দক্ষিণ এশিয়ায় যদিও দাবানলের মতোই দ্রুত ছড়িয়ে পড়ছে কোভিড-১৯, কিন্তু থেমে নেই এখানকার কৃষক! কাঁচামালের উচ্চমূল্য, অধিক শ্রম ব্যয় আর বন্যার চোখ রাঙানী উপক্ষো করে তারা ব্যস্ত এখন গ্রীষ্ম মৌসুমের ফসল বুনার কাজে
দক্ষিণ এশিয়ার বেশিরভাগ অঞ্চলেই এরই মধ্যে দক্ষিণ-পশ্চিম মৌসুমী বায়ুর প্রভাবে শুরু হয়েছে বৃষ্টিপাত। আর এর মাঝেই ভারত, পাকিস্তান, বাংলাদেশ আর নেপালের কৃষকরা গ্রীষ্মকালীন ফসল বুনতে শুরু করেছে। করোনা মহামারীতে নানাভাবে এখানকার কৃষি খাত ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হলেও চলতি মৌসুমের ফসল চাষ তো থেমে থাকতে পারে না!
পরিসংখ্যান বলছে দক্ষিণ এশিয়ার চার দেশে করোনা ভাইরাস সংক্রমনে ১০ লাখেরও বেশি মানুষ মারাত্বকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ভারত, পাকিস্তান আর বাংলাদেশে সংক্রমনের মাত্রা হু হু করে বাড়ছে। ভাইরাসের সংক্রমন মাত্রার রাশ টেনে ধরতে লকডাউনের মতো যেসব কার্যক্রম বাস্তবায়ন করা হচ্ছে তার উচ্চমূল্য দিতে হচ্ছে এখন এখানকার দেশগুলোকে – শিল্প ও সেবাখাতগুলোতে স্থবির এখন অর্থনৈতিক কর্মকান্ড। এ মুহুর্তে পর্যাপ্ত বৃষ্টিপাতের মধ্যে কৃষিখাতকে ঘিরেই অর্থনীতির চাকা সচল রাখার আশা দেখছেন অনেকেই।
যদিও নেপাল আর বাংলাদেশের জিডিপিতে কৃষির অবদান যথাক্রমে ২৫% ও ১৩%, তারপরেও এই সেক্টরটি দেশগুলোর কর্মসংস্থানের জন্য বিরাট ভূমিকা রেখে চলছে।
মহামারীসৃষ্ট লকডাউনের প্রভাবে শ্রমিকদের চলাফেরা আর যানবাহন পরিবহন ব্যাপকভাবে বাঁধাগ্রস্ত হওয়ায় এরই মধ্যে কৃষকদের শীত মৌসুমের ফসল উত্তোলন ও বিক্রিতে দুর্ভোগ পোহাতে হয়। পুরো উপমহাদেশেই তাই কৃষকদের গেল মৌসুমে ব্যাপক লোকসানের মুখোমুখি হতে হয়েছে। নেপালের মোরাং জেলার কৃষক ঈশ্বর আচার্য বলেন, গত কয়েক মাস যাবত আমি আমার গৃহপালিত পশুগুলোকে আমার জমিতে উৎপাদিত সবজি খাইয়েছি। কারন আমি আমার ফসল বাজারে বিক্রি করতে পারিনি।
কাঁচামালের অভাব ও কৃষিসংশ্লিষ্ট পন্যের মূল্য বৃদ্ধি
গ্রীষ্মকালীন ফসল বুনার মৌসুম যতই এগিয়ে আসছে, ততই কাঁচামালের অভাব ও কৃষিসংশ্লিষ্ট পন্যের মূল্য বৃদ্ধির বিষয়টি দৃশ্যত: সামনে আসছে। ভারতের রাঁচিস্থ অলাভজনক প্রতিষ্ঠান ট্রান্সফর্ম রুরাল ইন্ডিয়া ফাউন্ডেশন (টিআরআইএফ) দেশটির অধিকতর দরিদ্র রাজ্যগুলোতে কৃষকদের নিয়ে কাজ করে থাকে। জানতে চাইলে ওই প্রতিষ্ঠানের অশোক কুমার তারা বলেন, ঝাড়খন্ড ও বিহারে ক্ষুদ্র ও তৃণমূল কৃষকরা এখন বড্ড বিপাকে রয়েছে। কারন কৃষিবিজের মূল্য সেখানে ১৫ শতাংশ থেকে ২৫ শতাংশ পর্যন্ত বেড়ে গেছে।
তবে দেশটির খাদ্যসম্ভার হিসেবে বিবেচিত পাঞ্জাব, হরিয়ানা ও পশ্চিম উত্তর প্রদেশ রাজ্যের বড় বড় কৃষকদের জন্য এই চিত্র কিছুটা ভিন্ন। এ প্রসঙ্গে তৃণমূল কৃষকদের নিয়ে কাজ করা সংস্থা নয়াদিল্লিস্থ প্রফেশনাল অ্যাসিস্ট্যান্স ফর ডেভেলপমেন্ট অ্যাকশন-এর (পিআরএডিএএন) সত্যব্রত আচার্য্য বলেন, এখানকার বড় কৃষকরা আর্থিক সক্ষমতা থাকায় অগ্রীমভাবে বড় পরিমানে বীজ সংগ্রহ করে থাকেন।
ওদিকে ভারতের উত্তরাঞ্চলেও কৃষিপন্যের মূল্য বৃদ্ধি পেয়েছে। হায়দ্রাবাদ ভিত্তিক বেসরকারী সংস্থা ওয়াটারশেড সাপোর্ট সার্ভিসেস অ্যান্ড অ্যাক্টিভিটিস নেটওয়ার্ক (ডব্লিউএএসএসএএন)-এর রাভিন্দ্রা আদুসিমিল্লি বলেন, কৃষি উৎপাদক সংগঠনগুলো এই পরিস্থিতিতে ব্যাপক ইতিবাচক ভূমিকা রাখছে। বিশেষ করে অন্ধ্রপ্রদেশ, তেলেঙ্গানা ও কর্ণাটকের প্রান্তিক চাষীদের এখনও পর্যন্ত কৃষি বীজ সংকটের সম্মখীন হতে হয়নি।
তবে পাকিস্তানে কৃষি বীজসহ অন্যান্য ব্যয় অনেক বেড়ে গেছে বলে জানিয়েছে সেখানকার কৃষকরা। কৃষিতে সার ও কীটনাশক ব্যবহারের জন্য পাকিস্তানকে ব্যাপক পরিমানে রাসায়নিক বিদেশ থেকে আমদানী করতে হয়। কিন্তু চলমান এই লকডাউন ও করোনাসৃষ্ট অন্যান্য প্রতিবন্ধকতার কারনে এসব পন্যের মূল্য যথেষ্ট বৃদ্ধি পেয়েছে। দেশটির পাঞ্জাব প্রদেশের উত্তরাঞ্চলের কৃষক ওয়াকাস গোন্ডালের আশংকা এই মূল্য বৃদ্ধির কারনে আসলে তৃণমূল কৃষকরা ইপ্সিত লাভ থেকে বঞ্চিত হবে।
অবশ্য এই ক্ষতি কিছুটা যাতে পুষিয়ে আনা যায় সেজন্য দেশটির সরকার কৃষকদের কিছুটা আর্থিক সহায়তা প্রদান করেছে। দেশটির জাতীয় কৃষি গবেষণা কেন্দ্রের (এনএআরসি) খালিদ জামিল জানান যে প্রান্তিক কৃষকদের অচিরেই জ্বালানী ও বিদ্যুত সাশ্রয়ে প্রনোদনা দেয়া হবে। কৃষকদের ফসল উৎপাদনের সার্বিক ব্যয়ের ৩০ শতাংশই ব্যয় হয়ে থাকে এই খাতে।
এদিকে নেপালে এই মুহুর্তে সারের ব্যাপক সংকট চলছে। হিমালয় কন্যা নেপাল তার চাহিদার প্রায় সিংহভাগ রাসায়নিক সারই মূলত ভারতের বিভিন্ন বন্দর ব্যবহার করে মধ্যপ্রাচ্য ও চীন থেকে আমদানী করে থাকে। নেপালের কৃষি মন্ত্রণালয়ের তথ্য মতে, ভারতের কোলকাতা বন্দরে নেপালের আমদানীকৃত প্রায় ৫০ হাজার টন সার ও গুজরাটের কান্ডলা বন্দরে আরো প্রায় ২১ হাজার টন সার এ মুহুর্তে আটকে আছে।
আটকে থাকা বিপুল পরিমান এই সার দেশে ফিরিয়ে আনতে এক মাসেরও বেশি সময় লেগে যেতে পারে বলে সম্প্রতি এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানিয়েছে দেশটির কৃষি মন্ত্রণালয়। নেপাল সরকার কৃষকদের কোভিড-১৯ দুর্যোগ কাটিয়ে উঠতে চলতি বছরে প্রায় পাঁচ লাখ টন সার ভর্তুকি মূল্যে প্রদানের সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
দেশটির পূর্বাঞ্চলের কৃষক আচার্য্য বলেন, আপনি এখন কোনো সরাবরাহকারীর কাছ থেকে ইউরিয়া সার কিনতে চাইলে তার জবাব হবে – ‘আমাদের কাছে এ মুহুর্তে ইউরিয়া সার নেই’। আর যদি আপনার চাহিদা থাকে ডায়ামোনিয়াম ফসফেট (ডিএপি), আপনাকে বলা হবে কয়েক সপ্তাহ অপেক্ষা করতে। তিনি বলেন, প্রায় দুই সপ্তাহ অপেক্ষার পর আপনার চাহিদার মাত্র ২৫ শতাংশ প্রদান করা হবে!
শেষ প্রান্তে কেবল কৃষক
পাকিস্তানের পাঞ্জাব প্রদেশের পাকপাত্তান জেলার এক কৃষক আমের হায়াত ভান্দ্রা। তিনি বলেন, দু:খের বিষয় হচ্ছে কৃষকরা কখনই পণ্যের মূল্য নির্ধারণ করতে পারেনা। মধ্যস্বত্বভোগীরাই এটি নির্ধারণ করে থাকে। আর এক্ষেত্রে সরকারের ভূমিকাও ভয়াবহ। কৃষকদের জন্য সরকারের পক্ষ থেকে নূণ্যতম নিরাপত্তার কথাও বিবেচনা করা হয়না। এই দুর্যোগের সময় সরকার ক্ষুদ্র এই কৃষকদের সহায়তার জন্য কিছুটা আর্থিক প্রনোদনা দেয়া তো দুরে থাক, তারা রপ্তানীকারকদের জন্য বাজার উন্মুক্ত করে দেয়।
এতসব সমস্যার সাথে আরো যে নতুন সমস্যা যুক্ত হয়েছে তা হচ্ছে অভিবাসী শ্রমিক। প্রচুর পরিমানে অভিবাসী শ্রমিক কাজ হারিয়ে বড় বড় শহর থেকে গ্রামে ফিরে এসেছে। বেকার অবস্থায় থাকার কারনে তারা এখন নিজেদের সঞ্চয়ের অর্থ ব্যয় করে জীবন চালাচ্ছে। অথচ স্বাভাবিক অবস্থায় হয়ত এই অর্থ কৃষিতেই ব্যয় করতেন তারা।
পাকিস্তানে যেসব কৃষক ধান, যব, কার্পাস তুলা ও চিনি উৎপাদনের কাজ করতো এই মৌসুমে তাদের আশা-ভরসার যায়গায় ছেদ পড়ছে। এ ব্যাপারে ভান্দ্রা বলেন, আমাদের দেশের টেক্সটাইল শিল্প পুরোপুরি দেশে উৎপাদিত কার্পাসের উপরে নির্ভরশীল। এই অর্থবছরে কার্পাসের চাষের জন্য কোনো ধরনের প্রনোদনা রাখা হয়নি। আমাদের দেশের প্রধানমন্ত্রী নিজে এই কৃষিপণ্যটিকে আবারো ফিরিয়ে আনার ইচ্ছা প্রকাশ করলেও আদতে কোনো উন্নয়ন পরিকল্পনাই গ্রহন করা হয়নি। খেয়াল করলে দেখা যাবে কৃষি উন্নয়নে জাতীয় বাজেটে লক্ষ্যমাত্রা ২.৮ শতাংশ নির্ধারণ করা হলেও এটি স্বাভাবিক সময়ের চেয়ে অনেক কম।
এদিকে ভারত ও পাকিস্তানে ফসলের জমিতে পঙ্গপালের আক্রমনের ফলে কৃষিতে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি সাধন হয়েছে। আগামী জুলাই মাসে এই আক্রমনের পূনরাবৃত্তি ঘটার সম্ভাবনার কথা সরকারও উড়িয়ে দেয়নি।
শ্রমিকদের অবস্থা
এই লকডাউনে দক্ষিণ এশিয়াতে বিশাল সংখ্যক অভিবাসী শ্রমিক কাজ হারিয়ে গ্রামে ফিরে আসতে বাধ্য হয়েছে। এর ফলে কোথাও কোথাও শ্রমিকদের ঘাটতি দেখা যাচ্ছে আবার কোথাও প্রয়োজনের তুলনায় অনেক বেশি শ্রমিকের আধিক্য রয়েছে। ভারতের দরিদ্র অনেক রাজ্যের মধ্যে ঝাড়খন্ড একটি। সেখানে প্রচুর পরিমানে অভিবাসী শ্রমিক রয়েছে। সাম্প্রতিক সময়ে বড় রাজ্যগুলো থেকে ফেরত আসা বিপুল পরিমান শ্রমিক নিজ রাজ্যে ফিরে আসায় সেখানে এখন চাহিদার চেয়ে শ্রমিকের উপস্থিতি বেশি। একই অবস্থা কিন্তু বাংলাদেশ আর নেপালেও।
জমির মালিকের জন্য এটি নিতান্তই সুখকর হলেও শ্রমিকদের জন্য এটি কিন্তু আশংকার কথা। কারন এর ফলে মজুরী ব্যাপক হারে হ্রাস পেয়েছে। বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলের জেলা রংপুরের কৃষক আব্দুর রাজ্জাক বলেন, গত বেশ কয়েক বছর যাবত আমাদের দেশে কৃষি শ্রমিকদের মজুরী বৃদ্ধির একটি প্রবনতা লক্ষ্য করছিলাম। অনেক সময়ই প্রয়োজনের তুলনায় শ্রমিক খুঁজে পাওয়া ছিল বেশ দুষ্কর।
কিন্তু হঠাৎ করেই গেল কয়েক সপ্তাহে পরিস্থিতির আমূল পরিবর্তন দেখতে পাচ্ছি। তিনি বলেন, গ্রাম থেকে উন্নত কাজের আশায় এর আগে যারা বড় বড় শহরে চলে গিয়েছিল তারা আবার গ্রামে ফিরে আসছে দলে দলে। আর তাই শ্রমিকদের মজুরীও অনেক কমে গেছে।
ভারতের পরিস্থিতিও একই বলে জানান টিআরআইএফ-এর কুমার। অন্যদিকে ভারত ও পাকিস্তানের খাদ্য উৎপাদনে ভূমিকা রাখা বড় রাজ্যগুলোতে চলছে ব্যাপক শ্রমিক সংকট। ভারতের পাঞ্জাব প্রদেশের কৃষকদের সংগঠনগুলো এখন অন্যান্য রাজ্য থেকে শ্রমিকদের নিজ খরচে ফিরিয়ে আনছে। যেহেতু ধান চাষে প্রচুর শ্রমিকের প্রয়োজন হয় তাই এই সংকটের সময় মজুরীও অনেক বৃদ্ধি পেয়েছে। যার ফলে কৃষকরা লভ্যাংশ কমে আসতে পারে বলে আশংকা করছেন।
বন্যার আশংকা
মৌসুমী বৃষ্টিপাত দক্ষিণ এশিয়ার জন্য আশীর্বাদ, তারপরেও মৌসুমী জলবায়ু সৃষ্ট বন্যার কারনে এখানকার কৃষিকে প্রায়ই চরম মূল্য দিতে হয়। এবছর মৌসুমী জলবায়ুর প্রভাবে এরই মধ্যে বৃষ্টি পড়তে শুরু করেছে। অতিবৃষ্টির ফলে ভারতের রাজ্য সিকিম, আসাম, মেঘালয়সহ বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলীয় জেলাসমূহ, ভূটান ও নেপালে বন্যা শুরু হয়েছে। ভারতের আসামে ২৩ আর নেপালে ১৮ জনসহ দক্ষিণ এশিয়ায় এরই মধ্যে বন্যায় ৫০ জনের মতো মানুষ নিহত হয়েছে।
বন্যাপ্রবন বাংলাদেশের কৃষকরা এরই মধ্যে প্রস্তুতি নিতে শুরু করেছে। তিস্তা নদীর অববাহিকায় অবস্থিত লালমনিরহাট জেলার কৃষক আকরাম হোসেন বলেন, এবছর আমি আমন ধানের পরিবর্তে বন্যা-প্রতিরোধী ধানের চাষ করছি। বছরের এই সময়ে বাংলাদেশ ও ভারতের পূর্বাঞ্চলের রাজ্যগুলোতে মূলত আমন ধানের চাষ করা হয়।
তবে ভারতের বিহার রাজ্যের কৃষকরা বছরের অন্য সময়ের চেয়ে এখনও বন্যার আগাম প্রস্তুতি গ্রহন করেনি বলে মনে করেন অনেকেই। কোভিড-১৯ মহামারীর কারনে রাজ্যের বন্যা নিয়ন্ত্রণ প্রস্তুতি ব্যাহত হয়েছে। রাজ্যটির বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধ মেরামতের প্রায় ৩০ শতাংশ কাজই এখন পর্যন্ত অসমাপ্ত অবস্থায় রয়েছে। কোথাও কোনো বাঁধ ক্ষতিগ্রস্ত হলে তার খবর তাৎক্ষণিকভাবে টুইটার বার্তার মাধ্যমে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে অবহিত করার জন্য রাজ্য সরকার অতি সম্প্রতি নাগরিকদের অনুরোধ জানিয়েছে।
অনুবাদ: আরিক গিফার