মন্দির আর ঘাটের শহর বারানসী। নরেন্দ্র মোদী প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হওয়ার পর ভারতের প্রাচীন শহরটি আবারো আলোচনার শীর্ষে চলে আসে। ঐতিহাসিক এই শহরটিতে ট্র্যাফিক জ্যাম(যানজট) একটি নৈমিত্তিক ঘটনা। ডিজেল চালিত যানবাহনের ধোঁয়ার হাত থেকে বাঁচার জন্য এখানকার পথচারীরা মুখে কাপড় (মাস্ক) বেঁধে চলেন। বিগত বছরগুলোতে অর্থনৈতিক উন্নয়নে শহরটিতে মোটর সাইকেল (দ্বি-চক্র) ও গাড়ির আমদানী বাড়লেও অপ্রশস্ত সড়কগুলোর কোনো উন্নতি হয়নি। এসব সড়কে যুগ যুগ ধরে চলে আসছে রিক্সা, অটো আর গরুর গাড়ি। এগুলোই আসলে সৃষ্টি করছে যানজট আর ভয়াবহ বায়ু দূষন!
২০১১ সালের আদমশুমারী অনুযায়ি উত্তর প্রদেশের পূর্বাঞ্চলীয় এই শহরটির জনসংখ্যা ছিল ১.২ মিলিয়ন যা ২০০১ সালের মোট জনসংখ্যার থেকে ১৭.৩২ শতাংশ বেশি। শহরটিতে মেট্রো, ট্রাম ও বাস সার্ভিসের মতো পর্যাপ্ত গণপরিবহন ব্যবস্থা নেই। ফলে চলাফেরার জন্য এখানকার বাসিন্দাদের প্রায় ২৮ হাজার অটো-বিক্সার উপর নির্ভর করতে হয়।
বারানসীতে বায়ু দূষনের অন্যতম প্রধান কারণ হচ্ছে ব্যাপাক মাত্রার ধুলোকনা (পিএম ১০)। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী তাঁর নির্বাচনী প্রতিশ্রুতিতে এই শহরটিকে একটি ভিআইপি শহরে রুপান্তরের ঘোষনা দিয়েছিলেন। তিনি বলেছিলেন ‘এই শহরকে আমরা কোনোভাবেই নোংরা হতে দেব না।’গত ১২ জুন ২৪ ঘন্টায় এখানে বায়ু দূষনের মাত্রা (পিএম ১০) প্রতি ঘন মিটারে (ক্রম/স৩) ৫০০ মাইক্রোগ্রামে গিয়ে পৌছায় যা আসলে দেশের সার্বিক বায়ু দূষনের ক্ষেত্রে সবচেয়ে খারাপ পর্যায়ের। এ ধরনের দূষণের ফলে সাধারন মানুষ অসুস্থ্য হয়ে পড়ছে। পাশাপাশি যারা এরই মধ্যে দূষনজনিত রোগে ভূগছেন তাদের পরিস্থিতি দিনকে দিন আরো খারাপের দিকে যাচ্ছে। কেন্দ্রীয় দূষন নিয়ন্ত্রণ বোর্ড-এর (সিপিসিবি) সুপারিশ অনুযায়ি পিএম ১০ এর মাত্রা দিনে ৫০ পর্যন্ত স্বাভাবিক। অথচ বারানসীতে এর মাত্রা একদিনে ১৬৭ ছাড়িয়ে গেছে। এর ফলে মানুষের শ্বাস-প্রশ্বাসের সমস্যার পাশাপাশি ফুসফুস, অ্যাজমা ও হৃদরোগের প্রাদূর্ভাব বাড়ছে।
উত্তর প্রদেশ দূষন নিয়ন্ত্রণ বোর্ড-এর (ইউপিপিসিবি) সহকারি বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা টি এন সিংয়ের মতে, মূলত চারটি কারনে এখানে বায়ু দূষন ঘটছে। এগুলো হচ্ছে সরু রাস্তাঘাট, ব্যাপক ট্রাফিক জ্যাম, পয়:নিষ্কাশন লাইনের জন্য রাস্তা খোঁড়াখুঁড়ি এবং ডিজেল জেনারেশন কার্যক্রম। তিনি বলেন, ‘বারানসীতে বায়ু দূষনের সবচেয়ে বড় কারন মাত্রাতিরিক্ত যানবাহন – কোনো বাইপাস সড়ক না থাকায় যানবাহনগুলো শহরের ভিতর দিয়ে চলাচল করে।’
সিপিসিবি দেশের ১৭টি শহরকে চিহ্নিত করেছিল যারা দেশের সার্বিক বায়ু গুনাগুনকে ক্ষতি করছে। ২০০৬ সালের সেপ্টেম্বরে ‘এয়ার কোয়ালিটি ট্রেন্ডস অ্যান্ড অ্যাকশন প্ল্যান ফর কন্ট্রোল অব এয়ার পলিউশন ফ্রম সেভেনটিন সিটিস’শীর্ষক এক প্রতিবেদনে বারানসীর যানবাহনের ধরনকে ধীর ও দ্রুত গতির যুগলবন্দি হিসেবে উল্লেখ করা হয়। প্রতিবেদনে বলা হয়েছিল, বারানসীর সড়কগুলো অবৈধভাবে দখল হয়ে যাচ্ছে, এখানকার সড়কগুলো অপ্রশস্ত এবং যান-বাহনের চাপ কমাতে এখানে উপসড়ক বা বাইপাসের যথেষ্ট অভাব রয়েছে। প্রতিবেদনে আরো বলা হয়, এসব কারনে বারানসীতে ঘন্টার পর ঘন্টা যানজট লেগে থাকে।’এছাড়াও সেখানে প্রচুর কল-কারখানা রয়েছে যেগুলো বায়ু দূষনের মাত্রা বাড়াচ্ছে বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়। এই প্রতিবেদনটি ছাড়া দায়িত্বশীল অন্য কোনো সংস্থার পক্ষ থেকে অবশ্য বারানসীর বায়ু দূষণের কারন সম্পর্কে ব্যাখ্যা পাওয়া যায়নি।
যদিও বারানসীর বায়ুতে সালফার ডাই অক্সাইড (SO2) এবং নাইট্রোজেন ডাই অক্সাইডের (NO2) মাত্রা দেশের সার্বিক বায়ু গুনাগুন মাত্রার ক্ষেত্রে সহনীয় পর্যায়ে রয়েছে তবে রেসপায়রেবল সাসপেন্ডেড পার্টিকুলেট ম্যাটার (আরএসপিএম) এবং সাসপেন্ডেড পার্টিকুলেট ম্যাটারের (এসপিএম) মাত্রা স্বাভাবিক মাত্রা অতিক্রম করেছে। সিপিসিবি’র সাম্প্রতিক একটি প্রতিবেদনে বলা হয়, ন্যাশনাল এয়ার কোয়ালিটি অ্যামবিয়েন্ট স্ট্যাটাস ২০০৮ অনুযায়ি বারানসীর এসপিএম এবং আরএসপিএম-এর মাত্রা অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় রয়েছে। এগুলো দূষনের যে চারটি মাত্রা রয়েছে (স্বল্প, মধ্যম, উচ্চ এবং আশংকাজনক), তার সবচেয়ে উপরে অবস্থান করছে।
এসপিএম বাতাসে অন্যান্য উপাদানের সঙ্গে কঠিন অথবা তরল অবস্থায় মিশ্রিত থাকে। অপরদিকে আরএসপিএম হচ্ছে এসপিএমের মধ্যে বিভিন্ন উপাদান যেগুলো শ্বাস-প্রশ্বাসের সঙ্গে মানুষের শরীরে প্রবেশ করে। এভাবে নিশ্বাসের সঙ্গে আরএসপিএম প্রবেশ করলে যে কারো অ্যাজমা, কাশি, ব্যাথাযুক্ত শ্বাস-প্রশ্বাস, ক্রণিক ব্রংকাইটিসের মতো রোগসহ ফুসফুসের কার্যকারিতা কমে যেতে পারে।
গত পাঁচ বছর ধরে বারানসী শহরের বায়ু দূষন নিয়ে কাজ করছেন আশুতোষ কুমার পান্ডে। সম্প্রতি তিনি এ সংক্রান্ত একটি গবেষনা শেষ করেছেন। বারানসীর বায়ু দূষনের অবস্থা জানতে চাইলে দ্যথার্ডপোল.নেটকে তিনি বলেন, ‘এখানে একটি অদ্ভুত চিত্র দেখা যায়। শহরটিতে বড় বড় দালান কোঠার মাঝে ছড়িয়ে আছে অনেক সরু রাস্তাঘাট। এটি আসলে একটি গিরিখাতের (সুউচ্চ পর্বতের মাঝ দিয়ে বয়ে চলা জল প্রবাহ) মতো যেখানে দূষকগুলোর বেরিয়ে যাওয়ার পথ নেই।’
বারানসীর সড়কগুলো ধুলো আর ধোঁয়ায় আচ্ছন্ন থাকার কারন জানতে চাইলে তিনি বলেন, ভৌগলিকভাবে বারানসী ইন্দো-গাঙ্গীয় সমতলে অবস্থিত। এ ধরনের ভৌগলিক পরিবেশের একটি স্বাভাবিক বৈশিষ্ট্য হচ্ছে এখানে বায়ুতে প্রচুর ধুলীকনা থাকে। পাশাপাশি বারানসীর শহরের গঠনগত বৈশিষ্ট্যের (বহুতল বিল্ডিং এবং সরু সড়ক ব্যবস্থা) কারনে এখানে বাতাসে ধূলীকনাসহ বায়ু দূষনের অন্যান্য নিয়ামকগুলো পরিবেশে থেকে যায়।
ক্ষতিকর বর্জ্য পোড়ানো
বারানসী দেশের প্রাচীন শহরগুলোর মধ্যে একটি। একদিকে এটি দেশের অন্যতম একটি দূষিত নগরী আর অন্যদিকে এখানে চলছে পরিচ্ছন্নতা অভিযান। ফলে বিপাকে পড়েছে এখানকারন সাধারন মানুষ। সাবেক সেনা কর্মকর্তা শৈলেন্দ্র সিংয়ের (৮০) অভিব্যক্তিতে এনিয়ে বেশ বিরক্তির ছাপ দেখা যায়। তিনি বলেন, ‘প্রতিদিন প্রাত:ভ্রমনে বেরিয়ে আমি দেখি যেখানে সেখানে মণের পর মণ প্লাস্টিক পোড়ানো হচ্ছে। এর মধ্য দিয়েই আমাকে চলতে হয়। এতে বায়ু দূষণ হচ্ছে। আর এ ধরনের ক্ষতিকর বায়ু দূষণে আমি আরো বেশি অসুস্থ্য হয়ে পড়ছি।’
প্রকাশ্যে বর্জ্য পোড়ানো নিষিদ্ধ থাকলেও এই নিষেধাজ্ঞার যথাযথ কোনো প্রয়োগ নেই।
তিনি বহুবার মিউনিসিপালিটি অফিসে এ নিয়ে অভিযোগ জানিয়েছেন। কিন্তু কিছুই হয়নি কারন বহুদিন ধরে এখানে পরিচ্ছন্নতা কর্মীরা তাদের বেতন-ভাতা পাচ্ছেন না। গত মে মাসে একটি বর্জ্য সংগ্রহ ও ব্যবস্থাপনা কোম্পানির সাথে চুক্তি বাতিল করে মিউনিসিপ্যাল কর্পোরেশন। এরপর থেকে মূলত শহরের বর্জ্য ব্যবস্থাপনা ভেঙ্গে পড়ে। এরপর থেকে শহরের বাইরে বড় ভাগাড়গুলোতে ব্যাপক ভিত্তিতে বর্জ্য পোড়ানো শুরু হয়।
জনস্বাস্থ্যের উপরে প্রভাব
বানারাস হিন্দু ইউনিভার্সিটি’র (বিএইচইউ) রেসপাইরেটরি ডিজিজেজ বিভাগের অধ্যাপক এস কে আগারওয়াল বারানসীকে একটি ‘গ্যাস চেম্বার’ হিসেবে অভিহিত করেছেন। গত বেশ কয়েক দশক ধরে তিনি বায়ু দূষনের ফলে জনস্বাস্থ্যের উপরে তার প্রভাব নিয়ে গবেষনা করছেন। তিনি বলেন, আমি যখন বিএইচইউ’র ছাত্র ছিলাম, তখন দেখেছি একজন সাধারন মানুষের ফুসফুসের কার্যকারিতা এখনকার সময়ের চেয়ে ১৫ থেকে ২০ শতাংশ বেশি ছিল। এর প্রধান কারন বর্তমান বায়ু দূষন এবং লোকজনের শারিরিক ব্যায়ামের প্রতি অনীহা।
সাম্প্রতিক সময়ে ফুসফুসজনিত রোগ যেমন- অ্যাজমা ও ক্রনিক অবস্ট্রাকটিভ পালমোনারি ডিজিজে (সিওবিডি) আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা বেড়ে যাচ্ছে বলে দ্যথার্ডপোল.নেটকে জানান অধ্যাপক আগাওয়াল। তিনি বলেন, গ্রীষ্মে আমার কাছে যত রোগী আসে তার বেশিরভাগই ব্রংকাইটিস বা সিওবিডি রোগে আক্রান্ত। বর্ষা মৌসুমে আবার এ ধরনের রোগীর সংখ্যা কমতে থাকে। কারন তখন ধুলীকনার মতো অন্যান্য দূষক ক্রমান্বয়ে নিচে স্থির হতে শুরু করে।
১৯৯৮ সাল থেকে বারানসীর বায়ু দূষন নিয়ে কাজ করছেন একই বিশ্ববিদ্যালয়ের মাধুলিকা আগারওয়াল। তিনি মূলত শহরের শিল্প-কারখানাবেষ্টিত অঞ্চল, জনবহুল গঙ্গার ধার এবং বিশ্ববিদ্যালয় এলাকার বায়ু দূষনের মাত্রা পরীক্ষা করে আসছেন। তিনি গবেষনায় দেখেছেন বারানসীতে সালফার ডাই অক্সাইড-এর (SO2) মাত্রা নিচে নেমে এসেছে। তবে যেসব এলাকায় বড় বড় যানবাহন চলাচল করে সেখানে নাইট্রোজেন ডাই অক্সাইডের (NO2) মাত্রা স্বাভাবিকের তুলনায় চারগুন বেশি বেড়েছে।
তার গবেষনায় আরো দেখা গেছে বারানসীর উপশহর ও গ্রামের বাতাসে ওজোনের মাত্রা অত্যন্ত বেশি। তিনি বলেন, ‘বাতাসে ওজোনের মাত্রা বেশি থাকা খুবই ক্ষতিকর। এটি মারাত্বকভাবে গাছপালা ও ফসলের ক্ষতি করে। বিশেষ করে গম, মুগ, পালং শাক ও সরিষার ফলন কমে যাওয়ার পিছনে এটি দায়ী।
বিশ্বের অন্যতম প্রাচীন এই শহরটির মানুষ দিনের পর দিন বিষাক্ত বায়ু গ্রহন ও দূষিত জল ব্যবহার করতে বাধ্য হচ্ছে। তাদের আশা সরকার যথাশীঘ্রই প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়নে সচেষ্ট হবে।