জীববৈচিত্র্য

বাংলাদেশ ও ভারতে পাহাড় ধ্বসে শতাধিক মৃত্যু

মৌসুমের প্রথম ভারী বর্ষণে বাংলাদেশের চট্টগ্রাম ও সীমান্তবর্তী রাষ্ট্র ভারতের কয়েকটি রাজ্যে আকষ্মিক বন্যা ও পাহাড় ধ্বসের ঘটনা ঘটেছে
বাংলা
<p>The army has called off its search and rescue operation, but the fire service personnel are still continuing as many people are still missing [image by: Fazle Elahi]</p>

The army has called off its search and rescue operation, but the fire service personnel are still continuing as many people are still missing [image by: Fazle Elahi]

বাংলাদেশের পার্বত্য চট্টগ্রামের নোয়ারি পুলিশ লাইনে কর্মরত সুভাস চাকমা মানসিকভাবে সম্পূর্ণ ভেঙ্গে পড়েছেন। জুনের শুরুতে প্রবল বর্ষণের ফলে পাহাড় ধ্বসে মাটিতে ও ধ্বংসস্তুপে চাপা পড়ে একইসাথে তার স্ত্রী রুপালী এবং দুই মেয়ে জুঁইমণি ও ঝুমঝুমির মৃত্যু হয়। মাত্র ১৪ বছরের মেয়ে জুঁইমণিকে ঘিরে তার ছিল অনেক স্বপ্ন, মেয়ে বড় হয়ে একদিন ডাক্তার হবে। কিন্তু মর্মান্তিক ভূমি ধ্বসের কারণে তার পরিবারের আর কেউ রইলো না।

গত ১৬ জুন বাংলাদেশের কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে প্রবল বর্ষণের ফলে পার্বত্য চট্টগ্রাম ও চট্টগ্রাম শহরের বিভিন্ন স্থানে সৃষ্ট আকষ্মিক বন্যা ও পাহাড় ধ্বসের ঘটনায় সেনাসদস্যসহ কমপক্ষে ১৫৬ ব্যক্তির মৃত্যু হয়েছে

ভারতেও একই পরিস্থিতি

একই ঘটনায় বাংলাদেশের পার্বত্য চট্টগ্রামের সীমান্তবর্তী ভারতের মিজোরাম রাজ্যে কমপক্ষে আট ব্যক্তির মৃত্যুর খবর পাওয়া গেছে। প্রবল বৃষ্টিপাত শুরুর পর থেকেই মিজোরাম রাজ্যের উত্তর ও পূর্বের পাঁচ জেলা  – সারচিপ, লুংলেই, লংতলাই, সিয়াহা ও চাম্ফাই’য়ের সঙ্গে ভারতের অন্যান্য স্থানের যোগাযোগ পুরোপুরি বিচ্ছিন্ন  হয়ে যায়। ভারতে মৃত আটজনের প্রত্যেকেই লুংলেই জেলার অধিবাসী ছিলেন। ভারী বর্ষণের ফলে খাওথøাংতুউইপুই নদীতে আকষ্মিক বন্যা সৃষ্টি হয়। এর ফলে জেলার তিয়াবুং এলাকার কমপক্ষে ৩৫০টি বাড়িঘর চোখের পলকে তলিয়ে যায়। বন্যা ও ভারী বর্ষণের ফলে রাজ্যের রাজধানী এইজওয়ালের রাস্তাঘাট মারাত্বক ক্ষয়ক্ষতির শিকার হয়।

ভারতের অন্যান্য স্থানের মধ্যে ত্রিপুরা রাজ্য এবং আসামের ব্রক্ষ্মপুত্র উপত্যকায় ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতির ঘটনা ঘটেছে। অরুণাচল রাজ্যের বিভিন্ন  স্থানে পাহাড় ধ্বসের ঘটনায় যোগাযোগ ব্যবস্থা ভেঙ্গে পড়েছে। পাশ্ববর্তী মেঘালয় রাজ্যেও ভারী বৃষ্টিপাতের কারনে প্রচুর ক্ষতির ঘটনা ঘটে।

সাম্প্রতিক কালের সবচেয়ে ভয়াবহ ভূমি ধ্বস বাংলাদেশে

এ বছর জুনে পার্বত্য চট্টগ্রামের রাঙ্গামাটি ও বান্দরবানে ঘটে যাওয়া পাহাড়/ভূমি ধ্বসের ঘটনাকে সাম্প্রতিক সময়ের মধ্যে সবচেয়ে ভয়াবহ বলে বর্ণনা করছেন বাংলাদেশের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা। দেশটির দূর্যোগ ব্যবস্থাপনা বিভাগের মহাপরিচালক ঘটনার পর আনুষ্ঠানিক সংবাদ সম্মেলনে একথা জানিয়ে বলেন, এবার পাহাড়ে ঘটে যাওয়া ভূমি ধ্বসের মূল কারণ অত্যধিক ভারী বর্ষণ এবং  পরিবেশ বিপর্যয়। পরিবেশ বিপর্যয়ের অন্যতম কারণ হিসেবে তিনি পাহাড়ে জনসংখ্যা বৃদ্ধি এবং অনিয়ন্ত্রিতভাবে বনভূমি উজাড়কে দায়ী করেন।

জুনের ১৩ ও ১৪ ভোর থেকেই টানা বৃষ্টি শুরু হয়। এই দু’দিনে পার্বত্য চট্টগ্রামে বৃষ্টিপাতের পরিমান ৩০০ মিমি ছাড়িয়ে যায়। অন্যদিকে বাংলাদেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম শহর চট্টগ্রামে একই সময়ে বৃষ্টিপাতের পরিমান ছিল ২২২ মিমি। সাম্প্রতিক ইতিহাসে এই দুটি অঞ্চলে এই পরিমান বৃষ্টিপাত আর দেখা যায়নি বলে জানান রিয়াজ আহমেদ।

রাঙ্গামাটি, বান্দরবান ও খাগড়াছড়ি- এই তিনটি জেলা নিয়ে গঠিত পার্বত্য চট্টগ্রাম। এটি বাংলাদেশের একমাত্র পার্বত্য এলাকা। এখানকার বেশিরভাগ অধিবাসী আদিবাসী সম্প্রদায়ের। সাম্প্রতিক এই প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের পর এখনও সেখানে অনেক ব্যক্তির নিখোঁজ রয়েছেন বলে মনে করা হচ্ছে। তবে নিখোঁজ ওই ব্যক্তিদের খুঁজে পাওয়ার সম্ভাবনা অত্যন্ত ক্ষীণ মনে করে সেনাবাহিনী উদ্ধার কার্যক্রম আনুষ্ঠানিকভাবে ঘোষণা করেছে। তবে ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের উপ-পরিচালক এ কে এম শাকিল নেওয়াজ জানিয়েছেন তারা আরো কিছুদিন এই উদ্ধার তৎপরতা অব্যাহত রাখবেন।

সাংবাদিকদের ব্রিফিংকালে তিনি বলেন, আমাদের কাছে তথ্য আছে এখনও রাঙ্গামাটির বনরুপা ও রুপনগরে কেউ কেউ নিখোঁজ রয়েছেন। তবে আমরা এখনও পর্যন্ত বনরুপা থেকে কোনো মৃতদেহের সন্ধান পাইনি।’

রাঙ্গামাটিতে এবারের পাহাড় ধ্বসের ঘটনায় মৃতের সংখ্যা ১১০, চট্টগ্রামে ২৩, বান্দরবানে ৬, কক্সবাজারে ২ এবং খাগড়াছড়িতে একজনের মৃতদেহ উদ্ধার করা হয়েছে। এছাড়া চট্টগ্রামে আকষ্মিক বন্যা, বজ্রপাত ও গায়ের উপরে গাছ পড়ে আরো ১৪ জনের মৃত্যুর খবর পাওয়া গেছে।

এদিকে মৃত ব্যক্তির তালিকায় অন্যান্যদের মধ্যে চারজন সেনাসদস্যও রয়েছেন। প্রত্যক্ষদর্শী সূত্রে জানা গেছে, রাঙ্গামাটির মানিকছড়ির প্রধান সড়কটিকে কার্যকর অবস্থায় ফিরিয়ে আনতে সেনাবাহিনীর একটি দল কাজ করছিলো। এসময় সড়কের পার্শ্ববর্তী পাহাড়টি সেনাদলটির উপরে আকষ্মিকভাবে ধ্বসে পড়লে ১৫ জনের ওই দলটির প্রায় সবাই পাশে ৩০ ফুট গভীর খাদে পড়ে যায়। এসময় তাৎক্ষণিকভাবে চারজনের মৃত্যু ঘটে।

সারাদেহে মারাত্বক আঘাত নিয়ে রাঙ্গামাটি সদর হাসপাতালে রয়েছেন আব্দুল আজিজ (৫৫)। পাহাড় ধ্বসের সময় তার কান, নাক ও মুখে বালু প্রবেশ করে। সাংবাদিকদের কাছে ঘটনার বর্ণনা দিতে গিয়ে তিনি বলেন, সেদিন ভোরবেলা আমি বাড়ি থেকে একটু বাইরে গিয়েছিলাম। হঠাৎ দেখতে পাই পাহাড় থেকে ধ্বস নামছে। বিপদ বুঝতে পেরে আমি দ্রুত বাড়ির দিকে ছুটতে থাকি। যে মুহুর্তে আমি বাড়িতে প্রবেশ করি, ঠিক তখনই আমার পরিবারের চারজন সদস্য মাটির নিচে চাপা পড়ে মারা যায়। আমিও পাহাড়ি ধ্বসে চাপা পড়েছিলাম। কিন্তু আশেপাশে থাকা লোকজন আমাকে উদ্ধার করে হাসপাতালে নিয়ে আসে। এই ঘটনায় আমি আমার স্ত্রী, একমাত্র কন্যা আর দু’টি নাতীকে হারালাম।’

এদিকে দূর্ঘটনার পরপরই বাংলাদেশের সরকার ক্ষয়ক্ষতি কাটিয়ে উঠতে নানা পদক্ষেপ গ্রহন করে।  এরইমধ্যে রাঙ্গামাটি জেলা প্রশাসন ১৩টি আশ্রয়কেন্দ্র স্থাপন করেছে। জেলার বিভিন্ন বিদ্যালয় ও সরকারী স্থাপনা এসব আশ্রয়স্থল হিসেবে কাজ করছে। এসব আশ্রয়কেন্দ্রে ১,২৩৮ জন নিরাপদে অবস্থান করছেন। সেনাবহিনী তিনটি চিকিৎসা ক্যাম্প স্থাপন করেছে। যেসব পরিবার  প্রাকৃতিক এই বিপর্যয়ের কারনে কাউকে হারিয়েছেন তেমন প্রত্যেকটি পরিবারকে তাৎক্ষণিক সাহায্য হিসেবে সরকারের পক্ষ থেকে ২০ হাজার টাকা (২৪৭ মার্কিন ডলার) ও ২০ কেজি চাল দেয়া হয়েছে।

চট্টগ্রাম ও রাঙ্গামাটির সাথে এখনও পর্যন্ত খাগড়াছড়ি জেলার যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন রয়েছে। এখানকার সড়ক দিয়ে কেবল অটো-রিকশা চলাচল করছে। তবে স্বাভাবিক সময়ের চেয়ে জ্বালানী সহজলভ্য না হওয়ায় যাত্রিদের অতিরিক্ত ভাড়া গুণতে হচ্ছে।

বাংলাদেশের পার্বত্য এলাকায় পাহাড় ধ্বস একটি নিয়মিত প্রাকৃতিক বিপর্যয়ে পরিণত হয়েছে। বিশেষ করে বর্ষা মৌসুমে অর্থাৎ জুন থেকে সেপ্টেম্বর মাসের মধ্যে সামান্য থেকে ভারী বৃষ্টিপাত হলেই পাহাড় ধ্বসের ঘটনা ঘটতে থাকে। এর একটি অন্যতম কারণ হিসেবে অনিয়ন্ত্রিতভাবে বনভূমি উজাড়, জুম চাষ ও পাহাড়ে কোল ঘেষে বাড়ি নির্মানকে দায়ী করছেন সংশ্লিষ্টরা। এর আগে ২০০৭ সালের জুন মাসে পাহাড় ধ্বসের ঘটনায় চট্টগ্রামে ১২৩ জনের মৃত্যু হয়েছিল।

পার্বত্য চট্টগ্রামে প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের মূল কারণ বনভূমি উজাড়

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জিওলজি বিভাগের অধ্যাপক মাকসুদ কামাল বলেন, ব্যাপক ভিত্তিতে গাছপালা উজাড় করলে ভূমির স্বাভাবিক গঠন দূর্বল হয়ে পড়ে। ফলে পাহাড়গুলো ধ্বসের ঝুঁকির মধ্যে পড়ে। তিনি বলেন, সমগ্র পার্বত্য চট্টগ্রামে বনভূমি উজাড় করা হচ্ছে। লোকজন পাহাড় কেটে বাড়ি-ঘর তৈরি করছে।

এ প্রসঙ্গে সেতু ও সড়ক যোগাযোগ মন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বলেছেন, সরকার খুব শীঘ্রই পাহাড়ে অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ অভিযান পরিচালনা করবে।

ভারতের বিভিন্ন শহর জলমগ্ন

আকষ্মিক বন্যা ও পাহাড় ধ্বসে ঘটনায় ভারত ও বাংলাদেশে মানুষের মৃত্যু ও সম্পদের ক্ষয়ক্ষতির পাশাপাশি ভারতের উত্তর-পূর্বের রাজ্যগুলোর বিভিন্ন স্থানে ব্যাপক জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হয়েছে। উত্তর-পূর্বাঞ্চলের রাজ্যগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বড় শহর আসামের গুয়াহাটি সবচেয়ে বেশি ক্ষতির শিকার হয়েছে। সেখানে বৈদ্যুতিক তার ছিঁড়ে জলাবদ্ধ সড়কে পড়ে যাওয়ায় বিদ্যুতস্পৃষ্ট হয়ে তিনজনের মৃত্যুর খবর পাওয়া গেছে। ভারতীয় সেনাবাহিনী ব্রক্ষ্মপুত্রের তীরবর্তী অপেক্ষাকৃত নিচু এলাকায় বসবাসকারীদের সম্ভাব্য ক্ষয়ক্ষতি এড়াতে গুয়াহাটির নিরাপদ স্থানে সরিয়ে নিয়েছে। ত্রিপুরার রাজধানী আগারতলাও জলাবদ্ধ পরিস্থিতিতে রয়েছে।

আসামের অন্য তিনটি জেলা  – লখিমপুর, দারাং ও হাইলাকান্দির ৩৯টি গ্রামের প্রায় ১৪ হাজার বাসিন্দাকে প্রবল বন্যার কারনে অন্যত্র সরিয়ে নিয়েছে আসামের রাজ্য দূর্যোগ ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষ। এখানকার প্রায় ৪০০ হেক্টর এলাকার ফসল বন্যার কারনে সম্পূর্ণ নষ্ট হয়েছে।

এদিকে হাইলাকান্দি জেলায় কাটাখাল নদীর বাঁধ ভেঙ্গে যাওয়ার খবর পাওয়া গেছে। অপরদিকে ধলেশ্বরী নদীতে বন্যার কারনে হাইলাকান্দির প্রধান সড়ক জলমগ্ন হওয়ায় আশেপাশের এলাকাগুলোর সাথে যোগাযোগ বন্ধ রয়েছে।

 

Privacy Overview

This website uses cookies so that we can provide you with the best user experience possible. Cookie information is stored in your browser and performs functions such as recognising you when you return to our website and helping our team to understand which sections of the website you find most interesting and useful.

Strictly Necessary Cookies

Strictly Necessary Cookie should be enabled at all times so that we can save your preferences for cookie settings.

Analytics

This website uses Google Analytics to collect anonymous information such as the number of visitors to the site, and the most popular pages.

Keeping this cookie enabled helps us to improve our website.

Marketing

This website uses the following additional cookies:

(List the cookies that you are using on the website here.)