জলবায়ু

কপ ২৭: প্রাপ্তির ঝুড়িতে কেবল ‘লস অ্যান্ড ড্যামেজ’ তহবিল

'লস অ্যান্ড ড্যামেজ' মোকাবেলায় জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে ঝুঁকিতে থাকা বিশ্বের দরিদ্র দেশগুলোকে সহায়তায় আর্থিক তহবিল চালুর বিষয়টি এবারের সম্মেলনের একমাত্র প্রাপ্তি
<p>লস অ্যান্ড ড্যামেজ তহবিল চালুর দাবিতে নিয়ে দীর্ঘদিন যাবত ক্যাম্পেইন করছেন হারজিত সিং (বাম) এবং সালিমুল হক (ডান), এটি  বলতে গেলে এবারের কপ ২৭ সম্মেলনের অন্যতম সাফল্য  (ছবি: জয়দীপ গুপ্ত)</p>

লস অ্যান্ড ড্যামেজ তহবিল চালুর দাবিতে নিয়ে দীর্ঘদিন যাবত ক্যাম্পেইন করছেন হারজিত সিং (বাম) এবং সালিমুল হক (ডান), এটি  বলতে গেলে এবারের কপ ২৭ সম্মেলনের অন্যতম সাফল্য  (ছবি: জয়দীপ গুপ্ত)

জলবায়ু পরিবর্তনের মূল প্রসঙ্গ থেকে একেবারেই বিচ্ছিন্ন এবং কতগুলো কৃত্রিম ইস্যুকে বরাবরের মতো সামনে রেখে প্রতিবছরের মতো এবারো অনুষ্ঠিত হলো জাতিসংঘ আয়োজিত বিশ্ব জলবায়ু সম্মেলন। মিশরের শারম আল-শেখে অনুষ্ঠিত এই আসরের  বর্ধিত অংশের আলোচনাটি নির্দিষ্ট সময়ের চেয়ে প্রায় ৪০ ঘন্টা পরে শেষ হয়। এবারের কপ২৭-এর একমাত্র সাফল্য বলতে গেলে দরিদ্র দেশগুলোর জন্য একটি আর্থিক তহবিল গঠন, যার মাধ্যমে জলবায়ু পরিবর্তন জনিত লস অ্যান্ড ড্যামেজ মোকাবেলায় এসব দেশকে আর্থিক সহায়তা প্রদান করা হবে বলে সিদ্ধান্ত নেয়া হয়।

এটি বলা মোটেই বাহুল্য হবে না যে তিন দশক ধরে আলোচনা চালিয়ে যাবার পরেও একদিকে  যেমন গ্রিন হাউস গ্যাস নির্গমন কমানো যায়নি যা বায়ুমণ্ডলে উষ্ণতা বৃদ্ধির অন্যতম কারন। অবার দীর্ঘ এই পথপরিক্রমায় কার্যকর এমন কোনো অগ্রগতিই হয়নি যাতে দাবী করা যেতে পারে যে, জলবায়ু পরিবর্তনজনিত ক্ষয়ক্ষতি কাটিয়ে উঠতে অভিযোজন ব্যবস্থা গ্রহনে জনগন যথেষ্ট সক্ষমতা অর্জন করতে পেরেছে। আর তাই সবশেষ একটি ফলাফল হিসেবে এবারের সম্মেলনে জলবায়ু নিয়ে কাজ করা বিশ্বের বিভিন্ন দেশের প্রতিনিধীরা ‘লস অ্যান্ড ড্যামেজ’ মোকাবেলায় একটি তহবিল চালুর সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য হয়। যদিও এই তহবিলের যাবতীয় কার্যপরিধি ভবিষ্যতে নির্ধারণ করা হবে বলে জানানো হয়।

এই আসরের সমাপনী অধিবেশনে, জলবায়ু পরিবর্তন সংক্রান্ত জাতিসংঘের ফ্রেমওয়ার্ক কনভেনশনের নির্বাহী সেক্রেটারি সাইমন স্টিয়েল এবিষয়ে মন্তব্য করতে গিয়ে অকপটে স্বীকার করেন যে এই আলোচনা “মোটেও সহজ ছিল না”। তবে তিনি মনে করেন এই তহবিল প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে  “জলবায়ু পরিবর্তনের ক্ষতির মুখে থাকা প্রান্তিক জনগোষ্ঠী  অবশ্যই উপকৃত হবে।”.

‘কোডরেড’ সতর্কতার বছরেই ব্যর্থ কপ ২৭

দ্য ইন্টারগভর্নমেন্টাল প্যানেল অন ক্লাইমেট চেঞ্জ (আইপিসিসি) এর সতর্কবার্তা দিয়ে বছরটি শুরু হয়। এতে বলা হয়েছিল  বৈশ্বিক উষ্ণতার  মাত্রা আগামী ২০৩০ সালের মধ্যে অবশ্যই অর্ধেকে নিয়ে আসতে হবে । আর ২০৫০ সাল নাগাদ এই উঞ্চতার মাত্রা শূন্যের কোঠায় নামিয় আনতে হবে। এই প্রতিবেদনের নাম দেওয়া হয়েছে ‘কোড রেড’।

আইপিসিসির ‘কোড রেড‘ সতর্কতাটি অক্টোবর ২০২২-এ একাধিক প্রতিবেদনের মাধ্যমে অনেক বেশি জোরালো করে তোলা হয়। ওয়ার্ল্ড মেটিওরোলজিক্যাল অর্গানাইজেশন (ডব্লিউএমও) তাদের এক প্রতিবদনে বায়ুমণ্ডলে তিনটি প্রধান জিএইচজি – কার্বন ডাই অক্সাইড, মিথেন এবং নাইট্রাস অক্সাইডের রেকর্ড মাত্রায় বৃদ্ধি পাওয়ার বিষয়টি তুলে ধরে।

ইউএন ফ্রেমওয়ার্ক কনভেনশন অন ক্লাইমেট চেঞ্জ (ইউএনএফসিসিসি) প্রতিবেদন অনুযায়ি জিএইচজি নিঃসরণ নিয়ন্ত্রণে দেশগুলির বর্তমান প্রতিশ্রুতি (যাকে বলা হয় ন্যাশনালি ডিটারমাইন্ড কন্ট্রিবিউশনস বা এনডিসি) সম্পূর্ণরূপে অর্জিত হলেও, প্যারিস চুক্তি অনুযায়ি বিশ্বব্যাপী গড় তাপমাত্রা বৃদ্ধি দুই ডিগ্রি সেলসিয়াসের মধ্যে রাখতে ব্যর্থ হবে। প্যারিস চুক্তি অনুযায়ি বিশ্বের সব দেশ বৈশ্বিক তাপমাত্রা প্রাক-শিল্প যুগের চেয়ে সর্বোচ্চ ১.৫ ডিগ্রি সে. এর মধ্যে বজায় রাখার উচ্চ লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছিল। এর পরিবর্তে, আইপিসিসি ২১০০ সালের মধ্যে তাপমাত্রা ২.৪ থেকে ২.৬  ডিগ্রি সে. পর্যন্ত বৃদ্ধির একটি অনুমান প্রদন করে। ইউএনএফসিসি এক গবেষণায় দেখিয়েছে যে ২০৩০ সালের মধ্যে এনডিসি পূরণ করতে হলে উন্নয়নশীল দেশগুলোর ৫.৬ ট্রিলিয়ন মার্কিন ডলার প্রয়োজন হবে।

সম্মেলনে আসা সরকারী কর্তারা যেন শুনেও শুনছেন না

এবার বিশ্বের সব দেশ থেকেই বলতে গেলে সকল বিশেষজ্ঞ কপ২৭ সম্মেলনে যোগ দিয়েছেন। তারা তাদের সতর্কবার্তা পুনর্ব্যক্ত করেন এবংপাশাপাশি সমাধানের সুপারিশও তুলে ধরেন। কিন্তু অবস্থাদৃষ্টে মনে হয় অংশগ্রহনকারী দেশগুলোর সরকারের প্রতিনিধীরা এসব সমাধানের কথা শুনেছেন কিনা তা একেবারেই মনে হয়নি।  সম্মলনের অনুষ্ঠানের বিভিন্ন অংশে নানা দেশ থেকে আগত জলবায়ু বিপর্যয়ের শিকার ব্যক্তিরা তাদের ভয়াবহ অভিজ্ঞতার কথা বর্ণনা করেছেন, যা দর্শকদের অশ্রুসিক্ত করে তুলে। আর অন্যদিকে সম্মেলনস্থলের বিভিন্ন স্থানে পরিবেশকর্মীরা বিভিন্ন দাবী নিয়ে স্লোগান দিলেও সরকারের কোনো প্রতিনিধি কার্যত তাতে কর্ণপাত করেছেন বলে মনে হয়নি।

এছাড়াও তেল এবং গ্যাস কোম্পানিগুলোর পক্ষের প্রায় ৬০০ জনেরও বেশি লবিস্ট ছিল এই সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন। এবারের এই ধরনের অংশগ্রহনকারীর সংখ্যা ২০২১ সালের সম্মেলন থেকে কমপক্ষে ২৫ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে। এই ধরনের লবিষ্ট অংশগ্রহন এবং তৎপরতা জীবাশ্ম জ্বালানি পর্যায়ক্রমে হ্রাস করার ক্ষেত্রে জাতিসংঘের শীর্ষ সম্মেলনে দেয়া ভারতের প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়ন বাঁধাগ্রস্ত করতে পারে।

ক্লাইমেট অ্যাকশন নেটওয়ার্কের সাউথ এশিয়া বিষয়ক ডিরেক্টর সঞ্জয় বশিষ্ঠ বলেন, “এটি সত্যিই দুর্ভাগ্যজনক যে কপ২৭ জলবায়ু সংকটের সবচেয়ে খারাপ প্রভাবগুলি এড়ানোর জন্য জলবায়ু কর্মকে ত্বরান্বিত করতে পারে এমন তিনটি মূল সৃপারিশ রয়েছে তার একটিও বাস্তবায়ন বা এ বিষয়ক সিদ্ধান্ত প্রদানে ব্যর্থ হয়েছে। এবছর গ্রিনহাউস গ্যাস নির্গমন কমাতে কপ২৭-এ নতুন কোনোই প্রস্তাব করা হয়নি। অথচ সম্মেলনটি এমন একটি সময় অনুষ্ঠিত হলো যখন পাকিস্তানের ভয়াবহ বন্যার ঘটনা  বিশ্বকে দ্রুত এবং কঠোর সিদ্ধান্ত নেয়ার প্রয়োজনীয়তা বিষয়টিই ইঙ্গিত করে।” শ্রীলঙ্কার মতো দ্বীপ রাষ্ট্রগুলো যখন অর্থনৈতিক এবং জলবায়ু সংকটের সাথে ঝাঁপিয়ে পড়েছে, ঠিক এমন সময়েও জাতিসংশ নতুন বা অতিরিক্ত আর্থিক সহায়তার বিষয়টি তো দুরের কথা, বার্ষিক বিলিয়ন মার্কিন ডলার দেওয়ার যে প্রতিশ্রুতিও দিয়েছিল তা বাস্তবায়নেও সক্ষম হয়নি। একই সময়ে, বাংলাদেশ, মালদ্বীপ এবং নেপাল অনেক জলবায়ু বিপর্যয়ের মুখোমুখি হচ্ছে, এমন একটি সময়ে, জীবাশ্ম জ্বালানী পর্যায়ক্রমে বন্ধ করার ক্ষেত্রে বিশ্বের ধনী দেশগুলো বিশেষ করে আমেরিকার প্রতি কয়লা, তেল এবং গ্যাসের ব্যবহার থেকে বেরিয়ে টেকসই জ্বালানী ।ব্যবহারে ভারতের যে আহ্বান তা মানতে অনাগ্রহ প্রকাশ করে।

১৯৭টি সরকারের প্রতিনিধীরা বন্ধ দরজার পিছনে তাদের আলোচনা চালিয়ে যায়, আর অন্যদিকে ধনী দেশগুলো দরিদ্র দেশগুলোকে তাদের নির্গমন হ্রাসে উচ্চাকাঙ্ক্ষা বৃদ্ধির তাগিদ দেয়। ঠিক সেই সময় দরিদ্র দেশগুলো তাদের সহায়তা ছাড়া এই কার্যক্রম কি করে এগিয়ে নিয়ে যাবে তা নিয়ে ধনী দেশগুলোর কাছে জানতে চাইলে তারা নতুন কোনো অর্থ সহায়তার কথা তো দুরে থাক, নিজেদের এরই মধ্যে করা প্রতিশ্রুতির অর্থ কখন দেয়া হবে সে ব্যাপারেও কোনো কথা বলতে ছিল নারাজ। অথচ এই ধনী দেশগুলোই মূলত শিল্প  , যখন দরিদ্র দেশগুলি জিজ্ঞাসা করেছিল যে তারা ধনী দেশগুলি ছাড়া কীভাবে এটি করবে, কিন্তু শিল্প যুগের সূচনা করে এখন পর্যন্ত, প্রধান দূষণকারী দেশগুলি কেউ টাকা দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দেয়নি, এমনকি যদি তারা করেও তবে তারা কখনই টাকা দেয়নি। অখচ এই দেশগুলোই মূলত বৈশ্বিক উঞ্চতা বৃদ্ধির জন্য মূলত দায়ী। এবারের কপ২৭ সম্মেলন জলবায়ু নিয় দীর্ঘদিনের এই টানাপোড়েনের কোনোই সূরাহা করতে পারেনি।

আপসের প্রাণান্ত চেষ্টা, সাথে বাড়ছে হতাশার তীব্রতা

সম্মেলনের আয়োজক দেশ মিশরের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এবং কপ২৭-এর সভাপতি সামেহ শউকরি শীর্ষ সম্মেলনে বিভিন্নভাবে আপোসের আহ্বান জানান। এমনকি সম্মেলন শেষের দিন তিনি জনস্বার্থে একটি আজ্বান জানান আপোসের জন্য।

জাতিসংঘের মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস বলেন, “আমাদের এখন নির্গমন ব্যাপকভাবে হ্রাস করতে হবে – এবং এটি এমন একটি সমস্যা যা এই কপ সম্মেলন সমাধান করতে পারেনি।” “হয় সহযোগিতা বা না হয় ক্ষতিগ্রস্ত” এই আবেদন করার পরেও কোনো দিক থেকেই সহযোগিতার কোনো সুবাতাস বয়ে যাবার কোনোই ইঙ্গিত ছিল না । সমাপনী বিবৃতিতে তিনি বলেন, লস অ্যান্ড ড্যামেজ তহবিলটি হয়ত  কোনোভাবেই যথেষ্ট নয়, তবে এটি নিশ্চয়ই আমাদের মধ্যে বিশ্বাসের যে ভাঙ্গন ধরেছে তা কিঞ্চিত পূরণে একটি রাজনৈতিক সংকেত।

ইউরোপীয় ইউনিয়নও সমাপনী অধিবেশন চলাকালীন অভিযোজন  উচ্চাকাঙ্ক্ষার ঘাটতির সমালোচনা করেছে।

হতাশা এবং ব্যর্থতার বহি:প্রকাশ কপ২৭ সম্মেলনের ঘোষণাতেও দৃশ্যমান।  ঘোষনাপত্রে একটি অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে,  “বিশ্বব্যাপী ক্রমবর্ধমান জটিল এবং চ্যালেঞ্জিং ভূ-রাজনৈতিক পরিস্থিতি এবং জ্বালানী, খাদ্য ও অর্থনৈতিক পরিস্থিতির উপর তার প্রভাব, এবংসেই সাথে  করোনভাইরাস মহামারী থেকে বেরিয়ে এসে আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন পুনরুদ্ধারের সাথে যুক্ত অতিরিক্ত যেসব চ্যালেঞ্জ রয়েছে তা কোনোভাবেই জলবায়ু কার্যক্রমকে ব্যাহত করা, পিছিয়ে যাওয়া বা অগ্রাধিকার না দেয়ার মতো বিষয়কে অজুহাত হিসাবে ব্যবহার করা উচিত হবে না।”

এই ধরনের পর্যবেক্ষন এবং আরো অন্যান্য ঘোষণা সত্ত্বেও, কপ২৭ সম্মেলনের কার্যসূচিতে যে ধরনের সমঝোতার পরিচয় দেয়ার মধ্য দিয়ে এই সম্মেলনের ঘোষণাপত্রটিকে আরো অনেকখানি দুর্বল একটি ঘোষণাপত্রে পরিণত করেছে। সামনের বছর প্রশমন কর্মসূচির মধ্যে কেবল দু’টি বৈশ্বিক সংলাপকে অন্তর্ভূক্ত রাখা হয়েছে।

এই ঘোষণায় ২০৩০ সাল পর্যন্ত নবায়নযোগ্য জ্বালানিতে প্রতি বছর কমপক্ষে ৪ ট্রিলিয়ন মার্কিন ডলার বিনিয়োগ করার কথা উল্লেখ করা হয়েছে যাতে ২০৫০ সালের মধ্যে শূন্য নির্গমনে পৌঁছতে সক্ষম হওয়া যায়। তবে এর বাইরেও, স্বল্প কার্বন অর্থনীতিতে বৈশ্বিক রূপান্তরের ক্ষেত্রে প্রতি বছর কমপক্ষে আরো ৪ থেকে ৬ ট্রিলিয়ন মার্কিন ডলার বিনিয়োগের প্রয়োজন হবে বলে মনে করা হচ্ছে।

Protestors at COP27
মিশরের কপ২৭-এ নাগরিক সমাজের অনেক কর্মী জলবায়ু অর্থায়নের প্রয়োজনীয়তার উপর জোর দেন (ছবি: জয়দীপ গুপ্ত)

এই ঘোষণায় আরও বিশেষভাবে উল্লেখ করা হয় যে “এই ধরনের তহবিল সরবরাহের ক্ষেত্রে সামগ্রিক আর্থিক ব্যবস্থা এবং এর পরিকাঠামো  ও প্রক্রিয়া, সংশ্লিষ্ট সরকার, কেন্দ্রীয় ব্যাংক, বাণিজ্যিক ব্যাংক, প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারী এবং অন্যান্য আর্থিক প্রতিষ্ঠান বা ব্যক্তির ক্ষেত্রে একটি সার্বিক রুপান্তরের প্রয়োজন।”এতে আরো উল্লেখ করা হয় যে “উন্নয়নশীল দেশগুলোর চাহিদার মধ্যে ক্রমবর্ধমান ব্যবধানের উদ্বেগের  পাশাপাশি জলবায়ু পরিবর্তনের ক্রমবর্ধমান প্রভাব এবং তদসংশ্লিষ্ট ক্রমবর্ধমান ঋণ, এবং তাদের জাতীয়ভাবে নির্ধারিত অবদানগুলি বাস্তবায়নের জন্য তাদের প্রচেষ্টার বিষয়গুলো বাস্তবায়নে ২০৩০ সালের আগে প্রায় ৫.৮ থেকে ৫.৯ ট্রিলিয়ন  ডলার প্রয়োজন।”

দরিদ্র দেশগুলোর এই চাহিদার বিপরীতে, ধনী দেশগুলো ২০০৯ সালের প্রতিশ্রুতি অনুযায়ি আগামী ২০২০ সালের মধ্যে ১০০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার অর্থ সহায়তা প্রদানে ব্যর্থ হয়েছে।  এবারের কপ২৭ এই বিষয়টিও সূরাহা করতে ব্যর্থ হয়েছে।

ঘোষণায় আরো উল্লেখ করা হয় যে “উন্নয়নশীল দেশগুলোর সামগ্রিক চাহিদার তুলনায় বিশ্বব্যাপী জলবায়ু অর্থের প্রবাহ সংকীর্ণ, ২০১৯ – ২০২০ সালে এই ধরনের প্রবাহের পরিমাণ ছিল ৮০৩ বিলিয়ন মার্কিন ডলার, যা বৈশ্বিক তাপমাত্রা ১.৫ ডিগ্রি সে. বজায় রাখার জন্য প্রয়োজনীয় বার্ষিক বিনিয়োগের মাত্র ৩১% – ৩২%।

কপ২৭-এ কিছু ধনী দেশ অভিযোজন তহবিলে তাদের বরাদ্দ আরো বৃদ্ধি করবে বলে উল্লেখ করেছে। এর বাইরে এনিয়ে একমাত্র পরিকল্পনা হচ্ছে অভিযোজনে বরাদ্ধের অর্থ দ্বিগুণ করার সংক্রান্ত একটি প্রতিবেদন তৈরি করা, যা আসলে ২০২১ সালে গ্লাসগোতে শীর্ষ সম্মেলনেই সিদ্ধান্ত নেয়অ হয়েছিল।

ব্যর্থ কপ২৭-এ একমাত্র সাফল্য

এবার   শারম এল-শেখে অনেক উন্নয়নশীল দেশের প্রতিনিধিরা কেবল একটি মাত্র দাবী নিয়ে উপস্থিত ছিলেন, তা হচ্ছে লস অ্যান্ড ড্যামেজ মোকাবেলায় তহবিল গঠন। দীর্ঘ বৈরী আলোচনার পর এই তহবিলটি চালুর ঘোষণা আসে। ঢাকা-ভিত্তিক ইন্টারন্যাশনাল সেন্টার ফর ক্লাইমেট অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের প্রধান সালিমুল হক দ্য থার্ড পোলকে বলেন, “কপ২৭ -এ মানব-সৃষ্ট জলবায়ু পরিবর্তনের ক্ষয়ক্ষতি মোকাবেলার জন্য নতুন তহবিল গঠন সব উন্নয়নশীল দেশের জন্য একটি বড় অর্জন। এটি চালু করতে সম্মত হওয়ায় আমরা উন্নত দেশগুলিকে অভিনন্দন জানাই।”

ক্লাইমেট অ্যাকশন নেটওয়ার্ক ইন্টারন্যাশনালের গ্লোবাল পলিটিক্যাল স্ট্র্যাটেজির প্রধান হারজিৎ সিং বলেন,  “বিপদাপন্ন, জনগোষ্ঠীর মধ্যে হয়ত একটি আশার সঞ্চার করবে, যে তারা জলবায়ু বিপর্যয় থেকে পুনরুদ্ধার এবং তাদের জীবন-যাপন পুনর্গঠনে এই তহবিল থেকে সহায়তা পাবে।” সালিমুল হক এবং হারজিৎ সিং কয়েক দশক যাবত জলবায়ু আলোচনায় লস অ্যান্ড ড্যামেজ বিষয়টিকে বিশ্বব্যাপী আরো নীতি-ঘনীষ্ঠ করার ক্ষেত্রে নেতৃত্ব দিয়ে আসছেন।

তহবিল প্রতিষ্ঠাকে স্বাগত জানিয়ে সেক্রেটারি জেনারেল গুতেরেস বলেন, “এর মধ্য দিয়ে এবারের কপ ন্যায়বিচার সূরক্ষার পথেক একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ নিতে সক্ষম হলো … একথা পরিস্কার যে  এটি কোনোভাবেই যথেষ্ট নয়, তবে এটি যে ভেঙ্গে পড়া একটি বিশ্বাস পুনর্গঠনে প্রয়োজনীয় রাজনৈতিক সংকেত, সে কথা অনিবার্য… ন্যায়বিচারের বিশ্লেষনের সাথে আরো বেশ কয়েকটি মৌলিক বিষয়কে গণ্য করা উচিত।  অর্থ আরও অনেকগুলি হওয়া উচিত, যেমন – সার্বিকভাবে উন্নয়নশীল দেশগুলোর জন্য জলবায়ু অর্থায়নে বছরে ১০০ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের দীর্ঘ বিলম্বিত প্রতিশ্রুতি কার্যকর করা; দ্বিগুণ অভিযোজন অর্থায়ন দ্বিগুন পর্যায়ে নিয়ে যেতে স্বচ্ছতা এবং একটি বিশ্বাসযোগ্য রোডম্যাপ প্রকাশ করা; বহুপাক্ষিক উন্নয়ন ব্যাংক এবং আন্তর্জাতিক আর্থিক প্রতিষ্ঠানের ব্যবসা ধরনে পরিবর্তন আনা। তাদের এখন উচিত আরও ঝুঁকি গ্রহণের মধ্য দিয়ে যুক্তিসঙ্গত খরচে উন্নয়নশীল দেশগুলোর জন্য পদ্ধতিগতভাবে বেসরকারী অর্থায়ন বৃদ্ধি করা।”

তহবিল প্রতিষ্ঠাকে স্বাগত জানিয়ে, মার্সি কর্পস-এর পাকিস্তানের পরিচালক ফারাহ নওরীন বলেন, এর চেয়ে কম কিছু হলে হয়ত জলবায়ু আলোচনায় আস্থা সংকট তৈরি হতো এবং এর ফলে আমার নিজের দেশ পাকিস্তানের মতো আরো অনেক দেশকে তার চড়া মূল্য দিতে হতো। এখন আমাদের প্রয়োজন এই তহবিলের কার্যকারিতা পর্যবেক্ষণ করা  এবং মূল কাজটি আসলে এবারের কপ সম্মেলনের পরেই শুরু হবে।”