ল্যান্ডসেট কাউন্টডাউন প্রতিবেদনটির পঞ্চম সংখ্যা প্রকাশিত হয় একই দিনে যেদিন বিশ্ব আবহাওয়া সংস্থা (ওয়ার্ল্ড ম্যাটিওরোলোজিক্যাল অর্গানাইজেশন) তাদের একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে। তাদের ওই প্রতিবেদনে বলা হয়, প্রাক-শিল্প সময়ের চেয়ে বর্তমানে পৃথিবী ১.২ ডিগ্রি সেলসিয়াস বেশি উত্তপ্ত। যেহেতু কোভিড-১৯ মহামারী চলমান, এই অবস্থায় ল্যান্ডসেট প্রতিবেদনে বলা হয়েছে যে গত ৫০ বছরে চিকিৎসা ক্ষেত্রে যে অগ্রগতি সাধিত হয়েছে কেবল জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবের কারনে সেই ধারা কিভাবে ব্যর্থতায় পরিনত হতে পারে।
সারা বিশ্বের ১২০ জনেরও বেশি বিশেষজ্ঞ মিলে এই প্রতিবেদনটি তৈরি করে। এবারের প্রতিবেদনে বৈশ্বিক ৪৩টি সূচক প্রদর্শণ করা হয়। এদের মধ্যে বেশ কয়েকটি সূচকের সাথে দক্ষিণ এশিয়ার গভীর সামঞ্জস্য ও গুরুত্ব রয়েছে। প্রতিবেদনে ভারতকে অন্যতম একটি উদ্বেগপূর্ণ দেশ হিসেবে দেখানো হয়েছে।
প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, গত ২০ বছরে তাপমাত্রা বৃদ্ধির ফলে সৃষ্ট স্বাস্থ্য সমস্যার কারনে ৬৫ উর্ধ্ব মানুষের মৃত্যু হার ৫৩.৭ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে। ২০১৮ সালে এই ধরনের জটিলতায় মানুষের মৃত্যু সংখ্যা ২৯৬,০০০ গিয়ে পৌছায়। কর্মদক্ষতা হ্রাস পাওয়ার ফলে ৩০২ বিলিয়ন কর্মঘন্টা নষ্ট হয় বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে।
জীবন ও জীবিকার বিচারে তাপপ্রবাহের ফলে সৃষ্ট ক্ষতির পরিমান কিন্তু ব্যাপক আর ভারতের জন্য এই ক্ষতির পরিমান একটি বড় উদ্বেগের বিষয়। প্রতিবেদনটিতে বলা হয়, ভারত ও ইন্দোনেশিয়া এ ধরনের ক্ষতিগ্রস্থ্য দেশগুলোর মধ্যে অন্যতম। এই দুটি দেশে কর্মদক্ষতা হ্রাস পাওয়ায় যে ক্ষতি হয়েছে তার পরিমান দেশ দুটির বার্ষিক জিডিপির ৪ – ৫ শতাংশের সমপরিমান।
এই ধরনের ক্ষয়ক্ষতি সবচেয়ে বেশি আক্রান্ত করে দেশের কৃষিখাতকে। যেখানে দেখা যায় এই সেক্টরে কাজ করা শ্রমিকদের প্রায়ই চাহিদার তুলনায় স্বল্প মজুরী প্রদান করা হয়। এর ফলশ্রুতিতে দেখা যায় কেবল দরিদ্ররাই সকল ক্ষয়ক্ষতি মোকাবেলায় সবচেয়ে বেশি ব্যয় করে অথচ এই ক্ষয়ক্ষতি সৃষ্টির পিছনে তাদের কোনো ভূমিকাই থাকেনা।
এই ক্ষতির প্রভাব কিন্তু বিভিন্ন দেশে ছড়িয়ে পড়ে। কিন্তু এলসিআর৫ প্রতিবেদনে বলা হয়, বার্ষিক জিডিপির উন্নয়নের মধ্য দিয়ে পরিস্থিতি স্বাভাবিক অবস্থায় থাকার পরেও দরিদ্র দেশগুলোতে ২০১৯ সালে জলবায়ু পরিবর্তন সৃষ্ট অর্থনৈতিক ক্ষয়ক্ষতির পরিমান ছিল স্বাভাবিক সময়ের চেয়ে পাঁচ গুন। এমনকি নিম্ন আয়ের দেশগুলোর সার্বিক ক্ষতির মাত্র ৫ শতাংশ বীমাকৃত থাকলেও উন্নত আয়ের দেশগুলোতে এই ক্ষতির প্রায় ৬০ শতাংশই ছিল বীমাকৃত।
এই সংখ্যা বা পরিমাপ নিম্নগামী হওয়ার ক্ষেত্রে তেমন কোনো আশা নেই। এলসিআর৫ প্রতিবেদনে বলা হয়, বিগত ২০১০ সালের পর থেকে ১০টি বড় তাপপ্রবাহের বছরের মধ্যে কমপক্ষে আটটি ভারতে সংঘঠিত হয়। যেহেত দক্ষিণ এশিয়া, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া এবং চীনে কার্বন নিগর্মনের মাত্রা বৃদ্ধির পাশাপাশি জীবাশ্ম জ্বালানীর ব্যবহার এখনও উর্ধ্বমুখী (অন্যান্য স্থানে অবশ্য এই ধারা নিম্নগামী), ফলে এটি পরিস্কার যে আগামী দিনগুলোতে উঞ্চায়ন প্রক্রিয়া আরো ত্বরান্বিত হবে।
২০১৭ সাল থেকে ২০১৮ সালের মধ্যে বিশ্বব্যাপী কয়লা ব্যবহারের মাধ্যমে জ্বালানী/বিদ্যুত উৎপাদন ১.২ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে। ২০১৪ সালে কয়লা ব্যবহারের মাত্রা যে উচ্চহারে পৌছেছিল তার চেয়ে বর্তমান সময়ে এর মাত্রা কম হলেও ১৯৯০ সাল থেকে বিবেচনা করলে বিদ্যুত উৎপাদনে কয়লার ব্যবহার ৭৪ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে। বৈশ্বিক কয়লা ব্যবহারকারী দেশগুলোর মধ্যে সবচেয়ে উপরে রয়েছে চীন। বিশ্বের সার্বিক কয়লা ব্যবহারের প্রায় ৫২ শতাংশই করে থাকে চীন। বলা যায় বিদ্যুত উৎপাদনে কয়লার ব্যবহার বৃদ্ধির সর্বাগ্রে রয়েছে চীন।
প্রতিবেদনে আরো বলা হয়, ২০১৮ সালে সারা বিশ্বে বায়ু দূষণের ফলে সাত মিলিয়ন মানুষ মৃত্যুবরণ করে । এদের মধ্যে কেবল ভারতে মারা যায় প্রায় পাঁচ লক্ষ। এদের মধ্যে কেবল বাসাবাড়িতে জ্বালানীসহ, বিদ্যুত উৎপাদন এবং কারখানায় কয়লা ব্যবহারের ফলে মৃত্যু হয় এক লক্ষ মানুষের।
নবায়নযোগ্য জ্বালানী নিয়ে সুসংবাদ
অবশ্য, এনিয়ে সব খবরই কিন্তু হতাশাব্যঞ্জক নয়। নবায়নযোগ্য জ্বালানী খাতে কিন্তু দিনকে দিন চাকুরীর সুযোগ বাড়ছে। অন্যদিকে জীবাশ্ম জ্বালানী খাতে এই ২০১৯ সালে এই পরিমান ছিল নবায়নযোগ্য জ্বালানী খাতের চেয়ে সামান্য বেশি (১১.৫ মিলিয়ন এবং ১২.৭ মিলিয়ন)। সড়কে এখন বৈদ্যুতিক গাড়ির সংখ্যাও বাড়ছে।
জনগনের চাহিদার কারনেই এই পরিস্থিতির উন্নতি হতে পারে। এলসিআর৫ এর তথ্য মতে, ২০১৮ এবং ২০১৯ সালে বিশ্বের ৩৬টি দেশের প্রধান প্রধান সংবাদপত্রে জলবায়ু সংক্রান্ত সংবাদ পরিবেশন বৃদ্ধি পায় ৭৪ শতাংশ। অপরদিকে জলবায়ু পরিবর্তন এবং স্বাস্থ্য সংক্রান্ত সংবাদ বৃদ্ধি পায় ৯৬ শতাংশ।
আসলে প্যারিস চুক্তি অনুযায়ি জলবায়ু এবং স্বাস্থ্য বিষয়ক সরকারসমূহের করা বিভিন্ন প্রতিশ্রুতির অংশ হিসেবে জনগনের এই বিষয়গুলোর কথা কিন্তু দেশের সরকারগুলো আগ্রহ নিয়ে শুনছে বলেই প্রতীয়মান হয়। সেকারগুলো এনিয়ে জরীপ চালিয়ে যাচ্ছে, নতুন নতুন নীতি প্রবর্তন করা হচ্ছে এবং স্বাস্থ্যখাতে ব্যয় বৃদ্ধির প্রবনতা দেখা যাচ্ছে। অবশ্য সার্বিকভাবে এইসব খাতে ব্যয়ের পরিমান এখনো অনেক কম।
এলডিসিআর৫ এর তথ্য মতে, ভারতের জনগণ প্রতি স্বাস্থ্য অভিযোজন খাতে ব্যয় ০.৮০ মার্কিন ডলার যা কিনা ২০১৫/১৬ সালে ছিল ০.৬০ মার্কিন ডলার।
এখনো পর্যাপ্ত নয়
তবে এই ইতিবাচক বিষয়গুলো এখনো যথেষ্ট নয়, এমনকি একটি গ্রহনযোগ্য মাত্রার কাছাকাছিও নয়। জলবায়ু পরিবর্তনের নেতিবাচক প্রভাবের মূ্ল্য যে কোনো কিছুর চেয়ে বেশি। প্রতিবেদনে বলা হয়, বিশ্বব্যাপী সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা কেবলমাত্র এক মিটার বৃদ্ধির ফলে সারা বিশ্বে প্রায় ১৪৫ মিলিয়ন মানুষ ক্ষয়ক্ষতির শিকার হবে। যে প্রক্রিয়ায় এই বৃদ্ধি অব্যাহত আছে তাতে গড়ে ৫ মিটার বৃদ্ধি পেলে ক্ষতিগ্রস্থ্য মানুষের সংখ্যা দাঁড়াবে ৫৬৫ মিলিয়ন।
এই অস্বাভাবিক স্থানচ্যুতির ব্যাপারে আক্রান্ত দেশগুলো কিন্তু এখনো প্রস্তুত নয়। উন্নত দেশের যেসব শহরগুলোতে জরীপ চালানো হয়েছে তাতে দেখা যায় তারা আসলে জলবায়ু পরিবর্তনসৃষ্ট দুর্যোগের ক্ষেত্রে অত্যন্ত ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে।
জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে সবচেয়ে ক্ষতির শিকার হচ্ছে কৃষি খাত। বৃষ্টিপাতের ধরনে পরিবর্তন এবং জলবায়ু পরিবর্তনের কারনে বছরের যে সময় ফসল পরিপক্ক হবার কথা সেটি হচ্ছে না। ভূট্টা, যব, ধান এবং সয়াবিনের ফলন দিন দিন খারাপ হচ্ছে। অথচ এসব ফসল স্বাস্থ্য এবং পুষ্টির জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
সরকারগুলো এনিয়ে বিচ্ছিন্নভাবে কাজ করে যাচ্ছে। স্বাস্থ্য, অভিবাসন, কৃষি বিষয়ে সমন্বিতভাবে কাজ করা প্রয়োজন। অথচ তারা ঠিক সেভাবে কাজ করছে না।
মনে করা হচ্ছে কোভিড-১৯ এসময়ে সবার জন্য একটি জাগানিয়া আহ্বান। একইসাথে এটি একটি সতর্কবার্তাও। বিশেষ করে জলবায়ুসৃষ্ট সংকটের ফলে নানা ধরনের রোগের প্রাদুর্ভাব হতে পারে (যেমন বর্তমান সময়ে মশার মাধ্যমে ডেঙ্গু রোগ অনেক বেড়ে গেছে)।
এলসিআর৫ প্রতিবদনের তথ্য মতে, করোনা মহামারীর কারনে কার্বন নির্গমন ৮ শতাংশ হ্রাস পেয়েছে। তবে দেশগুলো মহামারীর আগে যে অবস্থায় ছিল সেখানে ফিরে গেলে এই ইতিবাচক পরিস্থিতি থেকে কোনো উপকারই আহরণ করা সম্ভব হবে না।
প্রতিবেদনে জোর দিয়ে বলা হয়, বিশ্ব সম্প্রদায় বর্তমান মহামারীর এই পরিস্থিতিকে একটি ইতিবাচক সুযোগ হিসেবে কাজে লাগিয়ে যেন সবুজায়নের পথে হাটে। প্রশ্ন হচ্ছে, দেশের নীতিনির্ধারকরা আসলে এই বিষয়টি অনুধাবন করবেন কিনা।
ল্যানেসট প্রতিবদন সম্পর্কে মতামত জানতে চাইলে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রীর স্বাস্থ্য বিষয়ক টাস্ক ফোর্স-এর সদস্য এবং আগা খান বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্লোবাল হেলথ অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট এর পরিচালক জুলফিকার ভুট্টো বলেন, জলবায়ু পরিবর্তন পাকিস্তানের জনগনকে একটি ভয়ংকর হুমকির মধ্যে নিবদ্ধ করেছে। এর ফলে দেশটির ভবিষ্যত উন্নয়ন মারাত্বকভাবে বাঁধাগ্রস্থ্য হবে। একই সাথে আমি মনে করি এটি বিভন্ন ধরনের রোগের বিস্তার ঘটানোসহ বৈশ্বিক নিরাপত্তার ক্ষেত্রে একটি বড় ধরনের ঝুঁকি তৈরি করছে।