জীববৈচিত্র্য

জেলেদের দারিদ্রতার কারনে বিপন্ন বাংলাদেশের ইলিশ ?

সংসারের অভাব মেটাতে কোনো উপায় না পেয়ে শেষ পর্যন্ত সরকারী নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে মাছ ধরতে নদীতে যেতে বাধ্য হচ্ছে মেঘনা পাড়ের জেলেরা
বাংলা
<p>A fisherman&#8217;s wife on the doorstep on poverty in Bangladesh [image by Zobaidur Rahman]</p>

A fisherman’s wife on the doorstep on poverty in Bangladesh [image by Zobaidur Rahman]

মাত্র নয় বছর বয়সে বাবার হাত ধরে মাছ ধরতে নদীতে যাওয়া শুরু হয়েছিল ভোলার তুলাতলীর সেলিম মিয়ার। গত ৪১ বছর ধরে মেঘনার বুকে মাছ ধরছেন। অথচ সংসারের অভাব মেটাতে আজও তাকে লড়াই করতে হচ্ছে।

‘বেঁচে থাকার জন্য আমরা নিত্য সংগ্রাম করে যাচ্ছি; এই সংগ্রাম কেবল কয়েক দিন বা রাতের নয়, আমরা দিনের পর দিন এই সংগ্রাম করে যাচ্ছি। আসলে এখন মনে হয় জেলে হয়ে জন্মানোটাই একটি অভিশাপ’।

দ্যথার্ডপোল.নেট-এর কাছে এভাবেই নিজেদের কষ্টের কথা তুলে ধরেন মেঘনা পাড়ের সেলিম মিয়া। ভোলা জেলায় তার মতো আরো প্রায় ২০০,০০০ জেলে রয়েছে যাদের অবস্থা প্রায় একই রকম। রাজধানী ঢাকার সুপার স্টোরগুলোতে এক কেজি ইলিশ বিক্রি হচ্ছে ১,১৫০ টাকায়। আর অন্যদিকে ভোলা ও চাঁদপুরের ইলিশ জেলেরা মাসিক ৩,০০০  – ৫,০০০ টাকা উপার্জন করতে গিয়ে হিমশিম খাচ্ছেন দিন-রাত।

বঙ্গোপসাগের যেসব মাছ পাওয়া যায় তার মধ্যে ইলিশ অন্যতম। উচ্চ পুষ্টিগুন ও অর্থনৈতিক মূল্য ছাড়াও বাঙালী সংস্কৃতিতে এই মাছটির রয়েছে আলাদা স্বকীয়তা। বাংলাদেশে পাঁচ লাখেরও বেশি উপকূলীয় মৎসজীবি সরাসরি এই মাছটি  ধরার সঙ্গে জড়িত। অন্যদিকে মাছের বিপনন, পরিবহন ও বাজারজাতকরণের সঙ্গে যুক্ত আছে আরো প্রায় ৩০ লাখ মানুষ। কিন্তু বেসরকারী সংস্থা ওয়ার্ল্ড ফিশ-এর তথ্য মতে, নদীতে ইলিশের পরিমান কমছে প্রতিনিয়ত, মারাত্বক ঝুঁকির মুখে রয়েছে বাঙালীর সবচেয়ে প্রিয় এই মাছটি। এর মূল কারণ হচ্ছে পলি জমে তলদেশ ভরাট হয়ে নদীর গভীরতা কমে যাওয়া এবং মাত্রাতিরিক্ত জাটকা (ইলিশের পোনা) নিধন।

গত ২০০১-০২ অর্থবছরে বাংলাদেশে ইলিশের উৎপাদন ছিল ২২০,০০০ মেট্রিক টন, ২০১৩-১৪ অর্থবছরে মাছটির উৎপাদন ছিল ৩৮৭,০০০ মেট্রিক টন, অর্থাৎ দশ বছরে এর উৎপাদন বৃদ্ধির হার ৭৫%। দ্যথার্ডপোল.নেটকে এ তথ্য জানান বাংলাদেশ মৎস্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক সৈয়দ আরিফ আজাদ। তবে নদী জুড়ে মাছের উৎপাদন বদ্ধি হলেও ভাগ্যের তেমন উন্নতি হয়নি এদেশের জেলে সম্প্রদায়ের।  চরম অভাবের সময় একটু বেশি আয়ের আশায় তাই অনেক সময়ই আইন অমান্য করে অনেক জেলে নদীতে জাটকা ধরতে যান। সত্যি বলতে কি, অভাবের তাড়নায় অনেক সময় এই অন্যায় পথ বেছে নিতে বাধ্য হন অনেক জেলে।

সেলিম মিয়া বলেন, ‘আমরা খুব ভালো করেই জানি যে জাটকা নিধন আইনত অবৈধ ও দন্ডণীয় জা না সত্বেও আমাদের মধ্যে অনেকেই এই নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে থাকে। আমরা জাটকা ধরার নিষেধাজ্ঞা ভঙ্গ করে নদীতে মাছ ধরতে যাই। কারন সেসময় আমাদের কোনো কাজ থাকে না। উপার্জনের অন্যান্য রাস্তাও বন্ধ থাকে। আর মহাজনরাও আমাদের ঋণের টাকা শোধ করার জন্য চাপ দিতে থাকে।’

মাঠপর্যায়ে বাস্তবতা

বেশিরভাগ জেলেরই নিজের কোনো জাল বা নৌকা নেই। তারা নৌকা ও জালের টাকা জোগাড় করেন স্থানীয় মহাজনদের কাছ থেকে ঋণ নিয়ে। তাই জাল, নৌকা ও এমনকি ধৃত মাছের উপরেও মহাজনদের পূর্ণ কর্তৃত্ব থাকে।

‘দরিদ্র্র জেলেরা সবসময়ই মহাজন বা ব্যাপারীদের দ্বারা শোষিত হয়। ব্যাপারীদের কাছে আমরা যে দামে মাছ বিক্রি করি, খোলা বা পাইকারী বাজারে প্রকৃতপক্ষে সেই মাছের দাম অনেক বেশি। আমরা কখনই মাছের প্রকৃত মূল্য পাই না।’ দ্যথার্ডপোল.নেটকে একথা বলেন ভোলার তুলাতলীর জেলে আব্দুল সাত্তার।

সাধারণত জেলেরা কখনই পাইকারী ও খূচড়া বিক্রেতা এবং ভোক্তাদের সাথে সরাসরি যোগাযোগ করেন না। তারা স্থানীয় ঘাটে ব্যাপারীদের কাছে মাছ বিক্রি করেন। জেলেদের কাছ থেকে এই মাছ সংগ্রহে মধ্যস্থতা করে স্থানীয় আড়তদার। এরা নিলাম মূল্যের ২ – ৫ শতাংশ  অর্থ কমিশন হিসেবে নিয়ে থাকে। ঘাটের এই নিলামকারী, আড়তদার ও ব্যাপারীরাই আসলে খোলা বাজারে ইলিশের মূল্য নির্ধারনে মূল ভূমিকা রাখেন। এই বৃত্তের সর্বনি¤œ পর্যায়ে রয়েছে জেলেরা যারা কখনই নিজেদের ইচ্ছায় মাছের মূল্য নির্ধারন করতে পারে না।

বেসরকারী সংস্থা কোষ্ট ট্রাষ্ট অনেক দিন ধরেই ভোলায় জেলেদের জীবনমান উন্নয়নে কাজ করে যাচ্ছে। সংস্থাটির কর্মসূচি সমন্বয়ক মিজানুর রহমান দ্যথার্ডপোল.নেটকে বলেন, গড়ে প্রতিটি জেলে পরিবারের ঋণের পরিমান ৬২,০০০ টাকা। পাওয়ার অ্যান্ড পার্টিসিপেশন রিসার্চ সেন্টার (পিপিআরসি) পরিচালিত এক গবেষনা প্রতিবেদনের তথ্য তুলে ধরে তিনি বলেন, ভোলার ৩৩% জেলের নিজস্ব কোনো বসতভিটা নেই, প্রায় ৪০% জেলের কোনো নৌকা নেই এবং ২৯% জেলের কোনো মাছ ধরার জাল নেই।

কাজে আসছে না সহায়তা প্রকল্প

ইলিশের উৎপাদন বৃদ্ধির লক্ষ্যে সরকার সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসুচির আওতায় দেশের ক্ষতিগ্রস্থ্য জেলেদের বিভিন্ন ধরনের সহায়তা প্রদান করে আসছে। এই সহায়তা প্রকল্পের অন্যতম উদ্দেশ্য হচ্ছে যাতে  জাটকা ও মা ইলিশের মৌসুমে জেলেদেও মাছ ধরা থেকে বিরত রাখা যায়। বছর জুড়ে মূলত চার মাস এই ধরনের নিষেধাজ্ঞা বাস্তবায়ন করে সরকার।

এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে মৎস ও পশুসম্পদ মন্ত্রী মুহাম্মদ সাইয়েদুল হক বলেন, গত ছয় বছরে সরকার ভিজিএফ কার্যত্রমের আওতায় ২২৪,০০০ জেলে পরিবারকে ১৫৮,০০০ মেট্রক টন খাদ্য সহায়তা প্রদান করেছে।

তবে বাস্তবে এই চিত্র একটু অন্যরকম। ভোলা জেলা কেন্দ্রীয়  মৎসজীবি সমবায় সমিতি’র সম্পদাক আবুল কালাম মাঝি বলেন বর্তমানে ভোলা জেলায় প্রকৃত জেলের সংখ্যা ২০০,০০০ – এর বেশি যারা ইলিশ ধরার সঙ্গে সরাসরি সম্পৃক্ত। কিন্তু এদের মধ্য থেকে সরকার মাত্র ১১৭,০০০ জনকে মৎসজীবি হিসেবে নিবন্ধিত করেছে। অথচ নিবন্ধিত অনেকেই মাছ ধরার সঙ্গে জড়িত নয়। স্থানীয় রাজনৈতিক নেতারা ভোট পাওয়ার জন্য প্রকৃত জেলেদের বাদ দিয়ে অনেক অপেশাজীবিকে জেলে হিসেবে নিবন্ধিত করেছে।

তার মতে, সরকারের পক্ষ থেকে দরিদ্র জেলেদের খাদ্য সহায়তা দেয়া হয় তা আসলে কোনো উপকারে আসছে না। তিনি বলেন, সরকারের এই কর্মসুচির আওতায় প্রতিটি পরিবারের ১৬০ কেজি করে চাল পাওয়ার কথা থাকলেও প্রকৃতপক্ষে তারা পাচ্ছেন মাত্র ৪০  – ৬০ কেজি চাল। দূর্নীতির অভিযোগ করে তিনি বলেন, সরকারের দেয়া সহায়তার এই চাল একজন জেলে হাতে পায় মাছ ধরার নিষেধাজ্ঞা মৌসুমের অনেক পরে। এমনিতেই জাটকা ও ইলিশের ডিম পাড়ার মৌসুমে মাছ ধরার উপরে নিষেধাজ্ঞা থাকায় জেলেদের ওই সময়ে কোনো উপার্জন থাকে না। অন্যদিকে সরকারের পক্ষ থেকে যে সহায়তা দেয়া হয় তা-ও সময়মতো হাতে পাওয়া যায়না। ফলে পরিবারের সদস্যদের খাদ্যের যোগান দিতে বাধ্য হয়ে অনেক জেলেই নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে মাছ ধরতে যায়।

যেহেতু এই সময় জেলেদের হাতে কোনো কাজ থাকে না, তাই বাধ্য হয়ে তারা মহাজন বা ব্যাপারীদের কাছ থেকে টাকা ঋণ নিয়ে সংসার চালান।

আব্দুল সাত্তার বলেন, ‘আমাদের অর্থ বা খাদ্য সহায়তার প্রয়োজন নেই। বরং আমাদের বিকল্প কর্মসংস্থ’ান কিংবা মৌসুমী ব্যবসার জন্য প্রশিক্ষণ বা অর্থ সহায়তা প্রদান করুন যাতে আমাদের দৈনন্দিন একটি উপার্জন হয়।’

সামনে আশার আলো

জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে মাত্রাতিরিক্ত ইলিশ নিধনে বন্ধে সরকার এরই মধ্যে নানা কর্মসুচি গ্রহন করেছে। হিলশা কনজারভেশন ট্রাষ্ট ফান্ড (এইচসিটিএফ) নামে একটি প্রকল্প চালুর মাধ্যমে সরকার ইলিশ সংরক্ষরনের পাশপাশি জেলেদের বিকল্প কর্মসংস্থান সৃষ্টির লক্ষ্যে কাজ করছে।

মৎস অধিদপ্তরের কর্মকর্তাদের দেয়া তথ্য মতে, ইলিশ ব্যবস্থাপনায় একটি তহবিল তৈরির লক্ষ্যে যুক্তরাজ্যের ডারউইন ইনিশিয়েটিভ বাংলাদেশ সরকারকে সহায়তা প্রদান করবে।

বেসরকারী সংস্থা ইন্টারন্যাশনাল ওয়াটার অ্যাসোসিয়েশন (আইডব্লিউএ) সম্প্রতি একটি প্রকল্প বাস্তবায়নের কাজ শুরু করেছে যার মাধ্যমে বাংলাদেশ ও ভারতে ইলিশ ধরার সাথে যুক্ত জেলেদের জাটকা মৌসুমে সরকারের পক্ষ থেকে কী ধরনের বিকল্প কর্মসংস্থান বা সহায়তা প্রদান করা যেতে পারে তা নিয়ে গবেষনা করাে হচ্ছে।

অন্যদিকে ঢাকাস্থ্য বাংলাদেশ সেন্টার ফর অ্যাডভান্সড স্টাডিজ (বিসিএএস), যুক্তরাজ্য ভিত্তিক প্রতিষ্ঠান ইন্টারন্যাশনাল ইন্সটিটিউট ফর এনভায়রনমেন্ট অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট (আইআইইডি) এবং বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় (বিএইউ) একসঙ্গে মৎস অধিদপ্তরের সঙ্গে কাজ করছে। ডারউইন ইনিশিয়েটিভের আওতায় এই প্রকল্পের উদ্দেশ্য হচ্ছে মেঘনায় ইলিশের উৎপাদন বৃদ্ধি করা।

বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক আব্দুল ওয়াহাব বলেন, ইলিশ সংরক্ষনে সবার আগে জাটকা নিধন বন্ধ করতে হবে। এজন্য প্রয়োজন জেলেদের কাজের খরা মোকাবেলা করা।

তিনি বলেন, ‘ইলিশ সংরক্ষনে ট্রাষ্ট ফান্ড গঠন করা গেলে জাটকা মৌসুমে জেলেদের বিকল্প কর্মসংস্থান সৃষ্টি করা যাবে।

 

অনুবাদতানজিলা রওশন

 

Privacy Overview

This website uses cookies so that we can provide you with the best user experience possible. Cookie information is stored in your browser and performs functions such as recognising you when you return to our website and helping our team to understand which sections of the website you find most interesting and useful.

Strictly Necessary Cookies

Strictly Necessary Cookie should be enabled at all times so that we can save your preferences for cookie settings.

Analytics

This website uses Google Analytics to collect anonymous information such as the number of visitors to the site, and the most popular pages.

Keeping this cookie enabled helps us to improve our website.

Marketing

This website uses the following additional cookies:

(List the cookies that you are using on the website here.)