নতুন একটি সমুদ্র সুরক্ষা কৌশল এবার বিশ্বের সবচেয়ে জনবহুল উপকূলীয় অঞ্চলগুলোর সুরক্ষায় কেবলমাত্র প্রথাগত রিং ফেন্সিংয়ের প্রক্রিয়ার অপেক্ষা না করে বরং চিত্র বদলে দেবার মতো ব্যাপক জলবায়ু সুবিধা অর্জনের নতুন দিগন্ত উন্মোচন করতে পারে। বিজ্ঞানীদের বলছেন, এটি গৃহীত হলে বাড়বে খাদ্য উৎপাদন, জেগে উঠবে এখানকার দূর্বল প্রকৃতির জীববৈচিত্র।
২৬ জনের একটি আন্তর্জাতিক গবেষকদল মনে করেন সমুদ্র তলদেশ সেচা বা ড্রেজিং মারাত্বক বিপদ বয়ে আনতে পারে। নদীর তলদেশ সেচে মাছ ধরার ফলে সামুদ্রিক পলিমাটি মারাত্বকভাবে ক্ষতিগ্রস্থ্য হয় যার ফলে সমুদ্র তলদেশে যে জৈব কার্বন রয়েছে তা নির্গত হতে থাকে। এর ফলে কার্বন ডাই অক্সাইডের মাত্রা (CO2) বাড়তে থাকে এবং একইসাথে শুরু হয় অম্লীকরণ। কেবলমাত্র ড্রেজিং প্রক্রিয়ায় মৎস আহরণ বন্ধ করা গেলে বার্ষিক কার্বন নির্গমনের পরিমান এক বিলিয়ন টন পর্যন্ত কমিয়ে আনা সম্ভব। এটি এভিয়েশন শিল্প পরিচালনার মাধ্যমে যে পরিমান কার্বন ডাই অক্সাইড নির্গমন হয় তার সমপরিমান এবং সমগ্র বিশে^র মোট নির্গমন মাত্রার ২.৫ শতাংশ।
জনবহুল উপকূলীয় অঞ্চলগুলোতে আরো নতুন নতুন সংরক্ষিত স্থান ঘোষণা করে সেগুলোকে মানুষের ব্যবহারের বাইরে রাখতে পারলে এবং একইসাথে টেকসই মৎস আহরণ পহ্না অবলম্বন করা গেলে এখানকার ক্ষতিগ্রস্থ্য জীববৈচিত্রসমূহ পুনরুদ্ধার করার পাশাপাশি মাছের আহরণও বৃদ্ধি করা সম্ভব। ন্যাচার নামক এক জার্নালে প্রকাশিত এক গবেষণা পত্রে গবেষকরা দাবী করেছেন অসংরক্ষিত জলাশয়ে স্বাস্থ্যকর মাছ এবং মাছের পোনা প্রাকৃতিকভাবেই ছড়িয়ে পড়ে।
সমুদ্র ব্যবস্থাপনায় ট্রিপল উইন সমাধান
গবেষণা পত্রের লেখক কানাডার ডালহাউস বিশ্ববিদ্যালয়ের জীবিজ্ঞানের অধ্যাপক বরিস ওয়ার্ম বলেন, খাদ্য, জীববৈচিত্র্য এবং জলবায়ু পরিবর্তন – বর্তমান সময়ে আমাদের জন্য এই তিনটিই হচ্ছে অন্যতম প্রধান চ্রালেঞ্জ। তাই আমরা বুঝার চেষ্টা করেছি যে আরো বুদ্ধিমত্তার সাথে কীভাবে সমুদ্র নিরাপত্তা নিশ্চিত করা যায় যাতে করে এই তিনটি উদ্দেশ্য একসাথে সাধরন করা সম্ভব হয়।
আরইভি ওশান ফাউন্ডেশনের পরিচালক এবং বৃটেনের অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনিয়র রিসার্চ ফেলো অ্যালেক্স রজার্স বলেন, সমুদ্র বিজ্ঞানী, সংরক্ষণবিদ এবং টেকসই ব্লু ইকোনমি নিয়ে যারা কাজ করছেন তাদের কাছে সমুদ্র ব্যবস্থাপনায় এই গবেষণা পত্রটি একটি ত্রি-মাত্রিক সমাধান হিসেবে বিবেচ্য হতে পারে। অ্যালেক্স রজার্স অবশ্য এই গবেষণাটির সাথে যুক্ত নন।
![](https://dialogue.earth/content/uploads/2021/03/Ocean_Story_2.jpg)
তিনি বলেন, এর সঙ্গে যুক্ত গবেষকরা বিভিন্ন মডলের মাধ্যমে দেখার চেষ্টা করেছেন যে কিভাবে সামুদ্রিক সংরক্ষিত এলাকাসমূহকে (মেরিন প্রোটেকটেড এরিয়া) ব্যবহার করে সাগরে জীববৈচিত্র সুরক্ষা, মৎসম্পদ এবং কার্বন ভা-ার সুরক্ষা করা যেতে পারে। এরপরে সম্ভাব্য নেতিবাচক দিকগুলো খুঁজে বের করতে তারা একটির উপরে অন্যটির প্রভাব কিংবা সবগুলোর একসাথে পর্যালোচনা করেছেন। এর ফলে যা বেরিয়ে এসেছে তা হচ্ছে স্ব স্ব ক্ষেত্রে যেমন দৃষ্টিভঙ্গিই থাক না কেন সামুদ্রিক নিরাপত্তার বিষয়টি আসলেই পুরোপুরি অপ্রতুল।
সমন্বিত উপায়ে সমুদ্র সুরক্ষা ব্যবস্থাপনা
বর্তমানে সারাবিশ্বের কেবল মাত্র ৭ শতাংশ সাগর/মহাসাগর কোনো না কোনো সুরক্ষা কার্যক্রমের আওতায় রয়েছে, তবে এর মধ্যে মাত্র ২.৩ শতাংশ অঞ্চল এমনভাবে সুরক্ষিত হচ্ছে যেখানে জীববৈচিত্র এবং খাদ্য উৎপাদনকে যথেষ্ট গুরুত্ব দিয়ে ব্যবস্থাপনায় অন্তর্ভূক্ত করা হয়েছে। বরিস ওয়ার্ম বলেন, কিন্তু আমরা এখন বিশ্বের সবচেয়ে বেশি যেসব স্থানে মৎস আহরিত হয়, অর্থাৎ বিশ্বের যে স্থানগুলো এই উদ্দেশ্যে সবচেয়ে ব্যবহৃত হয় সেকানেই ঘুরপাক খাচ্ছি। কারন এই স্থানগুলোতেই জীববৈচিত্র ও খাদ্য সুবিধাদী বেশি পাওয়া যায়।
গবেষণা মতে, দেশগুলো মৎসম্পদের কোনো ক্ষতি না করেই তাদের আওতাভূক্ত সাগর বা মহাসাগর এলাকার সর্বোচ্চ ৭০ শতাংশ পর্যন্ত সুরক্ষিত রাখতে পারে কারণ এর বাইরের অংশে গিয়ে মৎস সম্পদ আরো সুরক্ষিতভাবে বাড়তে পারে। বরিস ওয়ার্ম বলেন, আমরা মনে করি দেশগুলো এক্ষেত্রে বর্তমান সময়ের চেয়ে আরো বেশি ভূমিকা রাখতে পারে কারন তাদের সাগরের ৯৫ শতাংশ পর্যন্ত সরাসরি অধিকার রয়েছে। এর ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে তিনি ভারতের উদাহরণ দেন। তিনি বলেন, ভারতে অতিরিক্ত মৎস আহরণ হয়ে থাকলেও তারা এই পরিবর্তন করতে পারে কারন তাদের উন্নয়নের অনেক সুযোগ রয়েছে।
ভারতের পুনেতে অবস্থিতি ইন্ডিয়ান ইন্সটিটিউট অব ট্রপিক্যাল মেটিওরোলজির বিজ্হানী রক্সি ম্যাথিউ কোল বলেন, ভারত মহাসাগরে বিপদাপন্ন সামুদ্রিক বাস্তুসংস্থান সুরক্ষার লক্ষ্যে এই ধরণা ও পদ্ধতি গ্রহন করার লক্ষ্যে এটাই আমাদের জন্য একটি উৎকৃষ্ট সময়। ম্যাথিউ জাতিসংঘের জলবায়ু পরিবতন প্রতিবেদনে মহাসাগর ও বরফাচ্ছাদিত অঞ্চলের বর্তমান পরিস্থিতি সম্পর্কিত অংশের মূল লেখক। বিষয়টি নিয়ে ব্যাখ্যা করতে গিয়ে তিনি বলেন, আমাদের উত্তর ভারত সাগরে সামান্য কিছু প্রবাল দ্বীপ রয়েছে যেগুলো জলবায়ু পরিবর্তন এবং সরাসরি মানুষের নানা কর্মকাণ্ড যেমন প্রবাল এবং মৎস আহরনের কারনে হুমকির মধ্যে রয়েছে।
ম্যাথিউ কোল বলেন, সারাবিশে^র উপরিভাগের মাত্র ০.১ শতাংশ হচ্ছে প্রবাল দ্বীপ। অথচ সামুদ্রিক জীববৈচিত্রের প্রায় ২৫ শতাংশের আশ্রয় এই সব প্রবাল দ্বীপ বা প্রবাল প্রাচীর। আর যেহেতু মাছ সাগরের সবদিকে চলাফেরা করে, তাদের অনেকেই অত্যন্ত স্পর্শকাতর এই বাস্তুসংস্থানের কাছে এসে বংশবিস্তার করে। আর এই জন্যই আমাদের সামুদ্রিক বাস্তুসংস্থানের সুরক্ষায় অত্যন্ত কার্যকর ও শক্তিশালী আইন প্রনয়ন অত্যন্ত জরুরী হয়ে পড়েছে।
সারাবিশ্বের উপরিভাগের মাত্র ০.১ শতাংশ হচ্ছে প্রবাল দ্বীপ অথচ সামুদ্রিক জীববৈচিত্রের প্রায় ২৫ শতাংশের আশ্রয় এই সব প্রবাল দ্বীপ
ভারতের গোয়ায় কর্মরত সমুদ্র বিজ্ঞানী এবং আইইউসিএনের সমুদ্র সংরক্ষণ কমিটির সদস্য অ্যারণ লোবো বলেন, যদিও এই গবেষণায় দেখানো মডেলের মাধ্যমে প্রমান করা সম্ভব যে আরো বেশি বেশি মেরিন প্রোটেক্টেড অঞ্চল গড়ে তোলার মাধ্যমে ভবিষ্যতে উপকূলীয় অর্থনীতির উন্নয়ণ সম্ভব, তবে এ মুহুর্তে যে প্রশ্নটি মূখ্য হয়ে দেখা দিয়েছে তা হচ্ছে – আমাদের কী আসলেই সেই স্বাধীনতা ও সুযোগ রয়েছে এই ধরনের আইন প্রনয়ন করে সমুদ্রে আরো বেশি বেশি সুরক্ষিত এলাকা ঘোষণা করা এবং তার সঠিক ব্যবস্থাপনা করা, বিশেষ করে বঙ্গোপসাগরীয় দেশগুলোতে যেখানে এটি বাস্তাবয়নে যথেষ্ট বাঁধা রয়েছে, সেই সাথে রয়েছে এখানকার জনগোষ্ঠীর নিত্র দারিদ্র?
তিনি বলেন, আমরা প্রায়ই দেখি সংরক্ষিত এলাকা নির্ধারণ নিয়ে আলোচনার ক্ষেত্রে এবং এ সংক্রান্ত নীতি নির্ধারণী বিষয়ে স্থানীয় জনগোষ্ঠীর অংশগ্রহন উপক্ষো করা হয়। সামুদ্রিক সংরক্ষিত এলাকা একেবারেই ব্যবহারের বাইরে রেখে অত্যন্ত কঠোর নিরাপত্তা ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে জীববৈচিত্র সুরক্ষায় অত্যন্ত কার্যকর একটি উপায় হিসেবে বিবেচিত হয়। তকে এই ব্যবস্থাপনা বাস্তবায়ন করাটা খুব একটা সহজ নয়। বিশেষ করে দক্ষিণ এবং দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার বিভিন্ন অঞ্চলে এটি চলমান রাখা অত্যন্ত দূরহ, যদিও এখানকার জন্য এই ব্যবস্থাপনা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। লোবো বলেন, যেসব দেশে সুশাসনের কিচুটা ঘাটতি রয়েছে সেখানে এই আমূল পরিবর্তন নিয়ে আসা অত্যন্ত কঠিন। বিশেষ করে অনেক দূরবতী এলাকা রয়েছে যেখানে নজরদারী করাটা বেশ জটিল এবং এই অঞ্চলগুলোতেই ব্যাপকভিত্তিতে অবৈধ মৎস শিকার করা হয়।
তিনি বলেন, আসলে একটু বিস্তারিতভাবে চিন্তা করলেই এ ব্রাপারে অনেকগুলো নেতিবাচক দিক আমাদের চোখের সামনে ভেসে উঠবে। তার মতে, এই গবেষণা পত্রটি মূলত একটি বৈশ্বিক চিত্র তুলে ধরেছে। কিন্তু আমাদের এখন এর মধ্য থেকে আঞ্চলিক এবং স্থানীয় বিষয়গুলোকে বিবেচনায় নিতে হবে। আর তা করতে গেলে সুনির্দিষ্ট কিছু পদক্ষেপ গ্রহন করতে হবে যাতে অবশ্যই পরিকল্পনার প্রথম দিন থেকেই স্থানীয় জনগোষ্ঠীর অংশগ্রহন নিশ্চিত থাকতে হবে। একইসাথে সবচেয়ে পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর জন্য যে এটি দীর্ঘ-মেয়াদী সৃুবিধা বয়ে আনবে সে ব্যাপাওে নিশ্চয়তা প্রদান করতে হবে।
সেভ আওয়ার সিস ফাউন্ডেশন- এর প্রকল্প প্রধান এবং সমুদ্র বিজ্ঞানী দিপানী সুতারিয়াও ম্যাথিউ লোবোর বক্তব্যেও সমর্থন করেন। তিনি বলেন, আমরা জানি আরব সাগর এবং বঙ্গোপসাগরীয় অঞ্চল ভৌগলিক ও জীববৈচিত্রের দিক থেকে অত্যন্ত সমৃদ্ধ। তবে একইসাথে এখানকার একটি বড় সমস্যা হচ্ছে ভূ-রাজনৈতিক দিকে থেকে আন্ত:সীমান্ত সম্পদ ভাগাভাগি এবং জীববৈচিত্রের সুরক্ষা নিশ্চিত করা এখানে অত্যন্ত জটিল একটি প্রক্রিয়া। সবচেয়ে বড় কথা হচ্ছে উন্নয়নের মাপকাঠিতে পৃথিবীর মধ্যে অন্যতম একটি জনবহুল এলাকা হিসেবে হঠাৎ করেই উপর থেকে নিচের দিকে নির্দেশনার মাধ্যমে মৎস সম্পদের মতো অন্যান্য জীববৈচিত্রগত সেবা শ্লথ বা বন্ধ করার সিদ্ধান্ত একানে খুব ভালো কাজে আসবে না। তিনি বলেন, আমি মনে করি এই গবেষণা পত্রটি থেকে আমাদের অনুধাবন করার মতো যে বিষয়টি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ তা হচ্ছে আমাদের মেনে নিতে হবে যে আমরা সম্পদ আহরনের ক্ষেত্রে ত্বলানীতে এসে দাঁড়িয়েছি এবং জলবায়ু এবং সম্পদ যে অসীম নয় সেটি আমাদের অবশ্যই মানতে হবে।
অনুবাদ: আরিক গিফার