জলবায়ু

ব্রক্ষ্মপুত্র তীরের অশ্রুগাঁথা

স্থানীয়দের গানের সুর আর কথায় উঠে এসেছে বন্যার তোড়ে বাস্তুচ্যুত হওয়ার যন্ত্রণার দ্যোতনা। দ্য থার্ড পোল ব্রক্ষ্মপুত্র নদীর তীর ধরে ঘুরে তুলে এনেছে সেইসব গানের সুর আর তার পিছনের গল্প।

সঙ্গীত সবসময়ই সকল জনপদের রাজনৈতিক, সামাজিক, ভৌগলিক, ঐতিহাসিক, সাংস্কৃতিক এবং পরিবেশগত পরিবর্তনের ধারাবহিকতাকে আগলে রাখে।

সম্পাদকীয় বার্তা

এই মৌলিক প্রতিবেদনটি বন্যার কারনে বাস্তুচ্যুত হওয়া সম্প্রদায়ের গানগুলো নথিভুক্ত করার অভিপ্রায়ে বাস্তবায়িত আমাদের নেয়া প্রকল্পের প্রথম অংশ। সংগৃহীত গান শুনতে এখানে ক্লিক করুন:

জলবায়ু পরিবর্তনসৃষ্ট সংকট নিয়ে বিশ্বের অনেক সঙ্গীত শিল্পীই গান গেয়েছেন, যেমন বিলি ইলিস গেয়েছেন অল দ্য গুড গার্লস গো টু হেল, কেলি লি ওয়েনসের মেল্ট অথবা অ্যান্থনি গেয়েছেন ফোর ডিগ্রি।  

 ভারতের উত্তর-পূর্বের রাজ্য আসামের স্থানীয় সঙ্গীত শিল্পীরাও গানের মাধ্যমে তাদের জীবনে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে  নেমে আসা দূর্দশার কথা ব্যক্ত করেন। দ্য থার্ড পোলের পক্ষ থেকে ব্রক্ষ্মপুত্র অববাহিকায় ঘুরে করে এমন সব গানই সংগ্রহ করা হয়েছে।

আসাম ও জলবায়ু পরিবর্তন

জলবায়ু পরিবর্তনের মারাত্বক প্রভাবে বিপর্যস্ত ভারতের উত্তর-পূর্ব রাজ্যের আসাম। এই রাজ্যের প্রায় বেশিরভাগ অংশই ব্রক্ষ্মপুত্র নদীর অববাহিকা জুড়ে বিস্তৃত। এটি এমন একটি নদী যার গভীরতা ও প্রশস্ততা ঐতিহাসিকভাবে বহুবার পরিবর্তিত হয়েছে। এখন জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে নদীটিতে বন্যার ভয়াবহতা অতীতের যে কোনো সময়কে ছাড়িয়ে গেছে, অন্যদিকে পাল্লা দিয়ে বেড়েছে নদী ভাঙ্গন। এর কারন হচ্ছে উজানের বাঁধগুলোতে পলি বাধা পড়ে নদীটি আগের মতো আর পলি বহন করতে পারছে না ।

আর সাম্প্রতিক এই সমস্যাগুলো যুক্ত হয়েছে এই নদীতে ঘটে যাওয়া ঐতিহাসিক ভয়াবহ এক বিপর্যয়ের পর যা কিনা এই নদীর ভূসংস্থানকে পাল্টে দেয় রাতারাতি। সেটি হচ্ছে ১৯৫০ সালে ঘটে যাওয়া ৮.৭ মাত্রার একটি ভূমিকম্প। এর ফলে এই নদীর তীরে বসবাস করা বিশাল সংখ্যক মানুষকে বাস্তুচ্যুত হয়ে অন্যত্র স্থানান্তরে বাধ্য করে, যার মাত্রা এখন আরো বেড়েছে। আর এই দুর্দশার কথা অবধারিতভাবে এখানকার শিল্পের মাধ্যমে বর্ণীত হয়েছে, বিশেষ করে সঙ্গীতের মধ্য দিয়ে। ব্রক্ষ্মপুত্র পাড়ের বাসীন্দাদের গানে তাই উঠে এসেছে ঘরবাড়ি আর জীবিকা হারানোর তীব্র বেদনা। 

বাস্তুচ্যুতদের গান

শুনেন হিন্দু  মুসলমান/বলি একটি দু:খের গান/ব্রক্ষ্মপুত্র ভাইঙ্গা নিল তারাবারি গ্রাম

 ৭২ বছরের বৃদ্ধ মঈনুল ভূইয়ার কন্ঠে গাওয়া এই গানটির শুরুতেই যে সমস্যাটির কথা উঠে এসেছে তা সেই এলাকার হিন্দু-মুসলিম নির্বিশেষে সবাইকে তাড়িত করেছে। এই গানটিতে মঈনুলের গ্রাম তারাবাড়ির কথা উঠে এসেছে যে গ্রামটি প্রলয়ংকারী এক ভূ-কম্পনের কারনে সৃষ্ট বন্যায় তোড়ে ভেসে  যায়।

 জানতে চাইলে মঈনুল বলেন, ১৯৫০ সালের আগে এই এলাকাটি ছিল একটি বিখ্যাত বাণিজ্যিক কেন্দ্র। এটি ছিল একটি ঐতিহ্যবাহী পোতাঙ্গন। ব্যবসা বাণিজ্যের অন্যতম কেন্দ্র হওয়ায় এখানে বড় বড় জাহাজ এসে ভিড়ত। আমরা মূলত সেখানে পাটের ব্যবসা করতাম।

ভিডিওচিত্র: চন্দ্রানী সিণহা/দ্য থার্ড পোল

বর্তমানে আসামের বড়পেটা জেলাতেই ছিল তারাবাড়ির অবস্থান। এখানে সেসময় একটি স্কুল ছিল। আর ছিল একটি করে কলেজ, লাইব্রেরি, হাসপাতাল, বেশ কয়েকটি মন্দির ও মসজিদ, পুলিশ স্টেশন এবং খেলার মাঠ। বানের তোড়ে আজ ভেসে গেছে সব। এখানে বসবাস করা বাসিন্দারা এখন এই রাজ্য ও রাজ্যের বাইওর বিভিন্ন এলাকায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে গেছে – বেঁচে থাকার তাগিদে।

সেখানকার আরেক সাবেক বাসিন্দার নাম মোশাররফ করীম। তিনি এখন বরপেটায় একটি মুসলিম স্কুলে (মাদ্রাসা) শিক্ষকতা করেন। তিনি বলেন, নদী গর্ভে আমাদের গ্রামটি বিলীন না হলে হয়ত আজ আমায় এই ছোট একটি স্কুলে কাজ করতে হতো না।

ভিডিওচিত্র: চন্দ্রানী সিণহা/দ্য থার্ড পোল

মিসিংদের সুর

ব্রক্ষ্মপুত্র পাড়ের এক আদিবাসী জনগোষ্ঠীর নাম মিসিং। যতদুর মনে পড়ে তারা বহু যুগ ধরে এখানেই বসবাস করে আসছেন বলে দ্য থার্ড পোলকে জানান সেখানকার বাসিন্দারা। নদীজন বা নদী পাড়ের মানুষ নামে পরিচিত এই জনগোষ্ঠীর সংখ্যা প্রায় ৭ লাখ। শত শত বছর ধরে নদীর তীরে বসবাস করায় তারা রপ্ত করেছে কিভাবে বন্যা মোকাবেলা করতে হয় আর বালুতীরে বা চরে ঘর বানিয়ে বাঁচতে হয়। এদের বাড়ি তৈরি হয় বাঁশ দিয়ে যা অতি সহজেই প্রয়োজনমতো নির্মান করা যায়। কিন্তু আদিবাসী এই জনগোষ্ঠীর এখনকার সমস্যা হচ্ছে নদী ভাঙ্গন, তাদের ভাষায় – যেন মনে হয় তাদের পায়ের তলা থেকে মাটি সরে  যাচ্ছে।

মিসিং সম্প্রদায়ের অনেকেই ব্রক্ষ্মপুত্রের বুকে জেগে ওঠা দ্বীপ মাজুলিতে বসবাস করে। এই দ্বীপ বা চরটি প্রতি মুহুর্তে এখন ভাঙ্গনের শিকার হচ্ছে। এখানকার এক বাসিন্দা ৫৫ বছরের নীলামণি য়াংতে। তিনি জানান কীভাবে তার আত্মীয়-স্বজন ও প্রতিবেশীরা ভাঙ্গনের শিকার হয়ে বাস্তুচ্যুত হয়ে মূল ভূখন্ডে স্থানান্তরিত হয়। ব্রক্ষ্মপুত্রের করাল গ্রাসে তারা সবাই নিজিদের বসতভিটা আর ফসলী জমি হারান।

তিনি বলেন, নদীতীরের বাসিন্দা হিসেবে আমরা দেখেছি প্রচন্ড বাতাস বা ঝড়, ভারী বর্ষণ আর বন্যা। সেই সময় আমাদের পিতামহরা আমাদের সুরক্ষার ব্যবস্থা করতেন। তারপরেও আমরা প্রাকৃতিক দুর্যোগের সময় ভীত সন্ত্রস্ত থাকতাম। তখনকার সেই ভয়াল মুহুর্তগুলো আমাদের স্মৃতিতে এখনও ভাস্বর। তার গানে ব্রক্ষ্মপুত্র তীরের মানুষের সাথে বন্যার সখ্যতার বিষয়টিতে প্রবলভাবে উঠে এসেছে।

ভিডিওচিত্র: চন্দ্রানী সিণহা/দ্য থার্ড পোল

 মিসিং সম্প্রদায়ের মতোই আরেক আদিবাসী সম্প্রদায়ের নাম দেওড়ী। বন্যায় তাদের একটি গোত্র পুরোপুরি ভেসে যায়। সেদিনের সেই ঘটনা আজও তাদের মনকে কাঁদায়। ইন্ডিয়ান দেওড়ীর বয়স ৪৫ বছর। দ্য থার্ড পোলকে তিনি বলেন, আমরা সাদিয়া থেকে এখানে স্থানান্তরিত হই বন্যার কারনে। দেওড়ী সম্প্রদায়ের মধ্যে অনেকগুলো গ্রোত্র রয়েছে। বন্যার পরে অন্যত্র যাওয়ার সময় তাদের একটি গোত্র পুরোপুরি হারিয়ে যায়।

তার গাওয়া গানটিতে রয়েছে প্রণয়ের সুর। গানটিতে বন্যা আর ভাঙ্গনে হারিয়ে যাওয়া প্রিয় মানুষটিকে না পওায়ার বেদনা ফুটে উঠেছে।

ভিডিওচিত্র: চন্দ্রানী সিণহা/দ্য থার্ড পোল

ইউনানের সেই মানুষগুলো

শত শত বছর আগে চীনের ইউনান প্রদেশ থেকে তাই ফাকে সম্প্রদায় পূর্ব আসামের নাহারকাতিয়ায় বসবাসের জন্য আগমন করে। রাজ্যের একমাত্র বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের বাস বুড়ি দিহাইং নদীর তীরে। এটি ব্রক্ষ্মপুত্রের অন্যতম একটি শাখা নদী। কিন্তু অস্বাভাবিক ভাঙ্গনের ফলে নাম ফাকে গ্রামের সবচেয়ে পুরোনো মঠের প্রাচীরের কাছাকাছি পৌছে গেছে নদী।

 অম শ্য চ্যখাপ (৬০) এখানকারই বাসিন্দা। তিনি জানান ভারতে তাই ফাকে সম্প্রদায়ের আগমন মূলত থাইল্যান্ড থেকে। তারা থাইল্যান্ড থেকে এই অঞ্চলে আসেন কারণ এখানকার ভূমি কৃষির জন্য অনেক উর্বর। তিনি বলেন, আমার স্পষ্ট মনে আছে সেইসব দিনের কথা যখন বন্যার তোড়ে আমাদের গ্রামের একটি অংশ হারিয়ে যায়। আর এখন নদী তার গতি পরিবর্তন করে অন্যদিক দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। আর আমরা এখানে নদীর পলি জমতে  দেখছি। আবার একথাও সত্য যে এই নদীর কাছে আমরা নানাভাবে ঋনী। এটি আমাদের সংস্কৃতিরই একটি অংশ। তবে নদীর এই অভাবনীয় প্রভাবের ফলে আমাদের সম্প্রদায়ের অনেকেই বাস্তুচ্যুত হয়ে বিভিন্ন যায়গায় স্থানান্তরিত হয়েছে।

ভিডিওচিত্র: চন্দ্রানী সিণহা/দ্য থার্ড পোল

চা বাগানের আদিবাসি

১৯শ’ শতকে তৎকালীন বৃটিশ শাসকরা ভারতের বিভিন্ন স্থান থেকে মানুষদের জড়ো করে চা বাগানে কাজ করার জন্য আসামে নিয়ে আসে।  বিভিন্ন স্থান থেকে আসা এই জনগােষ্ঠীরা এখন চা সম্প্রদায় নামেই সমধিক পরিচিত। ভাদ্রা রাজওয়ার দিখোও নদীর তীরে নাজিরাে গ্রামে বসবাস করেন। এই নদীটিও ব্রক্ষ্মপুত্র নদীর একটি শাখানদী। তার গানে রয়েছে জলবায়ু পরিবর্তনের গল্প, রয়েছে তার মতো কিছু চা শ্রমিকের গল্প যারা নিজেরাই চাষাবাদ করতে চেয়েছিল আর বন্যার তোড়ে তাদের সেই স্বপ্নের আবাদ ভুমি ভেসে যাওয়ার গল্প। একদিকে বন্যায় তারা তাদের জমি হারায় আর অন্যদিকে কাঁধে বইতে হয় ঋণের বোঝা কারন অর্থ ঋণ নিয়েই তারা তাদের জমি চাষ শুরু করেছিল।

রাজওয়ার বলেন, আমাদের চোখের সামনেই অনেক চা বাগান বন্যায় ভেসে যায়। এটি আসলে আমাদের সম্প্রদায়ের জন্য বিশাল ক্ষতির  কারন হয়ে দাঁড়ায়।

ভিডিওচিত্র: চন্দ্রানী সিণহা/দ্য থার্ড পোল

আরেকটি ভাষা, একই দু:খগাঁথা

৫৫ বছর বয়স্ক খগেন সন্ন্যাসী স্থানীয় এক রেডিও স্টেশনে বাংলায় গান গেয়ে থাকেন। তার গানের কথায় রয়েছে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব আর অপ্রত্যাশিত বন্যার ফলে হাজার হাজার মানুষের দরিদ্র থেকে দরিদ্রতর হওয়ার গল্প।

গুয়াহাটি থেকে ১০০ কিলোমিটার পূর্বে মরিগাও জেলার ছোট একটি গ্রাম ভুরাগাওয়ে বাস করেন খগেন সন্ন্যাসী। তিনি জানান তার পরিবার যে জমির মালিক ছিল সেটি এখন নদী গর্ভে।

বৃক্ষ্মপুত্রের দিকে তাকিয়ে তিনি বলেন, এটি আসলে একটি উন্মত্ত নদী। প্রতিবছর এই নদী আমাদেরকে দরিদ্র থেকে আরো দরিদ্রতর করার পরিকল্পনা করে। তার গানে তিনি এখানে বসবাসরত মানুষের দু:খের কথা এবং নদীগর্ভে বিলীণ হয়ে যাওয়া বিভিন্ন স্থানের নামগুলো তুলে ধরেন।

ব্রক্ষ্মপুত্রের এক শাখা নদী দিখোও। তারই তীর ধরে গড়ে উঠেছে নাজিরা গ্রাম। এই গ্রামের বাসিন্দা চা শ্রমিক নেতা ভাদ্রা রাজওয়ার। তার গানের কথা রয়েছে বন্যায় এখানকার মানুষের দু:খের কথা আর তার মতো অনেক প্রান্তজন কৃষকের জীবিকা হারানোর বেদনার সুর। 

ভিডিওচিত্র: চন্দ্রানী সিণহা/দ্য থার্ড পোল

অনুবাদ: মোর্শেদা আক্তার পরী

FacebookTwitterWhatsAppLinkedInWeChat

Add a comment

Privacy Overview

This website uses cookies so that we can provide you with the best user experience possible. Cookie information is stored in your browser and performs functions such as recognising you when you return to our website and helping our team to understand which sections of the website you find most interesting and useful.

Strictly Necessary Cookies

Strictly Necessary Cookie should be enabled at all times so that we can save your preferences for cookie settings.

Analytics

This website uses Google Analytics to collect anonymous information such as the number of visitors to the site, and the most popular pages.

Keeping this cookie enabled helps us to improve our website.

Marketing

This website uses the following additional cookies:

(List the cookies that you are using on the website here.)