দূষন

ঢাকার প্রভাবশালী দূষণকারীদের সামনে মন্ত্রীও অসহায়

রাজধানী ঢাকার আশপাশের নদ-নদীর জল এতটাই দূষিত হয়ে পড়েছে যে এখন আর তা পরিশোধনের উপায় নেই। সরকার তাই এসব নদীর জল পরিশোধনের চিন্তা বাদ দিয়ে অধিকতর পরিস্কার নদীর জল ঢাকায় বয়ে নিয়ে এসে শোধন করে বসবাসকারীদের সরাবরাহের পরিকল্পনা বাস্তবায়নের কাজ শুরু করেছে
বাংলা
<p>Pollution in the river Buriganga, one of the main sources of water for Dhaka. (Photo credit: Rafiqul Islam)</p>

Pollution in the river Buriganga, one of the main sources of water for Dhaka. (Photo credit: Rafiqul Islam)

খুব অল্প সময়ের মধ্যেই ভয়াবহ জল সংকটের মুখামুখি হতে যাচ্ছে মেগাসিটি ঢাকার ১৪ মিলিয়ন জনগণ। এই শহরে বসবাসকারী মানুষের ব্যবহারের জলের অন্যতম উৎস শহরের চারপাশের নদী। অথচ ক্রমাগত অনিয়ন্ত্রিত দূষণের ফলে এসব নদীর জল এখন পানের একেবারেই অযোগ্য হয়ে পড়েছে। বিষয়টিকে মাথায় রেখে আগামী ২০২০ সালের মধ্যে ভূগর্ভস্থ্য উৎসের উপর নির্ভরশীলতা শূন্যের কোঠায় নামিয়ে আনার সিদ্ধান্ত নিয়েছে ঢাকা ওয়াশা।  শহরে বসবাসবারীদের জলের মোট চাহিদার ৭০ শতাংশই এখন থেকে ভূ-উপরিস্থিত উৎস অর্থাৎ নদ-নদী থেকে সংগ্রহ করা হবে। তবে নদী দূষণ যে হারে বেড়ে চলেছে তাতে বিষয়টিকে আপাতদৃষ্টে বেশ জটিল বলেই মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।

বুড়িগঙ্গা, শীতলক্ষ্মা, বংশী, তূরাগ, বালু ও ধলেশ্বরী – ঢাকাকে চারপাশ দিয়ে ঘিরে রেখেছে মূলত এই ৬টি নদী। সরকারের ভাবনা এই নদীগুলোর জলই বিশুদ্ধ করে ঢাকাবাসীকে সরাবরাহ করা হবে। কিন্তু দূষণের ফলে এই নদীগুলোর জল এতটাই বিষাক্ত হয়ে উঠেছে যে মানুষের ব্যবহারের জন্য তা পুরোপুরি অযোগ্য হয়ে পড়েছে।

সম্প্রতি বিশ্বব্যাংকের আর্থিক সহায়তায় প্লাজমা প্লাস অ্যাপ্লিকেশন অ্যান্ড রিসার্চ ল্যাবরেটরি নামের স্থানীয় একটি সংস্থার গবেষণায় এমন আশংকার কথাই বলা হয়েছে। সংস্থাটির পরিচালিত এক গবেষণায় বলা হয়েছে ঢাকার ৬টি নদীর জল এখন এতটাই দূষিত যে প্রচলিত প্রক্রিয়ায় এই জলকে ব্যবহারের উপযোগী করে তোলা ঢাকা ওয়াশার কোনোভাবেই সম্ভব নয়। বিশেষ করে শূষ্ক মৌসুমে এই জল পরিশোধন করা অসম্ভব। সবগুলো নদীর জলে দূষণ সৃষ্টিকারী জৈব জীবাণু এবং ভারী ধাতব পদার্থের পরিমান যেমন বেড়েই চলেছে। এছাড়া নদীগুলোর আশেপাশে গড়ে ওঠা কৃষিজমিতে ব্যবহৃত রাসায়নিক সার থেকে সৃষ্ট দূষণ, যেমন – নাইট্রোজেন ও ফসফেটের মতো রাসায়নিক পদার্থ ছড়িয়ে পড়ছে ব্যাপক হারে। এ অবস্থায় জলের গুণাগুণ নির্ণয় করার কাজে নিয়োজিত বিভিন্ন পরীক্ষাগারগুলো তাদের বিশ্লেষণ সক্ষমতা নিয়ে যথেষ্ট চাপের মুখে রয়েছে। কারণ প্রতিমুহুর্তেই এই সব নদীর জলে নতুন নতুন ধরনের দূষণ সৃষ্টিকারী জীবাণু চিহ্নিত করতে হচ্ছে, আর এই ধরনের জীবাণু চিহ্নিত করার কোনো প্রযুক্তি বা সক্ষমতাও নেই সংস্থাটির।

এই গবেষণাকারী দলটির প্রধান নিরীক্ষক আমির হোসাইন খান বলেন, নদীর জলে ক্ষুদ্র জৈব-দূষণ জীবাণু ও ভারী ধাতব পদার্থ অত্যন্ত বিপজ্জনক। কারণ এমন ধরণের জীবাণুর সন্ধান পাওয়া যাচ্ছে এসব নদীর জলে যা আসলে ওয়াশার পক্ষে চিহ্নিত করে শোধনা করা সম্ভব নয়।

ইন্সটিটিউট অব ওয়াটার মডেলিং – আইডব্লিউএম’র উপ-প্রধান নির্বাহী আবু সালেহ খান এ প্রসঙ্গে বলেন, কল-কারখানা থেকে সৃষ্ট দূষণ পুরোপুরিভাবে বন্ধ না হলে ঢাকার চারপাশের নদীগুলোর জল ব্যবহারের অযোগ্য হয়ে পড়াটাই স্বাভাবিক।

নির্ভরশীলতা বাড়ছে তাই আন্ত:সীমান্ত নদীর উপর

সরকারী তথ্য সূত্র অনুযায়ি, ঢাকা ওয়াশা এ মুহুর্তে শহওে বসকারীদের দৈনন্দিন মোট চাহিদার ৭৮ শতাংশ জল ভূ-গর্ভস্থ্য বিভিন্ন উৎস থেকে সংগ্রহ করে থাকে। বাকি ২২ শতাংশ জলের জন্য ভূ-উপরিস্থিত নদ-নদী ও অন্যান্য উৎসের উপর নির্ভর করতে হয়। বর্তমানে দৈনন্দিন মোট ২,৩৫০ মিলিয়ন লিটার চাহিদার বিপরীতে ঢাকা ওয়াশা ২,৪২০ মিলিয়ন লিটার জল সরাবরাহ করতে পারে। এই চাহিদার পরিমান ভবিষ্যতে আরো বাড়বে।

ভূ-গর্ভস্থ্য জলের স্তর ক্রমাগত নীচে নেমে যাওয়ার কারনে ঢাকা ওয়াশা ভূ-উপরিস্থিত বিভিন্ন উৎস থেকে জলের যোগান বৃদ্ধির পরিকল্পনা গ্রহন করেছে। বিশেষ করে পদ্মা (ভারতে যেটি গঙ্গা নামে পরিচিত) ও মেঘনার মতো আন্ত:সীমান্ত নদী থেকে এই জল সংগ্রহ করে সরাবরাহের কথা এখন ভাবা হচ্ছে – কারণ ঢাকার চারপাশের নদীর জল এখন আর ব্যবহারের অবস্থায় নেই।

ঢাকা ওয়াশার প্রধান নির্বাহী প্রকৌশলী এম শহীদ উদ্দিন জানান, চীন সরকারের সহায়তায় প্রায় ৩৫ বিলিয়ন টাকা (৪৪২ মিলিয়ন মার্কিন ডলার) ব্যয়ে পদ্মা (জশলদিয়া) জল পরিশোধন প্লান্ট স্থাপনের কাজ শুরু হয়েছে। এ প্রকল্পটির কাজ শেষ হলে এখান থেকে প্রতিদিন ৪৫০ মিলিয়ন লিটার জল পরিশোধন করা যাবে যা ঢাকার বাসিন্দাদের সরাবরাহ করা হবে।

এদিকে এশিয়া উন্নয়ন ব্যাংকের (এডিবি) আর্থিক সহায়তায় অপর একটি প্রকল্পের আওতায় মেঘনা নদী থেকে জল এনে ঢাকায় পরিশোধনের কাজও শুরু হয়েছে। ঢাকা ওয়াশা এই প্রকল্পের জন্য রাজধানীর খিলক্ষেতে একটি পরিশোধন প্লান্ট স্থাপনের কাজ করছে। এখান থেকে দৈনিক ৫০০ মিলিয়ন লিটার জল পরিশোধন করা হবে।

সরকার যেহেতু ঢাকার চারপাশের নদীগুলোর দূষণ নিয়ন্ত্রনে ব্যর্থ হয়েছে, তাই বাধ্য হয়েই তাকে অনেক দুরের নদী থেকে জল বয়ে নিয়ে এসে পরিশোধন করতে হচ্ছে। এছাড়া সরকারের আর কোনো বিকল্পও নেই। এমন মন্তব্য করেন আবু সালেহ খান।

আমির হোসাইন খান বলেন, মেঘনা নদী থেকে জল নিয়ে এসে ঢাকায় সরাবরাহ করার কাজটি বেশ জটিল। আমি মনে করি এটি দীর্ঘমেয়াদী কোনো সমাধান নয়। ঢাকার জল সংকট মোকাবেলা করতে হলে যে কোনো মূল্যে শহরের চারপাশের নদীগুলোতে দূষণ নিয়ন্ত্রণে কাজ করতে হবে।

নাজুক নগর জল ব্যবস্থাপনা

জলের সংকট থাকলেও ১৯৭১ সালে স্বাধীনতার পর থেকে দেশে শিল্প-কারখানা গড়ে উঠেছে ব্যাপকভাবে। আর শিল্প-কারখানার প্রায় অর্ধেকই গড়ে উঠেছে নদীর তীরে।  এই কারখানাগুলো থেকে সৃষ্ট সব ধরনের বর্জ্য সরাসরি নদীগুলোতে গিয়ে পড়ছে। সারাদেশের মতো রাজধানী ঢাকার চিত্রও একই। শহরের আশেপাশের সবগুলো কারখানা থেকে সৃষ্ট তরল রাসায়নিক বর্জ্য আশেপাশের এই ৬টি নদীতে ফেলা হচ্ছে। সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের পর্যাপ্ত তদারকির অভাবে এই নদীগুলোতে দূষণ তাই বন্ধ করা যাচ্ছে না।

বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনের (বাপা) সাধারণ সম্পাদক এম এ মতিন বলেন, ঢাকার চারপাশের ৬টি নদীর তীরে প্রায় ৭,৫০০টি শিল্প-কারখানা রয়েছে। এই সবগুলো কারখানা প্রতিদিনই তাদের বর্জ্য এই নদীগুলোতে ফেলছে।

সালেহ খান বলেন, আইন অনুযায়ি  দেশের সব কারখানায় বর্জ্য পরিশোধন প্লান্ট (ইটিপি) স্থাপন করা বাধ্যতামূলক। অথচ অধিক লাভের আশায় কারখানা মালিকরা তা অগ্রাহ্য করে আসছে দিনের পর দিন। ফলে প্রতিনিয়ত অপরিশোধিত রাসায়নিক ও ক্ষতিকর বর্জ্য অনায়াসে এই নদীগুলোতে গিয়ে পড়ছে।

তিনি বলেন, পরিবেশ দূষণ প্রতিরোধে আমাদের দেশে অনেক ভালো আইন রয়েছে। কিন্তু দু:খের বিষয় হচ্ছে এসব আইনের যথাযথ প্রয়োগ নেই। দূষণকারীরা তাই দিনকে দিন বাধাহীনভাবে এই নদীগুলোকে ধ্বংস করে চলেছে।

বাপার এম এ মতিন বলেন, ঢাকার চারপাশের এই নদীগুলোকে বাঁচাতে হলে কর্তৃপক্ষের প্রথমেই উচিত নদীগুলোতে ড্রেজিংয়ের মাধ্যমে নাব্যতা ফিরিয়ে আনা। পাশাপাশি এসব নদীর চারপাশে অবৈধ দখলদারদের উচ্ছেদ করতে হবে। তবে দু:খজনক হলেও সত্য, এক্ষেত্রে সরকারের সফলতা একেবারেই নেই। সম্প্রতি ঢাকায় একটি সেমিনারে দখল ও দূষণ প্রতিরোধে জলসম্পদ মন্ত্রী আনিসুল ইসলাম মাহমুদের বক্তব্যে তার ‘অসহায়ত্বের’ বিষয়টি স্পষ্ট হয়ে ওঠে। ওই সেমিনারে উপস্থিত শ্রোতাদের উদ্দেশ্যে এনিয়ে তার অসহায়ত্বের বিষয়টি খোলাখুলিভাবে তুলে ধরেন। এসময় তিনি সবাইকে দখল ও দূষণ প্রতিরোধে একযোগে কাজ করারও আহ্বান জানান।

পরিবেশ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক কাজী সারওয়ার ইমতিয়াজ হাশমী বলেন, আমাদের অধিদপ্তর নদী দূষণ নিয়ন্ত্রণে আইনের প্রয়োগ ও মনিটরিংয়ের কাজটি আরো জোরদার করেছে। তিনি বলেন, প্রধানমন্ত্রী  (শেখ হাসিনা) পরিবেশ সুরক্ষায় প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। তবে যারা দেশের জল দূষণ করছে তারা অত্যন্ত ক্ষমতাধর ও প্রভাবশালী । এদের কাছে অনেক সময় প্রধানমন্ত্রীও অসহায় হয়ে পড়েন!

 

Privacy Overview

This website uses cookies so that we can provide you with the best user experience possible. Cookie information is stored in your browser and performs functions such as recognising you when you return to our website and helping our team to understand which sections of the website you find most interesting and useful.

Strictly Necessary Cookies

Strictly Necessary Cookie should be enabled at all times so that we can save your preferences for cookie settings.

Analytics

This website uses Google Analytics to collect anonymous information such as the number of visitors to the site, and the most popular pages.

Keeping this cookie enabled helps us to improve our website.

Marketing

This website uses the following additional cookies:

(List the cookies that you are using on the website here.)