দূষন

এশিয়ার কয়লা নীতি – উন্নয়নের স্বপ্নে প্রাপ্তি কেবল অপরিণত মৃত্যু

গ্রীনপিস ও হার্ভার্ডের সাম্প্রতিক এক গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে এশিয়ার বিভিন্ন দেশে চীনের অর্থায়নে চলমান কয়লা প্রকল্পগুলোর ক্ষতিকর প্রভাবের কারনে বছরে ৭০ হাজার মানুষের অপরিণত বয়সে মৃত্যু ঘটে থাকে
বাংলা
<p>&#8220;Governments should not use poverty-reduction to justify coal projects that would condemn millions to a life of poor health&#8221; (Image by Kemal Jufri / Greenpeace)</p>

“Governments should not use poverty-reduction to justify coal projects that would condemn millions to a life of poor health” (Image by Kemal Jufri / Greenpeace)

এই শীতে উত্তর চীনের বিস্তৃত এলাকা জুড়ে গভীর ধোঁয়াশার চাদরের আচ্ছাদান দৃশ্যমান। কমপক্ষে ৪৬০ মিলিয়ন মানুষ, যা কি না যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা ও মেক্সিকোর মোট জনগনের সমান,  অত্যন্ত ঘন দূষিত বায়ুর কম্বলের চাঁদরে আচ্ছাদিত অবস্থায় রয়েছে, যা আসলে চীনের বায়ু দূষণের মাত্রার সকল রেকর্ডকে ছাড়িয়ে গেছে।

চীনে প্রতি সাতটি অপরিণত বয়সের মৃত্যুর মধ্যে কমপক্ষে একটি মৃত্যুর কারণ হচ্ছে বায়ু দূষণ। এখন প্রতিটি হাসপাতালে হাজার হাজার রোগী ভর্তি রয়েছে, যাদের মধ্যে অনেকেই শ্বাস-প্রশ্বাস জনিত রোগে আক্রান্ত। এই অবস্থার কারন কিন্তু সবার জানা – স্টিল, সিমেন্ট এবং সবচেয়ে ভয়াবহ কয়লা-চালিত শক্তির মতো ভারী কলকারখানাগুলোই হচ্ছে এই অভাবনীয় মৃত্যুর কারন।

বায়ু দূষণের এই সমস্যার বাড়াবাড়ি অবস্থা নিরুপণ করে এরই মধ্যে চীন সরকার তার দেশের শিল্প কারখানায় কয়লা ব্যবহারের হার কমিয়ে আনার ব্যাপারে যাবতীয় ব্যবস্থা গ্রহন করেছে। এমনকি এ মুহুর্তে কয়লা ভিত্তিক বিদ্যুত প্রকল্পে কোনো ধরনের অনুমোদনও দেয়া হচ্ছে না। কিন্তু আশ্চর্য্যরে বিষয় হচ্ছে এশিয়ার অন্য দেশগুলোতে দিনকে দিন কয়লা ভিত্তিক বিদ্যুত প্রকল্পের কাজ শুধু বেড়েই চলেছে। আর এইসব প্রকল্পের অন্যতম অর্থ যোগানদাতা কিন্তু চীনের বড় বড় কোম্পানী।

বিশ্বব্যাপী প্রায় ৮০টি কয়লা নির্ভর বিদ্যুত প্রকল্পে চীনের সরাসরি বিনিয়োগ রয়েছে। আর এই বিনিয়োগ এমন দেশগুলোতে করা হচ্ছে যেসব দেশ তুলনামূলকভাবে নির্গমন নিয়ন্ত্রনে চীনের চেয়ে অনেক পিছিয়ে। অবশ্য কেবল চীনই নয়, জাপান ও কোরিয়ার অনেক বড় প্রতিষ্ঠানও এশিয়া ও পশ্চিমা দেশগুলোতে দেদারসে কয়লা ভিত্তিক বিদ্যুত প্রকল্পে বিনিয়োগ করে যাচ্ছে। আর এসব ক্ষেত্রে তারা নিজেদের দেশের নিয়মকানুন না মেনেই অন্য দেশে বিনিয়োগ অব্যাহত রেখেছে।

কয়লা ভিত্তিক বিদ্যুত কেন্দ্রগুলোর কারনে সৃষ্ট তীব্র বায়ু দূষণের ফলে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় বছরে কমপক্ষে ২০ হাজার মৃত্যুর ঘটনা ঘটছে। হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয় ও গ্রীনপিসের সাম্প্রতিক এক গবেষণা অনুযায়ি সামনের দিনগুলোতে পরিকল্পনাধীন যেসব বিদ্যুত কেন্দ্র রয়েছে সেগুলো বাস্তবায়িত হলে এই মৃত্যুর সংখ্যা বছরে ৭০ হাজার পর্যন্ত ছাড়িয়ে যেতে পারে। আর এই মৃত্যুগুলোর পিছনে দায়ী হৃদরোগ, ফুসফুসের ক্যান্সার ও স্ট্রোকের মতো ভয়াবহ রোগসমূহ।

অর্থাৎ শুধুমাত্র কয়লা বিদ্যুত প্রকল্পের কারনে মৃত্যুর সংখ্যা ২০১৫ সালে ইন্দোনেশিয়ায় ঘটে যাওয়া ভয়াবহ প্রানহানীর সংখ্যাকে ছাড়িয়ে যেতে পারে বলে আশংকা করা হচ্ছে। আর এই প্রাণহানীর ঘটনা ঘটতে থাকবে প্রতিবছর।

আর ২০৩০ সাল নাগাদ কেবল চীনেই অতিরিক্ত নয় হাজার প্রাণহানীর ঘটনা ঘটতে পাওে বলে আমংকা করা হচ্ছে। এর অর্থ হচ্ছে, চীনে কয়লা প্রকল্পগুলো থেকে নির্গমণের মাত্রা কমিয়ে আনা হলেও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার অন্যান্য দেশে চলমান প্রকল্প গুলো থেকে সৃষ্ট দূষণ আরো বাড়তে থাকবে এবং তা আশেপাশের প্রতিবেশী দেশগুলোতেও ছড়িয়ে পড়বে।

কয়লায় স্বাস্থ্যহানী

এই অঞ্চলের সবগুলো কয়লা বিদ্যুত প্রকল্প থেকে সৃষ্ট দূষণের মাত্রার পরিমান নিয়ে কী হতে পারে তা নিয়ে গবেষণা করেছে একদল গবেষক। তারা ভবিষ্যতে এই দূষণের মাত্রা কতটুকু হতে পারে তা একটি মডেলের মাধ্যমে নিরুপন করে এর মাধ্যমে কী ধরণের স্বাস্থ্যহানী ঘটতে পারে সে বিষয়ে একটি প্রতিবেদন তৈরি করেছে।

এখানকার অনেকগুলো দেশেই, বিশেষ করে ইন্দোনেশিয়া ও থাইল্যান্ডে বিদ্যুতের ব্যাপক চাহিদা রয়েছে। এই চাহিদা মেটাতে তারা কয়লা বিদ্যুত প্রকল্পগুলোকেই সবচেয়ে সাশ্রয়ী সমাধান হিসেবে মনে করছে। কিন্তু দু:খের বিষয় হচ্ছে এই সরকারগুলো এই পরিকল্পনা বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে জনগণের স্বাস্থ্য ও পরিবেশের বিষয়টিকে মোটেও আমলে নিচ্ছে না। ইন্দোনেশিয়ায় চলমান কয়লা বিদ্যুত প্রকল্পে সৃষ্ট দূষণের কারনে জনস্বাস্থ্যের যে হানী হচ্ছে তার অর্থনৈতিক মূল্যায়ন করলে তা অনায়াসেই সেদেশের বার্ষিক স্বাস্থ্য বাজেটকে ছাড়িয়ে যাবে।

গবেষণায় প্রাপ্ত ফলাফল সংশ্লিষ্ট সরকারগুলো আমলে নিলে নিশ্চয়ই তারা এ ধরনের পরিকল্পনা বাস্তবায়নের আগে পূণর্বিবেচনার কথা ভেবে দেখবে। যদি এই অঞ্চলে প্রস্তাবিত ও পরিকল্পনামাফিক সবগুলো কয়লা বিদ্যুত প্রকল্প বাস্তবায়িত হয়ে যায় তাহলে কয়লাসৃষ্ট দূষণের মাত্রা ২০৩০ সাল নাগাদ তিন গুন বৃদ্ধি পাবে। আর তা বাস্তবায়িত হলে জলবায়ু পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে এই পৃথিবী একটি ভয়াবহ দূর্যোগের মুখোমুখি হবে বলে মনে করেন বিশ্বব্যায়কের প্রেসিডেন্ট।

বিষয়টি কিন্তু এমন নয় যে উন্নয়নের অর্থনৈতিক মূল্য ও প্রভাব এই ধরনের মৃত্যু হারকে ছাপিয়ে যাবে। আসলে কয়লা কোনোভাবেই মানুষকে দরিদ্র অবস্থা থেকে উত্তরণে সহায়তা করে না, সম্প্রতি বিশ্বের ১২টি সহায়তা সংস্থা এক প্রতিবেদনে এ তথ্য জানিয়েছে। সত্যি কথা বলতে কি, বাস্তবে এটি পুরোটাই ভিন্ন ও বিপরীত। কয়লা ভিত্তিক প্রকল্পগুলোর মাধ্যমে দারিদ্র বিমোচন কোনো ভাবেই সম্ভব নয় বরং এর মাধ্যমে লক্ষ লক্ষ দরিদ্র মানুষের প্রানহানীর ঘটনা ঘটাই স্বাভাবিক। সরকারের উচিত দারিদ্র বিমোচনের নামে এই ধরনের প্রকল্প থেকে বিরত থাকা।

আন্ত:দেশীয় দূষণের কবলে চীন

ঠিক যে সময় শিল্পোন্নত দেশগুলো বিশুদ্ধ ও নবায়নযোগ্য জ্বালানী ব্যবহারে মনযোগী হচ্ছে এবং ধীরে ধীরে কয়লা ব্যবহার থেকে সরে আসতে শুরু করেছে, ঠিক তখনই এশিয়ার বিভিন্ন দেশ ও অঞ্চল যেন এক শতাব্দী আগেই রয়ে গেছে। গত দশকেও একটা সময় ছিল যখন চীন ছিল বিশ্বে কয়লা ভিত্তিক শিল্প পরিচালনার দিক থেকে প্রথম সারির দেশগুলোর মধ্যে একটি। আর এখন এটি বিশ্বের অন্যতম একটি দেশ যে কি না শিল্প কারখানায় কয়লা নির্ভরতা কমিয়ে আনতে শক্ত সিদ্ধান্ত নিতে চলেছে। পাশাপাশি ভবিষ্যতে বিশুদ্ধ ও নবায়নযোগ্য জ্বালানী ব্যবহারের পথে আরো এগিয়ে চলেছে। অবশ্য এই সিদ্ধান্ত তাকে শেষ পর্যন্ত নিয়ে হয়েছে ভয়াবহ বায়ুদূষণের মূল্যের বিনিময়ে।

এই ধরনের দূষণ নিরুপনের ক্ষেত্রে অনেক সময়ই কিন্তু আশেপাশের দেশগুলোর দূষণকে আমলে নেয়া হয় না। কয়লা সৃষ্ট দূষণের কারণে মৃত্যুর বেশিরভাগ ঘটনা চীনের স্থানীয় পর্যায়ের নির্গমনের কারনে ঘটে থাকলেও প্রতিবেশী দেশগুলোতে কয়লা ভিত্তিক নানা প্রকল্পে অর্থায়নের মধ্য দিয়েও চীনে এই দূষণ চলমান থাকবে। ধারণা করা হচ্ছে যে প্রতিবেশী অঞ্চল ও দেশগুলো থেকে সৃষ্ট দূষণের কারনে  ২০৩০ সাল নাগাদ নয় হাজার মানুষের অপরিনত বয়সে মৃত্যুর ঘটনা ঘটতে পারে।

পরিস্থিতি দৃষ্টে মনে হচ্ছে এশিয়ার এ অঞ্চলের সরকার ও ব্যবসায়ীদের মধ্যে কয়লার প্রতি এক ধরনের তীব্র ঝোঁক রয়েছে। এ পরিস্থিতিতে যে ধরনের বাণিজ্যিক সিদ্ধান্ত নেয়া হচ্ছে তা আসলে আগামী দশকগুলোতে ভয়াবহ দূর্যোগের সৃষ্টি করতে পারে। এবছরের শীতে উত্তর চীনের হাসপাতালগুলোতে রোগীদের চিত্র যেন সেই দূর্যোগেরই অশণি সংকেত!

 

 

 

Privacy Overview

This website uses cookies so that we can provide you with the best user experience possible. Cookie information is stored in your browser and performs functions such as recognising you when you return to our website and helping our team to understand which sections of the website you find most interesting and useful.

Strictly Necessary Cookies

Strictly Necessary Cookie should be enabled at all times so that we can save your preferences for cookie settings.

Analytics

This website uses Google Analytics to collect anonymous information such as the number of visitors to the site, and the most popular pages.

Keeping this cookie enabled helps us to improve our website.

Marketing

This website uses the following additional cookies:

(List the cookies that you are using on the website here.)