জলবায়ু

বিশ্ব উঞ্চায়ন বৃদ্ধির ফলে হিমালয়ের সকল নদী অববাহিকায় পানির স্তর নিম্নমুখি

বিজ্ঞানীরা বলছেন, চলমান তাপমাত্রা বৃদ্ধির ফলে পানির চক্রে আসছে পরিবর্তন, ফলে বিশ্বের গুরুত্বপূর্ণ নদী অববাহিকায় পানির পরিমান হ্রাস পাচ্ছে
বাংলা
<p>Woman pumping water from a hand borewell in Varanasi, Uttar Pradesh, in the Ganga basin in India. (Photo credit: Dinodia Photos/Alamy S)</p>

Woman pumping water from a hand borewell in Varanasi, Uttar Pradesh, in the Ganga basin in India. (Photo credit: Dinodia Photos/Alamy S)

সম্প্রতি প্রকাশিত নতুন এক গবেষণায় দেখা যাচ্ছে বিশ্বের বড় বড় নদীগুলোতে পানির স্তর কমে যাচ্ছে। এর কারনে পানির প্রাপ্যতায় ব্যাপক প্রভাব পড়তে পারে যাকে ভবিষ্যতে পানির নিরাপত্তার উপরে মারাত্বক হুমকি হিসেবে মনে করা হচ্ছে। গবেষণায় বলা হয় এই হিমালয় অঞ্চলের বড় নদীগুলোতে এর প্রভাব সবচেয়ে বেশি লক্ষনীয়।

পানির প্রাপ্যতা নির্ভর করে ভূগর্ভে বা হ্রদ, নদ-নদীতে কী পরিমান পানি সঞ্চিত রয়েছে তার উপরে। এর মধ্যে আরো রয়েছে ভূমির আর্দ্রতা, তুষার এবং বরফ। এই সকল জলাধারের মধ্যে পানির প্রবাহের মাধ্যমে উৎসে পানি পূরণকে ওয়াটার রিচার্জ বলা হয়।

কিন্তু তাপমাত্রা বৃদ্ধির অর্থ হচ্ছে বাষ্পীভবনের মাধ্যমে আরো বেশি পানি হারিয়ে যাওয়া এবং গাছ-পালা, বৃক্ষরাজি দ্বার আরো বেশি পানির শোষণ। অন্যদিকে যেহেতু জলবায়ু পরিবর্তন হচ্ছে ফলে স্বল্প বৃষ্টিপাত ও তুষারপাতের কারনে স্বল্প পরিমানে পানি নদীতে প্রবেশ করে। এর ফলে অববাহিকায় পানির স্বল্পতা বৃদ্ধি পাচ্ছে, আর জলবায়ু পরিবর্তনের প্রবাবে এই ধারা অব্যাহত থাকবে বলে মনে করা হচ্ছে।

ইন্ডিয়ান ইন্সটিটিউট অব সাইন্স এবং অষ্ট্রেলিয়ার ইউনিভার্সিটি অব সাউথ ওয়েলস এর গবেষকরা ৩১ নদী অববাহিকায় এই গবেষণা পরিচালনা করেন।

গবেষণায় তারা দেখতে পান ইরাবতী নদীতে পানি পূরণ হওয়ার মাত্রা প্রতি এক ডিগ্রী তাপমাত্রা বৃদ্ধিতে ৩৯ শতাংশ হ্রাস পেয়েছে। আর সিন্ধু নদীতে এই মাত্রা ২৪ শতাংশ এবং গঙ্গা-ব্রক্ষ্মপুত্র নদী অববাহিকার এর মাত্রা ১৪ শতাংশ।  

গবেষণা পরিচালনা করা হয়েছে যেই ৩১টি নদীতে তার মধ্যে ২৩টি নদীতেই তাপমাত্রা বৃদ্ধির ফলে পানির স্তর হ্রাস পাওয়ার নিম্নমুখি প্রবনতা দেখা গেছে। 

ওয়াটার রিচার্জের গণনা

তাপমাত্রা বৃদ্ধির ফলে ওয়াটার রিচার্জের উপরে যে প্রভাব পড়ে তা বুঝতে গবেষকরা স্যাটেলাইট ডেটার মাধ্যমে টেরেস্ট্রিয়াল ওয়াটার রিচার্জ (টিডব্লিউউআর) নির্ণয়ের মাধ্যমে কী পরিমান পানি প্রতি বছর জলাধারের উপরিভাগ ও ভূ-গর্ভে যুক্ত হচ্ছে তা বের করার চেষ্টা করেন। বিভিন্ন অঞ্চলে বৃষ্টিপাত ও তুষারপাতের পরিমান মাত্রা আমলে নিয়ে গবেষকরা পানির উৎগুলোতে রিচার্জের পরিমান বের করেন।

বার্ষিক তাপমাত্রার সাথে প্রতিটি অববাহিকার পারস্পরিক সম্পকৃযুক্ত রিচার্জের পরিমান নির্ণয় করার জন্য তারা ২০০২ সালের এপ্রিল থেকে ২০১৭ সালেল জানুয়ারি মাস পর্যন্ত তথ্য পর্যালোচনা করেন। 

গবেষনায় অববাহিকাগুলোর স্বতন্ত্র ঋতুভিত্তিক উঞ্চতা এবং আর্দ্রতার চক্র প্রথমে তালিকাভুক্ত করা হয়, কারণ এসব অববাহিকাগুলো নির্দিষ্ট সময়ে পানির পরিমান বৃদ্ধি ও হ্রাস পায়। যেমন ভারতের গঙ্গা-ব্রক্ষ্মপুত্র অববাহিকায় মার্চ থেকে মে মাস পর্যন্ত আবহাওয়া শুষ্ক থাকে আর জুন থেকে সেপ্টেম্বর মাস পর্যন্ত এই অঞ্চলে আর্দ্র আবহাওয়া থাকে অর্থাৎ এই সময়ে এখানে বৃষ্টিপাত দেখা যায় যার মাধ্যমে পানির উৎসগুলো অতিরিক্ত পানি পেয়ে থাকে।

আর যেসব স্থানে তুষারপাতের ঘটনা ঘটে সেখানে শীত মৌসুমে জলাধারে নতুন পানির সঞ্চার হয়।

ব্যাঙ্গালোরের ন্যাশনাল ইন্সটিটিউট অব অ্যাডভান্সড স্টাডিজের এনার্জি অ্যান্ড এনভায়রনমেন্ট প্রোগ্রামের সহকারী অধ্যাপক হারিনি সান্থানাম অবশ্য এই গবেষণায় যুক্ত ছিলেন না। তিনি গবেষনার প্রক্রিয়ার বিষয়ে মন্তব্য করতে গিয়ে বলেন, স্যাটেলাইট ডেটার তথ্য ব্যবহার করে গবেষণার একটি দূর্বলতা হচ্ছে এই গবেষণার প্রাপ্ত ফলাফল অবশ্যই স্থল ভিত্তিক পর্যবেক্ষনের মাধ্যমে ভূগর্ভস্থ্য পানির স্তরের তথ্যের সাথে মিলিয়ে নেয়া বাঞ্ছনীয়। 

দক্ষিণ এশিয়ার জন্য রয়েছে সতর্কবার্তা

ভারতে পরিবেশ নিয়ে কাজ করা থিংক-ট্যাংক ওয়ার্ল্ড রিসোর্সেস ইন্সটিটিউট-এর ক্লাইমেট প্রোগ্রামের পরিচালক উল্কা কেলকার বলেন, দক্ষিণ এশিয়ার জন্য আসলে এই ধরনের বিশ্লেষণ একটি সতর্কবার্তা বলেই প্রতীয়মান হয়। কারন আমাদের কৃষিব্যবস্থা এবং ক্রমবর্ধমান নগরায়নের কারনে পানির ব্যবহার অত্যধিক বেশি।

দক্ষিণ এশিয়ার নদীগুলো মূলত মৌসুমী বৃষ্টিপাতের উপরে নির্ভরশীল। আর জলবাযু পরিবর্তনের প্রভাবে এখানকার মৌসুমী বৃষ্টিপাতের ধরনে কেমন পরিবর্তন আসতে পারে তার ব্যাপারে কোনো সুস্পষ্টভাবে কিছু বলা যায়না। তবে এই গবেষণায় যে বিষয়টি খুব সুস্পষ্টভাবে উঠে এসেছে তা হচ্ছে উঞ্চ আবহাওয়ার কারনে এখানে বাষ্পীভবনের মাধ্যমে এখানকার নদী, হ্রদ ও ভূ-গর্ভস্থ্য উৎস থেকে অধীক পরিমানে পানি হ্রাস পাবে, ফলশ্রুতিতে এই উৎসগুলোর রিচার্জের ক্ষেত্রে স্বল্প পরিমানে পানি অবশিষ্ট থাকবে।

সমগ্র বিশ্বে বার্ষিক ভূ-গর্ভস্থ্য পানির মোট ব্যবহারের অর্ধেকেরও বেশি পরিমান পানি ভারত, পাকিস্তান, বাংলাদেশ ও উত্তর চীনে ব্যবহৃত হয়। এই অঞ্চলের কৃষি, আঞ্চলিক অর্থনীতি এবং উন্নয়নের জন্য এখানকার নদ-নদীর পানি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।  

বিশ্বের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দুটি কৃষি অঞ্চলের পানির চাহিদা মিটিয়ে থাকে সিন্ধু ও গঙ্গা-ব্রক্ষ্মপুত্র নদী অববাহিকা। অথচ এই দুই অববাহিকাই এখন ব্যাপক ভিত্তিতে ভূ-গর্ভস্থ্য পানির সংকটে রয়েছে।

উল্কা কেলকার বলেন, ভারতের উত্তর প্রদেশ রাজ্যের গঙ্গা অববাহিকায় ভূ-গর্ভস্থ্য পানির প্রায় ৭০ শতাংশই ব্যবহৃত হয়ে গেছে। এর কারন হচ্ছে এই রাজ্যের জনবসতি অত্যন্ত বেশি এবং পুরো রাজ্য জুড়েই রয়েছে কৃষি জমি। একইভাবে ভারতের পাঞ্জাব রাজ্যে সিন্ধু নদীর অববাহিকায় ভূ-গর্ভস্থ্য পানির ব্যবহার ১৫০ শতাংশ ছাড়িয়ে গেছে।

তিনি বলেন, আমরা এই রাজ্যগুলোতে ব্যাপকভিত্তিতে জল-তৃঞ্চার্ত কৃষির ফলন করছি। এর ফলে বিশ্বে উঞ্চতা বৃদ্ধির ফলে এখানকার নদনদীগুলোতে তীব্র পানির সংকট দেখ দেবে বলে এই গবেষণায় আশংকা প্রবকাশ করা হয়েছে। 

চাষের জন্য ব্যাপক ভিত্তিতে পানির প্রয়োজন হয় যেসব ফসলের জন্য তার মধ্যে ধান অন্যতম। বিশ্বে ধান বা চাল উৎপাদনকারী অঞ্চলগুলোর বেশিরবাগই এশিয়ার নদ-নদীর তীরে গড়ে উঠেছে, এর বাইরে আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ অঞ্চল হচ্ছে ইরাবতী নদী অববাহিকা যেটির বেশিরভাগই মিয়ানমারে পড়েছে। নয়াদিল্লি ভিত্তিক ইন্টারন্যাশনাল ওয়াটার মানেজমেন্ট ইন্সটিটিউট (আইডব্লিউএমআই) এর মূখ্য গবেষক অদীতি মূখার্জি বলেন, ইরাবতি নদীর বাটি অঞ্চলে শুষ্ক মৌসুমের ফসল উৎপাদনের জন্য সেচের মাধ্যমে ব্যাপক ভিত্তিতে ভূ-গর্ভস্থ্য পানির ব্যবহার বেড়ে গেছে। এই অববাহিকার পানির ঘাটতি পূরনে অসাঞ্জস্য একটি বড় উদ্বেগের কারন হতে পারে বলে তিনি মনে করেন।

আইডব্লিউএমআই-এর গবেষণায় দেখা গেছে মধ্য মিয়ানমারের শুষ্ক অঞ্চলে ভূ-গর্ভস্থ্য পানির ঘাটতি পূরনের পরিমান ওই অববাহিকার অন্যান্য অঞ্চলের চেয়ে তুলনামূলকভাবে অনেক কম। দেশটিতে পানির তীব্র সংকটে থাকা অঞ্চলে প্রায় ১০ মিলিয়ন মানুষ বসবাস করে থাকে।

আসন্ন নাগরিক সংকট

অদীতি মূখার্জি বলেন, একটি স্থায়িত্বশীল ভূ-গর্ভস্থ্য পানি ব্যবস্থাপনা নীতিমালা প্রনয়নে সবচেয়ে বেশি যেটি দরকার তা হচ্ছে পানির রিচার্জ ডেটার বিশ্লষণ। ভারতের যেসব শহর অত্যন্ত ঘনবসতিপূর্ণ এবং নানা প্রয়োজনে ওই শহরগুলো ভূগর্ভস্থ্য পানির উপরে নির্ভরশীল  – এই গবেষণায় বলা হয়েছে জলবায়ু পরিবর্তনের কারনে এমন স্থানগুলোতে প্রাকৃতিকভাবে জলাধার বা ভূ-গর্ভস্থ্য জলের উৎগুলের রিচার্জ বা ঘাটতি পূরণ বাঁধাগ্রস্থ হতে পারে।

ডব্লিউডব্লিউএফ-এর একটি সাম্প্রতিক গবেষণায় বলা হয়েছে আগামী ২০৫০ সাল নাগাদ এশিয়ার প্রায় ৮০টি বড় শহরে তীব্র পানির সংকট দেখা দেবে। এদের মধ্যে কেবল ভারতেই রয়েছে ৩০টি শহর। গঙ্গা-ব্রক্ষ্মপুত্র অববাহিকর কোলকাতা এই তালিকায় থাকা অন্যতম একটি শহর যেটি উচ্চ ঝুঁকির পর্যায়ে রয়েছে।

অদীতি মূখার্জি বলেন, আরো অনেক বড় বড় শহরের মতো কোলকাতা চারপাশ জুড়ে রয়েছে গঙ্গা নদী, বিভিন্ন জলাধার-জলাভূমি। ওয়াটার রিচার্জের জন্য এগুলো মূলত প্রাকৃতিক অবকাঠামো। আমাদের আসলে এই অসংখ্য জলাভূমিগুলোর ভূমিকা কী রয়েছে তা বুঝতে হবে এবং এদেও বাঁচাতে টেকসই ব্যবস্থাপনা গড়ে তুলতে হবে।

গাছপালা-উদ্ভিদের উপরে প্রভাব

তাপমাত্রা বৃদ্ধির কারনে ওয়াটার রিচার্জ হ্রাস পেলে বৃক্ষ বা উদ্ভিদের উপরে কী ধরনের প্রভাব পড়তে পারে সেটি নিয়েও এই গবেষণায় আলোকপাত করা হয়েছে। গবেষণা পরিচালনার সময় গবেষকরা ২০টি নদীর অববাহিকার বিভিন্ন স্থান নির্বাচন করেন যেগুলোর ৫০ শতাংশেরও বেশি এলাকা গাছপালা বেষ্টিত এবং সামান্য কিছু এলাকা বরফ আচ্ছাদিত।

সেখানে দেখা যায় শুষ্ক মৌসুমে কমপক্ষে ১৮টি নদী অববাহিকায় উদ্ভিদের বৃদ্ধি তাৎপর্যপূর্ণভাবে হ্রাস পেয়েছে।

উল্কা কেরাকার বলেন, গবেষণার এই বিশেষ অংশটি বিশ্লেষনের ক্ষেত্রে গঙ্গা-ব্রক্ষ্মপুত্র ও সিন্ধু অববাহিকাকে বাদ দেয়া হয়েছে কারন এই অঞ্চলে ব্যাপকভিত্তিতে কৃষিকাজ করা হয়। তবে এশিয়ার অন্যান্য নদী যেমন ইরাবতী, মেকং এবং আমু দারিয়া অববাহিকায় দেখা গেছে পানির প্রাপ্যতার অভাবে সেখানে উদ্ভিদের বৃদ্ধি হ্রাস পেয়েছে। এর ফলে সেখানে জীববৈচিত্র্য ও কৃষিক্ষেত্রে সৃষ্টি হয়েছে নানা উদ্বেগ।

প্রাকৃতিকভাবে সৃষ্ট সবুজায়নের ফলে যেসব যে অপরিহার্য বাস্তুসংস্থান সেবা পাওয়া যায় তা ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্থ্য হবে বলে সতর্ক করেছেন গবেষকরা।

আগামী ২১০০ সালের মধ্যে প্রাকশিল্প মাত্রার চেয়ে তাপমাত্রা ৫ সেলসিয়াস বৃদ্ধি পেতে পারেন বলেন বিজ্ঞানীদের অনেকেই মনে করেন। তবে পানির প্রাপ্যতার প্রশ্নে বহুমুখি চ্যালেঞ্জের আশংকা থেকেই যাচ্ছে। উল্কা কেলাকার মনে করেন, এক্ষেত্রে উল্লেখিত অববাহিকায় থাকা ক্রমবর্ধনশীল শহরগুলোর উচিত যত দ্রুত সম্ভব পরিবেশসম্মত পরিকল্পনার মধ্য দিয়ে বৃষ্টির পানি সংরক্ষন, বর্জ্যপানির ব্যবস্থাপনা অধিক বিনিয়োগ এবং শহরে প্রকৃতি-ভিত্তিক সমাধানের মাধ্যমে তাপমাত্রাকে সহনীয় পর্যায়ে রাখা।

অনুবাদ: আরিক গিফার

Privacy Overview

This website uses cookies so that we can provide you with the best user experience possible. Cookie information is stored in your browser and performs functions such as recognising you when you return to our website and helping our team to understand which sections of the website you find most interesting and useful.

Strictly Necessary Cookies

Strictly Necessary Cookie should be enabled at all times so that we can save your preferences for cookie settings.

Analytics

This website uses Google Analytics to collect anonymous information such as the number of visitors to the site, and the most popular pages.

Keeping this cookie enabled helps us to improve our website.

Marketing

This website uses the following additional cookies:

(List the cookies that you are using on the website here.)