বিশ্বের শীর্ষস্থানীয় জলবায়ু বিজ্ঞানীরা আইপিসিসি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছেন, যা জলবায়ু পরিবর্তন সংক্রান্ত আন্তঃসরকারি প্যানেলের (আইপিসিসি) ষষ্ঠ মূল্যায়ন প্রতিবেদনের চূড়ান্ত অংশ। এতে জলবায়ু সংকট সম্পর্কে একটি “চূড়ান্ত সতর্কতা” রয়েছে। হিন্দুকুশ-হিমালয় অঞ্চলে কর্মরত বিশেষজ্ঞরা উদ্বেগ প্রকাশ করে বলেন যে যদি হিমবাহ আরও উষ্ণ হয় তবে এটি প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে প্রায় দুই বিলিয়ন মানুষের জীবনকে প্রভাবিত করবে।
আইপিসিসি এআর৬ সিনথেসিস রিপোর্টটি গত আট বছর ধরে বৈজ্ঞানিক মতামতের সংগ্রহ করে আসছে যাতে বলা হচ্ছে গ্রীনহাউস গ্যাস নির্গমনের মাত্রা হ্রাস পেলেও এই শতাব্দীতে বৈশ্বিক উঞ্চতা ১.৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস ছাড়িয়ে যাবে। এর ফলে বাড়বে খাদ্য নিরাপত্তার ঝুঁকি, বৈরী আবহাওয়া এবং একে অন্যের সাথে বিরোধ। বর্তমানে তাপমাত্রার যে পরিস্থিতি তার মধ্যেই পাহাড়ী জনগোষ্ঠী ভূমিধস, আকস্মিক বন্যা এবং পানির উৎস শুকিয়ে যাওয়ার মতো পরিস্থিতির মুখোমুখি হচ্ছে।
আইপিসিসি প্রতিবেদনে বলা হয়েছে যে ক্রায়োস্ফিয়ারের পরিবর্তনের কারণে, আগামীতে হিন্দুকুশ হিমালয়সহ বেশিরভাগ পার্বত্য অঞ্চলের জন্য “গুরুতর পরিণতি” ধেয়ে আসছে।
এই প্রতিবেদন প্রকাশের সময়, জাতিসংঘের মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস জি২০ দেশগুলিকে ২০৫০ সালের মধ্যে শূন্য নির্গমনে পৌঁছানোর আহ্বান জানিয়েছিলেন। ভারত, বিশ্বের চতুর্থ বৃহত্তম গ্রিনহাউস গ্যাস নির্গমনকারী, বর্তমানে জি২০ দেশগুলির সভাপতিত্ব করছে। ভারত ২০৭০ সালের মধ্যে শূন্য নির্গমনের লক্ষ্য অর্জনের সংকল্প করেছে।
• বৈশ্বিক উষ্ণায়নের কারণে বৈশ্বিক জলচক্র আরও খারাপ হবে বলে আশা করা হচ্ছে। সারা বিশ্বে বর্ষা অস্থিতিশীল থাকবে। ভারী বৃষ্টি ও খরা উভয়ের ক্ষেত্রেই আশঙ্কা বাড়বে ।
• ক্রায়োস্ফিয়ারে (হিমায়িত পর্বত) প্রায় সমস্ত উপাদানের পরিমাণ এবং মাত্রা কমে আসবে।
• তাপপ্রবাহ এবং খরা পরিস্থিতি উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি পাবে।
• গ্রীষ্মমন্ডলীয় ঘূর্ণিঝড় এবং বজ্রসহ ঝড় বাড়তে পারে।
• ভয়ঙ্কর তাপ ও খরার মতো পরিস্থিতি তৈরি হবে।
হিমালয়ের জন্য ১.৫ ডি. সে অত্যন্ত উঞ্চ
২০১৯ সালে, ইন্টারন্যাশনাল সেন্টার ফর ইন্টিগ্রেটেড মাউন্টেন ডেভেলপমেন্ট (ICIMOD)-এর একটি যুগান্তকারী প্রতিবেদনে দেখা যায়, হিন্দুকুশ-হিমালয় অঞ্চল বিশ্বের অন্যান্য অনেক স্থানের চেয়ে দ্রুত উষ্ণ হচ্ছে। আর এর মারাত্মক পরিণতি দেখা দিচ্ছে এই এলাকায়।
ICIMOD তার মূল্যায়নে বলেছে যে হিন্দুকুশ-হিমালয়ের জন্য ১.৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস “অত্যন্ত উঞ্চ”। ICIMOD-এর প্রাক্তন মহাপরিচালক ডেভিড মুলডেন সতর্ক করে বলেন, ১.৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসের বৈশ্বিক উষ্ণায়নের ফলে পাহাড়ে ২ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা বৃদ্ধি পাবে। এটি হিন্দুকুশ-হিমালয় অঞ্চলের অর্ধেক হিমবাহকে প্রভাবিত করবে, এশিয়ার নদীগুলোকে অস্থিতিশীল করবে এবং কোটি কোটি মানুষের জীবন ও জীবিকাকে মারাত্বকভাবে বিপন্ন করে তুলবে।
আইপিসিসি সারসংক্ষেপ প্রতিবেদনে বলা হয় যে হিমবাহের পশ্চাদপসরণ এবং গলিত পারমাফ্রস্টের কারণে বাস্তুতন্ত্রের উপর যে প্রভাব পড়ে তা বলতে গেলে একেবারেই “অপ্রতিরোধ্যতার কাছাকাছি”। এর অর্থ হচ্ছে এসব প্রভাব একেবারেই প্রতিহত করা যাবে না। এদেরকে স্বল্প প্রশমন সক্ষমতার বাস্তুসংস্থান হিসেবে বর্ণনা করা হয়েছে।
আইপিসিসি প্রতিবেদনের যে ৯৩ জন লেখক রয়েছে তাদের মধ্যে একজন অদিতি মুখার্জি। তিনি মূলত আন্তর্জাতিক কৃষি গবেষণা কেন্দ্রের কনসোর্টিয়ামের পরিচালক হিসেবে কাজ করছেন। দ্য থার্ড পোলকে অদিতি বলেন, “এই ধরনের ক্ষয়ক্ষতি সংক্রান্ত বিষয়গুলো নীতিনির্ধারকদের উচিত আরো বিস্তারিতভাবে তুলে ধরা। কারন আমাদের কাছে এর কোনো হিসেব নেই। তবে এই প্রতিবেদনে একটি বিষয় বেশ পরিস্কারভাবে তুলে ধরা হয়েছে, আর তা হচ্ছে – নীতিনির্ধারকরা গভীর নির্গমন হ্রাসের উপরে প্রয়োজনীয়তার উপর যথেষ্ট জোর দয় না। আর এর ফলে এই প্রভাবগুলো আরো বাড়তেই থাকবে।”
তিনি আরো বলেন, “হিমলায় অঞ্চলে উন্নয়ন কিন্তু সঠিক পথে চলছে না। তাই আমরা জোশীমঠের মতো ধংসাবশেষ দেখছি। আমরা দেখতে পাচ্ছি প্রতিনিয়ত প্রস্রবনগুলো শুকিয়ে যাচ্ছে। উন্নয়ণ বনাম পরিবেশ নিয়ে আগেকার দিনের দর্শনকে ভুলে আমাদরে আসলে এখন সময়োপযোগী পথে হাটতে হবে।”
আইপিসিসি প্রতিবেদনের প্রতিক্রিয়ায়, ICIMOD-এর লাইভলিহুড অ্যান্ড মাইগ্রেশন বিষয়ক সিনিয়র বিশেষজ্ঞ আমিনা মহারাজান, দ্য থার্ড পোলকে বলেন, “বন্যা এবং ভূমিধসের মতো জলবায়ু-পরিবর্তন জনিত প্রভাবের ফলে গুরুতর পরিণতি হবে৷ আর এর ফলে মানুষ, অবকাঠামো এবং পরিবেশকে ঝুঁকি বহন করতে হবে।”
মহারাজান হিমালয়ে বর্তমান অভিযোজন প্রতিক্রিয়াগুলিকে “ব্যাপকভাবে ক্রমবর্ধমান প্রক্রিয়া” হিসাবে বর্ণনা করেন। তিনি এটিকে একটি প্রারম্ভিক সতর্কতা ব্যবস্থা হিসেবে বর্ণনা করে বলেন এর ফলে জীবন-জীবিকাকে আরো বৈচিত্র্যময় করে তুলতে হবে।” তিনি আরো বলেন যে বর্তমান গতি, সুযোগ এবং অভিযোজন প্রচেষ্টার গভীরতা ভবিষ্যতের ঝুঁকি মোকাবেলায় অপর্যাপ্ত হবে।
ICIMOD-এর লাইভলিহুড বিষয়ক বিশ্লেষক আভাশ পান্ডে বলেন, “সমগ্র আইপিসিস প্রক্রিয়ায় শুধুমাত্র জলবায়ু পরিবর্তনের কারণেই নয়, পাহাড়ের সম্পদের উপর নির্ভরশীল একটি বৃহৎ জনসংখ্যার প্রেক্ষাপটে এই অঞ্চলের গুরুত্ব বিবেচনা করে, সম্ভাব্য সমস্যাগুলিকে অন্তর্ভুক্ত করা গুরুত্বপূর্ণ।”
আইপিসিসি প্রতিবেদনের পর জি২০ এর জন্য শক্তিশালী বার্তা
আইপিসিসি প্রতিবেদন প্রকাশের সময় এক ভিডিও বার্তায়, আন্তোনিও গুতেরেস বলেন যে তিনি “জি২০ এর জন্য একটি জলবায়ু সংহতি চুক্তি” প্রস্তাব করেছেন। তিনি এসব দেশের সরকারের প্রতি তাদের ‘নেট-জিরো ট্রানজিশন’ আরো ত্বরান্বিত করার প্রতি আহ্বান জানিয়ে বলেন ‘এক্ষেত্রে স্বতন্ত্র দায়িত্ব এবং নিজ নিজ ক্ষমতা অনুযায়ী একটি সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য অর্জনের নীতিতে এগিয়ে যেতে হবে।’
তিনি বলেন, উন্নত দেশগুলোকে ২০৪০ সালের মধ্যে নেট-জিরোতে পৌঁছাতে বিশেষভাবে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হতে হবে।
- অর্গানাইজেশন ফর ইকোনমিক কো-অপারেশন অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট (ওইসিডি) দেশগুলিতে ২০৩০ সালের মধ্যে এবং অন্যান্য সব দেশে ২০৪০ সালের মধ্যে কয়লা ব্যবহার বন্ধ করে এবং নতুন কয়লা-নির্ভর প্রকল্পগুলি শুরু করতে হবে;
- কয়লার নির্ভর প্রকল্পে সকল আন্তর্জাতিক সরকারী ও বেসরকারী তহবিল বন্ধ করতে হবে;
- তেল এবং গ্যাসচালিত প্রকল্পে সব ধরনের নতুন লাইসেন্স বা তহবিল বন্ধ করতে হবে;
- বিদ্যমান তেল ও গ্যাসের মজুদের সম্প্রসারণ বন্ধ করতে হবে;
- জীবাশ্ম জ্বালানি থেকে একটি ন্যায়ভিত্তিক জ্বালানী ব্যবহারের প্রক্রিয়ায় পরিচালনা করা;
- ২০৫০ সালের মধ্যে বিশ্বব্যাপী তেল ও গ্যাস উৎপাদন ধীরে ধীরে হ্রাসের মাধ্যমে নেট-শূন্য লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করা।
জাতিসংঘ মহাসচিব বলেন, “কপ২৮ [সংযুক্ত আরব আমিরাতে বিশ্ব জলবায়ু শীর্ষ সম্মেলন যা ২০২৩ সালের শেষে অনুষ্ঠিত হবে] শেষ না হওয়া পর্যন্ত, আমি সব জি২০ নেতাদের উচ্চাভিলাষী অর্থনীতিতে জাতীয়ভাবে নির্ধারিত অবদানে (এনডিসি) গ্রীনহাউস গ্যাসকে অন্তর্ভুক্ত করে ২০৩৫ এবং ২০৪০ সালকে লক্ষ্য করে সব ধরনের পরিকল্পনার প্রনয়নের প্রতিশ্রুতি প্রদানে আহ্বান জানাই।”
জি২০-এর বর্তমান সভাপতি ভারতের জন্য এটি একটি কঠিন লক্ষ্য। যদিও ভারত সরকার সৌর ও বায়ু উৎপাদন ক্ষমতা স্থাপনে দ্রুত এগোচ্ছে তবে পাশাপাশি সবচেয়ে খারাপ জীবাশ্ম জ্বালানী, কয়লার ব্যবহার প্রসারিত করার কাজটিও এগিয়ে নিচ্ছে।
বৈশ্বিক উষ্ণতাকে ১.৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসে সীমাবদ্ধ করা এখনও সম্ভব
আইপিসিসি এআর৬ প্রতিবেদনে বলা হয়েছে যে ২০২৫ সালের মধ্যে কার্বন ডাই অক্সাইড নির্গমন অবশ্যই সর্বোচ্চ হবে যদি প্রাক-শিল্প সময়ের থেকে গড় বৈশ্বিক তাপমাত্রার বৃদ্ধিকে ১.৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসের মধ্যে রাখতে হয়। এরপর এটিকে নামিয়ে আনতে হবে। কিন্তু মিটিগেশন অ্যান্ড অ্যাডাপ্টেশন অ্যাকশন (প্রশমন) এবং অভিযোজন প্রচেষ্টায় বিলম্ব অনেক ধরনের হুমকি বাড়িয়ে দেবে।
এই বছরের জাতিসংঘ জলবায়ু সম্মেলনের আগে এবং চলাকালীন সময় একটি বিষয় নিয়ে উত্তপ্ত বিতর্কের সম্ভাবনা রয়েছে। আর তা হচ্ছে প্যারিস চুক্তি। কারন ২০২৩ সালে প্যারিস চুক্তি বাস্তবায়নে কোন দেশ কতটুকু বিষয়ে অগ্রসর হয়েছে তা নিয়ে চুলচেরা বিশ্লেষন করা হবে।
এবারের আইপিসিসি প্রতিবেদন প্রকাশের পর সাংবাদিকদের এর আগের একটি আইপিসিসি প্রতিবেদনের একজন লেখক এবং দ্য এনার্জি অ্যান্ড রিসোর্সেস ইনস্টিটিউটের দীপক দাশগুপ্ত বলেন, “আসলে তাপমাত্রা বৃদ্ধির প্রতিটি ক্ষেত্রকে সীমিত করা উচিত।” তিনি আরও বলেন, নির্গমন হ্রাস করার “একাধিক সুযোগ” রয়েছে। এই প্রতিবেদনে বলা হয়েছে কীভাবে এই ট্রানজিশন ত্বরান্বিত করা যায়, উদাহরণস্বরূপ শহুরে তাপ,পানি ব্যবস্থাপনা এবং জ্বালানী পরিবর্তনের সাথে খাপ খাইয়ে যাওয়া।”
এবারের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে যে প্রায় ৩ বিলিয়নের চেয়ে বেশি মানুষ জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে।
প্রতিবেদন প্রকাশের প্রাক্কালে অদিতি মুখার্জি বলেন, ২০১০ থেকে ২০২০ সালের মধ্যে, অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ অঞ্চলে বন্যা, খরা এবং ঝড়ের কারণে মানুষের মৃত্যুর হার ১৫ গুণ বেশি ছিল অন্যান্য স্বল্প ঝুঁকিপূর্ণ অঞ্চলের তুলনায়। জলবায়ু পরিবর্তন এবং চরম আবহাওয়া যেভাবে বাস্তুচ্যুতিকে বাড়িয়ে তুলছে তাতে “জলবায়ু ন্যায়বিচার অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে কারণ যারা জলবায়ু পরিবর্তনে সবচেয়ে কম অবদান রাখছেন তারাই সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন।”