জলবায়ু

ক্রমবর্ধমান লবণাক্ততার কারনে বিপন্নতার মুখে বাংলাদেশের ‘বিশ্ব ঐতিহ্য’

জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে দেশের উপকূলবর্তী মসজিদের শহর বাগেরহাটের শত বছরের প্রাচীন প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শনগুলো আজ মারাত্বকভাবে হুমকির মুখে
বাংলা
<p>দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমের উপকূলীয় শহর বাগেরহাট যা মসজিদের শহর নামে পরিচিত। এখানকার শত বছরের পুরোনো প্রত্নতাত্বিক নিদর্শনগুলোর মধ্যে একটি চুনাখোলা মসজিদ, যা জাতিসংঘের ইউনেস্কো ঘোষিত একটি বিশ্ব ঐতিহ্য স্থাপনা বা ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সাইট। বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিম উপকূলে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শনগুলোর মধ্যে এই মসজিদটি অন্যতম। ছবিতে দেখা যাচ্ছে মাটির ইটের তৈরি দেয়ালের সাদা অংশ যা লবনাক্ততার প্রভাব। দেয়ালে পানি জমে পরবর্তীতে বাষ্পীভূত হবার পর অবশিষ্ট লবণ ভবনটির কাঠামোগত গুনাগুনকে ক্ষতিগ্রস্ত করতে পারে। (ছবি: এস ইনজামামুল হক)</p>

দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমের উপকূলীয় শহর বাগেরহাট যা মসজিদের শহর নামে পরিচিত। এখানকার শত বছরের পুরোনো প্রত্নতাত্বিক নিদর্শনগুলোর মধ্যে একটি চুনাখোলা মসজিদ, যা জাতিসংঘের ইউনেস্কো ঘোষিত একটি বিশ্ব ঐতিহ্য স্থাপনা বা ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সাইট। বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিম উপকূলে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শনগুলোর মধ্যে এই মসজিদটি অন্যতম। ছবিতে দেখা যাচ্ছে মাটির ইটের তৈরি দেয়ালের সাদা অংশ যা লবনাক্ততার প্রভাব। দেয়ালে পানি জমে পরবর্তীতে বাষ্পীভূত হবার পর অবশিষ্ট লবণ ভবনটির কাঠামোগত গুনাগুনকে ক্ষতিগ্রস্ত করতে পারে। (ছবি: এস ইনজামামুল হক)

‘এখানকার নোনা পানিতে নিশ্চয়ই কােনো না কোনো সমস্যা আছে’, বলছিলেন বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিম উপকূলে জাতিসংঘ ঘোষিত বিশ্ব ঐতিহ্য (ইউনেস্কো ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সাইট) খ্যাত মসজিদের শহর বাগেরহাটের ষাট গম্বুজ মসজিদের খতিব মোহাম্মদ হেলাল উদ্দিন মাতব্বর। “আমি  গত ছয়- সাত বছর ধরে দেখতে পাচ্ছি এই পরিবর্তনগুলো। এখানকার মসজিদের দেয়ালগুলি ক্রমশ স্যাঁতসেঁতে হয়ে যাচ্ছে, আর দেয়ালে ধীরে ধীরে একটি সবুজ রঙের আস্তরণ পড়ছে।‘

মসজিদের খতিব হিসেবে হেলাল উদ্দিন গত ৩০ বছর যাবত প্রতি শুক্রবার জুম’আর নামাজে খুতবা পাঠ করেন। গত ৩০ বছর ধরেই তিনি এই মসজিদ ভবনটির দায়িত্বে রয়েছেন। তিনি ষাট গম্বুজ মসজিদ নামে পরিচিত এই ঐতিহাসিক পূরাকীর্তির  পরিবর্তনের বিষয়টি নিয়ে বেশ উদ্বিগ্ন। “ভবনের ভিতরে এক ধরনের স্যাঁতসেঁতে অনুভূতি এড়াতে সারা রাত এখানে বৈদ্যুতিক বাতি জ্বালিয়ে রাখা হয়,” দ্য থার্ড পোলকে বলেন হেলাল উদ্দিন।

সুলতানি আমলে (১২০৪ – ১৫৭৬)  নির্মিত বিখ্যাত ষাট গম্বুজ মসজিদটি  বাংলাদেশের অন্যতম বৃহত্তম মসজিদ। ম্যানগ্রোভ বনের জন্য বিখ্যাত সুন্দরবন অঞ্চলের তৎকালীন গভর্নর খান জাহান আলী  মসজিদটি নির্মান করেছিলেন। এর নির্মান কাল ১৪৪২  থেকে ১৪৫৯ সাল পর্যন্ত।

বাংলাদেশের প্রত্নতত্ব অধীদপ্তরের খুলনা অঞ্চলের পরিচালক আফরোজা খান বলেন, দেশের ১৯টি উপকূলীয় জেলায় ১২৭টি  প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন রয়েছে। এর মধ্যে দেশের দক্ষিণ-পশ্চিম উপকূলে অন্তত ৫০টি পূরাকীর্তি জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে ক্ষতিগ্রস্তের মুখোমুখি হয়েছে।

The interior of a mosque with whitewashed walls, S Inzamamul Haque
ষাট গম্বুজ মসজিদের ভিতরের দেয়ালে সবুজ অংশগুলো মনে করা হয় জলবায়ু পরিবর্তন সংক্রান্ত কোনো প্র্রভাবে আক্রান্ত। ভবনের ভিতরে স্যাঁতসেঁতে ভাব দুর করতে সারা রাত বৈদ্যুতিক বাতি জ্বালিয়ে রাখা হয়। (ছবি: এস ইনজামামুল হক)

ওয়ার্ল্ড মেটিওরোলজিক্যাল অর্গানাইজেশন এবং ইন্টার গভর্ণমেন্টাল প্যানেল অন ক্লাইমেট চেঞ্জ (আইপিসিসি) অনুসারে, বাংলাদেশের এই অঞ্চলটি জলবায়ু পরিবর্তনের কারনে, বিশেষ করে লবণাক্ততার ফলে বিশেষভাবে ঝুঁকিপূর্ণ। বাংলাদেশ মৃত্তিকা সম্পদ উন্নয়ন ইনস্টিটিউটের তথ্য অনুযায়ী, ১৯৭৩ সালে উপকূলীয় ৮৩৩,০০০ হেক্টর জমি লবণাক্ত ছিল। ২০০৯ সালে, এটি এক মিলিয়ন হেক্টরে এসে দাঁড়িয়েছে। ২০০৫ সাল থেকে দেশে ঘন ঘন আঘাত হানা বড় সাইক্লোনের কারণে মাটি ও পানিতে লবণের ঘনত্ব এই পরিমানে বৃদ্ধি পেয়েছে।

ষাট গম্বুজ মসজিদের খতিব হেলাল উদ্দিন বলেন, “আমার মনে হয় নোনা পানির সাথে নোনা বাতাসও এই অবস্থার  জন্য দায়ী। আমি অনেকের চেয়ে অনেক কাছে থেকে এই পরিবর্তনগুলো খুব স্পষ্টভাবে দেখতে পাচ্ছি।”

লবণাক্ততা কিভাবে বাংলাদেশের ঐতিহ্যকে ক্ষতিগ্রস্ত করছে

বাংলাদেশের বাগেরহাটসহ উপকূলীয় প্রায় সব জেলায় বিপুল পরিমাণ জমি চাষাবাদের অনুপযোগী হয়ে পড়েছে এবং সেই সঙ্গে মারাত্বক হুমকিতে পড়েছে খাবার পানির সরবরাহ। অন্যদিকে দিন দিন লবনাক্ততার মাত্রা বাড়তে থাকায় বাসস্থান ও দালান-েকোঠা ক্ষতিগ্রস্ত ও হচ্ছে। কাঁদা দিয়ে তৈরি ইট এবং ইটের টুকরো দিয়ে প্রস্তুত করা হয় কংক্রিট। এই ইট অনেক সময়ই ছিদ্রযুক্ত, এবং ইট ভেদ করে আর্দ্রতা এবং আর্দ্রতায় দ্রবীভূত লবণ উভয়ই প্রভাবিত হতে পারে। পানি বাষ্পীভূত হয়ে যাবার পর দেয়ালে লবণটি থেকে যায়, যা প্রায়ই  সাদা রংয়ের এক ধরনের পদার্থের আকৃতি ধারণ করে দেয়ালে থেকে যায় যা ধীরে ধিরে ভবনের কাঠামোগত অখণ্ডতাকে ক্ষতিগ্রস্ত করতে পারে।

সরকারী সংস্থা হাউজিং অ্যান্ড বিল্ডিং রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (এইচবিআরআই) সিনিয়র রিসার্চ ইঞ্জিনিয়ার মোহাম্মদ আরিফুজ্জামান দ্য থার্ড পোলকে বলেন, “গত পাঁচ-ছয় বছর যাবত আমরা উপকূলীয় বাসিন্দাদের কাছ থেকে তাদের বাড়িতে লবণাক্ততার নানা ধরনের প্রভাবের কথা শুনে আসছি। তিনি বলেন, “আসলে, উপকূলে লবণাক্ততার নেতিবাচক প্রভাবের বিষয়টি নিয়ে আমরা মোটামুটি নিশ্চিত। এখন কীভাবে এটি প্রতিরোধ করা যায় এবং এর পরিণতি কী হবে তা নিয়ে আমরা কাজ করছি।”

উচ্চ লবনাক্ততার প্রভাবে দেশের প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শনগুলো মারাত্বকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। এগুলোর মধ্যে বাগেরহাটের ঐতিহাসিক ষাট গম্বুজ মসজিদটি অন্যতম যা মাটির ইট দ্বারা নির্মান করা হয়েছে। খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্থাপত্য বিভাগের অধ্যাপক খন্দকার মাহফুজ উদ দারাইন উপকূলীয় প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শনগুলোর উপর জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব নিয়ে গবেষণা করছেন। দ্য থার্ড পোলকে তিনি বলেন, “ষাট গম্বুজ মসজিদের উত্তর দিক বাদে বাকি তিন দিক বিশেষভাবে তৈরি করা ইট দিয়ে এক দশক আগে সংস্কার করা হয়েছিল। এসব সংস্কারকৃত স্থানে লবণ দেখা গেছে। নতুন ইটগুলিতে উত্তর দিকের পুরানোগুলির চেয়ে বেশি লবণের হার রয়েছে।”

A mosque with many domes
মসজিদের শহর বাগেরহাটে অবস্থিত বিখ্যাত ষাট গম্বুজ মসজিদ।বিশেষজ্ঞরা বলছেন, লবণাক্ততার প্রভাব কেবল কাদামাটি-ইটের দেয়ালেই পড়েনি, এর ফলে মসজটির গম্বুজও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। (ছবি: জোনাথন উইলসন / এলামি)

আফরোজা খান বলেন, মেরামতের মাধ্যমে নতুন স্থাপিত ইটগুলো লবণ-সহনশীল নাও হতে পারে। লবণ শুধু দেয়ালে নয়, গম্বুজের ওপরেও প্রভাব ফেলেছে। হেলাল উদ্দিন বলেন  তিনি লক্ষ্য করে দেখেছেন যে বাগেরহাটের আরো অনেক মসজিদই লবণাক্ততার প্রভাবে ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। “কেবল ষাট গম্বুজই নয়, আশেপাশে নয় গম্বুজ মসজিদ, বিবি বেগনি মসজিদ, রণবিজয়পুর মসজিদ ও চুনাখোলা মসজিদেরও বলতে গেলে একই অবস্থা। তবে সবচেয়ে বড় সমস্যা ষাট গম্বুজ ও চুনাখোলা মসজিদের,” তিনি বলেন।

অধ্যাপক দারাইন এক্ষেত্রে আরও দুটি প্রবণতা লক্ষ্য করেছেন। তিনি বলছেন যে এই ধরনের ঘটনা প্রবাহ জলবায়ু পরিবর্তনের অনিবার্য ফলাফল। এর একটি হল তাপমাত্রার সাধারণ বৃদ্ধি যা প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শনগুলির ভবনে ফাটলের সংখ্যা বাড়িয়েছে। প্রতি বছর গ্রীষ্মের সময় তাপমাত্রা বাড়ার সাথে সাথে ফাটলগুলি আরও প্রকট হয়ে ওঠে। এ অঞ্চলে বৃষ্টিপাত বেশি হওয়ায় এসব ফাটল দিয়ে অনবরত পানি পড়ে। “মাটির লবণাক্ততা কীভাবে এত বেশি হতে পারে বা হচ্ছে তা একিট বিস্তর গবেষণার বিষয়। তবে আপাতভাবে আমাদের মনে হয় অতিরিক্ত বৃষ্টিপাত এবং অত্যধিক তাপ এই ধরনের ফাটলের অন্যতম প্রধান কারণ, আফরোজা খান বলেন।

রয়েছে প্রস্তাব আর উদ্যোগ, কিন্তু ফলাফল দুরস্ত

২০১৯ সালে বাংলাদেশের প্রত্নতাত্বিক বিভাগ ইন্টারন্যাশনাল কাউন্সিল অন মনুমেন্টস অ্যান্ড সাইটস (আইসিওএমওএস), গুগল আর্টস অ্যান্ড কালচার (Google Arts & Culture), এবং ঐতিহ্যবাহী স্থানগুলির ডিজিটাল উপস্থাপনা প্রস্তুতকারী যুক্তরাষ্ট্র ভিত্তিক সংস্থা সাইআর্ক (CyArk) এর সাথে যৌথভাবে একটি কর্মশালা পরিচালনা করে। এটি বাংলাদেশের উপকূলীয় প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শনগুলোর উপরে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব সম্পর্কে পাঁচটি সুপারিশ তৈরি করে।

এর মধ্যে প্রথমটি ছিল প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শনগুলো বিশেষ করে বিশ্ব ঐতিহ্যবাহী স্থানগুলি সংরক্ষণ করার সময় জলবায়ু পরিবর্তনকে বিবেচনায় নেয়ার উপর জোর দেওয়া। এছাড়া অন্যান্য প্রস্তাবগুলোর মধ্যে ছিল: পুরাকীর্তি আইন হালনাগাদ করার সময় জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব থেকে সুরক্ষা দিতে প্রশমন সংক্রান্ত নীতিগুলো অন্তর্ভুক্ত করা; নীতিতে সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের গুরুত্বের অন্তর্ভুক্তি; গুরুত্বপূর্ণ প্রত্নতাত্ত্বিক স্থানগুলোর ত্রিমাত্রিক ডকুমেন্টেশন; এবং জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাবকে সংশ্লিষ্ট বিভাগ এবং এর মাঠ পর্যায়ের দফতর এবং কর্মকর্তা পর্যায়ে বিবেচনায় আনা।

এই মসজিদগুলো শুধু আমাদেরই নয়, এগুলো এখন সারা পৃথিবীর মানুষের সম্পদ।
ষাট গম্বুজ মসজিদের খতিব হেলাল উদ্দিন

“আমরা এ সংক্রান্ত বিষয়গুলো আমলে নিয়ে বেশ কিছু উদ্যোগ হাতে নিচ্ছি। বেশ কিছু আইন সংশোধন করা হয়েছে। উপকূলীয় অঞ্চলের গুরুত্বপূর্ণ ঝুঁকিপূর্ণ স্থানগুলো চিহ্নিত করার পর আগামী অর্থবছরে বাস্তবায়নের কাজ শুরু হবে,” দ্য থার্ড পোলের কাছে এই পরিকল্পনার কথা জানান প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের মহাপরিচালক রতন চন্দ্র পণ্ডিত৷

প্রত্নতাত্ত্বিকরা মনে করেন, উপকূলীয় এলাকায় ঐতিহাসিক পূরাকীর্তিগুলো রক্ষণাবেক্ষণের পদ্ধতিতে পরিবর্তন আনা প্রয়োজন, কিন্তু জলবায়ু উপযোগী প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শনগুলো সংরক্ষণের জন্য প্রয়োজনীয় অর্থ বরাদ্দ করা হয়নি। ফলে ঝুঁকিপূর্ণ ভবনগুলোর সুরক্ষায় বিশেষ কোনো ব্যবস্থা নেই।

বাংলাদেশ জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব থেকে প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শনগুলোকে রক্ষা করার জন্য বৈশ্বিক উদ্যোগে অংশ নিচ্ছে, তবে হেলাল উদ্দিনের মতো ব্যক্তিরা মনে করেন যে এই উদ্যোগগুলি দেরি না করে দ্রুত বাস্তবায়ন করা উচিত।

“এই মসজিদগুলো শুধু আমাদেরই নয়, এগুলো এখন সারা পৃথিবীর মানুষের সম্পদ। সরকার এবং বিশ্ব সম্প্রদায়কে অবশ্যই এগুলো সুরক্ষায় মনোযোগ দিতে হবে,” তিনি বলেন।