পানি

বাংলাদেশে উপকূলীয় এলাকায় পানির মূল্য শহরের চেয়ে ৪০ গুন বেশি

বাংলাদেশের উপকূলীয় এলাকাসমূহে পানির কোনো অভাব নেই, তবে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে সমুদ্রপৃষ্টের উচ্চতা বৃদ্ধির ফলে দিনকে দিন উৎসগুলো লবনাক্ত হয়ে পড়ায় পানের অযোগ্য হয়ে পড়েছে এখানকার পানি
বাংলা
<p>Brajasundari buys water, a new experience in previously water-abundant Bangladesh, where salt water intrusion is affecting water sources [Image by: Riyan Talha]</p>

Brajasundari buys water, a new experience in previously water-abundant Bangladesh, where salt water intrusion is affecting water sources [Image by: Riyan Talha]

পঞ্চাশোর্ধ ব্রজসুন্দরী বাড়ি কাঁচরাহাটি গ্রামে। খাবার পানি যোগাড় করতে তাকে সপ্তাহে কমপক্ষে দুই বার প্যাডেলযুক্ত বাহনে চড়ে তিন কিলোমিটার পথ পাড়ি দিয়ে পানি কিনে আনতে হয় নিজের পরিবারের জন্য। দক্ষিন এশিয়ার বহু শুষ্ক ও স্বল্প শুষ্ক অঞ্চলে বাস করা লক্ষ লক্ষ নারীকে পায়ে হেটে দিনে কমপক্ষে দুই বার খাবার পানি সংগ্রহ করতে হয়। তারা হয়ত ব্রজোসুন্দরীর সপ্তাহে দু’বার পানি সংগ্রহ করাকে সৌবাগ্য হিসেবেই দেখতে পারেন। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে ব্রজসুন্দরী বাস করেন বাংলাদেশের সমুদ্র উপকূলের একটি জেলায়। এখানে যেদিকে দৃষ্টি যায় – পুকুর, ছোট ছোট খাল, নদী বা বিল, সবখানেই কেবল পানিই চোখে পড়ে। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে, এই পানি একেবারেই পানের অযোগ্য।

জলবায়ু পরিবর্তনের কারনে বেড়ে গেছে সমুদ্র পৃষ্ঠের উচ্চতা। এর ফলে ক্রমাগত লবনাক্ত পানি প্রবেশ করে দক্ষিন এশিয়ার সমগ্র সমুদ্র উপকূলের অঞ্চলগুলোর মিষ্টি পানির উৎসগুলোকে বিষাক্ত করে তুলেছে। আর বাংলাদেশে লবন পানি ক্রমেই মূল ভূখন্ডের আরো ভিতরে প্রবেশ করছে।

তাই ব্রজসুন্দরীকে এখন নিত্যই দোকানে গিয়ে পানি কিনতে হয় যেখানে পাম্পের মাধ্যমে ভূ-গর্ভের গভীর থেকে পানি উত্তোলন করার পর বিশুদ্ধ করে তা বিক্রি করা হয় সাধারণ মানুষের কাছে। বাংলাদেশের দক্ষিন-পশ্চিমাঞ্চলের জেলার সাতক্ষীরার উপজেলা শ্যামনগরে বসবাসকারী এই বৃদ্ধ বাসিন্দা প্রতিবার ৬০ লিটার পানি ক্রয় করেন ৩০ টাকার বিনিময়ে (০.৩৫ মার্কিন ডলার) এবং এই পানি বহন করে আনতে তাকে পায়েটানা রিকশার জন্য আরো ব্যয় করতে হয় ২০ টাকা (০.২৪ মার্কিন ডলার)। সব মিলিয়ে মাসে ব্রজসুন্দরীকে পানির জন্য ব্যয় করতে হয় ৪০০ টাকা (৪.৭২ মার্কিন ডলার), যা কিনা সরকারের সর্বশেষ পরিসংখ্যান অনুযায়ি, একজন ভূমিহীন কৃষি শ্রমিকের গড় আয়ের ১০ শতাংশেরও বেশি।

  ব্রজসুন্দরী দ্যথার্ডপোল.নেটকে বলেন, কখনও ভাবিনি যে আমাকে একসময় টাকা দিয়ে পানি কিনে খেতে হবে। আগে আমাদেও বাড়ির কাছেই ছিল বড় বড় পুকুর। কিন্তু লবন পানি ঢুকে এখন সব বিনষ্ট হয়ে গেছে। দিন দিন পানির এই সমস্যা যেন মাত্রা ছাড়িয়ে যাচ্ছে।

২০১১ সালে ইম্পেরিয়াল কলেজ লন্ডন এবং লন্ডন স্কুল অব হাইজিন অ্যান্ড ট্রপিক্যাল মেডিসিন এক গবেষনার মধ্য দিয়ে জানিয়েছিল যে বাংলাদেশের উপকূলীয় এলাকায় বসবাসকারী মানুষের শরীরে পানির মাধ্যমে প্রবেশ করা লবনের মাত্রা স্বাভাবিক মাত্রার চেয়ে অনেকগুন ছাড়িয়ে গেছে। কিন্তু প্রকৃত সত্য হচ্ছে এই মুহুর্তে পরিস্থিতি আরো ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে।

সমস্যার ব্যাপকতা বহুমাত্রিক

বাংলাদেশের ১৯টি উপকূলীয় জেলার মধ্যে সাতক্ষীরা একটি। এর মধ্যে যে সাতটি জেলা সমুদ্রমুখী তার মধ্যেও সাতক্ষীরা রয়েছে। বাংলাদেশের মোট জনসংখ্যার ৩২ শতাংশ উপকূলীয় জেলাগুলোতে বসবাস করে। বাংলাদেশ সরকারের সাম্প্রতিক আদমশুমারী অনুযায়ি এই অঞ্চলে বসবাসকারী মোট জনসংখ্যা ৩৫ মিলিয়ন।

প্রচুর সংখ্যক গবেষণার মধ্য দিয়ে এটি এখন প্রতিষ্ঠিত যে জলবায়ু পরিবর্তনের ক্ষতিকর প্রভাবে বাংলাদেশের উপকূলীয় অঞ্চলে বসবাসকারী জনগণ পানির লবনাক্ততা বৃদ্ধিতে নানাবিধ সমস্যার মুখে পড়ছে এবং এই সমস্যা দিনের পর দিন বেড়েই চলেছে।

map of salinity effect on water supply in Bangladesh

রিভার স্যালাইনিটি অ্যান্ড ক্লাইমেট চেঞ্জ: এভিডেন্স ফ্রম কোস্টাল বাংলাদেশ শীর্ষক ২০১৪ সালে প্রকাশিত বিশ^ব্যাংকের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, আগামী ২০৫০ সাল নাগাদ অক্টোবর থেকে মে মাস পর্যন্ত শুষ্ক মৌসুমে দেশের দক্ষিন-পশ্চিম অঞ্চলের নদনদীগুলোর লবনাক্ততার কারনে ব্যাপক পরিবর্তন স্বাধিত হবে। এর ফলে খাবার পানির সংকটসহ সেচ ব্যবস্থা এবং জলজ বাস্তুসংস্থানে ব্যাপক পরিবর্তন দেখা যাবে।

ব্যবসা যখন পানি নিয়ে

আসলে পানির সংকট কিন্তু এরই মধ্যে পরিলক্ষিত হচ্ছে। আর এর মধ্য দিয়ে সমগ্র উপকূলীয় এলাকায় ক্রমবর্ধমান হারে নতুন এক ব্যবসা প্রসারিত হচ্ছে, আর তা হচ্ছে পাত্রে করে খাবার পানি বিক্রির ব্যবসা। 

এখন পানির দোকানগুলোর সামনে চোখে পড়ার মতো জনসমাগম একটি নৈমিত্তিক দৃশ্য। এই দোকানগুলো এমন স্থানে স্থাপন করা হয় যেখানে তুলনামূলকভাবে গভীর এবং বিশুদ্ধ ভূগর্ভস্থ্য পানির স্তর পাওয়া যায়। প্রথমে মাটির নিচ থেকে পানি সংগ্রহ করে তা রিভার্স অসমোসিস (আরও) পদ্ধতিতে বিশুদ্ধ করা করা। এই পাম্পটি দোকনের পিছনে স্থাপন করা হয়। সংগ্রহীত পানি লবনমুক্ত করে তা পানের যোগ্য করে তা স্থানীয়দের কাছে বিক্রি করা হয়।

শ্যামনগর শহরের নাকিপুর এলাকায় বসবাসকারী শাহীনুর রহমান এমন একটি দোকানের মালিক। তার ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের নাম মৌসুমী ড্রিকিং ওয়াটার প্ল্যান্ট। ২০১৮ সালে ৬০০,০০০ টাকা বিনিয়োগের মাধ্যমে তিনি এই ব্যবসা শুরু করেন। তার প্ল্যান্টে প্রতি ঘন্টায় এক হাজার লিটার পানি বিশুদ্ধ করা যায়। তিনি প্রতিদিন প্রায় ১০০ থেকে ১৫০ পরিবারের কাছে ৫০ পয়সা প্রতি লিটার পানি বিক্রি করেন।

দ্য থার্ডপোল.নেটকে তিনি বলেন, আমি প্রতি মাসে এখান থেকে ৪০ হাজার টাকা আয় করি। এখানে পানির ব্যবসা একটি বড় ব্যবসা। মানুষের আসলে পানির অত্যন্ত চাহিদা আর আমরা তাদের চাহিদা পূরণ করে যাচ্ছি।

Shahinur Rahman at his reverse osmosis water plant in Shyamnagar [Image by: Riyan Talha]

প্রায় চার লাখ বাসিন্দার জন্য শ্যামনগরে এ মুহুর্তে ২৫টি পানি বিশুদ্ধকরণ প্ল্যান্ট রয়েছে। এখানকার বাসিন্দারা রাজধানী ঢাকার বাসিন্দাদের চেয়েও বেশি মূল্যে পানি ক্রয় করলেও আশ্চর্যের বিষয় হচ্ছে এখানকার সবগুলো প্ল্যান্টই মুনাফা করে যাচ্ছে। ঢাকা ওয়াটার সাপ্লাই অ্যান্ড স্যুয়েরেজ অথরিটি (ওয়াশা) ঢাকায় মাত্র ১২ টাকায় এক হাজার লিটার পানি সরাবরাহ করে। অন্যদিকে শ্যামনগরের বাসিন্দারা মাত্র ২৪ লিটার পানির জন্য ব্যয় করে ১২ টাকা। 

রাজধানীতে বসবাসকারী সকল নাগরিকের নিজেদের বাড়িতে নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় পানি বিশুদ্ধকরণ ব্যবস্থা স্থাপন করার কথা। অথচ শ্যামনগরের মতো এলাকার বাসিন্দাদের চেয়ে রাজধানী ঢাকায় বসবাসকারী জনগণ অনেক কম মূল্যে পানি ক্রয় করছে । আশ্চর্যের বিষয় হচ্ছে আরো শ্যামনগরের বাসিন্দাদের গড় আয় ঢাকার বাসিন্দাদের গড় আয়ের অর্ধেক। 

২০১৩ সালে বেসরকারী সংস্থা ওয়াটারএইড বাংলাদেশ প্রকাশিত এক গবেষনায় বলা হয়, ঢাকার চেয়ে উপকূলীয় এলাকাগুলোতে পাত্রে সরাবরাহ করা পানির মূল্য অনেক বেশি। গবেষণাটি সাতক্ষীরা এবং খূলনায় পরিচালনা করা হয়।

গবেষণাটি সেসময় নেতৃত্ব দেন আফতাব ওপেল। বর্তমানে তিনি ভিশন স্প্রীং নামে অন্য একটি সংস্থায় কর্মরত। তিনি বলেন, বর্তমানে উপকূলীয় এলাকায় পানির ব্যবসা বেশ রমরমা। প্রতিদিনই এই ব্যবসার প্রসার বাড়ছে। ২০১৩ সালের তুলনায় এখন পানির মূল্য ঢাকায় লিটার প্রতি অনেক কমে গেছে, অথচ উপকূলীয় এসব এলাকায় এই পানির মূল্য কয়েকশত গুন বেশি।

জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবকে আরো ক্ষতির মুখে নিয়ে যাওয়া কিছু স্থানীয় কারণসমূহ

উপকূলে খাবার পানির উৎসগুলোতে লবনাক্ত বেড়ে যাওয়ার পিছনে অন্যতম একটি কারন হচ্ছে চিংড়ি চাষ যা কিনা ১৯৮০ সালের দিকে বাংলাদেশে শুরু হয়। চিংড়ি চাষিরা তাদের প্লটগুলোতে অবাধে লবন পানি প্রবেশ করায় কারন লবনাক্ত পানিতে চিংড়ি সবচেয়ে ভালো বৃদ্ধি পায়। আর এই লবন পানিই ধীরে ধীরে ভূগর্ভস্থ্য পানির উৎসগুলোতে গিয়ে ধীরে ধীরে জমতে থাকে। 

খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক দিলীপ দত্ত বলেন, লবনাক্ত বৃদ্ধি পাওয়ায় বড় বড় পুকুরের পানি এখন পানের অযোগ্য হয়ে পড়েছে। চিংড়ি চাষের সাথে যারা যুক্ত তারা এই সমস্যা সমাধানে নতুন কোনো জলাধার নির্মান করেনি। তারা কেবল মুনাফর চিন্তাই করে।

অস্ট্রেলিয়ান ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির সেবাক কুমার সাহা ২০১৭ সালে বাংলাদেশের দক্ষিন-পশ্চিম উপকূলে চিংড়ি চাষের ফলে আর্থ সামজিক ও পরিবেশগত প্রভাব নিয়ে একটি গবেষনা পরিচালনা করেন। তিনি বলেন, পানিতে লবনাক্ততা বৃদ্ধির কারনে সেখানে বসবাসকারী মানুষের শরীরে মারাত্বক প্রভাব পড়ছে। এর ফলে খাবার পানির সংকট হচ্ছে, এবং একই সাথে প্রাত্যহিক কর্মকান্ড যেমন ¯œান করা, রান্নার কাজ ব্যাহত হচ্ছে।

স্বাস্থ্যের উপরে প্রভাব

খাবার পানি আর অন্যান্য নিত্য প্রয়োজনীয় কাজে শ্যামনগরের মতো অন্যান্য উপকূলীয় এলাকার বাসিন্দারা পানি কিনতে বাধ্য হলেও তারা আর এই ব্যয় নির্বাহ করতে পারছে না। এর ফলে লবন পানি ব্যবহার বেড়ে গেছে স্নান ও পরিস্কার-পরিচ্ছন্নতার কাজে। স্বাস্থ্যের উপরে এর প্রভাব পড়ছে মারাত্বক ভাবে। এই এলাকার বাসিন্দাদের মধ্যে, বিশেষ করে নারীদের যেসব স্বাস্থ্যগত সমস্যা হচ্ছে তা হলো চর্মরোগ, মূত্রনালীতে সংক্রমন এবং শ্রোনী প্রদাহজনিত রোগ। এছাড়া নারীদের আরেকটি বড় সমস্যা হচ্ছে মাসিক ঋতুকালীন সমস্যা। এটি একটি বড় ধরনের স্বাস্থ্য ঝুঁকিতে পরিণত হয়েছে।

আসলে এখানকার মানুষদের যে পরিমান পানি পান করা উচিত সে পরিমান পানি তারা পান করেনা। শ্যামনগর উপজেলার ২৩ বছর বয়সী এক নারী বলেন, এখানে পানির খুব অভাব। তাই পানি পান করার আগে আমাকে চিন্তা করতে হয় কতটুকু পান করবো আর কতটুকু সংরক্ষণ করবো। এই নারী একটি চিংড়ির ঘেড়ে কাজ করেন। সেখানে কাজ করতে গিয়ে তাকে সারাদিন কোমর সমান লবন পানিতে ডুবে কাজ করতে হয়।  তার কর্মস্থলে পানি পানের কোনো ব্যবস্থাই নেই। ২০১৯ সালে মূত্রনালীতে সংক্রমনের সমস্যা হওয়ায় তাকে একবার স্থানীয় চিকিৎসকের শরণাপন্ন হতে হয়েছিল। তখন চিকিৎসক তাকে বলেছিলেন তিনি প্রয়োজনের তুলনায় কম পানি পান করেন বলেই এই সমস্যা বোধ করছেন।

ক্যামনগর হেলথ কেয়ার সেন্টাওে কর্মরত রত্না রানী পাল বলেন, আমাদের কাছে বেশিরভাগ নারী রোগীরা প্রজননতন্ত্রের সমস্যা নিয়ে আসেন। এর অন্যতম প্রধান কারন হচ্ছে মাসিক সংক্রান্ত প্রয়েঅজনীয় যত্ন আর ব্যবস্থাপনার অভাব।

সাতক্ষীরার কালীগঞ্জ উপজেলার তৃণমূল নারী সংগঠন প্রেরণা নারী উন্নয়ন সংস্থানের পরিচালক শম্পা গোস্বামী বলেন, এখানকার নারীদের জীবন অত্যন্ত হুমকির মুখে। পানিতে লবনাক্ততা, জলবায়ু পরিবর্তন আর একের পর এক ঘূর্ণিঝড় এখানকার নারীদের জীবনকে দিনকে দিন দূর্বিষহ করে তুলছে।

অনুবাদ: আরিক গিফার