ন্যায়বিচার

প্রথাগত আবাসভূমিতে পাঁচ তারকা হোটেল নির্মান, প্রতিবাদে বাংলাদেশের আদিবাসী সম্প্রদায়

পার্বত্য চট্টগ্রামে গড়ে তোলা হচ্ছে পাঁচ তারকা হোটেল ও বিনোদোন পার্ক। তবে এ উদ্যোগ মানতে পারছেন না সেখানকার আদিবাসী সম্প্রদায়। তাদের শংকা, এটি নির্মিত হলে নির্মানস্থলের আশেপাশে ক্ষতিগ্রস্ত হবে সুপেয় পানির উৎস। আর কমপক্ষে ১০,০০০ বাসিন্দা হারাবেন তাদের প্রথাগত জীবিকা
বাংলা
<p>নিজেদের প্রথাগত ভূমিতে রিসোর্ট তৈরির প্রতিবাদে ঢাকায় আদিবাসী ম্রো সম্প্রদায়ের বিক্ষোভ (ছবি: উতিং মারমা)</p>

নিজেদের প্রথাগত ভূমিতে রিসোর্ট তৈরির প্রতিবাদে ঢাকায় আদিবাসী ম্রো সম্প্রদায়ের বিক্ষোভ (ছবি: উতিং মারমা)

জীবনে প্রথমবারের মতো গত মাসে রাজধানী শহর ঢাকায় আসেন মিন চিক ম্রো (৫০)।  দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়ে তার ঢাকায় আসার উদ্দেশ্য ছিল প্রতিবাদ কর্মসুচিতে অংশগ্রহন। মিন চিক ম্রোর বাড়ি বাংলাদেশের দক্ষিণ-পূর্ব এলাকার পাহাড়ি জেলা বান্দরবান। সেখানে তাদের প্রথাগত আবাসভূমিতে গড়ে তোলা হচ্ছে বিলাসবহুল রিসোর্ট। পার্শ্ববর্তী দেশ মিয়ানমার ও ভারতের মিজোরাম রাজ্যের সাথে লাগোয়া দেশের এই সীমান্ত জেলায়  পাঁচ তারকা হোটেল নির্মান কাজ শুরু হয়ে গেছে। প্রতিবাদে তাই সোচ্চার দেশের আদিবাসী সম্প্রদায়।

ব্যাখ্যা: জুমিয়া ও জুম চাষ

জুম চাষ হচ্ছে একটি প্রাচীন পদ্ধতি যার মাধ্যমে একটি জমিতে অস্থায়িভাবে চাষাবাদ করা হয় এবং সেই জমি একটি নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত
অব্যবহৃত থাকে যাতে সেখানে পুনরায় উর্বরতা ফিরে আসে। এটি একটি বিশেষ চক্রীয় প্রক্রিয়া যাতে প্রথাগত চাষাবাদ পদ্ধতির বেশি জমির প্রয়োজন হয়।
আর যারা জুম চাষের সাথে যুক্ত তাদের জুমিয়া বলা হয়। এটি একটি স্থানীয় শব্দ।

মিন চিক ম্রো পেশায় জুম চাষী। বান্দরবানের প্রত্যন্ত গ্রাম কাপ্রুপাড়ায় তাঁর বাড়ি। হিমালয়ের পাদদেশে বাংলাদেশের দূর্গম ও অনুন্নত পার্বত্য অঞ্চলে বাস করা আদিবাসী সম্প্রদায় বংশ পরম্পরায় জুম চাষ করে জীবিকা নির্বাহ করে আসছে।

গত ২ মার্চ আরো ৩০ জন জুমিয়া সম্প্রদায়ের সদস্যদের সাথে মিন চিক ম্রো তাদের ঐতিহ্যবাহী পোশাক পড়ে ঢাকায় প্রতিবাদ কর্মসুচিতে অংশ নিয়েছিলেন। তারা সেসময় বাঁশের তৈরি তাদের ঐতিহ্যবাহী বাঁশী ‘প্লু’ বাজিয়ে প্রতিবাদ জানাচ্ছিলেন।

তিনটি জেলা নিয়ে পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চল গঠিত। এটি বাংলাদেশের মোট আয়তনের ১০ শতাংশ। এখানকার বেশিরভাগ বাসিন্দাই আদিবাসী সম্প্রদায়ের। সবমিলিয়ে সেখানে ১১টি আদিবাসী সম্প্রদায়ের বসবাস। এদের মধ্যে ম্রোরা চতুর্থ সংখ্যাগরিষ্ঠ সম্প্রদায়। তারা কোনো ভাবেই তাদের গ্রামের পাশের নাইতাং পাহাড়ে বিলাস বহুল হোটেল  গড়ে উঠুক, তা চান না।

ঢাকায় বিক্ষোভ করার সময় সাংবাদিকদের মিন চিক ম্রো বলেন, আমরা কোনো ভাবেই চাই না এই পাহাড়ে কোনো হোটেল হোক তা । জুম চাষের এই পাহাড়গুলো আমাদের বেঁচে থাকার প্রধান অবলম্বন। এখানে অনেক পাহাড়ি ঝিরি আর সবুজ বনাঞ্চল রয়েছে। এখানে যদি কোনো হোটেল নির্মান করা হয় তাহলে প্রাকৃতিক এই সম্পদগুলো ধ্বংস হয়ে যাবে। আর সেই সাথে আমাদের জীবন যাপন হুমকির মধ্যে পড়বে।

হোটেলটি নির্মানের জন্য বান্দরবান জেলা পরিষদ ২০ একর জমি  সেনাবাহিনীকে বন্দোবস্তি দিয়েছে। এ জমিতে বেসরকারি কোম্পানী সিকদার গ্রুপ রিসোর্ট বানাচ্ছে। কিন্তু প্রতিবাদী ম্রো এবং আইনজীবিরা জানান এই প্রক্রিয়ায় জমি বন্দোবস্তি দেয়ার কোনো আইনগত অধিকার জেলা পরিষদের নেই।

হোটেল বিরোধী আন্দোলনের ফলশ্রুতিতে গত ২০ মার্চ নাইতাং পাহাড়ে হোটেল নির্মানস্থল পরিদর্শন করে জাতীয় সংসদের একটি প্রতিনিধি দল। পরিদর্শনকালে সামরিক বাহিনীর একজন উর্ধ্বতন কর্মকর্তা সংসদীয় প্রতিনিধি দলটিকে নির্মানস্থলের একটি ম্যাপ দেখান। সংসদীয় দলের  সদস্যদের জানানো হয়, আর্মি ওয়েলফেয়ার ট্রাস্ট এবং সিকদার গ্রুপ কোনো ভাবেই  বন্দোবস্তি পাওয়া ২০ একর জমির বাইরে কোনো স্থাপনা নির্মান করবে না। তারা আরও জানান যে, যেখানে হোটেল হচ্ছে সেই এলাকার আড়াই কিলোমিটারের মধ্যে কোনো ধরনের আবাসস্থল নেই। আর তাই কোনোভাবেই প্রকল্প বাস্তবায়নের জন্য কাউকে উচ্ছেদের প্রশ্ন অবান্তর।

এপ্রিল মাসে উক্ত নির্মানস্থলে সংসদীয় প্রতনিধিদলটির পরিদর্শনের পরেও পাঁচ তারকা হোটেল এবং বিনোদোন পার্কের নির্মান কাজ অব্যাহত রয়েছে। এই প্রকল্পটি মূলত সিকদার গ্রুপের মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠান আর অ্যান্ড আর হোল্ডিংস এবং বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর ২৪ পদাতিক ডিভিশনের আওতাধীন বান্দরবান ব্রিগেডের ৬৯ পদাতিক বাহিনী যৌথভাবে নির্মান করছে।

জমির প্রকৃত মালিক তবে কারা?

বান্দরবান পার্বত্য জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান ক্যাও শ্য হ্লা ২০১৪ সালের ২ ফেব্রুয়ারি ৬৯ পদাতিক ব্রিগেডের প্রধানের সাথে জমি বন্দোবস্তি বিষয়ে একটি চুক্তি স্বাক্ষর করেন। চুক্তি অনুযায়ি বন্দোবস্তির মেয়াদ ৪০ বছর।

দীর্ঘদিন যাবত দেশে বসবাসরত আদিবাসী সম্প্রদায়ের অধিকার নিয়ে কাজ করছেন বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবি দেবাশীষ রায় ।  তিনি বলেন, বান্দরবান পার্বত্য জেলা পরিষদ কোনো ভাবেই  পাঁচ তারকা হোটেল নির্মানের জন্য বন্দোবস্তিকৃত জমির মালিক নয়। যদি তাই হয় তাহলে কীভাবে তারা অন্য আরেকটি প্রতিষ্ঠানকে ব্যবসায়িক উদ্দেশে ব্যবহারের জন্য এই জমি দিলো? এটি দেশের প্রচলিত আইনের সম্পূর্ণ লংঘন।

 দেবাশীষ রয়ের আরেকটি বড় পরিচয় হচ্ছে তিনি চাকমা সার্কেল প্রধান। পার্বত্য চট্টগ্রামের চাকমা, বোহমং ও মং -এই তিন সার্কেল আছে। তারা সরকাররে হয়ে এসব সার্কেলের রাজস্ব আদায় করেন। চাকমা আদিবাসী এই সম্প্রদায় বাংলাদেশ ও ভারতে বসবাস করে।

“আমরা কোনো ভাবেই চাই না পাহাড়ে কোনো হোটেল হোক। জুম ভূমি এই পাহাড়ে টিকে থাকার জন্য আমাদের প্রধান অবলম্বন। এখানে রয়েছে  বহু পাহাড়ি ঝিরি আর সবুজ বনভূমি । এভাবে হোটেল নির্মান করা হলে প্রাকৃতিক এই সম্পদগুলো ধ্বংস হয়ে যাবে।”
মিন চিক ম্রো

বাংলাদেশের পার্বত্য জেলাগুলোতে ব্যক্তিগতভাবে কেউ জমির মালিক নন, বরং এখানে জমির মালিকানা থাকে গোত্র বা সম্প্রদায়ের কাছে। কোনো গোত্রের সামগ্রিক জমি কয়েকটি মৌজায় বিভক্ত করা হয়। একেকটি মৌজা কয়েকটি গ্রাম নিয়ে গঠিত হয়। প্রত্যেকটি মৌজার জন্য একজন দায়িত্বপ্রাপ্ত হেডম্যান থাকে। পাবর্ত্য চট্টগ্রামের প্রচলিত আইন অনুসারে, সেখানকার কোনো জমিতে কোনো ধরনের নির্মান বা উন্নয়ন কাজের জন্য মৌজার হেডম্যানের অনুমোদন অপরিহার্য।

আলোচিত এই রিসোর্ট লুলেইন মৌজায় নির্মান করা হচ্ছে। এই মৌজার হেডম্যান সিংপাশ চৌধুরী বলেন, এই জমিটি যখন হোটেল নির্মানের জন্য চূড়ান্ত হয় (সেনাবাহিনী এবং নির্মান প্রতিষ্ঠানকে যখন বন্দোবস্তি দেওয়া হয়)  তখন আমার চাচা এখানকার হেডম্যানের দায়িত্বে ছিলেন। তিনি এই উদ্দেশে কোনো প্রকার লিখিত অনুমোদন করেননি। তাকে মৌখিকভাবে জানানো হয়েছিল মাত্র। আসলে নির্মানকাজে ব্যবহারের জন্য এই জমি নিষ্পত্তির ক্ষেত্রে প্রচলিত কোনো আইনের তোয়াক্তা করেনি সংশ্লিষ্টরা।

উদ্বেগ এখন পানি নিয়ে 

যে পাহাড়ের চূড়ায় হোটেলটি নির্মান করা হচ্ছে সেখানে কোনো পানির উৎস নেই। সংসদীয় প্রতিনিধি দলটিকে স্থানীয় গ্রামের  অধিবাসীরা জানিয়েছে যে সিকদার গ্রুপ আশেপাশের গ্রামের মানুষের জন্য প্রধান জলের উৎস লুলাইন খাল এবং দোলাপাড়া ঝিরিতে এরই মধ্যে বাঁধ নির্মানের কাজ শুরু করেছে। যদি এখানে বাঁধ নির্মান হয়েই যায় তাহলে স্থানীয় গ্রামবাসী আশংকা করছেন যে তাদের জলের একমাত্র উৎসটি হাতছাড়া হয়ে যাবে।

জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরের বান্দরবান কার্যালয়ের কর্মকর্তারা জানিয়েছে জেলার মোট চার লাখ অধিবাসীর মধ্যে অর্ধেকই পানি সরবরাহ নেটওয়ার্কের বাইরে রয়েছে। সরকারের এই সংস্থাটি পার্বত্য এলাকায় ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান পর্যায়ে সুপেয় পানি সরাবরাহ করে থাকে। পাহাড়ের ঠিক যে অঞ্চলে এই হোটিলটি নির্মান করা হচ্ছে তার আশেপাশে বসবাস করা ৭০ শতাংশ অধিবাসী পানির জন্য ছোট ছোট পাহাড়ী ঝর্ণা, খাল ও নদীর উপরে নির্ভর করে থাকে।

দীর্ঘদিন থেকেই পাহাড়ি এই ঝিরি বা ঝর্ণাগুলো খুব সংকটাপন্ন অবস্থায় রয়েছে। ওয়াটার এইড বাংলাদেশ ২০২১ সালে একটি গবেষণা পরিচালনা করে। তাতে বলা হয়েছিল ২০০৮ সালে  পরিচালিত জরীপে পাওয়া এখানকার ১০টি পাহাড়ী ছড়া বা পানির উৎসগুলোর মধ্যে কমপক্ষে ৭টির পানির স্তর নিচে নেমে গেছে।  

স্থানীয় বাসিন্দারা জানান, গত মার্চে সংসদীয় কমিটির পরির্দশনের সময় অনুষ্ঠিত সভায় উপস্থিত ছিলে নির্মিতব্য হোটেল প্রকল্পের প্রকল্প ব্যবস্থাপক সিরাজুল ইসলাম। সেই সভায় হোটেল কর্তৃপক্ষ কোথা থেকে পানির সংস্থান করবে জানতে চাইলে তিনি কোনো জবাব দিতে পারেননি।

Buddha Chakm
বান্দরবানে আদিবাসী ম্রো সম্প্রদায়ের প্রতিবাদ (ছবি: বুদ্ধ চাকমা)

স্থানীয়রা এখন পানির সংস্থান নিয়ে বেশ চিন্তিত। তাদের ভয় অচিরেই হয়ত নিজ বাসস্থান থেকে তাদের অন্যত্র চলে যেতে বাধ্য করা হতে পারে। বাংলাদেশের প্রধামন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে পাঠানো এক খোলা চিঠিতে ম্রো সম্প্রদায়ের নেতারা বলেন, চিম্বুক ও নাইতাং পাহাড়ে শত শত বছর ধরে আমাদের বসবাস। এখানে আমরা যুগ যুগ ধরে জুম চাষ করে জীবন ধারন করে আসছি। এখানে হোটেলটি নির্মান হলে আমাদের সবার ঘর-বাড়ি, সমাধীস্থল, পবীত্র পাঁথর, পবীত্র বৃক্ষরাজি এবং পানির উৎসগুলো সব হারিয়ে আমাদের অন্যত্র চলে যেতে হবে।

উন্নয়নের ফলে সামাজিক প্রাকৃতিক পরিবেশের উপরে প্রভাব

কাউকে তার বসবাড়ি থেকে উৎখাত করা হবে না বলে হোটেল নির্মান প্রকল্পের সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন প্রকৃতপক্ষে তা বিশ্বাসযোগ্য নয় বলে মনে করেন ম্রো সম্প্রদায়ের নেতৃবন্দ। তাদের মতে, এই প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হলে আশেপাশের ১,০০০ একর এলাকা নিয়ে গঠিত প্রায় ছয়টি গ্রামকে পুরোপুরি উৎখাত করা হবে। এর ফলে এসব গ্রামে বসবাস করা প্রায় ১০,০০০ বাসিন্দা হারাবেন নিজের ঐতিহ্যগত জীবিকার পথ।

ম্রো সম্প্রদায়ের নেতারা সংসদীয় কমিটির সদস্যদের জানান যে নির্মান প্রকল্পের লোকজন এরই মধ্যে লিজকৃত ২০ একর জমির বাইরে আরো প্রায় তিনটি গ্রাম পর্যন্ত বাঁশ দিয়ে ঘেরাও প্রদান করেছে। এই তিনটি গ্রাম হচ্ছে কাপ্রুপাড়া, দোলাপাড়া এবং কালাইপাড়া। প্রকল্পের লোকজন বলছেন বিনোদন পার্কেও জন্য তাদের এই পরিমান জায়গা প্রয়োজন। স্থানীদের বিক্ষোভের কারনে আপাতত বিনোদোন পার্কের কাজটি স্থগিত রয়েছে।

রেং ইয়াং ম্রো একজন স্থানীয় শিক্ষার্থী। তিনি বলেন, দেখুন, এটি আসলে রাষ্ট্রের জন্য কোনো আবিশ্যক স্থাপনা নয়। এর উদ্দেশ্যই হচ্ছে বিনিয়োগকারীদের মুনাফা, উচ্চবিত্তের বিলাসবহুল পর্যটন আনন্দ, বিনোদন এবং আনন্দ উদযাপন। আসলে আমরা মনে করি পার্বত্য অঞ্চলের ঐতিহ্যবাহী জীবন প্রক্রিয়া, ব্যক্তিগত ও সামাজিক মূল্যবোধ, নারীদের সম্মান এবং সর্বোপরি পরিবেশ ধ্বংসের লক্ষ্যে একটি নীল নকশা প্রনয়ন করা হয়েছে।

 ২০১৭ সালে সেন্টার ফর এনভায়রনমেন্ট অ্যান্ড জিওগ্রাফিক্যাল ইনফরমেশন সার্ভিসেস এবং ওয়াটারএইড বাংলাদেশ পরিচালিত এক গবেষনায় দেখা গেছে গত ২০ বছরে পার্বত্য চট্টগ্রামের ৩ লাখ ৭২ হাজার হেক্টরের বেশি বনভূমি হারিয়ে গেছে।

স্থানীয়রা এখন পানির সংস্থান নিয়ে বেশ চিন্তিত। তাদের ভয় অচিরেই হয়ত নিজ বাসস্থান থেকে তাদের অন্যত্র চলে যেতে বাধ্য করা হতে পারে। বাংলাদেশের প্রধামন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে পাঠানো এক খোলা চিঠিতে ম্রো সম্প্রদায়ের নেতারা বলেন, চিম্বুক ও নাইতাং পাহাড়ে শত শত বছর ধরে আমাদের বসবাস। এখানে আমরা যুগ যুগ ধরে জুম চাষ করে জীবন ধারন করে আসছি। এখানে হোটেলটি নির্মান হলে আমাদের সবার ঘর-বাড়ি, সমাধীস্থল, পবীত্র পাঁথর, পবীত্র বৃক্ষরাজি এবং পানির উৎসগুলো সব হারিয়ে আমাদের অন্যত্র চলে যেতে হবে।

উন্নয়নের ফলে সামাজিক প্রাকৃতিক পরিবেশের উপরে প্রভাব

কাউকে তার বসবাড়ি থেকে উৎখাত করা হবে না বলে হোটেল নির্মান প্রকল্পের সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন প্রকৃতপক্ষে তা বিশ্বাসযোগ্য নয় বলে মনে করেন ম্রো সম্প্রদায়ের নেতৃবন্দ। তাদের মতে, এই প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হলে আশেপাশের ১,০০০ একর এলাকা নিয়ে গঠিত প্রায় ছয়টি গ্রামকে পুরোপুরি উৎখাত করা হবে। এর ফলে এসব গ্রামে বসবাস করা প্রায় ১০,০০০ বাসিন্দা হারাবেন নিজের ঐতিহ্যগত জীবিকার পথ।

ম্রো সম্প্রদায়ের নেতারা সংসদীয় কমিটির সদস্যদের জানান যে নির্মান প্রকল্পের লোকজন এরই মধ্যে লিজকৃত ২০ একর জমির বাইরে আরো প্রায় তিনটি গ্রাম পর্যন্ত বাঁশ দিয়ে ঘেরাও প্রদান করেছে। এই তিনটি গ্রাম হচ্ছে কাপ্রুপাড়া, দোলাপাড়া এবং কালাইপাড়া। প্রকল্পের লোকজন বলছেন বিনোদন পার্কেও জন্য তাদের এই পরিমান জায়গা প্রয়োজন। স্থানীদের বিক্ষোভের কারনে আপাতত বিনোদোন পার্কের কাজটি স্থগিত রয়েছে।

রেং ইয়াং ম্রো একজন স্থানীয় শিক্ষার্থী। তিনি বলেন, দেখুন, এটি আসলে রাষ্ট্রের জন্য কোনো আবিশ্যক স্থাপনা নয়। এর উদ্দেশ্যই হচ্ছে বিনিয়োগকারীদের মুনাফা, উচ্চবিত্তের বিলাসবহুল পর্যটন আনন্দ, বিনোদন এবং আনন্দ উদযাপন। আসলে আমরা মনে করি পার্বত্য অঞ্চলের ঐতিহ্যবাহী জীবন প্রক্রিয়া, ব্যক্তিগত ও সামাজিক মূল্যবোধ, নারীদের সম্মান এবং সর্বোপরি পরিবেশ ধ্বংসের লক্ষ্যে একটি নীল নকশা প্রনয়ন করা হয়েছে।

 ২০১৭ সালে সেন্টার ফর এনভায়রনমেন্ট অ্যান্ড জিওগ্রাফিক্যাল ইনফরমেশন সার্ভিসেস এবং ওয়াটারএইড বাংলাদেশ পরিচালিত এক গবেষনায় দেখা গেছে গত ২০ বছরে পার্বত্য চট্টগ্রামের ৩ লাখ ৭২ হাজার হেক্টরের বেশি বনভূমি হারিয়ে গেছে।

“সরকার এবং এই হোটেল নির্মান প্রকল্প সংশ্লিষ্টদের অবশ্যই নির্মান এলাকায় পানি ব্যবস্থাপনা পদ্ধতি কীভাবে পরিচালনা করা হবে সেটি পরিস্কার করতে হবে।”
মোহাম্মদ জাকারিয়া, নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়

বাংলাদেশের নর্থসাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ বিজ্ঞান ও ব্যবস্থাপনা বিভাগের অধ্যাপক মোহাম্মদ জাকারিয়া বলেন, ভূমির ধরণ, পানির প্রবাহ বা আবহওয়ার মতো গুরুত্বপূর্ন বিষয়গুলো বিবেচনায় না নিয়েই পার্বত্য চট্টগ্রামে গড়ে তোলা হচ্ছে নানা ধরনের উন্নয়ন প্রকল্প এবং বসতি। এর ফলে এখানকার বনভূমি এবং পানির উৎসগুলো মারাত্বকভাবে ক্ষতিগ্রস্থ্য হচ্ছে।

তিনি বলেন, পাবর্ত্য চট্টগ্রামের মতো ভৌগলিকবাবে স্পর্শকাতর এলাকায় কোনো বিলাসবহুল হোটেল বা রিসোর্ট নির্মানের আগে অবশ্যই পরিবেশগত প্রভাব মূল্যায়ন (এনভায়রনমন্টোল ইম্প্যাক্ট অ্যাসেসমেন্ট) সম্পন্ন করতে হবে। সরকার এবং এই হোটেল নির্মান প্রকল্প সংশ্লিষ্টদের অবশ্যই নির্মান এলাকায় পানি ব্যবস্থাপনা পদ্ধতি কীভাবে পরিচালনা করা হবে সেটি পরিস্কার করতে হবে।

এখানকার জেলা পরিষদেও চেয়ারম্যান কৈ শ্য হ্লা জানতে চাইলে এ ব্যাপারে কোনো মন্তব্য করতে রাজী হননি। তবে এই প্রতিবেদকের কাছে তিনি নিশ্চিত করে বলেন, কোনো এনভায়রনমন্টোল ইম্প্যাক্ট অ্যাসেসমেন্ট প্রতিবেদনের কথা তার জানা নেই।

হাতির চলার পথ

যে এলাকায় হোটেলটি হচ্ছে অর্থাৎ বান্দরবানের লামা উপজেলা বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের থাকা বন্য হাতির চলাচলের রাস্তা। বান্দরবানে থাকা রোহিঙ্গা ক্যাম্পের কারনে এরই মধ্যে হাতির চলাচল পথ নানাভাবে বাঁধাগ্রস্থ্য হচ্ছে।

অধ্যাপক জাকারিয়া বলেন, বান্দরবানের লামা উপজেলা এশিয়ান এলিফ্যান্ট-এর (এশীয় হাতি) জন্য একটি অন্যতম বিচরণ ক্ষেত্রে। এই অঞ্চলে ব্যাপক জনসমাগম হলে তা অবশ্যই হাতির স্বাভাবিক চলাফেরার জন্য এক ধরনের বিঘ্ন সৃষ্টি করবে। বাংলাদেশে প্রায় ৩০০-৩৫০ বন্য হাতি বিচরণ করে যার মধ্যে কমপক্ষে ২০০ হাতি স্থানীয়।

লামা বন বিভাগের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা (ডিএফও) এস এম কাইসার বলেন, স্থানীয় বন্য হাতিগুলো পার্বত্য চট্টগ্রাম ও কক্সবাজারের বিভিন্ন বনাঞ্চলে ঘুরে বেড়ায়। আলোচিত এই রিসোর্টটি চালু হলে হাতির জন্য তা কতটুকু ক্ষতিকর হতে পারে জানতে চাইলে এস এম কাইসার বলেন, হাতি সাধারণত উঁচু পাহাড়গুলোতে ওঠে না। তবে একজন সরকারী কর্মকর্তা হিসেবে এই হোটেল নির্মান প্রসঙ্গে আমার মন্তব্য করা সমীচিন হবে না। 

হোটেল নির্মানের বিরুদ্ধে জাতিসংঘ

গত ফেব্রুয়ারিতে জাতিসংঘের মানবাধিকার বিষয়ক হাই কমিশনারের কার্যালয় এক বিবৃতিতে অবিলম্বেব পার্বত্য চট্টগ্রামে হোটেল নির্মান বন্ধের অনুরোধ জানিয়েছে। বিবৃতীতে বলা হয়, বাংলাদেশের উচিত অবিলম্বে পার্বত্য চট্টগ্রামে ব্যাপক ভিত্তিক পর্যটন হোটেল নির্মান বন্ধ করা । কারন এটি স্থানীয় আদিবাসী ম্রো সম্প্রদায়ের প্রথাগত ভূমি হারানো প্রতি একটি বিরাট হুমকি সৃষ্টি করেছে। আর এর মাধ্যমে সেখানকার প্রাকৃতিক পরিবেশ মারাত্বকভাবে ক্ষতিগ্রস্থ্য হওয়ার আশংকা দেখা দিয়েছে।

কিন্তু এতকিছুর পরেও থামেনি হোটেল নির্মান কাজ ।

Privacy Overview

This website uses cookies so that we can provide you with the best user experience possible. Cookie information is stored in your browser and performs functions such as recognising you when you return to our website and helping our team to understand which sections of the website you find most interesting and useful.

Strictly Necessary Cookies

Strictly Necessary Cookie should be enabled at all times so that we can save your preferences for cookie settings.

Analytics

This website uses Google Analytics to collect anonymous information such as the number of visitors to the site, and the most popular pages.

Keeping this cookie enabled helps us to improve our website.

Marketing

This website uses the following additional cookies:

(List the cookies that you are using on the website here.)