবাসনে আগ্রহী কিন্তু তা করার উপায় (সম্পদ এবং সামাজিক নেটওয়ার্ক) না থাকে, তাহলে তারা “ফাঁদে” বা “অনিচ্ছাকৃত” অ-অভিবাসী।

মল্লিক মনে করেন স্বেচ্ছায় অ-অভিবাসীদের তুলনায় বিশ্বব্যাপী অনিচ্ছাকৃত অ-অভিবাসীদের সংখ্যা খুবই কম। তার মতে করোনা মহামারীটি অভিবাসনের ক্ষেত্রে একটি পরিবর্তনকে উৎসাহিত করেছে, তা হচ্ছে মানুষকে বাড়িতে থেকে তাদের আয়ের ধারাকে বৈচিত্র্যময় করে তোলা।

জলবায়ু বিপর্যয়ের মুখেও মানুষ কেন স্থানান্তরিত হতে চায় না ?

হাবিদুলের প্রতিবেশী, সইদুল ইসলাম (আত্মীয়তার কোনও সম্পর্ক নেই) ২০২০ সালের ডিসেম্বরে দিল্লিতে একটি তথ্য প্রযুক্তি কোর্স সম্পন্ন করেন।  সেসময় তাকে মাসিক ১০,০০০ – ১৫,০০০ টাকা বেতনে একটি সফ্টওয়্যার প্রশিক্ষণার্থী হিসাবে চাকরির প্রস্তাব দেওয়া হয়। প্রত্যাশিত পেশার পথ বেছে নেওয়ার পরিবর্তে, লকডাউনের সময় দুবার চাকরি পরিবর্তন করতে হয়। তিনি আসামে ফিরে এসে একটি পাইকারি পোল্ট্রি ব্যবসা শুরু করেন। তিনি ভুটান এবং পার্শ্ববর্তী ভারতের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের উৎপাদকদের কাছ থেকে মুরগি কিনেন এবং স্থানীয় ক্রেতাদের কাছে বিক্রি করেন।

২০২২ সালের ফেব্রুয়ারিতে সইদুলের সাথে কথা হয় দ্য থার্ড পোলের – তার ব্যবসা শুরু করার মাত্র কয়েক সপ্তাহ পরে। তিনি বলেন যে ইতিমধ্যেই তিনি প্রতিদিন ১,০০০ – ১,৫০০ (মার্কিন ১৩ – ২০) উপার্জন করছেন৷ তিনি তার গ্রামের বাইরের ক্রেতাদের সাথে আলোচনা শুরু করেছেন এবং তার আয় অনেক বৃদ্ধির বিষয়ে এখন তিনি অনেক আত্মবিশ্বাসী। তিনি গ্রামবাসীদের বলেন যারা অনেক দূরে শহরে চাকরি নিয়েছে তারা যেন সেখানে স্থায়ীভাবে বসবাস না করে। তিনি বলেন যে বন্যা তার জন্য উদ্বেগ নয়, বা ভবিষ্যতে অভিবাসনের জন্য একটি সম্ভাব্য বড় কারন হিসেবে দাঁড়াবে না। কারণ তিনি নদীর ধারে বড় হয়েছেন এবং তার প্রবৃত্তির উপর আস্থা রেখেছেন।

A man sits in front of a corrugated structure
ছবিতে সোইদুল ইসলাম যিনি আসামের রূপকুচিতে একটি পোল্ট্রি ব্যবসা স্থাপনের প্রাথমিক পর্যায়ে রয়েছে (ছবি: আত্রেয়ী ধর)

সোইদুল বলেন, “যেহেতু আমাদের বাড়ির মুখোমুখি রাস্তাটি মাটি ফেলে উচু করা হয়েছে যাতে এটি একটি বাঁধ হিসাবে কাজ করতে পারে, তাই বন্যার সময় আমাদের বাড়িতে পানি প্রবেশের সুযোগ কম।  তিনি নদীর পলি দ্বারা সমৃদ্ধ একটি খামারের মালিক।তিনি যে খাদ্য গ্রহন করেন তার ৭৫ শতাংশই আসে তার এই খামার থেকে। অথচ অভিবাসনের ফলে তিনি অন্যত্র গিয়ে বসবাস করলে খাদ্যের জন্য তাকে এই মূল্য পরিশোধ করতে হতো।

জাপানের কেইও ইউনিভার্সিটির গ্র্যাজুয়েট স্কুল অব মিডিয়া অ্যান্ড গভর্ন্যান্সের অধ্যাপক এবং জলবায়ু অভিযোজন এবং দুর্যোগ ঝুঁকি ব্যবস্থাপনার বিশেষজ্ঞ রাজীব শ-এর মতে স্বেচ্ছায় অ-অভিবাসনের মূল কারণগুলোর মধ্যে একটি হচ্ছে স্থানীয় সম্পদের উপর নির্ভরশীলতা। স্থানান্তর না করার সচেতন পছন্দটি সঠিক স্থানান্তর করার জায়গার অভাব, নিজের এলাকার সাথে পূর্বপুরুষের সংযুক্তি, ইতিবাচক জীবিকার বিকল্প এবং সমাজের সংহতির কারণেও হতে পারে।

রাজীব শ বলেন, “অভিবাসন করার বিষয়টির সাথে ঝুঁকি বিষয়টি অত্যন্ত সম্পর্কযুক্ত।  যদি কোনো ব্যক্তি তার বসবাসের এলাকার সম্ভাব্য ঝুঁকির সম্পর্কে ভালভাবে অবগত থাকে, এবং তার জরুরী ভিত্তিতে স্থানান্তরিত হবার স্পষ্ট পরিবল্পনা এবং সক্ষমতা থাকে তাহলে এটি ঠিক হওয়া উচিত।

সামাজিক অবকাঠামোর অর্থ হচ্ছে নারীদের থাকার সম্ভাবনা সবচেয়ে বেশি 

হাবিদুলের স্ত্রী, ইনাওয়ারা খাতুন, একজন কারিগর যিনি একইসাথে  শাড়ি, চুরি, পোশাক এবং ব্যাগ ডিজাইন করেন। প্রতি মাসে তিনি তিন থেকে চার হাজার টাকা (৪০ -৬৫ মার্কন ডলার) উপার্জন করেন, যা তিনি তার মেয়ের শিক্ষার পিছনে ব্যয় করেন।

সামাজিক সম্পর্ক এবং নেটওয়ার্ক ইনাওয়ারাকে বন্যা এবং মহামারীর মতো ঘটনা দ্বারা সৃষ্ট আর্থিক কষ্ট এবং মানসিক যন্ত্রণার সাথে লড়াই করতে সক্ষম করে তুলেছে। অভিবাসন নেই হারানো। তিনি বলেন, “গ্রামে, আমরা বন্যার সময়ও সহযোগিতা করি যাতে কেউ ক্ষুধার্ত না থাকে। উদাহরণস্বরূপ, একটি কৃষক পরিবার তাদের উৎপাদিত পণ্যের একটি অংশ আমাদের জন্য বরাদ্দ করে। যদি একটি পরিবারের অর্থের প্রয়োজন হয়, আমাদের প্রতিবেশীরা দ্বিতীয়বার চিন্তা ছাড়াই আমাদের ঋণ দেয়। যখন কেউ অসুস্থ হয় তখন এটি অনেক বেশি ঘটে। ” এই ধরেনর সম্পর্ক শহরে কখনই মিলবে না বলে কিনি মনে করেন।

নিরাপত্তাহীনতার অনুভূতি, পারিবারিক সংযুক্তি, প্রাথমিক শিক্ষার অভাব এবং শহুরে এলাকায় প্রয়োজনীয় দক্ষতার অভাবের মতো কারণগুলির সংমিশ্রণ নারীদের অভিবাসন না করার সিদ্ধান্তে অবদান রাখে
রাজীব শ, কেইও ইউনিভার্সিটি

সোইদুল ইসলামের মতোই তিনি বলেন যে শহরে পরিবারের খাবারের খরচ  মেটাতে গিয়েই সঞ্চয়ের জন্য কিছু থাকেনা।

উপকূলীয় বাংলাদেশের উপর ২০২১ সালে পরিচালিত একটি  গবেষণায় জেন্ডার এবং অভ্যন্তরীণ কাঠামোকে নিজ বাসস্থানেই থেকে যাবার সিদ্ধান্তের মূল কারণ হিসাবে উল্লেখ করেছে। এই গবেষণার প্রধান লেখক রাজীব শ দ্য থার্ড পোলকে বলেন যে নিরাপত্তাহীনতার অনুভূতি, পারিবারিক সংযুক্তি, প্রাথমিক শিক্ষার অভাব এবং শহুরে এলাকায় প্রয়োজনীয় দক্ষতার অভাবের মতো কারণগুলির সংমিশ্রণ নারীদের অভিবাসন না করার সিদ্ধান্তে অবদান রাখে। অন্যদিকে দুর্যোগ প্রবন এলাকায় ক্ষুদ্র ঋণ, মাইক্রো-ফাইনান্স এবং ইন্টারনেট সুবিধাসহ আরও ভাল সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনীর সুযোগ তাদের ক্ষমতায়নের চাবিকাঠি, তিনি যোগ করেন।

জলবায়ু অভিযোজনে স্বেচ্ছায় অ-অভিবাসীদের অন্তর্ভুক্ত করা উচিত

দিল্লি-ভিত্তিক থিঙ্ক ট্যাঙ্ক দ্য কাউন্সিল অন এনার্জি, এনভায়রনমেন্ট অ্যান্ড ওয়াটার (CEEW) এর ২০২১ সালের  সমীক্ষা আসামকে ভারতের পাঁচটি রাজ্যের মধ্যে একটি হিসাবে স্থান দিয়েছে যেটি বন্যা এবং খরার মতো চরম জলবায়ু ঘটনাগুলির জন্য অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ। প্রতিবেদনে বলা হয়ে যে আসাম, অরুণাচল প্রদেশ এবং মণিপুরে অন্যান্য উত্তর-পূর্ব রাজ্যগুলির তুলনায় কম অভিযোজনের ক্ষমতা রয়েছে। তা সত্ত্বেও, জলবায়ু পরিবর্তন-জনিত সমস্যার শিকার অনেক মানুষ এখান থেকে সরতে চায় না – এমন একটি সত্য যা মূলত অভিবাসন তত্ত্ব বা বিশ্বজুড়ে বিপর্যয়ের উপর দৃষ্টি নিবদ্ধ করা গবেষণায় হয়ত এড়িয়ে যায়।

ইন্টারন্যাশনাল ডিসপ্লেসমেন্ট মনিটরিং সেন্টারের তথ্য মতে ৩১ ডিসেম্বর ২০২০ পর্যন্ত বিশ্বব্যাপী ৫৫ মিলিয়ন বাস্তুচ্যুত মানুষের মধ্যে ৭ মিলিয়ন মানুষ জলবায়ু বিপর্যয়ের ফলে স্থানান্তর করতে বাধ্য হয়েছিল। এ বিষয়ে মল্লিক বলেন, আইডিএমসির এই গবেবষণায় আসলে ঠিক কী পরিমান মানুষ আবার নিজ বাস্থানে পরবর্তীতে ফিরে এসেছে সেটি তুলে ধরতে ব্যর্থ হয়েছে। এটি অভিবাসনের প্রকৃত প্রভাবকে অস্পষ্ট করে, এবং দুর্যোগের কারণে যারা স্থানান্তরিত হয়েছে তাদের ফিরে যেতে বা আরও প্রশমন ব্যবস্থায় সক্ষম হয়ে উঠতে সাহায্য করার জন্য নেওয়া পদক্ষেপগুলিকে উপেক্ষা করে।

তিনি স্বেচ্ছাসেবী অ-অভিবাসীদেরকে অভিবাসীদের মতোই সমান অগ্রাধিকারের সাথে বিবেচনার আহ্বান জানান এবং ভবিষ্যতের অভিযোজন উদ্যোগে অন্তর্ভুক্ত করার আহ্বান জানান। তিনি বলেন, সুশীল সমাজ এবং সরকারের উচিত উন্নত জীবনযাত্রার মান প্রদান এবং দুর্যোগের পরে মানুষের আয়ের কৌশলে বৈচিত্র্যকরণের দিকে মনোনিবেশ করা।

Privacy Overview

This website uses cookies so that we can provide you with the best user experience possible. Cookie information is stored in your browser and performs functions such as recognising you when you return to our website and helping our team to understand which sections of the website you find most interesting and useful.

Strictly Necessary Cookies

Strictly Necessary Cookie should be enabled at all times so that we can save your preferences for cookie settings.

Analytics

This website uses Google Analytics to collect anonymous information such as the number of visitors to the site, and the most popular pages.

Keeping this cookie enabled helps us to improve our website.

Marketing

This website uses the following additional cookies:

(List the cookies that you are using on the website here.)