শ্রীলংকার পর দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে উন্মুক্ত স্থানে মল ত্যাগ বন্ধ করতে অসামান্য সফলতা পেয়েছে বাংলাদেশ। ১৯৭১ সালে স্বাধীনতার পর সামজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিকভাবে বিপর্যস্ত একটি দেশ হয়েও এমন একটি ক্ষেত্রে এগিয়ে যাওয়া নিশ্চয়ই একটি বড় অর্জন। তবে এক্ষেত্রে শতভাগ সাফল্য এখনও পায়নি বাংলাদেশ। পশ্চাৎপদ জনপদ হিসেবে পরিচিত ‘হাওর’ অঞ্চলগুলো এখনও এই সাফল্যের অংশিদার হতে পারেনি। বাংলাদেশের এই অঞ্চলগুলো এখনও মূল ধারার উন্নয়নের চেয়ে অনেক পিছিয়ে আছে।
আরো জানতে পড়–ন (ইংরেজীতে): বাংলাদেশে খোলা স্থানে মলত্যাগ প্রায়া শূন্যের কোঠায়
হাওর অঞ্চল বলে পরিচিত দেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের বিস্তীর্ণ এলাকা বছরের প্রায় ছয় মাসই জলের নিচে ডুবে থাকে। এখানকার অধিবাসীরা বালুর উপর বাড়ি-ঘর নির্মান করে বসবাস করে। শুষ্ক মৌসুমে এ অঞ্চলের মানুষজন কোনো কোনো পরিবার অস্থায়ি সৌচাগার ব্যবহার করলেও শিশুরা উন্মুক্ত স্থানেই মল-মূত্র ত্যাগ করে। তবে বর্ষা মৌসুমে পুরো বিষয়টি একটি নাজুক আকার ধারণ করে। কারন এসময় কেবল বসবাসের ঘর-বাড়িগুলো ছাড়া পুরো এলাকাই চলে যায় জলের নিচে।
বাংলাদেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের জেলা সুনামগঞ্জের ঘাগটিয়া গ্রামের মকবুল হোসাইন জানান, বর্ষা মৌসুমে হাওরবাসীরা জলের উপরে অস্থায়ি ভিত্তিতে কোনো রকমে ঝুলন্ত সৌচাগার তৈরি করে থাকেন। এ ধরনের সৌচাগার থেকে সৃষ্ট বর্জ্যরে শতভাগই অপরিশোধিত অবস্থায় জলের সাথে মিশে যায়। ভৌগলিক কারনেই এসব অঞ্চলে শুকনো জমির পরিমান অনেক কম। ফলে স্থায়ি সৌচাগার নির্মান করা একটি অত্যন্ত দূরহ কাজ। সারাদেশের ৮৫ শতাংশ জনগণ স্বাস্থ্যসম্মত স্যানিটেশন কার্যক্রমের আন্তর্ভূক্ত হলেও, জল ও স্বাস্থ্য ব্যবস্থা নিয়ে কাজ করে এমন একটি বেসরকারী সংস্থা এনজিও ফোরাম প্রনীত এক মানচিত্র অনুযায়ি দেশের কেবল ৩০ থেকে ৩৯ শতাংশ এলাকার জন্য এই তথ্য প্রযোজ্য। এছাড়া বাংলাদেশের অন্যতম উন্নয়ন প্রকল্প হাওর ডেভেলপমেন্ট মাস্টার প্ল্যান অনুযায়ি এদেশে একটি সৌচাগার কমপক্ষে ১১ জন ব্যক্তি ব্যবহার করে থাকে।
তবে, এ বছর, এই চিত্র কিছুটা পাল্টে গেছে।
দ্যথার্ডপোল.নেটকে হোসাইন বলেন, কোনো উপায় না থাকায় আগে আমাদের এলাকায় বসবাসকারী লোকজন যেখানে সেখানে মল-মূত্র ত্যাগের মাধ্যমে জল দূষণ করতো। তবে আমরা আজকাল এই ভাসমান সৌচাগার ব্যবহার করছি। এটি প্রকৃত অর্থে আমাদের জন্য বেশ ভালো একটি সমাধান বয়ে নিয়ে এসেছে ।
পথ দেখালো এক উদ্বাবনী ধারণা
সুনামগঞ্জে চাকুরীরত সরকারী কর্মকর্তা মোহাম্মদ তালাতের মাথায় প্রথম ভাসমান সৌচাগারের ধারনাটি সৃষ্টি হয়। দ্যথার্ডপোল.নেট-এর কাছে তিনি এই অভিনব সৌচাগার নিয়ে কথা বলেন।
ভাসমান সৌচাগার সম্পর্কে জানতে চাইলে মোহাম্মদ তালাত বলেন, এটি আসলে খুব সাধারন একটি কারিগরী। যে কেউই তিন থেকে পাঁচটি খালি ড্রাম, একটি প্লাস্টিক প্যান, বাঁশ, দড়ি এবং আড়াল তৈরির জন্য কিছু পলিথিনের টুকরো বা কাপড় দিয়ে এই ধরনের একটি সৌচাগার তৈরি করতে পারেন। তিনি বলেন, এই সৌচাগার তৈরি করতে হলে প্রথমে তিনটি ড্রামকে পাশপাশি ও আড়াআড়িভাবে রাখতে হবে। এক্ষেত্রে দু’টি ড্রাম ব্যবহৃত হবে মাঁচা (প্লাটফর্ম) হিসেবে এবং মাঝখানে থাকা অপর ড্রামটি ব্যবহৃত হবে বর্জ্য আধার (সেপটিক ট্যাংক) হিসেবে। মাঝখানের ড্রামটিকে একটু কেটে নিয়ে সেখানে একটি প্ল্যাষ্টিক প্যান বসিয়ে দেয়া যেতে পারে।
শুষ্ক মৌসুমে এসব সৌচাগার মাটিতেই থাকতে পারে আর বর্ষায় অনায়াসে এটি ভাসমান সৌচাগার হিসেবে ব্যবহার করা যায়। প্ল্যাস্টিক প্যানের মাধ্যমে বর্জ্যগুলো ড্রামের মধ্যে প্রবেশ করিয়ে সাময়িক সংরক্ষন করা যায়। একটি ২০০ লিটার ড্রাম সর্বোচ্চ ১৬০ লিটার পর্যন্ত বর্জ্য ধারণ করতে পারে। অবশ্য ড্রাম পূর্ণ হয়ে গেলে বর্জ্য সংরক্ষন করার নির্দিষ্ট আধারে (স্থায়ি সেপটিক ট্যাংক) এসব বর্জ্য অপসারন করে ড্রামটিকে খালি করতে হবে। তালাতের মতে, তিন সদস্যের একটি পরিবারের জন্য এই ট্যাংক (মাঝের ড্রাম) পূর্ণ হতে প্রায় একমাস সময় লাগে। অত্যন্ত স্বল্প খরচে তৈরি এই ধরনের সৌচাগার একটি পরিবার প্রায় চার থেকে পাঁচ বছর পর্যন্ত ব্যবহার করতে পারবে।
মাত্র তিন হাজার টাকায় (৪০ মার্কিন ডলার) এ ধরনের একটি সৌচাগার তৈরি করা যায়। অন্যদিকে প্রচলিত একটি স্যানিটারি সৌচাগার তৈরির খরচ এর খরচের প্রায় দশ গুন। সুনামগঞ্জ জেলা প্রশাসন কার্যালয় প্রাঙ্গনে অব্যবহৃতভাবে পড়ে থাকা অবৈধ বালু ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে বাজেয়াপ্ত করা বিপুল সংখ্যক খালি ড্রাম দেখে এই ধারণাটি তার মাথায় আসে বলে তিনি জানান।
তিনি বলেন, আমি ভাবছিলাম কীভাবে হাওর অঞ্চলের জনগনের স্যানিটেশন সমস্যার সমাধান করা যায়। এক পর্যায়ে দেখলাম এই সমস্যার সমাধান তো আমাদের হাতের নাগালেই রয়েছে! এসব জিনিস দিয়েই আমি ভাসমান সৌচাগারের নকশা এঁকে ফেলি। এক পর্যায়ে বর্ষা মৌসুমে জলমগ্ন মানুষের জন্য ভাসমান সৌচাগার নির্মান প্রকল্পের আওতায় আমরা ঘাগটিয়ার ৪৮টি পরিবারে এই সৌচাগার প্রদান করি।
ভবিষ্যত পরিকল্পনা
ভবিষ্যত পরিকল্পনা সম্পর্কে জানতে চাইলে হোসাইন বলেন, গ্রামের লোকজন এই সৌচাগার পেয়ে খুব খুশী। পরবর্তী পদক্ষেপ কী হবে জানতে চাইলে তিনি বলেন, এসব সৌচাগার থেকে সৃষ্ট সব বর্জ্য থেকে সার প্রস্তুত করা হবে । সরকার এরই মধ্যে আমাদের গ্রামে চারটি বড় আকারের স্থায়ী সেপটিক ট্যাংক নির্মান করে দিয়েছে। এছাড়াও দেয়া হয়েছে দু’টি শক্তিশালী পাম্প। গ্রামের চারটি ট্যাংকে বর্জ্য সংরক্ষন করা হবে। আর ভাসমান সৌচাগারগুলোর ট্যাংকগুলো ভরে গেলে পাম্পের মাধ্যমে সেখান থেকে বর্জ্যগুলো স্থায়ী সেপটিক ট্যাংকে পাঠানো হবে।
তবে এই প্রকল্পটির সাফল্য নির্ভর করবে জনগনের পরিবর্তীত মনোভাবের উপরে। জানতে চাইলে ভাসমান সৌচাগারের ডিজাইনার মোহাম্মদ তালাত বলেন, আসলে সৌচাগারের নকশা তৈরি করাটা কিন্তু মূল চ্যালেঞ্জ ছিল না। আমাদের জন্য মূল চ্যালেঞ্জটি হলো সাধারণ মানুষের অভ্যাসের পরিবর্তনের প্রবনতা সৃষ্টি করা। দেখতে হবে এ ধরনের সৌচাগার পেয়ে তাদের মধ্যে উন্মুক্ত স্থানে মল-মূত্র ত্যাগের অভ্যাসের কোনো পরিবর্তন হচ্ছে কিনা।
তবে একটি ভালো দিক হচ্ছে এখন পর্যন্ত এই সৌচাগার নিয়ে প্রশাসন ও ব্যবহারকারী স্থানীয় অধিবাসীদের মধ্যে বেশ ইতিবাচক মনোভাব লক্ষ্য করা যাচ্ছে। স্থানীয় প্রশাসন এই প্রকল্পের সাফল্য নিয়ে বেশ আশাবাদী। সুনামগঞ্জ জেলার জেলা প্রশাসক শেখ রফিকুল ইসলাম বলেন, ভাসমান সৌচাগার নিয়ে স্থানীয় প্রশাসনের হাতে নেয়া প্রকল্পটি একটি অসাধারন উদ্যোগ। আমরা এখন জেলার অন্যান্য হাওর এলাকাতেও এই প্রকল্প পরিচালনা করতে চাই। খুব শীঘ্রই সরকারের কাছে অর্থ চেয়ে এ ধরনের একটি প্রকল্প প্রস্তাব করবো। কারন আমরা মনে করছি এই প্রকল্পের মাধ্যমে এই এলাকার জনগনের অপরিচ্ছন্ন জীবন যাপনের প্রবনতা পরিবর্তন করা সম্ভব হবে।
অনুবাদ: তানজিলা রওশন