দূষন

নতুন সুরক্ষা নীতিমালা কি ঢাকার চারপাশের নদী বাঁচাতে যথেষ্ট?

বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকার চারপাশের চারটি নদী সুরক্ষায় সেগুলোকে পরিবেশগত ঝুঁকিপূর্ণ এলাকা (ইসিএ) হিসেবে ঘোষণা করার সরকারী সিদ্ধান্তকে এখন সমালোচনার দৃষ্টিতে দেখছেন পরিবেশবিদ ও বিশেষজ্ঞরা
বাংলা
<p>People wash chemical bags  in the Turag River.</p>

People wash chemical bags in the Turag River.

ঢাকার চারপাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া চারটি নদী  – বুড়িগঙ্গা, তুরাগ, বালু ও শীতলক্ষ্যাকে বাঁচাতে সরকারের গৃহীত নানা পদক্ষেপের বিষয়ে গত ৭ জুন জাতীয় সংসদে বক্তব্য উপস্থাপন করেন পরিবেশ মন্ত্রী আনোয়ার হোসেন মঞ্জু। সেখানে তিনি সরকারের বিভিন্ন পদক্ষেপের বিষয়ে আলোচনা করতে গিয়ে এই নদীগুলোকে ইসিএ হিসেবে ঘোষণার বিষয়টি তুলে ধরেন। পরিবেশ মন্ত্রীর বক্তব্যের পর ইসিএ ঘোষণাকে কেন্দ্র করে বিভিন্ন মহলে সমালোচনা সৃষ্টি হয়।

ঢাকার চারপাশের চারটি নদীকে ঢাকায় বসবাসকারী ১৬ মিলিয়ন মানুষের জন্য এই লাইফলাইন (জীবন রেখা বা প্রাণ বাঁচানোর জন্য যে উপকরণ) হিসেবে তুলনা করা হয়। ১৯৯৫ সালের পরিবেশ সংরক্ষণ আইন- ১৯৯৫ অনুযায়ি বাংলাদেশের পরিবেশ বিভাগ এই চারটি নদীকে ইসিএ হিসেবে ঘোষণা করে।

‘আমরা এখন এই নদীগুলোতে আবার প্রাণ ফিরিয়ে আনতে কাজ করে যাচ্ছি। আশা করি আমরা এক্ষেত্রে সফল হতে পারবো’ – দ্যথার্ডপোল.নেট এর কাছে এভাবেই নিজেদের অবস্থান তুলে ধরেন পরিবেশ বিভাগের উপপরিচালক রফিকুল ইসলাম।

তবে সরকারের সিদ্ধান্তকে অনেকেই যথেষ্ট বলে মনে করছেন না। তারা এই সিদ্ধান্তের সমালোচনাও করছেন বেশ কঠিনভাবে। তাদের মতে কেবল ইসিএ ঘোষণা করে এই নদী সুরক্ষা সম্ভব নয়। কারণ এরই মধ্যে অনেক দেরী হয়ে গেছে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূগোল বিভাগের অধ্যাপক আমানত উল্লাহ খান বলেন, আমি এই নদীগুলোকে এ মুহুর্তে ইসিএ ঘোষণা করার কোনো অর্থ খূঁজে পাই না। এই নদীগুলো কমপক্ষে ২০ বছর আগে স্বাভাবিক জীবন হারিয়েছে। অবৈধ দখলদাররা নদীগুলোকে গ্রাস করেছে। এসব নদীতে আসলে জল নেই, আসলে কেবল দূষণ ছাড়া নদীগুলোতে আর কিছুই অবশিষ্ট নেই।

তিনি আরো বলেন, আসলে এই নদীগুলোকে ইসিএ হিসেবে ঘোষণা করার আগে সরকারের উচিত নদীগুলোতে হাজার হাজার টন অপরিশোধিত দূষণ হওয়ার সুযোগ বন্ধ করা। যেখানে সরকার নিজেই এই নদীগুলোতে দূষণ-আবর্জনা ফেলছে সেখানে সরকার কী করে বাণিজ্যিক কারকানগুলোকে আবর্জণা ফেলা থেকে বিরত থাকতে বাধ্য করে?

উপমহাদেশের অন্যতম প্রাচীন এই শহরের বয়স প্রায় ৪০০ বছর। অথচ সরকার আজ অবধি এই শহরে একটি পরিবেশ বান্ধব পয়:নিষ্কাশন ব্যবস্থা গড়ে তুলতে পারেনি। উপরন্তু শহরের সব ধরনের আবর্জনা এবং বৃষ্টির জল এই চারটি নদীতে নিয়ে ফেলা হচ্ছে।

জাতীয় সংসদের স্থানীয় সরকার বিষয়ক কমিটির সভাপতি আবুল হাসনাত আব্দুল্লাহ দ্যথার্ডপোল.নেটকে বলেন, ঢাকা জল সরাবরাহ ও পয়:নিষ্কাশন কর্তৃপক্ষ (ওয়াসা) শহরের মোট আবর্জনার মাত্র ২০ শতাংশ পরিশোধন করতে পারে। বাকি আবর্জণা সরাসরি এই চারটি নদীতে নিয়ে ফেলা হয়।

স্থানীয় দূষণকারী টেক্সটাইল কারখানা এবং চামড়াজাত পণ্য উৎপাদনকারী কারখানাগুলো (ট্যানারি) সৃষ্ট অপরিশোধিত আবর্জণা নদীতে নিয়ে ফেলে থাকে। আর সবচেয়ে উদ্বেগজনক বিষয় হচ্ছে স্থানীয় প্রভাবশালী মহলগুলো নদী তীর ও অববাহিকা দখল করে কলকারখানা স্থাপন করেছে।

ঢাকা বুড়িঙ্গার তীরে অবস্থিত। এক সময় প্রায় ৫০০ মিটার ছিল এর প্রস্থ্য, ছিল প্রচুর মাছ আর ডলফিন। আর এখন কোথাও কোথাও এই নদীটির প্রস্থ্য মাত্র তিন মিটার! দখলকারীরা নদীর ভিতরে বালু এবং আবর্জণা ফেলে নদী ভরাট করে দখল করে নিচ্ছে, তৈরি করছে ইন্ডাষ্ট্রিয়াল প্লট। আর দায়িত্বপ্রাপ্ত সরকারী কর্মকর্তা/সংস্থাগুলো অনেকসময় অপারগ হয়ে এই অন্যায়গুলো দেখেও না দেখার ভান করে থাকে।

কর্তৃপক্ষের এই উদাসীনতার কারণে গুরুত্বপূর্ণ এই চারটি নদীর জীববৈচ্যিত্র বিশেষ করে মৎস সম্পদ মারাত্বক হুমকির মুখে, নৌ-চলাচল বলতে গেলে বন্ধ হওয়ার মতো অবস্থা। নদীগুলো এখন অনেকটাই দূর্গন্ধের নদী – নদীর ধারে হাঁটার সময় রুমালে নাঁক না চেপে হাঁটা সম্ভব নয়।

শীতলক্ষ্যা নদীর জল কখনও লাল আবার কখনও নীল, সবুজ আবার কালো। নদীর চারপাশে ট্রেক্সটাইল এবং ডায়িং (কাপড়ে রং করার কারখানা) কারখানাগুলোর বিষাক্ত রাসায়নিক বর্জ্য নদীতে গিয়ে পড়ছে প্রতিদিন। নদীর চারপাশে গড়ে উঠেছে শত শত স্টোন ক্রাশিং মেশিন (পাথর গুড়ো করার যন্ত্র)। এসব মেশিন থেকে পাথরের গুড়ো ও অন্যান্য উপাদান বেরিয়ে এসে বাতাসের সঙ্গে মিশে পুরো এলাকায় একধরনের মেঘের মতো আস্তরণ সৃষ্টি করে। একপর্যায় এগুলো থিতু হয়ে নদীর তলানীতে গিয়ে জমা হয়। আর এভাবেই কমতে থাকে নদীর গভীরতা।

তূরাগ নদীর দূষণের অন্যতম কারণ এর চারপাশে গড়ে ওঠা শত শত টেক্সটাইল (তৈরী পোশাক) কারখানা। তবে বালু নদীর অবস্থা আরো ভয়াবহ। এই নদীটির জলের রঙ দেখতে অনেকটাই মোটর এঞ্জিনের পোড়া তেলের রঙের মতো। আর এর জন্য মূলত দায়ী হচ্ছে ঢাকা ওয়াশা। আবুল হাসনাত আব্দুল্লাহ এ প্রসঙ্গে দ্যথার্ডপোল.নেটকে বলেন, গত দু’মাস আগে সংসদীয় কমিটি ঢাকার বর্জ্য ব্যবস্থাপনা নিয়ে বৈঠক করেছে। কমিটি অবলিম্বে রাজধানীতে প্রয়োজনীয় সংখ্যক বর্জ্য ব্যবস্থাপনা কেন্দ্র স্থাপনের সুপারিশ করেছে।

পরিবেশ বিভাগের এক গবেষণায় দেখা গেছে বুড়িগঙ্গা নদীর জল দূষণের ৩৫ শতাংশই আসে ট্যানারি কারখানা থেকে। অবাক করার বিষয় হচ্ছে  একই পরিমান দূষণের কারণ হচ্ছে ঢাকা ওয়াশা। দ্যথার্ডপোল.নেটকে এ তথ্য জানান পরিবেশ বিভাগের পরিচালক সুলতান আহমেদ।

বাংলাদেশের তৈরি পোশাক খাত হচ্ছে দেশের অন্যতম প্রধান দূষণসৃষ্টিকারী শিল্প। প্রতিদিন এই কারখানাগুলো লক্ষ লক্ষ টন তরল রাসায়নিক বর্জ্য নদীতে নিয়ে ফেলছে। ব্যাপকহারে পলিথিন ব্যাগের ব্যবহার, ব্যবহৃত প্লাস্টিক প্যাকেট ও বোতল নদীতে দূষণ সৃষ্টির আরো একটি অন্যতম কারণ। বলা হয়ে থাকে বুড়িগঙ্গা নদীর তলানীতে কেবল পলিথিন ব্যাগের কারনে কমপক্ষে ১০ ফুট উচ্চতার স্তর রয়েছে।

বাংলাদেশ সেন্টার ফর অ্যাডভান্সড ষ্টাডিজ নামক একটি বেসরকারী সংস্থা ২০০৯ সালে একটি সমীক্ষা পরিচালনা করে। ওই সমীক্ষা অনুযায়ি দেশের মাত্র ১০ শতাংশ কারখানার নিজস্ব বর্জ্য পরিশোধন কেন্দ্র (ইটিপি)  রয়েছে। এছাড়া আরো ১০ শতাংশ কারখানা এই কেন্দ্র স্থাপনে কাজ করে যাচ্ছে। এর অর্থ অত্যন্ত ভয়াবহ – দেশের অধিকাংশেরও বেশি কারখানা তাদের সৃষ্ট বর্জ্য সরাসরি নদীতে ফেলছে।

ইসিএ বলতে কী বোঝায়

ইসিএ সম্পর্কে জানতে চাইলে বিশিষ্ট পরিবেশবিদ ও নদী বিশেষজ্ঞ আইনুন নিশাত বলেন, কোনো এলাকাকে ইসিএ হিসেবে ঘোষণা করার অর্থ হচ্ছে বিভিন্ন ধরনের হুমকির কারনে ওই এলাকাটির অস্তিত্ব বিপন্নতার ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে। সরকার ইসিএ ঘোষণার মধ্য দিয়ে সেটিকে সব ধরনের ঝূঁকি থেকে মুক্ত রাখে এবং এর জীববৈচ্যিত্র ও পরিবেশকে পুনরুদ্ধার করার উদ্যোগ গ্রহন করে।

তবে ঢাকার চারপাশের এই নদীগুলোর ক্ষেত্রে ইসিএ আইন কার্যকর করতে হলে আসলে দূষণের উৎসগুরো চিহ্নিত করে তা পুরোপুরি বন্ধ করতে হবে। একই সাথে নদীর উপরে সব ধরনের দখলদ-ভরাট বন্ধ করতে হবে। যদি সঠিকভাবে এসব প্রক্রিয়া কার্যকর করা যায় সেক্ষেত্রে একটি ইসিএ’কে ধ্বংসের হাত থেকে সুরক্ষা করা যাবে বলে আমি মনে করি। আমরা ঢাকার বাইরে অনেকগুলো ইসিএ’কে সঠিকভাবে সুরক্ষা করতে সক্ষম হয়েছি। সেসব অভিজ্ঞতা এখানে কাজে লাগানো যেতে পারে।

কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে ঢাকার চারপাশের এই নদীগুলোর ক্ষেত্রে এটি বাস্তবায়ন অত্যন্ত জটিল। নদীর চারপাশে হাজার হাজার অবৈধ স্থাপনা তৈরী করা হয়েছে। যেমন- বুড়িগঙ্গাকে রক্ষা করতে হলে, এরই মধ্যে নদীর যেসব অংশ ভরাট করে দখলে নেয়া হয়েছে সরকারকে সেই অংশগুলো পূণ:রুদ্ধার করতে হবে। শুধুমাত্র ইসিএ ঘোষণা করেই চুপচাপ বসে থাকলে এই নদীগুলোকে পুন:রুদ্ধার করা সম্ভব হবে না।

এ অবস্থায় কেবল সময়ই বলে দেবে আসলে সরকার কি অবৈধ দখলদারদের কবল থেকে এই নদীগুলোকে রক্ষা করতে পারবে, নাকি একসময় নদীগুলো ইতিহাসে পরিণত হবে। তবে পরিবেশ বিভাগের পরিচালক সূলতান আহমেদ বলেন, সরকার এরই মধ্যে ট্যানারি কারখানাগুলোকে বুড়িগঙ্গার তীর থেকে অন্যত্র স্থানান্তর করার প্রক্রিয়া শুরু করেছে।

তিনি বলেন, আগামী ছয় মাসের মধ্যে এসব ট্যানারি কারখানা স্থানান্তরের কাজ শেষ হবে। নতুন স্থানে এদের সবার ইটিপি স্থাপন করা বাধ্যতামূলক করা হয়েছে । ট্যানারি থেকে বর্জ্য ফেরা পুরোপুরি বন্ধ হলে বুড়িগঙ্গার ৩৫ শতাংশ দূষণ বন্ধ করা সম্ভব হবে।

Privacy Overview

This website uses cookies so that we can provide you with the best user experience possible. Cookie information is stored in your browser and performs functions such as recognising you when you return to our website and helping our team to understand which sections of the website you find most interesting and useful.

Strictly Necessary Cookies

Strictly Necessary Cookie should be enabled at all times so that we can save your preferences for cookie settings.

Analytics

This website uses Google Analytics to collect anonymous information such as the number of visitors to the site, and the most popular pages.

Keeping this cookie enabled helps us to improve our website.

Marketing

This website uses the following additional cookies:

(List the cookies that you are using on the website here.)