করোনা ভাইরাসের বিস্তার ঠেকাতে দক্ষিণ এশিয়ার প্রায় সবগুলো দেশই এ মুহুর্তে লকডাউন কার্যকর করে চলেছে। আর এই সুযোগটিই কাজে লাগাচ্ছে অবৈধভাবে বন্যপ্রানী শিকার ও বানিজ্যের সাথে যুক্ত থাকা অপরাধীরা। সরকার এ মুহুর্তে লকডাউন কার্যকরে সার্বিক প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখায়, চোরা শিকারীরা তাদের অবৈধ কাজ চালিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে আইন প্রয়োগকারী সংস্থার চোখকে অনায়াসেই এড়িয়ে যেতে পারছে।
ভারত, পাকিস্তান ও নেপালের কর্মকর্তারা বলছেন তাদের দেশে বিপন্ন প্রজাতির প্রানী ও বিরল পাখিসহ সব ধরনের বন্য প্রানী শিকার বা চোরা শিকারীদের তৎপরতা অনেক বেড়ে গেছে। কোভিড-১৯ মোকাবেলায় সরকার লকডাউন কার্যকর করাতে দেশব্যাপী সৃষ্টি হয়েছে মারাত্বক অর্থনৈতিক সংকট। ফলে স্বাভাবিক আয়-উপার্জনের পথ হারিয়ে এখন অনেকেই বন্য প্রানী শিকার ও এর বানিজ্যের সাথে যুক্ত হয়ে পড়েছে।
এই পরিস্থিতি এখন বিশ্বব্যাপী। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া, আফ্রিকা, ব্রাজিল ও কলম্বিয়াতে চলছে একই অবস্থা। কারন হিসেবে সেখানকার বিশেষজ্ঞরা কোভিড-১৯ সংক্রান্ত নানা সরকারী বিধিনিষেধের কথাই বলছেন। এসব দেশে এখন চোরা শিকারের পাশাপাশি ব্যাপকহারে বনাঞ্চল উজাড়ের ঘটনাও বাড়ছে।
ওয়াইল্ড লাইফ কনজারভেশন সোসাইটির সংরক্ষণ বিভাগের প্রধান যোসেফ ওয়ালটন বলেন, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার অনেক দেশেই ব্যাপক হারে আভ্যন্তরীন অভিবাসনের ঘটনা ঘটছে। বিশেষ করে প্রচুর মানুষ রাতারাতি চাকুরী বা উপার্জনের পথ হারিয়ে শহর থেকে গ্রামে ফিরে যেতে বাধ্য হচ্ছে। এদের মধ্যে কেউ কেউ চোরা শিকার, বৃক্ষ নিধনসহ বিভিন্ন ধরনের অবৈধ কর্মকান্ডে লিপ্ত হওয়ার মাধ্যমে প্রকৃতিকে বিনষ্ট করছে। আসলে এদের হাতে উপার্জনের উপায় না থাকাতেই তারা এ ধরনের কর্মকান্ডে জড়িয়ে পড়ছে।
এই চিত্র দক্ষিণ এশিয়ার জন্যেও সমভাবে প্রযোজ্য। ভারতের ক্ষেত্রে এ মুহুর্তে চোরা শিকারের যে ঘটনা লীপিবদ্ধ হচ্ছে তা কেবল ‘হিমবাহের অগ্রভাগ’ দেখার মতোই। পাকিস্তানের কর্মকর্তারা বলছেন গত মার্চ থেকে এপ্রিল মাস পর্যন্ত দেশটিতে রেকর্ড পরিমানে অবৈধভাবে বন্য প্রানী শিকারের ঘটনা লিপিবদ্ধ হয়েছে। নোপালে সাম্প্রতিক বছরগুলোর মধ্যে এই ধরনের ঘটনা উদ্বেগজনক আকার ধারণ করেছে। তবে আশার কথা, কেবল বাংলাদেশেই বন্য প্রানী নিধন ও চোরা শিকারের ঘটনা নি¤œমুখী, যদিও প্রানী সংরক্ষণবিদরা বন্য প্রানীদের হুমকিতে থাকা নিয়ে যথেষ্ট উদ্বিগ্ন।
বহু বছর ধরেই এখানকার দেশগুলো অবৈধভাবে বন্য প্রানী নিধন ও বাণিজ্য বন্ধে নিরন্তর কাজ করে চলেছে, তারপরও সাম্প্রতিক সময়ে এই লকডাউন পরিস্থিতিতে দেখা যাচ্ছে এসব কর্মকান্ডের বিস্তার অভাবনীয় হারে বেড়ে চলেছে।
পাকিস্তানের বিভিন্ন অঞ্চলে পাচারের হার বেড়েছে তিনগুন
দেশটির উত্তরাঞ্চলে খাইবার পাখতুনখোয়ায় (কেপি) চলতি বছরের ১২ মার্চ থেকে ২২ মে পর্যন্ত চলমান লকডাউনকালে অবৈধভাবে চোরা শিকার বৃদ্ধি পেয়েছে।
কেপির বন্যপ্রানী বিভাগের বিভাগীয় কর্মকর্তা মুহাম্মদ নিয়াজ বলেন, গত ২০ মার্চ থেকে ৩০ এপ্রিলের মধ্যে আমরা মোটামুটি অবৈধ বন্যপ্রানী শিকার ও নিধনের ৬০০টি ঘটনা লিপিবদ্ধ করেছি। স্বাভাবিক সময়ে এই ধরনের ঘটনা সাধারণত ১৫০ থেকে ২০০ এর মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে।
বেশিরভাগ ক্ষেত্রে দেশের বড় শহরগুলোতে মানুষের বাড়িতে পোষা পাখি ও প্রানীর চাহিদা মেটাতে চোরাপথে অবৈধ প্রক্রিয়ায় এগুলো সরাবরাহ করা হয়। অনেক ক্ষেত্রেই আবার এসব প্রানী মানুষের দৈনন্দিন চাহিদার অংশ হিসেবেই খোলা বাজারে বিক্রি করা হয়।
কেবল দেরা ইসমাইল খান জেলাতেই বন বিভাগের কর্মকর্তারা ২২০জন বন্য প্রানী শিকারীকে আটক করে যারা ইন্দাস নদীর আশে পাশের এলাকায় কার্যক্রম পরিচালনা করতো। দ্যথার্ডপোল.নেটকে এই তথ্য জানান সেখানকার জেলা বন্যপ্রানী কর্মকর্তা খান মালুক।
তিনি বলেন, সাম্প্রতিক সময়ে বন্য প্রানী চোরাচালানের সবচেয়ে বড় ঘটনাটি ঘটে গত ২৪ মার্চ। এদিন একদল চোরাকারবারী ৬৫টি সারস পাখি ডি.আই. খান থেকে পেশওয়ারে নিয়ে যাওয়ার পথে ধরা পড়ে। এই চালানটি আটক করার পর দেখা যায় চোরাকারবারীরা পাচারের লক্ষ্যে সারসগুলোর মাথা একসঙ্গে কাপড় দিয়ে ঢেকে এম্বুলেন্সে এমনভাবে নিয়ে যাচ্ছিল যাতে মনে হয় এম্বুলেন্সটিতে কোনো ব্যক্তিকে বহন করা হচ্ছিল।
বেলুচিস্তান প্রদেশের প্রধান বন্যপ্রানী ও বন সংরক্ষক শরিফুদ্দিন বলেন, খাইবার পাখতুনখোয়ায় চোরাচালানের ঘটনা দিন দিন বাড়ছে কারন পাকিস্তানের এই প্রদেশটি পরিযায়ী পাখিদের জন্য একটি অন্যতম বিশ্রামের কেন্দ্র। শীতের সময়ে কাটিয়ে ভারত থেকে সাইবেরিয়া যাওয়ার পথে পরিযায়ী এসব পাখি খাইবার পাখতুনখোয়ায় কিছুদিন অবস্থান করে বিশ্রামের উদ্দেশ্যে।
লাভজনক বাণিজ্য
পেশওয়ারের পাখি বিক্রেতা মুহাম্মদ শোহাইব বলেন, আসলে চোরা শিকার ও পাচার একটি বেশ লাভজনক বাণিজ্য। আর তাই অনেকেই করোনাকালীন লকডাউনের সময় বনবিভাগের দৈনন্দিন কর্মকান্ডের শিথীলতার সুযোগটি নিচ্ছে। এই সময়ে খোলা বাজারে চোরা শিকারীদের বদৌলতে পাখির চালান অনেক বৃদ্ধি পেয়েছে বলে শিকার করেন শোহাইব।
পরিযায়ী পাখিসহ বন্য পাখি বেচাকেনায় লাভের পরিমান অনেক বেশি। চোরা শিকারীরা সারস/বক পাখিসহ অন্যান্য প্রজাতির পাখি বিক্রি করে মাসে লাখ লাখ টাকা উপার্জন করে থাকে। পাকিস্তানে সারস জাতীয় বক পাখির মূল্য সাধারনত ৭০০০ পাকিস্তানী রুপী (৪৪ মার্কিন ডলার) থেকে ২০ লাখ রুপী (১২,৫০০ মার্কি ডলার) পর্যন্ত বিক্রি হয়ে থাকে।
শোহাইব বলেন, আসলে খোলা বাজারে বিরল প্রজাতির বন্য প্রানীর উচ্চমূল্যই অনেককে এই অবৈধ কাজে লিপ্ত হতে আগ্রহী করে তুলছে। যা আসলে এই ধরনের বিপন্ন প্রজাতির বন্যপ্রানীদের জন্য মারাত্বক হুমকিস্বরুপ।
বনবিভাগের কর্মকর্তাদের বিশ্বাস এই লকডাউনে বিকল্প উপার্জনের আশায় প্রচুর মানুষ এখন চোরাগোপ্তাভাবে বন্যপ্রানী নিধন ও এর বাণিজ্যের সাথে যুক্ত হয়েছে। কারন লকডাউনের ফলে স্বাভাবিক অর্থনৈতিক কর্মকান্ড পুরোপুরি বন্ধ রয়েছে। এ অবস্থায় দায়িত্বশীল কর্তৃপক্ষের নজরদারী কিছুটা কম থাকায় কেবল পেশাদার চোরা শিকারীই নয়, অন্যান্য সাধারণ মানুষও এই অবৈধ আয়ের পথে মাঠে নামছে।
এছাড়াও লকডাউনে বাসা-বাড়িতে অলস সময় কাটানো তরুন-তরুণীরা তাদের সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে শিকার করা বন্য প্রানীদের ছবি ব্যাপকহারে ছড়িয়ে দিচ্ছে। এর মাধ্যমেও মানুষের মধ্যে এই ধরনের প্রানী সংগ্রহের প্রবনতা কিছুটা বাড়ছে। আর এই সুযোগেই নতুন নতুন মানুষ চোরা শিকারীর কাতারে সামিল হচ্ছে। দ্যথার্ডপোল.নেট-এর কাছে এভাবেই মন্তব্য করেন বনবিভাগের কর্মকর্তারা।
নেপালে মারা পড়ছে বিপন্ন প্রজাতির বহু বন্য প্রানী
নেপালে বিভিন্ন ধরনের বিপন্ন প্রজাতির বন্যপ্রানী সংক্রান্ত বেশ কয়েকটি ঘটনা জনমনে এখন একটি প্রশ্নেরই জন্ম দিচ্ছে। আর তা হচ্ছে লকডাউন কার্যক্রম শুরুর পর থেকেই দেশটিতে চোরা শিকারের ঘটনা কেবল বাড়ছেই।
দায়িত্বশীল কর্মকর্তাদের ধারনা, করোনা মহামারীর কারনে মানুষের উপার্জনের পথ বন্ধ হয়ে যাওয়া, চলাফেরার উপরে বিধি নিষেধ এবং পর্যটন সংশ্লিষ্ট অর্থনৈতিক কর্মকান্ড বন্ধ থাকায় অনেকেই এখন কর্মহীন। তাই উপার্জনের পথ বেছে অনেকেই জড়িয়ে পড়ছে অবৈধ বন্য প্রানী শিকার ও চোরাচালানের কাজে।
গত ২৫ এপ্রিল দেশটিতে লকডাউনের কার্যকরের প্রায় এক মাস পরে এভারেস্ট পর্বতের পাদদেশে অবস্থিত সাগরমাথা জাতীয় পার্কে ৬টি কস্তুরী হরিণের দেহ উদ্বার করা হয়। পার্কটির কর্মকর্তারা মনে করছেন সাম্প্রতিক বছরগুলোর মধ্যে সংঘঠিত চোরা শিকারের সংক্রান্ত এটিই সবচেয়ে বড় ও মারাত্বক ঘটনা।
সাগরমাথা জাতীয় পার্কের প্রধান সংরক্ষক ভূমিরাজ উপাধ্যায় বলেন, আমরা যখন ঠিক ঘটনাস্থলে পৌছাই, তখন দেখতে পাই হরিণগুলোকে ফাঁদ পেতে শিকারের চেষ্টা করা হয়েছে। আমরা পৌছে প্রানীগুলোকে মৃত অবস্থায় পাই। প্রানীগুলোর মধ্যে একটি পুরুষ হরিণের শরীর থেকে শিম্ব অপসারণ করা হয়।
দক্ষিণ এশিয়ায় হিমালয় মাস্ক ডিয়ার কস্তুরী নামেই ব্যাপক পরিচিত। এ অঞ্চলে এই প্রজাতির হরিণ একটি বিপন্ন প্রজাতির প্রানী হিসেবে বিবেচিত। এই প্রজাতির পুরুষ হরিণের সুগন্ধীযুক্ত গ্রন্থি (মৃগনাভী) উচ্চমূল্যে বিক্রি হয়। এছাড়াও সুগন্ধী ও নানা ধরনের প্রথাগত পথ্য তৈরীতে মৃগনাভী ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হয়।
হিমালয়ের পাদদেশে অবস্থিত খুম্বু শহরের বাসিন্দা দাওয়া নুরু শেরপা। সম্প্রতি তিনি তার ফেসবুকে এ ধরনের আরো একটি ঘটনার কথা উল্লেখ করেন। তার ওই পোষ্টে তিনি বলেন, একই এলাকায় কিছুদিন আগে একটি মৃত সোনালী ঈগল পাওয়া যায়। ঈগল পাখিটিকে টোপ দিয়ে আটকের চেষ্টা করা হয়েছিল। সেখানে তারের তৈরি অনেকগুলো টোপ পাওয়া যায়।
এদিকে দেশটির উত্তরাঞ্চলে অবস্থিত পারসা জাতীয় পার্কে চোরা শিকারীদের সাথে টহলরত সৈনিকদের মধ্যে গুলি বিনিময়ের ঘটনা ঘটে। দেশটির জাতীয় উদ্যান ও বন্য প্রানী সংরক্ষণ বিভাগের তথ্য কর্মকর্তা বিঞ্চু শ্রেষ্ঠা জানান, ওই ঘটনায় একজন সৈন্য গুলিবিদ্ধ হয়। আর অপরপক্ষে একজন চোরা শিকারী ঘটনাস্থলেই গুলিবিদ্ধ হয়ে নিহত হয়।
পার্কটির প্রধান সংরক্ষন কর্মকর্তা আমির মহারাজন জানান, ওই ঘটনায় কর্তৃপক্ষ ওই দলের একজনকে গ্রেফতার করতে সক্ষম হয়। গ্রেফতকারকৃত ওই ব্যক্তি আসলে কাঠমন্ডুতে চিত্রকর হিসেবে কাজ করতেন। লকডাউন শুরুর পর তিনি কাজ হারিয়ে গ্রামের বাড়িতে চলে আসেন।
এভাবে একের পর এক ঘটনার পর সার্বিক নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার করেছে নেপালের প্রানী সংরক্ষণ কর্তৃপক্ষ। এ বিষয়ে বিঞ্চু শ্রেষ্টা বলেন, যদিও সরকার আমাদের বিভাগকে এই লকডাউনের সময় অত্যাবশ্যকীয় সেবা প্রদানকারী সংস্থা হিসেবে চিহ্নিত না করলেও আমরা আমাদের সকল কার্যালয় এখন খোলা রেখেছি।
নেপালে সাধারণত বসন্তে সবগুলো জাতীয় উদ্যানে পর্যটকদের আগমন ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পায়। ভূমিরাজ উপাধ্যায় বলেন, আমাদের সবগুলো সংরক্ষিত এলাকা এখন পর্যটকশূন্য। আর এ কারনেই চোরা শিকারীরা বন্য প্রানী নিধনের সুযোগ পাচ্ছে। বসন্তের আগমনের সাথে সাথে এভারেস্টের পাদদেশের পুরো অঞ্চলটি পর্যটকে পূর্ণ হয়ে যায়। কিন্তু এ বছর কেবল লকডাউনের প্রভাবে সেখানে নিরবতা, নেই কোনো পর্যটক। আর তাই ফাঁদ পাততে উঠে পড়ে লেগেছে চোরা শিকারীর দল।
বিঞ্চু শ্রেষ্টা আরো বলেন, লকডাউন শুরু হওয়ার পর থেকেই দেশের বিভিন্ন স্থানে বন্যপ্রানী শিকার ও অবৈধভাবে বনভূমি উজাড়ের মতো প্রচুর ঘটনা ঘটছে। দেশটির সবচেয়ে জনপ্রিয় উদ্যান হচ্ছে চিতওয়ান জাতীয় উদ্যান। সেখানেও সম্প্রতি একটি হাতি ও তিনটি কুমির হত্যার ঘটনা ঘটেছে বলে জানা যায়।
ভারতের বিপন্ন বন্য প্রানী
লকডাউন শুরুর পর থেকেই ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলে চোরা শিকারের ঘটনা বাড়তে থাকে। অবৈধভাবে বন্য পাখি শিকার করে খাঁচায় পুড়ে বিক্রি থেকে শুরু করে মানুষের রসনা বিলাসের জন্য বন্য প্রানীর মাংস আর এসব প্রানীর বিভিন্ন অঙ্গ থেকে তৈরি নানা পন্যের অবৈধ আন্তর্জাতিক বাজার যেন এক রমরমা বাণিজ্য যা উৎসাহিত করে চোর শিকারীদের।
উরিষ্যার সিমলিপাল টাইগার রিজার্ভ এলাকা থেকে গত ১০ মে একটি চিতা বাঘের চামড়াসহ চার ব্যক্তিকে গ্রেফতার করা হয়। একই দিনে দেশটির উত্তর-পূর্ব রাজ্য আসামের কাজীরাঙ্গা জাতীয় উদ্যান থেকে চোরা শিকারীদের হাতে নিহত একটি গ-ার উদ্ধার করা হয়। ভারতের বন্য প্রানী সংরক্ষনের সাথে জড়িতরা বলছেন, পর্যাপ্ত নজরদারীর অভাবে এভাবে চোরা শিকারীদের হাতে মারা পড়তে থাকলে খুব অল্প সময়ের ভিতরেই ভারত থেকে গ-ার হারিয়ে যাবে চিরতরে। শিংয়ের উচ্চমূল্যের কারনেই এভাবে দিনকে দিন চোরা শিকারীদের লোভের বলী হচ্ছে অসহায় এই গ-ারগুলো।
চোরা শিকারের ঘটনা বাড়ছে রাজস্থানেও। সেখানে অতিবিপন্ন প্রানী চিংকারা (মরুভূমির কৃঞ্চসারমৃগ) চোরা শিকারীদের হাতে মারা পড়ছে। আগে ভারতের বিস্তির্ন এলাকায় এদের বিচরণ থাকলেও বর্তমানে কেবল রাজস্থানেই এদের দেখতে পাওয়া যায়।
তবে গণমাধ্যমে যেসব তথ্য আসছে তা সামগ্রিক ঘটনার আংশিক চিত্র মাত্র। মরুভূমি বাস্তুবিদ্যার (ডেজার্ট ইকোলজি) শিক্ষার্থী সুমিত দুকিয়া বলেন, আমাদের কাছে প্রাপ্ত তথ্য মতে পশ্চিম রাজস্থানে সাম্প্রতিক সময়ে কমপক্ষে ৫৫টি বন্য প্রানী শিকার/হত্যার ঘটনা ঘটেছে। চোরা শিকারীদের হাতে মারা পড়া প্রানীদের মধ্যে রয়েছে চিংকারা, কৃঞ্চসার, গিরগিটি, মরু খরগোশ, ময়ূর, গুইসাপ ও মেটে তিতির। সুমিত কমিউনিটি কনজারভেশন নিয়েও কাজ করে থাকেন।
এদিকে কর্নাটকের বান্দিপুর টাইগার রিজার্ভেও একটি চোরা শিকারী দলের সন্ধান পাওয়া গেছে। সম্প্রতি চিতল হরিনের ৫০ কেজি মাংসসহ নয়জন ব্যক্তিকে গ্রেফতার করা হয়। এই ঘটনাগুলো দেশে ঘটে যাওয়া আরো অনেক ঘটনার অংশিক চিত্র মাত্র। এসব ঘটনায় জড়িত অনেকেই বন বিভাগের বিভিন্ন অস্থায়ি পদে কর্মরত ছিলেন।
বাংলাদেশে অবৈধ প্রানী শিকার এখন শূন্যের কোঠায়
দক্ষিণ এশিয়ার অন্য দেশগুলোর তুলনায় বাংলাদেশে অবৈধ প্রানী শিকার লকডাউনের সময় কড়া নিয়ন্ত্রনের মধ্যে রয়েছে বলেন জানিয়েছে বনবিভাগ।
দেশটির বন্যপ্রানী ও প্রকৃতি সংরক্ষণ সার্কেলের বন সংরক্ষক মিহির কুমার দে বলেন, বাংলাদেশে করোনা মহামারী শুরুর পর থেকে এখন অব্দি অবৈধ বন্য প্রানী শিকারের ঘটনা ঘটেনি। আসলে এই লকডাউনের মধ্যেও আমাদের বন্য প্রানী অপরাধ নিয়ন্ত্রণ বিভাগ (ডব্লিউসিসিইউ) বিরামহীন কাজ করে যাচ্ছে। যেহেতু এ মুহুর্তে যান চলাচল ও পরিবহনে বিধিনিষেধ রয়েছে, তাই বন্য প্রানী শিকার ও পরিবহন নিয়ন্ত্রনে রাখা গেছে।
দেশটির প্রধান বন সংরক্ষক মো. আমির হোসাইন চৌধুরী বলেন, বাংলাদেশে মূলত বন্য প্রানীর কোনো বাজার বা স্থানীয়ভাবে এর কোনো চাহিদা নেই। বরং বাংলাদেশ বন্য প্রানী চোরাচালানের ক্ষেত্রে একটি আন্তর্জাতিক রুট হিসেবে ব্যবহৃত হয়ে থাকে… তবে আমরা দেখেছি করোনা মহামারীর এই সময়ে অবৈধ বন্য প্রানী শিকার ও চোরাচালান নিচের দিকে নেমে এসেছে।
ডব্লিউসিসিইউ’র হিসেব মতে, ২০১৩ থেকে ২০১৯ সালের শেষ পর্যন্ত সারাদেশে ৪৩৮টি বন্য প্রানী চোরাচালানের ঘটনা রেকর্ড করা হয়। এর মধ্যে ২০১৯ সালে মাত্র ১৯৭টি পাচারের ঘটনা ঘটে।
তবে সরকারের এই মন্তব্যের বিরোধীতাও রয়েছে। অনেকেই মনে করেন দেশে বন্য প্রানী নিয়ে অবৈধ বাণিজ্য বেশ বহাল তবিয়তেই চলছে। দেশের কিছু স্থানীয় বন্য প্রানীর প্রজাতি যেমন হরিণ, বনরুই, কাছিম ও কিছু স্থানীয় প্রজাতির পাখি এখনও পাচারের লক্ষ্যে অবৈধভাবে শিকারের মুখে পড়ছে বলে মন্তব্য করেন ক্রিয়েটিভ কনজারভেশন অ্যালায়েন্স-এর প্রধান নির্বাহী শাহরিয়ার সিজার রহমান।
তিনি বলেন, আইন-শৃংখলা বাহিনীর সদস্যরা এখন করোনা ভাইরাস মোকাবেলায় নানা ধরনের বিধিনিষেধ বাস্তবায়নে তৎপর। আর এর ভিতরেই অবৈধ পাচারকারীরা দেশের স্থল বন্দরগুলো ব্যবহার বন্য প্রানী চোরাচালান চালিয়ে যাচ্ছে। দেশের পার্বত্য অঞ্চলে বসবাসকারী অনেক আদিবাসী সম্প্রদায়ের সদস্যরাও জীবিকার মাধ্যম হিসেবে এখন এই অপরাধটিকে বেছে নিচ্ছে। এটি আসলে সত্যিকার অর্থেই বেশ উদ্বেগজনক।
প্রতিবেদনটি তৈরিতে কাজ করেছেন: পাকিস্তানের আদিল সাঈদ, ভারতের নেহা সিনহা, নেপালের এ আর যোশি ও বাংলাদেশের নাজমুন নাহার শিশির।
ইংরেজিতে প্রকাশিত মূল প্রতিবেদনটির বাংলা অনুবাদ করেছেন আরিক গিফার।