এবছর মধ্য আগষ্টে শুরু হওয়া বন্যায় ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতির শিকার হয় বাংলাদেশ। এর ফলে দেশের ৬৪টি জেলার মধ্যে ৩২টি জেলার কমপক্ষে ৮০ লক্ষ মানুষ ক্ষয়ক্ষতির শিকার হয়। বন্যার কারণে সারাদেশে ৭ হাজার ঘরবাড়ি সম্পূর্ণ অথবা আংশিকভাবে ক্ষতিগ্রস্থ্য হয়। একইসাথে এবারের বন্যায় এখন পর্যন্ত মৃত্যের সংখ্যা দাড়িয়েছে ১৪০ আর এদের মধ্যে বেশিরভাগই পানিতে ডুবে মারা যায়। ক্ষয়ক্ষতির পরিমান বা মৃতের সংখ্যা এবার তুলনামূলকভাবে কিছুটা বেশি হলেও, দক্ষিণ এশিয়ার এই দেশটি কিন্তু বন্যাকালীন ও বন্যাপরবর্তী সময়ে স্বাস্থ্য সুরক্ষায় ব্যাপক অগ্রগতি সাধন করতে সক্ষম হয়েছে। বিশেষ করে ডায়রিয়া, কলেরাসহ অন্যান্য পানিবাহিত রোগ মহামারি হিসেবে ছড়িয়ে পড়ার সম্ভাবনা বলা যায় পুরোপুরি প্রতিহত করার সাফল্য অর্জন করেছে দক্ষিণ এশিয়ার এই দেশ।
এর আগে বাংলাদেশ ১৯৮৭, ১৯৮৮, ১৯৮৯, ১৯৯৮, ২০০৪ এবং ২০০৭ সালে বড় ধরনের বন্যায় আক্রান্ত হয়। ওই বন্যার পরবর্তী সময়ে ডায়রিয়াসহ অন্যান্য পানিবাহিত রোগ মহামারি আকারে ছড়িয়ে যাওয়ার ঘটনা অনেকবারই ঘটেছে। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের অধীন মহামারি, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা কেন্দ্র (আইইডিসিআর) এর পরিচালক মিরজাদি সাবরিনা ফ্লোরার কাছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, পূর্ববর্তী বন্যাগুলোর ক্ষেত্রে ডায়রিয়া ও কলেরা ছিল অন্যতম প্রধান পানি বাহিত রোগ।
ডায়রিয়া ছিল অন্যতম ঘাতক
দি আমেরিকান জার্ণাল ফর ট্রপিক্যাল মেডিসিন অ্যান্ড হাইজিন এ সম্প্রতি একটি প্রবন্ধ প্রকাশ করে। এতে বলা হয় ১৯৮৮, ১৯৯৮ এবং ২০০৪ সালের বন্যায় ডায়রিয়াসৃষ্ট কলেরা ছিল সবচেয়ে প্রচলিত রোগ। এর পরেই ছিল রোটা ভাইরাস। ১৯৮৮ সালের বন্যায় প্রায় ৩৫ শতাংশ পানিবাহিত রোগই ছিল ডায়রিয়া। সেসময় গ্রামাঞ্চলে প্রায় ৪৫ হাজার রোগীর মধ্যে ১৫৪টি মৃত্যুর ঘটনা ঘটে যা ছিল মোট মৃত্যুর ২৭ শতাংশ।
২০০৭ সালের বন্যায় বন্যা-সৃষ্ট ডায়রিয়ার ঘটনা উল্লেখযোগ্যভাবে হ্রাস পায়। ওই সময়ে ইউনিসেফের প্রতিবেদনে বলা হয় ২০০৭ সালের বন্যায় সব মিলিয়ে ডায়রিয়া আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা ছিল ৬৮,৮৬২। এসময় সব মিলিয়ে মৃতের সংখ্যা ৬১৫ আর কেবল ডায়রিয়া আক্রান্ত হয়েই মৃত্যুর সংখ্যা ছিল মাত্র ১৭।
ডায়রিয়ায় কারো মৃত্যু নয়
এবার রোগাক্রান্ত হয়ে মৃত্যের সংখ্যা খুবই নগণ্য। এব্যাপাওে সাবরিণা ফ্লোরা বলেন, চলতি বছর আগষ্টের ১২ তারিখে আমাদের দেশে বন্যা আঘাত করে। কিন্তু দেশের কোথাও থেকে এখনও পর্যন্ত আমরা একটিও ডায়রিয়ায় আক্রান্ত রোগীর খবর পাইনি। এটি আসলেই একটি বড় ধরনের সাফল্য। অতীতের কোনো বন্যায়ই এমনটি দেখা যায়নি। তবে এসময় তিনি আরেকটি বিষয়ে সাবধান করে দিয়ে বলেন, পানিবাহিত রোগের প্রাদূর্ভাব কিন্তু বন্যা পরবর্তী সময়েই বেশি দেখা দেয়। তাই এখনও অবশ্য ডায়রিয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অধীন জরুরী রোগ নিয়ন্ত্রন কেন্দ্রের স্বাস্থ্য কর্মকর্তা শাখাওয়াত হোসাইন বলেন, আগষ্টের ২৭ তারিখ পর্যন্ত সারাদেশের কোথাও ডায়রিয়া, কলেরা বা অন্য কোনো ধরনের পানি বাহিত রোগ ছড়িয়ে পড়ার কোনো খবর পাওয়া যায়নি।
জেলার সিভিল সার্জন কার্যালয়সমূহ প্রতিদিন ডায়রিয়াসহ অন্যান্য পানিবাহিত রোগের তথ্য সংগ্রহ করে দৈনিক ভিত্তিতে ঢাকার নিয়ন্ত্রণ কক্ষকে অবহিত করে থাকে।
গত ১২ আগষ্ট থেকে দেশে বন্যা পরিস্থিতি মারাত্বক আকার ধারণ করে। ব্যাপক বৃষ্টিপাত এবং দেশের নদ-নদীগুলোতে উজানের দেশগুলো থেকে অতিরিক্ত পানির ঢল নামায় এই বন্যা পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। এতে দেশের উত্তরাঞ্চলের বেশিরভাগ জেলাই বন্যার পানিতে ডুবে যায়।
শাখাওয়াত হোসাইন বলেন, দেখুন, বাংলাদেশে ডায়রিয়া একটি অন্যতম প্রধান রোগ। তবে এই মুহুর্তে সারা বছরের তুলনায় এটি অত্যন্ত স্বাভাবিক পর্যায়ে রয়েছে, যেমনটি বছরের অন্যান্য সময়েও থাকে।
তিনি আরো বলেন, বন্যার ফলে বছরের এই স্বাভাবিক চিত্রের কোনো তারতম্য আমরা লক্ষ্য করিনি। বাংলাদেশের রোগীদের ৩৫ শতাংশই ডায়রিয়া আক্রান্ত রোগী। উদাহরণ হিসিবে তিনি বলেন, ‘যেমন ধরুন, আজ (আগষ্ট ২৭) সারা দেশ থেকে প্রাপ্ত তথ্য থেকে দেখা যাচ্ছে দেশের ৩২টি জেলায় ১,৬১১ জন রোগী অসুস্থ্য হয়েছেন। এর মধ্যে ডায়রিয়া আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা ৬৯০।
কুড়িগ্রাম জেলার সিভিল সার্জন এস এম আমিনুল ইসলাম জানান তার জেলায় বন্যায় সব মিলিযে ২৩ জনের মৃত্যু হয়েছে। এবারের বন্যায় সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্থ্য জেলাগুলোর মধ্যে কুড়িগ্রাম একটি। তিনি বলেন, এই ২৩ জনের মধ্যে প্রায় সবারই মৃত্যু হয় পানিতে ডুবে। তবে কেউই কলেরা বা অন্যান্য পানিবাহিত রোগে মারা যায়নি।
আমিনুল জানান এবারের বন্যার সময় তার জেলায় সব মিলিয়ে ৩০০ জন রোগী ডায়রিয়ায় আক্রান্ত হয়। তবে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে এই জেলার অধিবাসীদের মধ্যে চর্মরোগসহ অন্যান্য রোগে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যাই বেশি। তিনি বলেন, ‘আমরা গড়ে দৈনিক ২১ জন ডায়রিয়ায় আক্রান্ত রোগী দেখতে হয়। এটি একটি স্বাভাবিক সংখ্যা।’
সাফল্যের মূলে যা রয়েছে?
বন্যাসৃষ্ট রোগ প্রতিরোধে সরকারের আগাম প্রস্তুতিকেই সাফল্যের কারণ হিসেবে দেখছেন বিশেষজ্ঞরা। এ ব্যাপারে জানতে চাইলে সাবরিণা ফ্লোরা বলেন, গত জুলাই মাস থেকেই সরকারের বিভিন্ন সংস্থা বন্যার বিষয়ে আগাম সতর্কবার্তা প্রচার করে আসছিল। সরকারের সতর্ক বার্তায় আগষ্টে বন্যার সম্ভাবনার কথা বলা হয়। তখন থেকেই স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের নির্দেশনায় দেশের সবগুলো জেলার স্বাস্থ্য কার্যালয় (সিভিল সার্জন কার্যালয়) পানিবাহিত রোগসহ অন্যান্য রোগ মোকাবেলায় আগাম প্রস্তুতি গ্রহন করে।
ফ্লোরা বলেন, বন্যা দূর্গতদের যাতে বিশুদ্ধ পানির সমস্যা না হয় তার লক্ষ্যে আমরা প্রথম থেকেই পানি পরিশোধন ট্যাবলেট সরাবরাহের ব্যাপক প্রস্তুতি গ্রহন করি। বন্যা দূর্গতদের আশ্রয়কেন্দ্রগুলোতে আমরা ব্লিচিং পাউডারসহ অন্যান্য সামগ্রী প্রথম থেকেই সরাবরাহ করি। পাশাপাশি আমাদের জরুরী মেডিকেল টিম দৈনিক ভিত্তিতে আশ্রয়কেন্দ্রসহ আক্রান্ত রোগীদের বাড়ি বাড়ি গিয়ে সেবা প্রদান করে।
এই বিষয়ে জানতে চাইলে স্বাস্থ্য প্রতিমন্ত্রী জাহিদ মালেক বলেন, বন্যার সময় যে কোনো ধরনের পানিবাহিত রোগ প্রতিরোধ করতে সরকার ব্যাপক প্রস্তুতি গ্রহন করে। একইসঙ্গে চালানো হয় প্রচারণা কার্যক্রম।
তিনি বলেন, আমাদের দেশে সাধারণ মানুষ থেকে সমাজের সব পর্যায়েই ডায়রিয়া প্রতিরোধে খাবার স্যালাইন সম্পর্কে সচেতন।
দিনাজপুরের সিভিল সার্জন মওলা বক্স চৌধুরী বলেন, আমরা গড়ে দৈনিক পাঁচ জন ডায়রিয়া আক্রান্ত রোগী পেয়ে থাকি। তিনি বলেন, এবারের বন্যায় দিনাজপুর শহরের ৯৭ শতাংশ এবং ১৩টি উপজেলা বন্যায় ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্থ্য হয়। কিন্তু সৌভাগ্যজনকভাবে ডায়রিয়া পরিস্থিতি অন্যান্য সময়ের মতোই স্বাভাবিক পর্যায়ে ছিল।
তিনি বলেন, আমরা আশ্রয়কেন্দ্রগুলোতে বিশুদ্ধ পানি সরাবরাহ করেছি। এসব কেন্দ্র থেকে দূর্গতরা বাড়ি ফিরে যাওয়ার আগে আমরা প্রত্যেককে পানি পরিশোধন ট্যাবলেট প্রদান করেছি। পাশাপাশি আমরা সবাইকে খাবার স্যালাইনও সরাবরাহ করেছি যাতে সম্ভাব্য ডায়রিয়া এড়ানো যায়। কারণ খাবার সালাইনের মাধ্যমে ডায়রিয়া অনেকটাই নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব।
এবার ডায়রিয়াসহ অন্যান্য পানিবাহিত রোগ যাতে না ছড়ায় সেজন্য পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তর, সুশীল সমাজ, বেসরকারী সংস্থা, রাজনৈতিক দল ও বিভিন্ন সামাজিক-সাংস্কৃতিক দল একযোগে কাজ করে।
গণস্বাস্থ্য ইন্সটিটিউটের পাবলিক এনালিষ্ট আবু বকর সিদ্দিক বলেন, এখন মানুষ খাবার জন্য এক লিটার পানি ২০ টাকায় বাজার থেকে কিনে পান করে। ২০ বছর আগে এটি ভাবাই যেত না। এখন একজন দরিদ্র মানুষও প্রয়োজনে ১৫ টাকায় ৫০০ মিলিলিটার পানি কিনে পান করে। এর কারণ হচ্ছে মানুষ এখন অনেক বেশি সচেতন। তারা ডায়রিয়াসহ অন্যান্য পানিবাহিত রোগ এড়াতে সব ধরনের প্রস্তুতি নিয়ে থাকে।
তিনি আরো বলেন, সমাজের একটি বিরাট অংশ এখন জানে যে খাবার আগে এবং মলমূত্র ত্যাগের পরে সাবান ব্যবহার করে হাত পরিস্কার করতে হয় যাতে কলেরা না ছড়ায়।
এই ধরনের সচেতনতা সৃষ্টিতে গণমাধ্যম একটি বিরাট ভূমিকা পালন করে এসেছে।