<p>নিজের পালিত দু&#8217;টি ছাগল ছানার সাথে সীমা। সীমার বাড়ি বাংলাদেশের জামালপুর জেলার চর শুভগাছা। এবছর তাকে আর এই ছাগলগুলো বড় হবার আগেই স্বল্প মূল্যে বিক্রি করতে হবে না, কারণ বর্ষা মৌসুমে বন্যার পানি থেকে তাদের গৃহপালিত পশুদের রাখার জন্য এবার নিজের বাড়ির উঠোনের একটি অংশ নতুন ভাবে উঁচু করেছেন যাতে বন্যায় এদের কোনো ক্ষতি না হয় (ছবি: মোহাম্মদ আব্দুস সালাম/দ্য থার্ড পোল)</p>
জলবায়ু

ভাঙ্গাগড়ার জীবনে স্বপ্ন টিকিয়ে রাখার অদম্য প্রচেষ্টায় চরের মানুষ

অভিযোজনের নতুন নতুন প্রচেষ্টায় আশার আলো ব্রহ্মপুত্রের চরের হাজারো মানুষের মনে
বাংলা

সত্তর বছরের সুখী বেগম জীবনে মাত্র কয়েকবারই সুখের মুখ দেখেছেন। গত ৫০ বছরে প্রমত্তা ব্রক্ষ্মপুত্রের বন্যা আর নদী ভাঙ্গনে সাত বার নিজের ভিটে-মাটি হারিয়েছেন সুখী বেগম। পাঁচ সন্তানের জননী সুখী বেগম এখনও নদীর বুকে জন্ম নেয়া এক ধরনের দ্বীপে বসবাস করেন যার স্থানীয় নাম চর। এই চরে নিজের ঘর থাকলেও মনে সব সময়ই ভয় কখন আবার বন্যার পানিতে সব হারিয়ে যায়। আর সেজন্যই তার মতো হাজারো চরবাসী নতনু নতুন কৌশল অবলম্বন করছে নদীকেন্দ্রীক বিপদ থেকে বাঁচার জন্য। হয়ত এই প্রচেষ্টার মধ্য দিয়েই তারা স্বপ্ন দেখেন আগামীর।

Sukhi Begum with her 50-year-old daughter Bani Begum in the background at her home in Pakuar Char, Jamalpur, Bangladesh
বাংলাদেশের জামালপুরের পাকুয়ার চরে নিজ বাড়ির পিছনে মেয়ে বানী বেগমের (৫০) সাথে সুখী বেগম। ২৪ এপ্রিল, ২০২২ (ছবি: মোহাম্মদ আবদুস সালাম/ দ্য থার্ড পোল)

“প্রায় ৫০ বছর আগে আমরা সারিয়াকান্দির পাকুয়ার চরে গিয়ে বসত গড়েছিলাম (সারিয়াকান্দি বাংলাদেশের উত্তরের জেলা বগুড়ার অন্তর্গত)। সেই দিনটির কথা আমার এখনও স্পষ্টভাবে মনে পড়ে যেদিন প্রথমবারের মতো নদী ভাঙনের কারনে আমাদের ঘরবাড়ি ভিটেমাটি হারিয়ে অন্যত্র চলে যেতে হয়েছিল। সেখানে নতুন জীবনের আশায় আমরা ঘর বেঁধেছিলাম, কিন্তু প্রমত্তা এই নদী বার বার আমাদের ঘর-বাড়ি ভাসিয়ে নিয়ে গেছে।”

সুখী বেগম এখনও অন্য কোথাও গিয়ে আবারো নতুন করে বসত গড়তে চান না। বন্যা সব কিছু ভাসিয়ে নিয়ে য়ায় সেটা যেমন জানেন সুখী বেগম, তেমনি এটাও বোঝেন যে এই বন্যার পানি সুদূর হিমালয় থেকে পলি বয়ে এনে এই চরগুলোকে একটি উর্বর ভূমিতে রুপান্তর করে। “আমি এই চরের মাটিতেই জন্ম গ্রহন করেছি, আর এই চরের বুকেই শেষ নি:শ্বাস ত্যাগ করতে চাই।”

যেভাবে ব্রহ্মপুত্রের বুকে সৃষ্টি হয় চর

ব্রহ্মপুত্র নদ বিশ্বের অন্যতম সর্বোচ্চ পলি বহনকারী একটি নদী এবং এর পলি পরিবহনের গতিশীলতা উত্তর-পূর্ব ভারত এবং ভাটিতে অবস্থিত বাংলাদেশের বাস্তুতন্ত্র এবং কৃষিকে মারাত্বকভাবে প্রভাবিত করে।

ঢাকা-ভিত্তিক সেন্টার ফর এনভায়রনমেন্টাল অ্যান্ড জিওগ্রাফিক ইনফরমেশন সিস্টেমের (সিইজিআইএস) নির্বাহী পরিচালক মালিক ফিদা এ খান বলেন, “প্রতি বছর প্রায় ৫৫০ থেকে ৬০০ মিলিয়ন টন পলি উজান থেকে ব্রহ্মপুত্র নদের মাধ্যমে আমাদের দেশে আসে। উজান থেকে আসা পলির সবটুকুই বঙ্গোপসাগরে গিয়ে পতিত হয় না। এর একটি অংশ নদীল বুকে জমে সৃষ্ট করে ছোট বড় অনেক চর।

ফিদা এ খান বলেন, ব্রহ্মপুত্র ও এর উপনদীর বাংলাদেশের অংশে প্রায় ৫০টি ছোট-বড় চর রয়েছে। এছাড়াও এখানে আরো প্রায় ২০ থেকে ২৫টি ডুবো চর রয়েছে।

ব্রক্ষ্মপুত্র নদীটি বাংলাদেশে প্রবেশ করে এক পর্যায়ে যমুনা নাম ধারণ করেছে। এই নদীটি ঠিক যেভাবে বছর বছর বন্যায় অনেক চর ধ্বংস করে আবার হাজার ক্রোশ দুর থেক পলি বয়ে এনে চরের বুকে জমিয়ে নতুন নতুন চরের জন্ম দেয়। ঠিক যেমনটি ঘটেছে পাকুয়ার চরের একপাশে। সেখানে পাটের আবাদ করেছেন ৩৪ বছরের যুবক জিয়াউর রহমান। পেশায় কৃষক জিয়াউর রহমান ভালো করেই জানেন যে জুন থেকে সেপ্টেম্বর মাসের এই বর্ষা মৌসুমে যে কোনো সময় বন্যার কারনে তার এই ফসল তলিয়ে যেতে পারে। তিনি তার বাড়িটি কিছুটা দুরে গিয়ে অনেকটাই স্থায়ী একটি চরে সরিয়ে নিয়ছেন। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে বন্যার মাত্রা বেড়ে যাওয়ায় এভাবেই এক স্থান থেকে অন্য স্থানে বসত বাড়ি সরিয়ে নেয়াটা এক ধরনের অভিযোজনের অংশ এখানকার মানুষের।

Char Kawamara, Sharishabari, Jamalpur, Bangladesh
চর কাউয়ামারা, সরিষাবাড়ি, জামালপুর, বাংলাদেশ (ছবি: মোহাম্মদ আব্দুস সালাম/দ্য থার্ড পোল)
Sand-filled bags on the banks of Pakuar Char to prevent river erosion
নদী ভাঙন ঠেকাতে পাকুয়ার চরে নদীর তীর ধরে বালু ভর্তি ব্যাগ (ছবি: মোহাম্মদ আব্দুস সালাম/দ্য থার্ড পোল)

অভিযোজন প্রতি বর্ষায়

ব্রক্ষ্মপুত্রের চরে বাস করা মানুষগুলো ভালো করেই জানে যে প্রতি বর্ষা মৌসুমেই বালু আর পলিতে  গড়া অপেক্ষাকৃত নিচু এই সব দ্বীপের বিরাট অংশ বন্যার পানিতে তলিয়ে যায় – এর জন্য বড় ধরনের কোনো বন্যার প্রয়োজন হয় না, সামান্য বন্যাতেই এখানকার নিচু অংশগুলো ডুবে যায়। তাই এখানকার বাসিন্দাদের অনেকেই নিজেদের মাটির ঘরগুলোকে নিজেদের সাধ্যমতো ভূমি থেকে কিছুটা উঁচু করে তৈরি করে থাকে। পাশাপাশি তারা তাদের বাড়ির ভিতরের বিছানাগুলো হ্যামকের মতো দড়ি দিয়ে বেঁধে ঝুলিয়ে রাখে। তক্তাগুলোকে একসাথে হাতুড়ী দিয়ে পিটিয়ে মাঁচার মতো করে সমান উচ্চতায় রাখা হয়। আর বন্যার পানি নিজেদের ঘরের মেঝেতে পৌছে গেলে তারা এভাবেই বসবাস করে থাকে।

child laying in hanging bed: Hanging a bed like a hammock to keep it above the floodwaters is a widespread practice
জামালপুরের শুভগাছা চরে বন্যার সময় পানির থেকে বাঁচতে হ্যামোকের মতো করে এভাবে দড়ি দিয়ে বিছানা ঝুলিয়ে রাখার কৌশলটি সেখানকার মাসুষের কাছে এখন বেশ জনপ্রিয় (ছবি: মোহাম্মদ আব্দুস সালাম/ দ্য থার্ড পোল)

কিন্তু অস্বাভাবিক বন্যা হলে পানি আরো উচ্চতায় পৌছে যায়। তাই প্রায় প্রতিটি বাড়িতেই কলা গাছের কাণ্ড কেটে তারা এক ধরনের ভেলা বানিয়ে রাখে যাতে প্রবল বন্যার সময় তারা সেই ভেলাতে আশ্রয় নিতে পারে। মাঝে মাঝে ভেলায় ভেসে তাদের দিনের পর দিন বসবাস করতে হয়। অপেক্ষাকৃত স্বচ্ছল পরিবারগুলো বন্যার সময় পানিতে বাড়ি ডুবে গেলে নিজেদের নৌকায়  বসবাস করে। এসময় বাড়ি-ঘর, রাস্তাঘাট, বাজার – সবই থাকে পানির নিচে।

Before building their homes, char residents raise the earthen foundations as high as they can afford to in an effort to keep their homes safe during floods – Char Shubhagacha, Jamalpur (Photo: Mohammad Abdus Salam/The Third Pole)
চরে বাড়ি তৈরীর সময় সেখানকার বাসিন্দারা মাটি দিয়ে উঁচু ভিত তৈরী করে নিজেদের সাধ্যমতো যাতে বন্যার সময় বাড়ির সামনে পানি এলেও নিজেদের ঘর কিছুটা উঁচুতে থাকে। (শুভগাছা চর, জামালপুর থেকে ছবিটি তুলেছেন মোহাম্মদ আব্দুস সালাম/দ্য থার্ড পোল)

“যখন বন্যার পানিতে আমাদের ঘরবাড়ি তলিয়ে যায়, আমরা তখন ঘরের ভিতরে মাঁচা বানিয়ে কিংবা নৌকা বা ভেলায় বসবাস করি। যখন পরিস্থিতি খুব খারাপ হয়ে যায়, তখন প্রাণ বাঁচাতে চরের বাসিন্দারা (সরকার পরিচালিত) আশ্রয় কেন্দ্রে ছুটে যায়। তবে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই আমাদের মতো সহায় সম্বলহীন মানুষগুলো নিজেদের যা কিছুই আছে তা রেখে আশ্রয় কেন্দ্রে যেতে চায় না, বলছিলেন জিয়াউর।

চরের প্রায় প্রতিটি বাড়িতেই একটি বিষয় খুব চোখে পড়ে, বিশেষ করে দরিদ্র পরিবারগুলোতে – আর সেটি হচ্ছে একটি পানি নিরোধক বাক্স। বন্যার সময় চরের বাসিন্দারা তাদের জমির দলিলপত্রসহ অন্যান্য প্রয়োজনীয় কাগজপত্র পলিথিন দিয়ে মুড়িয়ে এই বাক্সের ভিতরে রেখে দেয় যাতে পানিতে তা ক্ষতিগ্রস্ত না হয়।

There is one watertight box in every home to keep legal and other important documents safe from floodwaters – Char Damodarpur, Jamalpur
চরে প্রায় প্রত্যেকটি পরিবারেই একটি করে পানি নিরোধক বাক্স থাকে যাতে বন্যার সময় তারা নিজেদের গুরুত্বপূর্ণ দলিল দস্তাবেজসহ অন্যান্য নথিপত্র নিরাপদে রাখতে পারে। (দমোদরপুর চর থেকে দ্য থার্ড পোলের জন্য ছবিটি তুলেছেন মোহাম্মদ আব্দুস সালাম)

চরে সবচেয়ে বড় অভিযোজনের বিষয়টি দেখা যায় কৃষির ক্ষেত্রে। পাশেই আরেক চর শুভগাছার মোজাম মণ্ডল বলেন, আমাদের এখানকার চাষীরা এখন বন্যার পানি সহায়ক ভূট্টার চাষ শুরু করছে। “এই বছর আমি প্রায় এক একর জমিতে (০.৪ হেক্টর) ভূট্টার চাষ করে বাম্পার ফলন পেয়েছি।”

“আমরা আসলে চরে ভূট্টা চাষে বেশ আগ্রহ বোধ করছি কারণ এই ফসল বিক্রি করে আমরা ন্যায্য মূল্য পাচ্ছি। অন্যান্য ফসল  বিক্রি করে আমরা যে মুনাফা পাই তার চেয়ে ভূট্টা চাষে মুনাফা অনেক বেশি। আমি এবছর প্রতি মন ভূট্টা (৩৭.৩২ কেজি) ১,৩০০ টাকায় (১৫ মার্কিন ডলার) বিক্রি করেছি”, সরিষাবাড়ি  উপজেলার অন্তর্গত চর দৌলতপুরের কৃষক মোজাম্মেল হক দ্য থার্ড পোলের কাছে এ মন্তব্য করেন।

Maize is widely cultivated on Char lands on the Brahmaputra riverbed in Bangladesh - Char Shubhagacha, Jamalpur
বাংলাদেশের ব্রক্ষ্মপুত্র নদীর চরগুলোতে ব্যাপকভাবে ভূট্টার চাষ করা হয়। (ছবিটি জামালপুরের শুভগাছা চর থেকে তোলা। দ্য থার্ড পোলের জন্য ছবিটি তুলেছেন মোহাম্মদ আব্দুস সালাম)

বন্যার সময় গৃহপালিত পশুদের কী অবস্থা হয়? জানতে চাইলে মোজাম বলেন, আসলে নিজেদের পাশাপাশি বন্যার সময় তৈরি করা ভেলাগুলোতে গৃহপালিত পশুগুলোকেও একসাথে রাখা হয়। চরবাসীরা শুকনো চালের বিভিন্ন ধরনের খাদ্য সাথে রেখে থাকেন। বন্যার সময় কোনো ঘাসময় জমি পাওয়া পর্যন্ত এসব গৃহপালিত পশু অনেকটাই না খেয়ে থাকে।

উঁচু ভীতে ঘর বেঁধে স্বপ্নের বুনন

এমিলি বেগম (৫০) জানতেন তার পরিবার ভিত উঁচু করে ঘর বাঁধতে সক্ষম নয়। কিন্তু ২০২১ সালে সরকারী উন্নয়ন সংস্থা পল্লী কর্ম সহায়ক ফাউণ্ডেশনের পক্ষ থেকে তাদের  ঘর উঁচু করে বাঁধার জন্য সহায়তা দেয়া হয়। এখন তার মনে হচ্ছে তার পরিবার এখন আগের চেয়ে অনেকটাই নিরাপদ।

“আগে বন্যার সময় আমাদের গৃহপালিত পশুগুলোকে নিরাপদে রাখার মতো জায়গা না থাকায় অত্যন্ত স্বল্প মূল্যে এসব পশু বন্যার আগে আগে বাজারে বিক্রি করতে হতো”, এমিলি বলেন। কিন্তু এখন ঘরের ভীত আরো উঁচু হওয়ায় সেখানে নিজেদের ছাগলসহ অন্যান্য গৃহপালিত পশুগুলোকে সহজেই নিরাপদে রাখা সম্ভব। “এখন আর আমাদের বন্যার সময় স্বল্প মূল্যে ছাগলগুলোকে বিক্রি করার প্রয়োজন পড়ে না।”

A scheme helps build a raised goat pen to keep the animals safe during floods in Char Shubhagacha, Jamalpur
চরের বাসিন্দাদের জন্য নেয়া এই প্রকল্পের মাধ্যমে জামালপুরের চর শুভগাছায় বন্যার সময় ছাগলসহ অন্যান্য গৃহপালিত পশুদের নিরাপদ রাখতে এই ধরনের উঁচু ভীত তৈরি করা হয়। (ছবি: মোহাম্মদ আব্দুস সালাম/ দ্য থার্ড পোল)

এসব উঁচু ভীতগুলো অনেক সময় বেশ প্রশস্ত হয় যেখানে চরের বাসিন্দারা ফলমূল ও শাকসব্জি চাষ করতে পারে। “আমি এবার আমাদের বাড়ির উঁচু ভীতে লাউ চাষ করে ১,৪০০ টাকা (১৬ মার্কিন ডলার) আয় করেছি”, এই চরের আরেক বাসিন্দা সীমা বেগম বেশ উচ্ছ্বসিত হয়ে এ কথা বলেন। “আমি এবার পেঁপে বিক্রি করে আরো টাকা আয় করবো। আমার গাছের ফলগুলো এখন পাকতে শুরু করেছে।”

পিকেএসএফের এক্সটেন্ডেড কমিউনিটি ক্লাইমেট প্রজেক্টের সমন্বয়ক ফরিদুর রহমান বলেন, এই প্রকল্পের মাধ্যমে ৮৭টি পরিবারকে জলবায় সহায়ক উঁচু ভীতের বাড়ি তৈরীর জন্য আর্থিক সহায়তা প্রদান করা হয়েছে। তবে এটি পর্যাপ্ত নয় কারন এসব চরে অসংখ্য দরিদ্র পরিবারের বসবাস।

ডুবে যাওয়া টিউবওয়েল আর টয়লেটের সুরক্ষা

বন্যার সময় চরের টিউবঅয়েলগুলো একেবারেই যুবে যায়। এসব টিউবঅয়েল চরবাসীর খাবার পানির উৎস। আর প্রতি বর্ষায় এসব চরে পানির প্রচন্ড স্বল্পতা থাকে। কিন্তু বর্তমান সময়ে এখানকার পয়:নিষ্কাশন ব্যবস্থার বেশ উন্নয়ন হয়েছে – সরকারী সহায়তায় গড়ে তোলা এসব টয়লেট এখন উঁচু ভীতের উপরে স্থাপন করা হচ্ছে। এখন আর আগের মতো এসব টয়লেট বন্যার সময় পানিতে তলিয়ে যায় না।

মাদারগঞ্জের নদঘরি চরের আফরোজা বেগম বলেন, “আগে বন্যার সময় আমাদের টয়লেট আর টিউবঅয়েলগুলো পানিতে ডুবে যেত। এখন আমরা এই টয়লেট আর টিউবঅয়েল উঁচু ভীতের উপরে স্থাপন করছি। আমাদের বিশ্বাস ভবিষ্যতে বন্যার সময় আমাদের আর পানি এবং পয়:নিষ্কাশন নিয়ে সমস্যায় পড়তে হবে না।”

A public toilet built on a raised platform in Char Shubhagacha, Jamalpur, to keep it above floodwaters
শুভগাছা চরে বন্যার সময় পানিতে তলিয়ে যাবার হাত থেকে সুরক্ষায় উঁচু ভীতের উপরে স্থাপিত একটি পাবলিক টয়লেট। (ছবি: মোহাম্মদ আব্দুস সালাম/দ্য থার্ড পোল)

বন্যায় সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত নারী ও শিশু

একটি বন্যা কিন্তু নারীদের প্রথাগত যে ভূমিকা রয়েছে তা কোনো অংশেই হ্রাস করে না – যেমন পরিবারের জন্য রান্না করা এবং পানীয় জল বয়ে আনা ইত্যাদি। বন্যা হলে এসব পারিবারিক কার্যক্রম তাদের জন্য আরো কঠিন হয়ে যায়।  অনেককেই একটি কার্যকর টিউবঅয়েলের খোঁজে কমপক্ষে এক কিলোমিটার পথ হাটতে হয়।  কেউ কেউ নৌকা বা ভেলায় করে সেসব স্থানে পৌঁছায়। আবার অনেককেই গলা সমান বন্যার পানিতে হেঁটে অন্যদের মধ্য দিয়ে পানির খোঁজে বের হতে হয়।

জামালপুর জেলার চর দামুদুরপুরের বাসিন্দা মাহমুদা বেগম বলেন, “খাবার পানি সংগ্রহ করা সত্যিই একটি কঠিন কাজ। “আমাদের নৌকা বা ভেলায় করে অনেক দূর যেতে হয়।”

বাংলাদেশের স্থানীয় এনজিও নেটওয়ার্ক অন ক্লাইমেট চেঞ্জ-এর গবেষণা ও অ্যাডভোকেসি ম্যানেজার মুহাম্মদ ফররুখ রহমান বলেন, “আর যখন নারীদের আশ্রয়কেন্দ্রে বা বাঁধের উপরে থাকতে বাধ্য হতে হয়, তখন তারা অনেক সময় যৌন হয়রানিরও শিকার হয়ে থাকেন, বিশেষ করে যখন তারা রাতে পাবলিক টয়লেট ব্যবহার করেন।”

চরাঞ্চলে শিশুদের জন্য পর্যাপ্ত শিক্ষার সুযোগ নেই। যে কয়েকটি স্কুল আছে তা প্রতি বছর বন্যার সময় বন্ধ থাকে।  শিশুদের মাসের পর মাস ক্লাস বন্ধ করে বাড়িতে বসে থাকতে হয়।

Few of the children living in chars go to school, which remain flooded and closed for months every year – Char Shubhagacha, Jamalpur
চরে বসবাসকারী অল্প সংখ্যক শিশুই স্কুলে যায়,এসব স্কুল প্রতি বছর কয়েক মাস বন্যার পানিতে ডুবে থাকে এবং বন্ধ থাকে – চর শুভগাছা, জামালপুর (ছবি: মোহাম্মদ আব্দুস সালাম/দ্য থার্ড পোল)

কেন মানুষ চরে বাস করে ?

ব্রহ্মপুত্র, গঙ্গা এবং অন্যান্য নদী হিমালয় থেকে পলি বয়ে নিয়ে এসে এই চরগুলোককে এতই উর্বর করে তোলে যে সেগুলি নিয়ে বহু শতাব্দী ধরে লড়াই হয়ে আসছে – স্থানীয় জমিদাররা চর দখল করার জন্য ব্যক্তিগত বাহিনী গড়ে থুলতেন  (যাদের পাইক এবং লাঠিয়াল বলা হয়)। তারা ভূমিহীন কৃষকদের চরের জমি চাষ করতে এবং অসুবিধা সত্ত্বেও সেখানে বসবাস করতে উৎসাহিত করে। চরে বসবাসকারী কৃষক পরিবারের অনেকেই আজ তাদের বংশধর।

চরে তারা ধান, ভুট্টা, পাট, শাকসবজির ফলন করে – সবই অন্য মাটির চেয়ে ভালো জন্মায়। বছরের যেকোনো সময় চরে ফসলের অভাব হয় না। মাহমুদা বেগম বলেন, “চরে ফসলের কোনো অভাব নেই. এখানে বারো মাসে তেরো ফসল হয়।”

স্বাস্থ্য ও অন্যান্য সেবার ঘাটতি

চর শুভগাছার বাসিন্দা আলাল মন্ডল বলেন, কেউ অসুস্থ হলে আমাদের এখানে ডাক্তার পাওয়া যায় না। “সুতরাং, রোগীকে নৌকা বা ভেলায় করে তিন কিলোমিটার দূরে গাবের গ্রামে নিয়ে যেতে হয়। এরপর তাদের জামালপুরের হাসপাতালে স্থানান্তর করতে হতে পারে।” তার প্রতিবেশী আবদুর রহমান জানান, চরে কোনো কমিউনিটি ক্লিনিক নেই।

চরের বাসিন্দাদের সরকার পরিচালিত নানা প্রকল্প যেমন ভিজিএফ (ভালনারেবল গ্রুপ ফিডিং), ভিজিডি (ভালনারেবল গ্রুপ ডেভেলপমেন্ট) কর্মসূচি, বয়স্ক ভাতা, বিধবা ভাতা বা প্রতিবন্ধী ভাতার সুযোগ খুব কম। অভিযোগ রয়েছে যে কাউকে একটি প্রকল্পে অন্তর্ভুক্ত করতে রাজি হওয়ার আগে কর্মকর্তারা ঘুষ চেয়ে থাকেন।

The river and the char – Kawamara, Sharishabari, Jamalpur
নদী ও চর – কাউয়ামারা, সরিষাবাড়ী, জামালপুর (ছবি: মোহাম্মদ আব্দুস সালাম/ দ্য থার্ড পোল)