खाना

বোরো ধান চাষে নতুন পদ্ধতি আশা জাগিয়েছে বাংলাদেশে

জল সংকটের এই সময়ে বাংলাদেশে বোরো ধান চাষীরা নতুন করে আশার পথ দেখছেন। আর এই আশার পথ দেখাচ্ছে বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজ্ঞানীরা। তাদের আবিষ্কৃত নতুন চাষ পদ্ধতি সফলভাবে প্রয়োগ করা গেলে জল সংকট মোকাবেলায় নতুন এক দ্বার উন্মোচিত হবে বলে মনে করা হচ্ছে।
বাংলা
<p>Boro paddy field, Bangladesh. Image source:  Vespertunes</p>

Boro paddy field, Bangladesh. Image source: Vespertunes

উৎপাদন, পুষ্টিগুন ও চাহিদার বিচারে বাংলাদেশে বিভিন্ন জাতের ধানের মধ্যে বোরো বরাবরই শীর্ষ অবস্থানে থেকেছে। তবে এই ধান চাষে সেচের মাধ্যমে প্রচুর পরিমান জলের প্রয়োজন হয় কারন প্রাকৃতিকভাবেই এটি জল-সহনীয় একটি প্রজাতি। অত্যধিক জলের প্রয়োজন হয় বলে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে বোরো চাষের ক্ষেত্রে আজকাল কৃষকদের মধ্যে অনীহা সৃষ্টি হয়েছে।

বাংলাদেশে বোরোর যে কয়টি প্রজাত পাওয়া যায় তার মধ্যে জনপ্রিয় প্রায় সবগুলোই উদ্ভাবন করেছে বাংলাদেশ ধান গবেষনা ইন্সটিটিউট। এই জাতের ধান উদ্ভাবনের মূল উদ্দেশ্য ছিল যাতে এগুলো বন্যার সময় জলাবদ্ধ জমিতে টিকে থাকতে পারে। বহু বছর যাবত এই  ধান সাফল্যের সাথে বাংলাদেশ, ভারত ও নেপালে চাষ হয়ে আসছে। বাংলাদেশ উৎপাদিত ধানের মধ্যে বোরো সবচেয়ে এগিয়ে রয়েছে। গত ২০১৩-১৪ সালে সারাদেশে উৎপাদিত ধানের পরিমান ছিল ৩৪.৫ মিলিয়ন মেট্রিক টন। এর মধ্যে ১৯ মিলিয়ন মেট্রিক টনই ছিল বোরো।   দেশের খাদ্য চাহিদা মোকাবেলায় বোরো’র যথেষ্ট ভূমিকা থাকা স্বত্বেও ক্রমবর্ধমান জল সংকট এবং জলবায়ু পরিবর্তনের বিরুপ প্রভাবের কথা বিবেচনা করে বাংলাদেশ সরকার গত বেশ কয়েক বছর যাবত এই ধান উৎপাদনে কিছুটা উৎসাহ হারিয়েছে।

বোরো ধান থেকে এক কেজি চাল উৎপাদনে কমপক্ষে ৩,৫০০ লিটার জলের প্রয়োজন হয়। সাধারণত ডিসেম্বরের মাঝামাঝি সময়ে বোরো চাষীরা বীজতলায় এর চারা প্রস্তুত করেন। বীজতলা থেকে জমিতে চারা রোপনের পর্যায়ে আসতে ৪৫ দিন সময় প্রয়োজন হয়।

বীজতলা থেকে চারা উৎপাদনের পর তা জলমগ্ন জমিতে বপন করা হতো। গত কয়েক দশকে শহরাঞ্চলে জলের চাহিদা বৃদ্ধি এবং ভূ-গর্ভস্থ্য জলের স্তর নিচে নেমে যাওয়ায় কৃষকরা এই ধান উৎপাদনে আগ্রহ হারিয়েছেন অনেকটা। ক্রমবর্ধমান জল সংকটের ফলে বাংলাদেশের কৃষির অন্যতম বুনিয়াদ বোরো ধান গত কয়েক বছরে কিছুটা আশংকার মধ্যে পড়েছে। অপরদিকে যথেষ্ট উৎপাদন হলেও সরকারের কাছ থেকে যথাযথ মূল্যও পাচ্ছেন না কৃষকরা।

বোরো চাষে শুষ্ক পদ্ধতি

বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজ্ঞানীরা বোরো চাষের জন্য নতুন একটি পদ্ধতি আবিস্কার করেছে। তারা একে বলছেন শুষ্ক পদ্ধতি। নতুন এ পদ্ধতিটি বোরো চাষে জলের ব্যবহার অনেক কমিয়ে এনেছে। বলা হচ্ছে প্রচলিত পদ্ধতিতে চাষ না করে এই পদ্ধতিতে বোরো ধান চাষ করা হলে জলের ব্যবহার অর্ধেকে নেমে আসবে।

নতুন এই পদ্ধতির প্রবক্তা বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক মশিউর রহমান। তিনি বলেন, এই প্রক্রিয়ায় বোরো ধান চাষ করা হলে জলের ব্যবহার ৫০ শতাংশ হ্রাস করা সম্ভব।

নতুন এই পদ্ধতিতে জমিতে বীজতলা থেকে চারা তৈরীর যে প্রক্রিয়া রয়েছে তা বাদ দেয়া হয়েছে। এর পরিবর্তে বপনের আগে বীজগুলো ২৪ ঘন্টা জলের মধ্যে রেখে দেয়া হয়। ফলে যথেষ্ট সময় ও জল বাঁচানো যায়। এরপর জমিতে বীজ বপনের সময়ও একটি প্রক্রিয়া অনুরসরন করা হয়, তা হচ্ছে  – জমিতে বীজতলায় তৈরীর সময় একটি বীজ থেকে অপর বীজের দুরত্ব রাখা হয় ১৫ সে.মি. এবং এক সারি থেকে অপর সারির দুরত্ব রাখা হয ২৫ সে.মি. – ঠিক যেভাবে গম চাষ করা হয়। এভাবে বীজতলা থেকে চারা উৎপাদনের প্রক্রিয়া এড়িয়ে জলের ব্যবহার কমে আসে ৩৫ শতাংশ। এছাড়াও যেহেতু চারাগুলোকে ১৫ দিন জলের নিচে থাকতে হয় না তাই এর মাধ্যমেও জলের ব্যবহার আরো ১৫ শতাংশ কমানো যায়।

প্রচলিত এবং নতুন পদ্ধতি – ঊভয় ক্ষেত্রেই চারা থেকে পরিপূর্ণ ধান হয়ে উঠতে ৩০ দিন সময় লাগে। এসময় অবশ্য জমিতে জলের প্রয়োজন হয়। নতুন এই পদ্ধতিতে জানুয়ারির শেষ দিকে জমিতে বীজ বপন করতে হয় এবং ফসল ঘরে তুলতে কৃষকের সময় লাগে ১০৫ থেকে ১১৫ দিন। অন্যদিকে প্রচলিত প্রক্রিয়ায় চাষের পর ফসল তুলতে প্রয়োজন হয় ৯৫ দিন।

গবেষনা প্রেক্ষাপট

এই গবেষনার সাথে সংশ্লিষ্ট মূখ্য গবেষক অধ্যাপক মশিউর রহমান ২০০৬ সালে বিশ্ববিদ্যালয়ে পরীক্ষাগারে এ নিয়ে গবেষনা শুরু করেন। প্রায় দুই বছর পর তিনি সফলতার মুখ দেখেন। এরপর তিনি কৃষি জমিতে এই পদ্ধতির সফল প্রয়োগের কাজ শুরু করেন। ২০০৯ সাল থেকে তিনি রাজশাহী, রংপুর, দিনাজপুর, টাংগাইল ও নেত্রকোনার কয়েকটি কৃষি জমিতে এই পদ্ধতিতে চাষ শুরু করেন।

নতুন এই পদ্ধতিতে চাষের ক্ষেত্রে প্রায় শতভাগ সফল হলেও এক্ষেত্রে এখনও কিছুটা সমস্যা রয়েছে বলে মনে করেন মশিউর। দেখা গেছে পাশপাশি দুটি জমিতে প্রচলিত ও নতুন পদ্ধতিতে বোরো ধান চাষ  করা হলে প্রচলিত পদ্ধতিতে চাষ করা জমি থেকে আগেই ফষল ঘরে তোলা যায়। অন্যদিকে নতুন পদ্ধতির জমিতে ফসল তখনও অপরিপক্ক থাকায় পাশের জমি থেকে পোকামাকরের আক্রমনের সম্ভাবনা থাকতে পারে। অন্যদিকে কৃষকরা আগে-ভাগেই ফসল বোনার সময় কিছুটা এগিয়ে নিতে চান না কারন সেসময় শীতে চারা নষ্ট হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। এই সমস্যা থেকে বাঁচার প্রধান উপায় হচ্ছে পাশাপাশি সব জমিতে একইসাথে নতুন পদ্ধতিতে চাষ করতে হবে। দ্যথার্ডপোল.নেটের সাথে আলাপকালে মশিউর রহমান এ অভিমত ব্যক্ত করেন।

মশিউর রহমান প্রবর্তিত নতুন এই পদ্ধতিতে নিজের ১.৫ একর জমিতে বোরো ধান চাষ করেছেন বাংলাদেশের দিনাজপুরের কৃষক আনোয়ারুল ইসলাম। এ ব্যাপারে দ্যথার্ডপোল.নেটকে তিনি বলেন, এটি সম্পুর্ন একটি নতুন পদ্ধতি। কিন্তু তারপরও একই পরিমান জমিতে এর উৎপাদন প্রায় সমান। আমি দেখেছি এই পদ্ধতিতে চাষ করলে জলের ব্যবহার অনেক কম হয়। আর এর ফলে সার্বিক ব্যয়ও কমে আসে। তবে পাশের জমিতে যদি পুরাতন পদ্ধতিতে চাষ করা হয় তাহলে কিছুটা সমস্যা দেখা যায়। যেমন ওই জমি থেকে জল এসে আমার জমিতে প্রবেশ করেছিল। এর ফলে ফসলের ক্ষতি হওয়ার সম্ভাবনা থাকে।

বাংলাদেশ সরকার অবশ্য মশিউর রহমান আবিস্কৃত এই পদ্ধতিকে স্বাগত জানিয়েছে। সরকার এরই মধ্যে মশিউর রহমানের এই পদ্ধতি সরকারী পর্যায়ে প্রদর্শন করতে অনুরোধ জানিয়েছে। বাংলাদেশ ধান গবেষনা ইন্সটিটিউটের মহাপরিচালক দ্যথার্ডপোল.নেটকে বলেন, মশিউর রহমানের আবিস্কৃত এই পদ্ধতি বেশ অভিনব।আমি নিজে এই পদ্ধতি খতিয়ে দেখেছি এবং আমি মনে করি এই প্রক্রিয়ায় বোরো ধান চাষ করা হলে জলের ব্যবহার অনেক কম হবে।  তবে এই পদ্ধতিতে বোরো ধান চাষ করে সার্বিক সাফল্য পেতে হলে দেশব্যাপি একই প্রক্রিয়া অনুসরণ করে চাষ করতে হবে।

 

 

Privacy Overview

This website uses cookies so that we can provide you with the best user experience possible. Cookie information is stored in your browser and performs functions such as recognising you when you return to our website and helping our team to understand which sections of the website you find most interesting and useful.

Strictly Necessary Cookies

Strictly Necessary Cookie should be enabled at all times so that we can save your preferences for cookie settings.

Analytics

This website uses Google Analytics to collect anonymous information such as the number of visitors to the site, and the most popular pages.

Keeping this cookie enabled helps us to improve our website.

Marketing

This website uses the following additional cookies:

(List the cookies that you are using on the website here.)