দূষন

সুন্দরবনে ফের জাহাজ দূর্ঘটনা!

সুন্দরবনে আবারো একটি জাহাজডুবির ঘটনার মধ্য দিয়ে প্রমানিত হলো যে কর্তৃপক্ষ অতীতের ঘটনাগুলো থেকে কোনো শিক্ষা নিতে পারেনি বরং ভবিষ্যতে এ ধরনের ঘটনা মোকাবেলায় প্রস্তুতি যে কতটাই ঠুনকো তা আরো পরিস্কার হয়ে উঠলো
বাংলা
<p>A lighterage vessel on the Pashur [image by Sharif Jamil]</p>

A lighterage vessel on the Pashur [image by Sharif Jamil]

প্রায় এক হাজার টন অপরিশোধিত কয়লা নিয়ে গত ১৩ জানুয়ারি বাংলাদেশের কোঙ্গা নদীর মোহনায় দূর্ঘটনায় পড়ে ডুবে গেছে লাইটারেজ জাহাজ এম ভি আইচগাতি। দূর্ঘটনার ৪৮ ঘন্টার  পেরিয়ে গেলেও গত রোববার পর্যন্ত, জাহাজটি উদ্ধারের কোনো তৎপরতা দেখা যায়নি স্থানীয় কর্তৃপক্ষের তরফ থেকে। অথচ দূর্ঘটনাস্থল থেকে দূষণ ছড়িয়ে পড়ছে বলে জানা গেছে।

এই ঘটনার পর পরিবেশবাদীরা সুন্দরবনের অদূরে নির্মিতব্য রামপাল কয়লা বিদ্যুত প্রকল্প নিয়ে আবারো উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। এই ঘটনার বিশ্লেষণে তারা বলছেন, রামপাল বিদ্যুত প্রকল্প নির্মাণ হলে ভারত-বাংলাদেশ সীমান্তে অবস্থিত বিশ্ব ঐতিহ্য সুন্দরবন ম্যানগ্রোভ বনাঞ্চলে ভয়াবহ প্রাকৃতিক বিপর্যয় বয়ে আসতে পারে।

সুন্দরবনের অভ্যন্তর ও চারপাশ জুড়ে রয়েছে অসংখ্য নদ-নদী, জলাধার ও খাল। কেবল সুন্দরবনের বাংলাদেশ অংশের প্রায় ৬,০০০ কিলোমিটার এলাকায় ৪০০টি ছোট – বড় নদী ও খাল রয়েছে। কয়লা ভর্তি জাহাজটি সুন্দরবনের পাশে পশুর ও শিবসা নদীর মোহনায় এসে দূর্ঘটনায় মুখে পড়ে। সুন্দরবনের জন্য এই দু’টি হচ্ছে অন্যতম প্রধান নদী।

গত শুক্রবার কয়লা ভর্তি করে দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের বাণিজ্যিক জেলা যশোরের নোয়াপাড়ার উদ্দেশ্যে রওনা দেয় এম ভি আইচগাতি। দু:খজনক এই যাত্রা শুরুর পর সকাল সাড়ে নয়টার দিকে জাহাজটির গায়ে ফাটল দেখা দেয়। ফলে দ্রুত জাহাজের ইঞ্জিনরুমে জল প্রবেশ করতে শুরু করে। এসময় খুব কাছ দিয়ে যাওয়া অপর একটি জাহাজ দূর্ঘটনায় পতিত এম ভি আইচগাতির ১২ জন ক্রু ও চারজন নিরাপত্তা কর্মীকে উদ্ধার করে। উদ্ধারকারী জাহাজটি সেই সময় ফ্লাই অ্যাশ বহন করছিল।

এম ভি আইচগাতি বহির্নোঙ্গরে অবস্থানরত ইন্দোনেশীয় জাহাজ এম ভি লেডি মেরি থেকে কয়লা ভর্তি করে নোয়াপাড়ার উদ্দেশ্যে রওনা হয়েছিল। দক্ষিণ আফ্রিকা থেকে এসব কয়লা আমদানী করা হয়। এম ভি আইচগাতির মতো এসব লাইটারেজ জাহাজ বহির্নোঙ্গরে অবস্থানরত সমুদ্রগামী জাহাজে পন্য আনা নেয়া ও পৌঁছে দেয়ার কাজ করে থাকে। সমুদ্রগামী এসব জাহাজ সাধারণত অগভীর জলে চলাচল করতে পারে না। তাই এই জাহাজগুলোকে বন্দরের বাইরে বহির্নোঙ্গরে অবস্থান করতে হয়। গত বুধবার থেকে এম ভি লেডি মেরি থেকে পন্য (কয়লা) খালাসের কাজ শুরু হয়। এই জাহাজটি থেকে পন্য খালাস করার কাজে আরো প্রায় ১২টি লাইটারেজ জাহাজ নিযুক্ত ছিল। এই জাহাজগুলো বহির্নোঙ্গর থেকে কয়লা বোঝাই করে কোঙ্গা ও পশুর নদীর বিভিন্ন চ্যানেল দিয়ে নোয়াপাড়া আসছিল।

নেই উদ্ধারকারী কোনো জাহাজ, উদ্ধারে ধীরগতি

মংলা বন্দরের হার্বার মাষ্টার মোহাম্মদ ওয়ালিউল্লাহ’র কাছে জানতে চাইলে তিনি দ্যথার্ডপোল.নেটকে বলেন, এই জাহাজ দূর্ঘটনাটির কারনে মংলা বন্দরের প্রধান চ্যানেলে স্বাভাবিক নৌ চলাচলে কোনো ধরনের সমস্যা হচ্ছে না। দূর্ঘটনার পর সমুদ্র ছিল বেশ উত্তাল। এ অবস্থায় এ ধরনের উদ্ধারকাজ ও নিমজ্জিত জাহাজের অবস্থান খুঁজে বের করার কাজটি অত্যন্ত জটিল হয়ে পড়ে।

এ ব্যাপারে দেশটির দায়িত্বশীল কর্তৃপক্ষের কেন্দ্রীয় পর্যায় থেকে কোনো বক্তব্য এখনও পর্যন্ত পাওয়া যায়নি। তবে মংলা বন্দর কর্তৃপক্ষ এরই মধ্যে দূর্ঘটনায় পতিত জাহাজটির অবস্থান চিহ্নিত করে সেখান থেকে সেটিকে অফসারণের ব্যবস্থা গ্রহনের জন্য নোয়াপাড়ার ব্যবসায়ীদের প্রতি অনুরোধ জানিয়েছে। এরই মধ্যে উদ্ধারকৃত ক্রুরা স্থানীয় পুলিশ স্টেশনে রিপোর্ট দাখিল করেছে। দূর্ঘটনায় পতিত জাহাজটির স্বত্বাধিকারী কাজি গোলাম ফারুক বলেছেন, এ মুহুর্তে তারা জাহাজটিকে অপসারণের উপায় কেমন হতে পারে তা নিরুপনের কাজটি করছেন। তবে প্রকৃত অপসারণ প্রক্রিয়া শুরু হতে আরো কয়েকদিন সময় লেগে যেতে পারে। এদিকে জাহাজ ডুবির এই ঘটনায় সর্বত্র আলোচনা-সমালোচনা শুরু হলে সরকারের পক্ষ থেকে এই ঘটনায় জাহাজের মালিক ও মাষ্টারের বিরুদ্ধে এরই মধ্যে একটি মামলা দায়ের করা হয়েছে।

খূলনা নিবাসী ম্যাংগ্রোপিডিয়ার সম্পাদক হাসান মেহেদী এ ব্যাপারে জানতে চাইলে দ্যথার্ডপোল.নেটকে বলেন, এ ধরনের ঘটনার পর জরুরী অবস্থা মোকাবেলায় করনীয় কী হতে পারে সে সম্পর্কে কোনো বিশেষ পরিকল্পনাই নেই দায়িত্বশীল কর্তৃপক্ষের। ম্যাংগ্রোপিডিয়া সুন্দরবন সম্পর্কিত একটি উদ্যোগ। বর্তমান সময়ের প্রেক্ষিতে উদ্ধারকারী জাহাজ হামজা ও রুস্তমের ঘটনাস্থলে পৌছাতে কমপক্ষে তিন দিন লাগতে পারে বলে তিনি জানান।

এ ধরনের দূর্ঘটনার ইতিহাস 

কোঙ্গা নদীতে ঘটে যাওয়া এই দূর্ঘটনার এক দিন পর ওয়াটারকিপারস বাংলাদেশ নামক একটি স্থানীয় একটি বেসরকারী সংস্থা জানায়, এম ভি আইচগাতির এই ঘটনাসহ গত দুই বছরে সুন্দরবনে এ ধরনের দূর্ঘটনা পঞ্চম বারের মতো ঘটলো। ২০১৪ সালের ডিসেম্বরে চাঁদপাই ডলফিন অভয়ারণ্যে ৩৫০ মেট্রিক টন তেল নিয়ে একটি তেলবাহী জাহাজ ডুবে যায় যা সাগরের জোয়ারের জল ও শ্যালা নদীর ¯্রােতের সাথে মিশে সুন্দরবনের ৪০ কিলোমিটার এলাকায় ছড়িয়ে পড়ে, ঠিক পাঁচ মাস পরে ২০১৫ সালের মে মাসে পটাশ ভর্তি একটি জাহাজ ডুবে যায় ভোলা নদীতে; একই বছর অক্টোবরে ৫৭০ টন কয়লা নিয়ে পশুর নদীতে ঢাংমারী ডলফিন অভয়ারন্যে ডুবে যায় আরো একটি কার্গো জাহাজ। এছাড়া ২০১৬ সালের মার্চে ১,২৪৫ টন কয়লা নিয়ে শ্যালা নদীতে ডুবে যায় আরো একটি কার্গো।

একের পর এক ঘটে যাওয়া এসব ঘটনায় ঢাংমারী ও চাঁদপাই ডলফিনের অভয়ারণ্যে মারাত্বক ক্ষতিকর প্রভাব লক্ষ্য করা যায়। দূর্লভ ইরাবতী ও গাঙ্গেয় ডলফিন সুরক্ষায় এই এলাকাগুলোকে অভয়ারণ্য হিসেবে ঘোষণা দেয়া হয়েছিল।

অতীতের ঘটনা থেকে শিক্ষা নেই

পরিবেশবাদীদের একের একের পর উদ্বেগ প্রকাশ ও সতর্কবার্তার পরেও দূর্ঘটনার এমন ঘটনা ঘটেই চলেছে। বাংলাদেশ এনভায়রণমেন্ট লয়ার্স অ্যাসোসিয়েশন- এর (বেলা) প্রধান নির্বাহী সৈয়দা রেজওয়ানা হাসান এ বিষয়ে দ্যথার্ডপোল.নেটকে বলেন, এ ধরনের ভয়াবহ ঘটনা থেকে শিক্ষা নেয়ার পরিবর্তে সরকার এক প্রকার জোর করেই রামপাল বিদ্যুত কেন্দ্র স্থাপনে জোর প্রক্রিয়া অব্যাহত রেখেছে। এই প্রকল্প বাস্তবায়ন হলে বিশ্ব ঐতিহ্য সুন্দরবনের ভিতর দিয়ে আরো ব্যাপক ভিত্তিতে কয়লা বোঝাই জাহাজ চলাচলে অনুমতি দেয়া হবে বলে আশংকা প্রকাশ করেন তিনি।

আরো জানতে পড়–ন (ইংরেজীতে):Bangladesh struggles to fund controversial Sundarbans coal project

ওয়াটারকিপার্স বাংলাদেশের সমন্বয়ক শরীফ জামিল বলেন, রামপাল বিদ্যুত কেন্দ্র চালু হলে সুন্দরবনের ভিতর দিয়ে শতাধিক জাহাজ ও কার্গো কয়লা নিয়ে নিয়মিত চলাচল করবে। আরো অনেকগুলো কারণ থাকলেও কয়লাবাহী জাহাজ চলাচলের কারনে সমূহ বিপদের কথা বিবেচনা করে বিশ্ব ঐতিহ্য কেন্দ্র ও আইইউসিএন রামপাল বিদ্যুত কেন্দ্রকে সুন্দরবনের জন্য মারাত্বক হুমকি হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। একইসাথে তারা অবিলম্বে এই প্রকল্প এখান থেকে স্থানান্তরের পরামর্শ দেয়।

বাংলাদেশের বহুল প্রচারিত ইংরেজী ভাষায় প্রকাশিত পত্রিকা দ্য ডেইলি স্টারে প্রকাশিত রামপাল প্রকল্পের পরিবেশগত প্রভাব সমীক্ষা প্রতিবেদনে বলা হয়, সমুদ্রগামী বিভিন্ন জাহাজে প্রায় ৮০,০০০ টন কয়লা আমদানী করে সুন্দরবনের বহির্নোঙ্গরে আকরাম পয়েন্টে খালাস করা হবে। এরপর সেখান থেকে বিভিন্ন লাইটারেজ জাহাজে করে পশুর নদী দিয়ে এই কয়লা নিয়ে আসা হবে রামপাল প্রকল্পে। এই প্রকল্পে প্রতিদিন ১০,০০০ টন কয়লা প্রয়োজন হবে। এর অর্থ হচ্ছে প্রায় প্রতিদিনই বেশ কয়েকটি জাহাজ পশুর নদী দিয়ে সুন্দরবনের ভিতর দিয়ে কয়লা নিয়ে চলাচল করবে যা আসলে বিশ্বের সবচেয়ে বড় এই ম্যানগ্রোভ বনাঞ্চলের জন্য একটি ভয়াবহ হুমকি!

 

 

Privacy Overview

This website uses cookies so that we can provide you with the best user experience possible. Cookie information is stored in your browser and performs functions such as recognising you when you return to our website and helping our team to understand which sections of the website you find most interesting and useful.

Strictly Necessary Cookies

Strictly Necessary Cookie should be enabled at all times so that we can save your preferences for cookie settings.

Analytics

This website uses Google Analytics to collect anonymous information such as the number of visitors to the site, and the most popular pages.

Keeping this cookie enabled helps us to improve our website.

Marketing

This website uses the following additional cookies:

(List the cookies that you are using on the website here.)