জলবায়ু

কোনো পূর্ব-প্রস্তুততির সুযোগ না দিয়েই বন্যা এলো বাংলাদেশে

দূর্যোগ ব্যবস্থাপনায় প্রশংসনীয় অগ্রগতি থাকলেও এবারের বন্যায় বিপুল সংখ্যক মৃতের ঘটনা বাংলাদেশকে বেশ ভাবিয়ে তুলেছে। এ বছর বন্যায় বেশিরভাগ মৃতের ঘটনা ঘটেছে এমন এলাকাতে যেখানে সাধারণত বিগত কোনো বছরেই বন্যা দেখা যায়নি।
বাংলা
<p>This year the monsoon flood has inundated most of the parts of the country [image by: Zobaidur Rahman]</p>

This year the monsoon flood has inundated most of the parts of the country [image by: Zobaidur Rahman]

বাংলাদেশ দূর্যোগ ব্যবস্থাপনায় সারাবিশ্বে একটি নেতৃত্বস্থানীয় অবস্থানে রয়েছে। এক্ষেত্রে বিশেষ দক্ষতার কারণে সারাবিশ্বে বাংলাদেশকে একটি রোলমডেল হিসেবে বিবেচনা করা হয়। তবে এবারের বন্যার ভয়াবহতা বাংলাদেশকে ব্যাপকভাবে ভাবিয়ে তুলেছে, কারণ এই বন্যায় অতীতের যেকোনো সময়ের চেয়ে মৃতের ঘটনা বেশি ঘটেছে। আর বেশিরভাগ মৃত্যুর ঘটনাগুলো এমন স্থানে ঘটেছে সাধারণত যেসব স্থানকে বন্যাপ্রবণ এলাকা হিসেবে বিবেচনা করা হয়না। গত ১৭ আগষ্ট দেশের দূর্যোগ ব্যবস্থাপনা বিভাগের তথ্য মতে, এবারের বন্যায় দেশের ২৬টি জেলায় সব মিলিয়ে ৬১টি প্রাণহানীর ঘটনা ঘটেছে।

দিনাজপুর ও কুড়িগ্রাম জেলায় এবারের বন্যায় কমপক্ষে ৪২ ব্যক্তির প্রাণহানী ঘটে। স্থানীয় সূত্র মতে এদের সবাই পানিতে ডুবে মারা যায়। এই দু’টি জেলা দিয়ে ভারত থেকে ব্রক্ষ্মপুত্র, তিস্তা, পূণর্ভবা, আত্রাই, টাঙ্গনসহ অন্যান্য বেশ কয়েকটি নদী বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে। এই দু’টি জেলা দেশের উত্তরাঞ্চলের মধ্যে তুলনামূলক উঁচু জেলা হিসেবে বিবেচিত। ১২ আগষ্ট থেকে শুরু হওয়া সপ্তাহব্যাপী টানা ও ভারী বর্ষণে সেই বন্যা ভয়াবহ আকার ধারণ করে।

দিনাজপুরের বাসিন্দা মোজাম্মেল হোসেন বলেন, ‘বন্যা শুরুর দু’দিনের মধ্যেই আমাদের বাড়ির জানালা দিয়ে বন্যার পানি প্রবাহিত হতে শুরু করে। আমাদের এলাকায় আসলে কখনও এ ধরনের বন্যা হয়নি।’ এই জেলার বেশিরভাগ বাড়ি-ঘর কমপক্ষে পাঁচ ফুট পানির নিচে রয়েছে বেশ কিছু দিন যাবত।

তিনি বলেন, যেহেতু দিনাজপুর কখনই এবকটি বন্যা প্রবণ এলাকা হিসেবে পরিচিত নয়, তাই আমরা বন্যার সময় লোকজনকে সরিয়ে নিরাপদ স্থানে নিয়ে যেতে ১০টি নৌকাও খুঁজে পাইনি। বিশেষ করে নারী, শিশু ও বৃদ্ধ লোকজনকে নিরাপদ স্থানে সরিয়ে নিয়ে যাওয়াটা একটি দূরহ কাজ হিসেবে দেখা  দেয় সেই মুহুর্তে।

দিনাজপুর জেলার অতিরিক্ত কমিশনার মোহাম্মদ গোলাম রব্বানী বলেন, দিনাজপুরে শিশু ও বৃদ্ধসহ সব মিলিয়ে ২৪টি প্রাণহানীর ঘটনা ঘটেছে। এটি আসলে অন্য যে কোনে জেলার চেয়ে বেশি। অন্যদিকে পার্শ্ববর্তী কুড়িগ্রাম জেলায় বন্যায় ১৪ জণের প্রানহানী ঘটেছে। এদের বেশিরভাগই পানিতে ডুবে মারা যায়। এর মধ্যে কমপক্ষে তিনজন মারা যায় বাড়ির দেয়াল ধ্বসে।

কুড়িগ্রাম জেলার উপ কমিশনার এ এস এম ফেরদৌস খান জানান, কুড়িগ্রাম জেলায় সাম্প্রতিক বন্যায় যারা মারা যায় তাদের মধ্যে বেশিরভাগই সাঁতার জানতো না। যদি সাঁতার জানা থাকতো তাহলে হয়ত এত বেশি মানুষের প্রাণহানী হতো না।

দিনাজপুর শহরের নির্বাচিত সংসদ সদস্য ইকবালুর রহিম বলেন, আমাদের এখানে বড় কোনো নদী নেই। উত্তরবঙ্গের অন্যান্য অনেক জেলার মধ্যে দিনাজপুর তুলনামূলকভাবে কিছুটা উঁচু। এখানে সাধারণত বন্যা হয় না। জেলার বেশিরভাগ মানুষই সাঁতার জানে না। ফলে আকষ্মিক বন্যার ধাক্কা তারা সামলে উঠতে পারেনি। আমি পার্শ্ববর্তী কয়েকটি জেলা থেকে নৌকা সংগ্রহ করেছিলাম যাতে লোকজনকে নিরাপদ স্থানে সরিয়ে নিতে পারি।

দিনাজপুর জেলাকে মূলত দেশের খাদ্য উৎপাদনকারী জেলা হিসেবে (ফুড বাস্কেট) দেখা হয়। এই জেলার মধ্য দিয়ে পূনর্ভবা, টাঙ্গন আর আত্রাই নদী প্রবাহিত হয়েছে।

দূর্যোগ যেন আর থামছে না

দূর্যোগ ব্যবস্থাপনা বিভাগের তথ্য মতে, দেশের উত্তরাঞ্চলের ২৬টি জেলার ৪.৮ মিলিয়ন এবারের বন্যায় আক্রান্ত হয়। বন্যা পূর্বাভাস কেন্দ্রের সুপারিনটেন্ড্যান্ট সাইফুল হোসাইন দ্যথার্ডপোলডটনেটকে বলেন, উত্তরবঙ্গে বন্যা পরিস্থিতির কিছুটা উন্নতি হলেও দেশের মধ্য, দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে বিরুপ আকার ধারণ করছে। আগামী আরো চারদিন এই পরিস্থিতি অব্যাহত থাকবে বলে ধারণা করা হচ্ছে।

বিশিষ্ট পানি বিশেষজ্ঞ ড. আইনুন নিশাত বলেন, অন্যান্য বছরের মতো এবারো যদি বন্যার পূর্বাভাস সরাসরি সাধারণ মানুষের কাছে পৌছে দেয়া যেতো তাহলে দিনাজপুরসহ উত্তরবঙ্গের অন্যান্য জেলার প্রাণাহানী অনেকাংশে কমিয়ে আনা যেতো।

ইতিহাস থেকে কোনো শিক্ষা নেই

ড. আইনুন নিশাত বলেন, দিনাজপুর কিন্তু কখনই একটি বন্যাপ্রবন জেলা হিসেবে বিবেচিত ছিল না। প্রায় ৩০ বছর আগে (১৯৮৭ সালে) বাংলাদেশে একটি বড় বন্যা হয়েছিল। আমার মনে হয় ওই বন্যা থেকে মানুষ কোনো শিক্ষা গ্রহন করেনি। বন্যার সাথে খাপ খাইয়ে চলার সক্ষমতা এখানকার মানুষের একেবারেই নেই বলে আমার ধারণা। এই জেলার ভিতর দিয়ে বয়ে চলা প্রায় সব ক’টি নদী যেমন পূনর্ভবা, টাঙ্গন আর আত্রাই নদীর গভীরতা একেবারেই কমে গেছে। এই নদীগুলোর পানি ধারণ ক্ষমতা তাই ব্যাপকভাবে হ্রাস পেয়েছে।

বাংলাদেশের ইতিহাসে সবচেয়ে প্রলয়ংকারী বন্যা হয়েছিল ১৯৮৮ সালে। সেসময় দুই দফা বন্যায় বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলের বিভিন্ন জেলাসহ সারাদেশে ৪৫ মিলিয়ন মানুষ ভয়াবহ ক্ষয়ক্ষতির শিকার হয়। দূর্যোগ ব্যবস্থাপনা বিভাগের তথ্য অনুযায়ি ১৯৮৭ সালে ১,৪৭০ জন এবং পরবর্তী বছরে ১,৬২১ মানুষ মারা যায়্। ১৯৮৭ সালের বন্যায় দেশের ৫০ টি জেলার ৩৪৭টি উপজেলা ক্ষয়ক্ষতির শিকার হয়।

কিন্তু গত ৩০ বছরে দিনাজপুরের বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধগুলোর কোনো রক্ষণাবেক্ষণ করা হয়নি। এর কারণ এসময়ের মধ্যে এখানে বড় কোনো ধরনের বন্যার ঘটনা ঘটেনি।

চলতি বছর ভারী মৌসুমে ভারতে অস্বাভাবিক বৃষ্টিপাত হওয়ায় নদীগুলো উজান থেকে প্রচুর পরিমানে পানি বহন করে নিয়ে আসে। এর ফলে নদীগুলোতে পানির চাপ বাড়তে থাকে। ফলে বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধ ভেঙ্গে পড়ে। আইনুন নিশাত বলেন, এই বারের বন্যা কিন্তু বাংলাদেশের জন্য একটি বড় শিক্ষা!

তিনি বলেন, বন্যা হোক আর না হোক, প্রত্যেকটি বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধকে প্রতি বছর রক্ষণাবেক্ষণ করতে হবে। যদি নিয়ন্ত্রণ বাঁধগুলো সঠিকভাবে রক্ষণাবেক্ষণ করা হয় তাহলে মানুষ নিরাপদ স্থানে চলে যাওয়ার সুযোগ পাবে। পাশাপাশি অনেক প্রাণহানীও এড়ানো যাবে।

পানি উন্নয়ন বোর্ডের হাইড্রোলজি ও বন্যা পূর্বাভাস বিভাগের সাবেক প্রকৌশলী শওকত আলী বলেন, দেশের দক্ষিণাঞ্চলে প্রতি বছর বন্যা, সাইক্লোন ও নদীভাঙ্গনসহ নানা ধরনের প্রাকৃতিক দূর্যোগ ঘটে থাকে। অথচ সেখানেও কিন্তু এতো প্রাণহানীর ঘটনা ঘটে না।

আন্ত:দেশীয় সহযোগিতা

১৯৮৭ সালের বন্যার পর বন্যা নিয়ন্ত্রণ ও পূর্বাভাস ব্যবস্থাকে আরো কার্যকর করতে একটি দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা গ্রহন করে। এক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সহযোগিতা গ্রহন করা হয়। বন্যা নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থাকে আরো কার্যকর করে গড়ে তুলতে ভারত, নেপাল ও ভূটানের সাথে সহযোগিতার প্রক্রিয়া শুরু করে বাংলাদেশ।

আন্ত:দেশীয় নদ-নদীগুলোর তথ্য বিনিময়ের মাধ্যমে বন্যা ও বন্যাসৃষ্ট ক্ষয়ক্ষতি মোকাবেলা করা সম্ভব বলে মনে করেন সাইফুল হোসাইন। তিনি পানি উন্নয়ন বোর্ডের বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কবার্তা বিভাগের একজন প্রকৌশলী।

অপরিকল্পিত নগরায়নের কারনে বন্যার হুমকিতে দরিদ্র জনগোষ্ঠী

সান্টু মিয়া (৬৫) দিনাজপুর জেলার বিরল উপজেলার একজন অধিবাসী। পেশায় তিনি একজন কৃষক। তিনি বলেন, প্লাবনভূমিতে সব ধরনের স্থাপনা নির্মান বন্ধ করা গেলে বন্যার ক্ষয়ক্ষতি বহুলাংশে কমিয়ে আনা যাবে।

দরিদ্র জনগণ নদী তীরবর্তী এলাকায় ঘরবাড়ি গড়ে তুলতে আগ্রহী কারণ এসব স্থানে অন্যান্য স্থানের চেয়ে জমির মূল্য কিছুটা কম হয়ে থাকে। এছাড়াও অনেকেই আছেন যারা উঁচু এলাকায় নিজেদের জমি বিক্রি করে থাকেন। কারণ নগরায়নের কারনে এসব জমির দাম হু হু করে বাড়ছে। পরবর্তীতে তারা নিজেদের জন্য অধিকতর নিচু এলাকায় নিজেদেও বাড়িঘর নির্মান করে বসবাস করে। আর আর এর ফলে তারা অনেকেই বন্যার সময় ক্ষয়ক্ষতির শিকার হয়ে থাকেন। দেশের প্রায় সব এলাকাতেই এই চিত্র দেখা যায়। উদাহরণ হিসেবে ঢাকার পাশে ডিএনডি বাঁধ (ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ-ডেমরা) নির্মান করা হয়েছিল মূলত কৃষি বিষয়টিকে মাথায় রেখে। অথচ স্থানীয়রা এটিকে একটি আবাসিক এলাকা হিসেবে গড়ে তুলেছে। এখন এই এলাকার একটি বিরাট সমস্যা হচ্ছে জলাবদ্ধতা  ও বন্যা। আর নিচু ভূমিতে বাড়ি-ঘরসহ অন্যান্য স্থাপনা নির্মান করলে এই ধরনের ক্ষয়ক্ষতির সম্মুখীন হতেই হবে।

Privacy Overview

This website uses cookies so that we can provide you with the best user experience possible. Cookie information is stored in your browser and performs functions such as recognising you when you return to our website and helping our team to understand which sections of the website you find most interesting and useful.

Strictly Necessary Cookies

Strictly Necessary Cookie should be enabled at all times so that we can save your preferences for cookie settings.

Analytics

This website uses Google Analytics to collect anonymous information such as the number of visitors to the site, and the most popular pages.

Keeping this cookie enabled helps us to improve our website.

Marketing

This website uses the following additional cookies:

(List the cookies that you are using on the website here.)