বাংলাদেশের উপকূলীয় জেলাগুলোতে কাঁকড়া চাষ ও রপ্তানীর সাথে জড়িত চাষী ও সশ্লিষ্ট ব্যবসায়ীরা এখন ভয়াবহ অর্থনৈতিক সংকটের মুখে রয়েছেন। কারণ বিশ্বব্যাপী করোনা মহামারীর কারনে অনির্দিষ্ট কালের জন্য স্থগিত রয়েছে বিদেশে কাঁকড়া রপ্তানী। সারাবিশ্বে করোনা মহামারীর রুপ নিয়েছে। তবে এই শিল্পের সঙ্গে সংশ্লিষ্টরা লোকাসান গুনতে শুরু করেন বাংলাদেশে করোনা মহামারী হিসেবে বিস্তারের অনেক আগে থেকেই। এখানকার রপ্তানীযোগ্য কাঁকড়ার সবচেয়ে বড় বাজার হচ্ছে চীন। করোনার কারনে দেশটি গত ২৫ জানুয়ারী থেকে সব ধরনের পণ্য আমদানীর উপরে নিষেধাজ্ঞা জারী রেখেছে।
সার্বিক পরিস্থিতির বিষয়ে জানতে চাইলে দেশের রামপাল-বাগেরহাট কাঁকড়া ডিলার সমিতির সাধারণ সম্পাদক স্বপন মণ্ডল বলেন, সাধারনত নববর্ষ উৎসবের সময় চীনে প্রচুর পরিমানে কাঁকড়ার চাহিদা থাকে। আমরা তাই চীনের নববর্ষকে সামনে রেখে ব্যাপক পরিমানে দেশটিতে কাঁকড়া রপ্তানী করে থাকি। কিন্তু এবছর তা সম্ভব হয়নি, ফলে প্রচুর পরিমানে কাঁকড়া নষ্ট হয়েছে। এর ফলে আমাদের মতো প্রান্তিক ব্যবসায়ীদের ব্যাপকভাবে আর্থিক লোকসানের মুখোমুখি হতে হচ্ছে।
বাংলাদেশে অবস্থিত বিশ্বের সবচেয়ে বড় ম্যানগ্রোভ বন সুন্দরবনের লাগোয়া মূলত তিনটি উপকূলীয় জেলায় কাঁকড়ার চাষ ও রপ্তানী প্রক্রিয়াজাত করা হয়ে থাকে। দেশে উৎপাদিত ও প্রক্রিয়াকৃত এই কাঁকড়া মূলত চীন, জাপান, তাইওয়ান, বেলজিয়াম, যুক্তরাজ্য, নেদারল্যান্ডস, জার্মানী ও অষ্ট্রেলিয়ায় রপ্তানী করা হয়। তবে মোট রপ্তানীর প্রায় ৮৫ শতাংশই ধরে রেখেছে চীনের বাজার।
গত ২৫ জানুয়ারী থেকে ফেব্রুয়ারী মাস পর্যন্ত চীনে কাঁকড়া রপ্তানী পুরোপুরি বন্ধ রয়েছে বলে নিশ্চিত করেন বাংলাদেশ লাইভ ক্র্যাব অ্যান্ড ঈল ফিশ এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশন -এর (বাংলাদেশ কাঁকরা ও বান মাছ রপ্তানীকারকদের সংগঠন) মহাসচিব কাজী মাহাবুবুল আলম আজাদ।
তিনি বলেন, এরপর কিছুদিন আমরা চীনের কয়েকটি প্রদেশে রপ্তানী অব্যাহত রাখার চেষ্টা করেছিলাম। কিন্তু গত ২৩ মার্চের পর থেকে বাংলাদেশ সরকার দেশের সব বিমান বন্দরগুলো বন্ধ করে দেয়। এ অবস্থায় পরিস্থিতির কিছুটা উন্নতি হলে আমরা হয়ত ৫ এপ্রিলের পরে আবারো রপ্তানী শুরু করতে পারবো বলে আশা করছি।
তিনি আরো বলেন, আমাদের জন্য আরো একটি বড় সমস্যা হচ্ছে আমরা এখনও পর্যন্ত রপ্তানীকৃত কাঁকড়ার কোনো মূল্য পাইনি। বিদেশে রপ্তানী করা কোনো চালানের মূল্যই এখন পর্যন্ত আমাদেরকে পরিশোধ করেনি এসব চালানের আন্তর্জাতিক ক্রেতারা।
প্রাথমিক ক্ষতির পরিমান সম্পর্কে জানতে চাইলে মাহাবুবুল আলম আজাদ বলেন, আমাদের হিসাব মতে এই খাতে এখন পর্যন্ত লোকসানের পরিমান কমপক্ষে চার বিলিয়ন টাকা (৪৬.৯০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার)।
এই ক্ষতির সবচেয়ে বড় ভুক্তভোগী হচ্ছে এই খাতের সাথে জড়িত তৃণমূল পর্যায়ের প্রান্তিক চাষীরা। দেশে এই শিল্পের সাথে জড়িত আছে প্রায় পাঁচ লাখেরও বেশি প্রান্তিক চাষী যাদের প্রায় সবাই দারিদ্রসীমার নিচে বসবাস করে।
আজাদ বলেন, আমরা ২৫ জানুয়ারীর পর ইউরোপের কয়েকটি দেশেও ছোট খাটো কিছু চালান পাঠিয়েছি। কিন্তু সব ধরনের ফ্লাইট বন্ধ হয়ে যাবার কারনে এখন রপ্তানী প্রক্রিয়া পুরোপুরি বন্ধ হয়ে গেছে। এই অবস্থা চলতে থাকলে আমরা যে ভয়াবহ ক্ষতির সম্মুখীন হবো যেটি কাটিয়ে ওঠা হয়ত আমাদের পক্ষে একপ্রকার অসম্ভব!
দরপতনের বিভীষিকা
চাহিদা কমে যাওয়ায় স্থানীয় বাজারেও কাঁকড়ার ভয়াবহ দরপতন লক্ষ্য করা যাচ্ছে। স্থানীয় বাজারে কাঁকড়ার মূল্য কমপক্ষে দুই-তৃতীয়াংশ হ্রাস পেয়েছে। এ প্রসঙ্গে মাহাবুবুল আলম আজাদ বলেন, স্বাভাবিক সময়ে দেশের স্থানীয় বাজারে উন্নত প্রজাতির কাঁকড়ার মূল্য কেজি প্রতি ছিল ২,৫০০ টাকা। আর মহামারীর এই সময়ে কাঁকড়ার মূল্য মারাত্বকভাবে নিম্নগামী, এখন আমরা দেশের বাজারে এক কেজি কাঁকড়া ৮০০ থেকে ৯০০ টাকার (৯.৪০ – ১০.৫০ মার্কিন ডলার) বেশি কোনোভাবেই বিক্রি করতে পারছি না।
বাজারে মূল্য কমার পাশপাশি আমাদের আরেকটি বড় সমস্যা হচ্ছে আমাদের কাছে এখন বিপুল পরিমান অবিক্রিত প্রক্রিয়াজাতকৃত কাঁকড়া পড়ে আছে। দেশের বাজারে কাঁকড়া ও বান মাছের চাহিদা এখন বলতে গেলে একদমই নেই। এখানে বলে রাখা ভালো যে বাংলাদেশের কাঁকড়া ব্যবসায়ীরা পুরোপুরি বিদেশী বাজারের উপরেই নির্ভরশীল।
দেশের তিন উপকূলীয় জেলা খূলনা, বাগেরহাট ও সাতক্ষীরায় এক সময়কার অত্যন্ত ব্যস্ত কাঁকড়ার বাজার আর ঘেরগুলোতে শূণ্যতা আর অনিশ্চিয়তা দৃশ্যমান|
তাপস মণ্ডল একজন ক্ষুদ্র কাঁকড়া চাষী। খুলনার জেলার পাইকগাছা উপজেলার সরল গ্রামে তার স্থায়ী বসবাস । সেখান থেকেই তিনি জীবিকার কাঁকড়া চাষ ও রপ্তানীর বাণিজ্য পরিচালনা করে আসছেন। গেল মৌসুমে সাড়ে চার লাখ টাকা (৫,৩০০ মার্কিন ডলার) ঋণ নিয়ে তার এক নিজের একর জমিতে কাঁকড়া মোটা-তাজাকরনের কার্যক্রম শুরু করেন। জমিটি পার্শ্ববর্তী নদীগুলোর সাথে যুক্ত থাকায় জোয়ারের সময় লবনাক্ত জলে প্লাবিত হয় দিনের একটি নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত যা তিনি সেই জমিতে ধরে রাখেন। এই লবনাক্ত জল ও পরিবেশ প্রবেশ করে কাঁকড়া চাষের জন্য উপযুক্ত। স্বাভাবিক অবস্থায় এক কেজি সাধারণ কাঁকড়ার মূল্য কেজি প্রতি ৫০০ টাকা (৬ মার্কিন ডলার)| যা মোটা-তাজাকরনের পর খোলা বাজারে কেজি প্রতি ১,৫০০ টাকা থেকে ১,৮০০ টাকা (১৮ থেকে ২১ মার্কিন ডলার) পর্যন্ত বিক্রি স্বাভাবিক হয়ে থাকে ।
তাপস বলেন, এ বছর তিনি মাত্র ৩০ হাজার টাকার কাঁকড়া বিক্রি করতে পেরেছেন। অথচ বিক্রির মতো তার ফার্মে উৎপাদিত কাঁকড়ার পরিমান ছিল প্রায় এক টন। সময়মতো বিক্রি না হওয়ায় তার সব কাঁকড়াগুলো মরে যায়। স্থানীয় খোলা বাজারে সামান্য কিছু পরিমান বিক্রি করতে পারলেও তার এখন সব মিলিয়ে লোকসানের পরিমান দাঁড়িয়েছে ৭ লক্ষ টাকা (৮,২০০ মার্কিন ডলার)। এ অবস্থায় ঋণের টাকা কী করে শোধ করবেন তরবেন বুঝতে পারছেন না। এ মুহুর্তে কোনো ভাবেই ঋণের এতগুলো টাকা তিনি ও তার পরিবারের পক্ষে শোধ করা সম্ভব নয় বলে জানান তিনি। সামনের দিনগুলোতে কীভাবে এই ক্ষতি কাটিয়ে উঠবেন তা নিয়ে রয়েছেন দুশ্চিন্তায়। সম্ভাব্য লোকসানের বিষয়ে জানতে চাইলে এভাবেই নিজের দূর্দশার কথা তুলে ধরেন তাপস।
জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব
বাংলাদেশে জলবায়ু পরিবর্তনের সবচেয়ে নেতিবাচক প্রভাব লক্ষ্য করা যায় দেশের দক্ষিণ-পশ্চিম অঞ্চলের কয়েকটি জেলায়। বিশেষ করে উপকূলীয় জেলা খুলনা, সাতক্ষীরা ও বাগেরহাটে গত প্রায় তিন দশক ধরে জলবায়ুর পরিবর্তনের মারাত্বক নেতিবাচক প্রভাবে পড়েছে সেখানকার প্রাকৃতিক পরিবেশ ও মানুষের জীবন-জীবিকার উপরে। সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধির প্রভাবে সেখানকার চাষযোগ্য ভূমি ও সব ধরনের জলের উৎসগুলো লবনাক্ততায় পূর্ণ। তাই সেখানকার কৃষকরা বাধ্য হয়েই ধান বা অন্যান্য শস্যের পরিবর্তে কাঁকড়া চাষের সঙ্গে যুক্ত হয়েছেন। কারন লবনাক্ততার ফলে সেখানে ধান বা অন্যান্য শষ্য উৎপাদন সম্ভব নয়। আর লবনাক্ত পরিবেশে কাঁকড়া চাষ অত্যন্ত লাভজনক। তাই ব্যাপক পরিমানে প্রান্তিক কৃষক এখন এই শিল্পের সাথে যুক্ত। প্রাথমিক অবস্থায় দেশীয় কাঁকড়ার অন্যতম বড় বাজার ছিল জাপান। গত পাঁচ বছরে আরো অনেকগুলো দেশে জনপ্রিয় খাদ্য হিসেবে চাহিদার কারনে কাঁকড়া ও বান মাছ মোটাতাজাকরনের শিল্প প্রসারতা পেয়েছে।
গত ২০০৭ ও ২০০৮ অর্থবছরে এই খাত থেকে বাংলাদেশ ৭ মিলিয়ন মার্কিন ডলার আয় করেছে। এরপর থেকেই শিল্পটি অত্যন্ত দ্রুত প্রসার পেয়েছে।
তবে এ মুহুর্তে এই শিল্পের সাথে জড়িত বড় ব্যবসায়ী থেকে শুরু করে প্রান্তিক চাষী- সবার পরিস্থিতিই অত্যন্ত নাজুক! সুন্দরবন কাঁকড়া ও মৎসজীবি সমবায় সমিতির ভাইস প্রেসিডেন্ট মৃণাল কান্তি দে বলেন, আমি প্রতিদিন সব মিলিয়ে প্রায় ৮০০ থেকে ৯০০ কেজি কাঁকড়া বিক্রি করতাম। কিন্তু এ মুহুর্তে আমার দৈনিক বিক্রি ২০০ থেকে ২৫০ কেজির মধ্যেই সীমাবদ্ধ রাখতে হচ্ছে| কারন আন্তর্জাতিক বাজারে, বিশেষ করে চীনে চলতি বছর জানুয়ারী মাসের পর থেকে রপ্তানী বন্ধ রয়েছে।
গত ২৫ বছর যাবত সুন্দরবনে কাঁকড়া ধরে জীবিকা নির্বাহ করে আসছেন খুলনার বটিয়াঘাটা উপজেলার খলশীবুনিয়া গ্রামের শীবপদ বিশ্বাস। কিন্তু এই বছর জানুয়ারীর পর থেকে তিনি উপয়ান্তর না পেয়ে কাঁকড়া আহরণকারীর পেশা ছেড়ে এখন দিনমজুরের কাজ করছেন|
তার জীবনে কখনও এমন পরিস্থিতির সম্মুখীন হতে হয়নি বলে জানান শীবপদ বিশ্বাস। তিনি বলেন, এখন তো কাঁকড়ার কোনো চাহিদাই নেই। যেখানে এক সময়ে বড় কাঁকড়ার মূল্য ছিল কেজি প্রতি ১৫০০ টাকা (১৮ মার্কিন ডলার) আর সেখানে এখন তা স্থানীয় বাজারে বিক্রি হচ্ছে মাত্র ৫০০ টাকায় (৬ মার্কিন ডলার)। (সমাপ্ত)
ইংরেজী থেকে বাংলায় অনুবাদ: মো. আরিক গিফার