জলবায়ু

হিমবাহের পরিবর্তে বাঁধের ব্যবহার সমীচিন ?

ইউরোপিয় গবেষকরা এবার আল্পস পর্বতমালায় হিমবাহগুলোর কাছাকাছি কৃত্রিম বাঁধ নির্মানের পরামর্শ দিয়েছেন - তবে এক্ষেত্রে তারা হয়ত হিমালয় পাবর্ত্যাঞ্চলে প্রচলিত বিভিন্ন উদ্যোগগুলো পর্যালোচনা করে নিজেদের ক্ষেত্রে প্রয়োগ করতে পারেন।
বাংলা
<p>Biafo Glacier, Gilgit, Pakistan &#8211; local people in this areahave a long tradition of growing glaciers to irrigate crops [image by Ben Tubby/Flickr]</p>

Biafo Glacier, Gilgit, Pakistan – local people in this areahave a long tradition of growing glaciers to irrigate crops [image by Ben Tubby/Flickr]

গলতে থাকা হিমবাহ থেকে জল সংরক্ষণ করতে এবং গ্রীষ্মে জল সংকট মোকাবেলায় আল্পসে এবার বাঁধ নির্মানের প্রস্তাব দিয়েছেন সুইস গবেষকরা।

ইউরোপিয় কমিশনের যৌথ গবেষণা কেন্দ্র ও সুইস ফেডারেল রিসার্চ ইনস্টিটিউট (ডব্লিউএসএল) পরিচালিত এক গবেষণায় এই পরামর্শ দেয়া হয়েছে। এতে বলা হয়:

‘‘হিমবাহ গলে সৃষ্ট জলাধারগুলোর সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা করা হলে গ্রীষ্মে সম্ভাব্য জল সংকট মোকাবেলা করাটা অনেক সহজ হবে।   গবেষণা দলটি ইউরোপিয় আল্পস পার্বত্যাঞ্চলে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব নির্ণয়ে বেশ কিছু কৃত্রিম মডেলের মাধ্যমে গবেষণা পরিচালনা করেছেন। এসব পরীক্ষা থেকে পাওয়া ফলাফল বিশ্লেষণ করে তারা মনে করছেন, এই পদ্ধতি অবলম্বন করে যেসব এলাকা বরফমুক্ত হয়ে যাচ্ছে সেখানে জলের সংকট কমপক্ষে দুই-তৃতীয়াংশ মোকাবেলা করা সম্ভব।

দানিয়ুব, পো, রাইন ও রোণ ছাড়াও ইউরোপের প্রধান নদ-নদীগুলোর জলের অন্যতম প্রধান উৎস হচ্ছে আলপাইন পর্বতমালার এসব হিমবাহ –  এখানকার প্রায় ৪,০০০ হিমবাহ হারিয়ে গেলে গ্রীষ্মে এই নদীতে জলের প্রবাহ ভয়াবহভাবে সংকটের মুখে পড়বে। এই হিমবাহগুলো নিয়ে বিশ্বের অন্যান্য সব পর্বতমালার হিমবাহগুলোর চেয়ে বেশি গবেষণা হয়েছে, তবে হতাশার কথা হচ্ছে এই হিমবাহগুলো জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে ক্ষতির মুখোমুখি।

অবশ্য প্রস্তাবিত যে সমাধানটি তারা দিয়েছেন তা একটি আংশিক সমাধান মাত্র। কৃত্রিম বাঁধ কখনোই হিমবাহ থেকে উৎসারিত প্রাকৃতিক জলপ্রবাহের প্রক্রিয়াকে প্রতিস্থাপন করতে পারেনা। গবেষকরা এটাও বুঝতে পারছেন যে বড় বাঁধগুলো উজানে অবস্থিত ক্ষুদ্র সম্প্রদায়গুলোর তেমন একটা কাজে আসবে না এবং এজন্য একটি পরিপূর্ণ জলব্যবস্থাপনা পদ্ধতি প্রণয়ন করতে হতে পারে।

হিমালয় অঞ্চলে প্রচলিত সমাধান

হিন্দুকূশ হিমালয় পর্বতমালায় বসবাসরত বিভিন্ন সম্প্রদায় তাদের নিজেদের মতো করে এসব সমস্যা সমাধানের পথ খূঁজে বের করেছে, যেমন – গ্রীষ্মে যখন তাদের হিমবাহগুলো হারিয়ে যায়, তখন তারা নিজেদের মতো করে এই পরিস্থিতির সঙ্গে খাঁপ খাইয়ে নেয়ার মতো উপায় বের করে নেয়।

তিব্বতীয় মালভূমির অনূর্বর এলাকার একটি হচ্ছে ভারতের লাদাখ। জলের সংকট মোকাবেলায় সেখানকার বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের ধর্মীয় নেতা ও স্থানীয় জনগণ মিলে তৈরি করেছে ‘বরফ স্টুপা’ – এগুলো বরফের তৈরি এক ধরনের বিশালাকৃতির কৃত্রিম পিরামিড যা শুষ্ক মৌসুমে ফসলের জমিতে সেচের জন্য জল সংরক্ষনের কাজে ব্যবহার করা হয়। ছেওয়াং নোরফেল, একজন অবসরপ্রাপ্ত প্রকৌশলী, যিনি লাদাখে ‘বরফ মানব’ বলে পরিচিত। তিনি জল সংরক্ষণের এই কৌশলটি আবিস্কার করেন। এর ফলে এখানকার কৃষকরা এখন শুষ্ক মৌসুমে যব, গম, ফল এবং সব্জি চাষ করতে পারছেন। আপাত সহজ কিন্তু কার্যকর একটি সমাধান উদ্ভাবনের জন্য তিনি হিমালয় অঞ্চলের জনগনের কাছে অন্যতম এক ব্যক্তিত্বে পরিণত হয়েছেন। পরবর্তীতে সোনাম ওয়াংচুক এই প্রকল্পটিকে এগিয়ে নিয়ে যান, তিনি বরফের শঙ্কু তৈরি করেন যা স্থানীয়ভাবে ‘বরফের স্টুপা’ হিসেবে পরিচিতি পায়।

হিন্দুকূশের একটি ছোট্ট গ্রাম গিলগিট বালতিস্তান। এই অঞ্চলে বাস করা বালটি গোত্রের মানুষ মূলত তিব্বতীয় অঞ্চলের একটি আদিবাসী গোত্র। ভারত ও পাকিস্তান  – উভয় দেশেই এদের দেখতে পাওয়া যায়। জল সংরক্ষণের জন্য এরা শত শত বছর ধরে একটি বিশেষ পদ্ধতি ব্যবহার করে আসছে। এই পদ্ধতিতে স্থানীয় জনগণ ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র কৃত্রিম হিমবাহ তৈরি করে যা থেকে সংকটকালীন সময়ে ফসলের জমিতে জল সরাবরাহ করা হয়। এমনকি এখান থেকে তারা ক্ষুদ্র জল বিদ্যুত প্রকল্পও তৈরি করে বিদ্যুত উৎপন্ন করে। এই পদ্ধতিতে স্থানীয় বালটি সম্প্রদায় প্রাকৃতিক হিমবাহ থেকে বরফ সংগ্রহ করে পাহাড়ের আরো অনেক উচ্চতায় উঠে এক ধরনের গুহা তৈরী করে সেখানে বরফ স্তুপ করে রাখে। এসব গুহায় বরফের সাথে লবন, কাঠের গুড়ি, গমের উচ্ছ্বিষ্ট  ও কয়লা রাখা হয়।

কাল্পকাহিনী ও রূপকথা

জল সংরক্ষণের অভিনব এই পদ্ধতির কথা এখানকার প্রচলিত কল্পকাহিনীতেও উল্লেখ রয়েছে – যা আসলে প্রজন্ম থেকে প্রজন্ম  মুখে মুখে ছড়িয়ে গেছে। এসব অঞ্চলের অধিবাসীরা হিমবাহকে জীবন্ত সত্বা হিসেবে বিবেচনা করে (যেখানে ‘পুরুষ’ ও ‘নারী’ হিমবাহের রয়েছে ভিন্ন ভিন্ন ভূমিকা)। আমরা সবাই জানি যে হিমবাহ মানুষের জীবনে বয়ে নিয়ে আসতে পারে ভয়াবহ দূর্যোগ। নরওয়ের এক শিক্ষার্থীর ইংভার নর্সটেহার্ড তেভিতেন তার ¯¯œাতকোত্তর গবেষনামূলক প্রবন্ধে বালটি রীতির এক আকর্ষণীয় বিবরণ লিপিবদ্ধ করেন।

এমনই এক গল্প থেকে জানা যায় কী করে বালটি জনগণ জল সংরক্ষনের ক্ষেত্রে এই পদ্ধতি সম্পর্কে ধারণা পেতে শুরু করে। গল্প অনুযায়ি এক দূর্ঘটনা থেকে এর সূচনা। এক বৃদ্ধা একদিন জল ভর্তি লাউ থেকে তৈরি একটি পাত্র ফেলে যান। ধীরে ধীরে এটিই একসময় বরফ জমে তৈরি করে কারাকোরামের বিশাল কোনডাস হিমবাহ। এই হিমবাহ দৈবক্রমে বালতিস্তান ও চীনের কাশগরের মাঝামাঝি  অবস্থানে থাকা একটি গুরুত্বপূর্ণ যোগাযোগের পথ বন্ধ করে দেয়। ফলে বন্ধ হয়ে যায় বহি:দেশ থেকে  আক্রমনকারীদের অন্যতম এই প্রবেশপথ। বালতিস্তান কৌশলগত একটি ভৌগলিক অবস্থানে ছিল, যা প্রায়ই বিভিন্ন যুদ্ধগ্রস্থ্য প্রদেশের লড়াইয়ের মাঝে পড়ে। পাকিস্তান, ভারত, আফগানিস্তান এবং চীনের সীমান্তে এর অবস্থান হওয়ার কারণে বালতিস্তান সব সময়ই একটি কৌশলগত অঞ্চল হিসেবে বিবেচিত হতো। বালতিস্তানের পূর্ব দিকে কাশ্মীর যেটি সিয়াচেন হিমবাহের উপত্যকায় অবস্থিত  – কাশ্মীর নিয়ে এখনও ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে দ্বন্দ্ব চলছে।

এই হিমবাহ তৈরির ঐতিহ্য পরবর্তীতে ইসলামিক পূরাণেও অন্তর্ভূক্ত হয়। বেশীরভাগ বালটি জনগণ পনেরশ’ শতকের দিকে বৌদ্ধ ধর্ম ত্যাগ করে। অনেকেই এখন মনে করেন, মীর সৈয়দ আলি হামাদানি নামে একজন পারস্য সুফি ধর্মপ্রচারক এই এলাকায় প্রথম ইসলামের আগমন ঘটান। জনশ্রুতি আছে, তিনিই প্রথম এখানকার মানুষকে শিখিয়েছেন কিভাবে কৃত্রিম হিমবাহ তৈরি করা যায়।

ইউরোপিয়রা হিমালয় পর্বতাঞ্চলের এসব অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগিয়ে দেখতে পারে। জল সংকট মোকাবেলায় বাঁধ নির্মানের চেয়ে কৃত্রিম হিমবাহ সৃষ্টি করা বা বরফ স্টুপা তৈরির মতো পদ্ধতি অনেক বেশি কার্যকর হবে বলে মনে করা হয়।

 

(বাংলায় অনুবাদ করেছেন ফারজাদ খাঁন)

Privacy Overview

This website uses cookies so that we can provide you with the best user experience possible. Cookie information is stored in your browser and performs functions such as recognising you when you return to our website and helping our team to understand which sections of the website you find most interesting and useful.

Strictly Necessary Cookies

Strictly Necessary Cookie should be enabled at all times so that we can save your preferences for cookie settings.

Analytics

This website uses Google Analytics to collect anonymous information such as the number of visitors to the site, and the most popular pages.

Keeping this cookie enabled helps us to improve our website.

Marketing

This website uses the following additional cookies:

(List the cookies that you are using on the website here.)