জলবায়ু

জলবায়ু প্রতিশ্রুতি জোরাদারে পিছন পথে হাটছে ভারত

ভারত জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবেলায় তার ছোটখাটো প্রতিশ্রুতিগুলোর বাস্তবায়ন করছে ঠিকই, তবে এখনও পর্যন্ত তারা কয়লার উপরে জোর দিচ্ছে এবং জলবায়ু পরিবর্তনের সবচেয়ে ক্ষতিকর প্রভাবগুলো থেকে সাধারণ মানুষকে রক্ষার জন্য প্রাকৃতিক সম্পদ যে সুরক্ষা করা প্রয়োজন তা নিশ্চিত করতে ব্যর্থ হচ্ছে
বাংলা

যে প্রশ্নটির মুখোমুখি হলে চট করে ভারতের বন, পরিবেশ ও জলবায়ু পরিবর্তন বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের যে কোনো উর্ধ্বতন কর্মকর্তা চরম বিরক্তি প্রকাশ করবেন সেটি হচ্ছে – সরকার কি প্যারিস লক্ষ্যমাত্রা আরো জোরদারে কাজ করছে? বিষয়টির মুখোমুখি হলে মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী থেকে যুগ্ম সচিব, সকলেরই তাৎক্ষণিক জবাব, কেন আমাদের সেটি করতে হবে? জি-২০ দেশ হিসেবে আমরাই একমাত্র দেশ যারা প্যারিস চুক্তির লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে কাজ করছি। এক্ষেত্রে আমাদের অনেকটাই সন্তোষজনক অগ্রগতি হয়েছে, আমরা অনেকখানি এগিয়ে গেছি। কিন্তু আমাদেরকে যারা জ্ঞানের কথা শোনাচ্ছে আপনারা কেন সেই দেশগুলোকে প্রশ্ন করছেন না যে তারা বরং আমাদের বাদ দিয়ে নিজেদের করনীয়গুলো বাস্তবায়নে কাজ করুক।

যুগান্তকারী প্যারিস চুক্তির পাঁচ বছর পর, মহামারীর ফলে গ্রিন হাউস গ্যাস নির্গমনে (জিএইচজি) কিছুটা বিরতি দেখা গেলেও জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবগুলো বাড়তে দেখা যাচ্ছে। জলবায়ু পরিবর্তনের ক্ষতিকর এই প্রভাবগুলো এ অঞ্চলের মানুষের জন্য যে ভোগান্তি বয়ে আনছে তা একেবারেই দৃশ্যমান। আর সেই সাথে নির্গমনের মাত্রা নিয়ন্ত্রনে স্ব স্ব প্রতিশ্রুতির বাস্তবায়ন এখনও অপর্যাপ্ত।

এবছর জাতিসংঘের বার্ষিক জলবায়ু সম্মেলন ২০২০-এ অংশগ্রহনকারী ১৯৫টি দেশের সরকার ও ইউরোপীয় ইউনিয়ন, জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবেলায় আরো সমন্বিত প্রচেষ্টার প্রতিশ্রুতির কথা শোনা যাবে বলে বিশ^জুড়ে এক প্রকার প্রত্যাশার সৃষ্টি হয়। কোভিড-১৯ এর কারনে গ্লাসগো শহরে অনুষ্ঠিতব্য ওই সম্মেলনটি এক বছরের জন্য স্থগিত করা হয়েছে।

এরই মধ্যে বিশ্বের বড় কয়েকটি অর্থনীতির দেশ যেমন চীন, জাপান এবং দক্ষিণ কোরিয়াসহ সবমিলিয়ে ১২৬টি দেশ আগামী কতদিনের মধ্যে নিজেদের কার্বন নিরপেক্ষ দেশ হিসেবে ঘোষণা করবে তার দিনক্ষণ ঘোষণা করেছে। একই সাথে আরো আশা করা হচ্ছে যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পরবর্তী প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব নেয়ার পরপরই জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবেলায় বড় ধরনের কিছু প্রতিশ্রুতির ঘোষণা দিবেন জো বাইডেন।

এ অবস্থায় সব মিলিয়ে প্যারিস চুক্তিতে করা প্রতিশ্রুতিগুলো পূরনে করনীয়গুলো আরো বেগবান করতে বিশ্বের চতুর্থ বৃহত গ্রিন হাউস গ্যাস (জিএইচজি) দূষণকারী দেশ ভারতের প্রতি ধনী রাষ্ট্রগুলোর পক্ষ থেকে  এক প্রকার জোর দাবী প্রতিলক্ষিত হচ্ছে ক্রমশ। জিএইচজি দূষণকারী সবচেয়ে বড় দেশগুলোর মধ্যে চীন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) পরেই ভারতের অবস্থান।

এসব ঘটনার পরম্পরায় ভারত সরকার এখন নিজেদের মধ্যে বেশ নড়ে চড়ে বসেছে এবং জলবায়ু পরিবর্তনের ক্ষতি মোকাবেলায় সরকারের পক্ষ থেকে কী ধরনের কার্যক্রম গ্রহন করা হচ্ছে তা জনসমক্ষে বারবার তুলে ধরার চেষ্টা করছে। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী সাম্প্রতিক জি ২০ ভার্চুয়াল শীর্ষ সম্মেলনে ব্যাখ্যা করে বলেন যে,  কীভাবে ভারত এই মুহুর্তে বিশ্বের সবচেয়ে উচ্চাভিলাশী নবায়নযোগ্য শক্তি কর্মসূচী বাস্তবায়নের পথে অগ্রসর হচ্ছে। সম্মেলনে সরকারের প্রতিশ্রুতির কথা উল্লেখ করতে গিয়ে তিনি বলেন, ২০২২ সালের মধ্যে  নবায়নযোগ্য বিদ‌্যুতের উৎপাদন ১৭৫ মেগাওয়াটে (জিডব্লিউ) উন্নীত করার যে লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে, আমরা তার অনেক আগেই সেই লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে সক্ষম হবো। এ মুহুর্তে আমরা ২০৩০ সালের মধ্যে ৪৫০ গিগাওয়াটের লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের মহাপরিকল্পনার পথে অগ্রসর হচ্ছি। বর্তমানে ৭৮ গিগাওয়াট নবায়নযোগ্য বিদ‌্যুতের উৎপাদন সক্ষমতার জন্য প্রয়োজনীয় অবকাঠামো নির্মান সম্পন্ন হয়েছে এবং একই পরিমান বিদ‌্যুত বা শক্তি উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে প্রয়োজনীয় অবকাঠামো নির্মান অব্যাহত রয়েছে। পর্যবেক্ষকরা মনে করছেন নির্ধারিত সময়ের মধ্যে ১৭৫ গিগাওয়াট নবায়ন যোগ্য বিদ্যুত উৎপাদনের জন্য প্রয়োজনীয় অবকাঠামো নির্মানের কাজ সম্পন্ন হলেও, বিতরণ ব্যবস্থাপনার অবকাঠামো নির্মানের কাজ সমান্তরালভাবে সম্পন্ন করা সম্ভব হবে না কিংবা প্রত্যাশা অনুযায়ি পিছিয়ে থাকার সম্ভাবনা রয়েছে।

পরিবেশ মন্ত্রী প্রকাশ জাভেদকার বরাবরাই বলে আসছেন যে আন্তর্জাতিক পর্যায়ের জলবায়ু বিশ্লেষকগণদের হিসেব অনুযায়ি বিশ্বের বড় অর্থনীতির দেশগুলোর মধ্যে ভারতই একমাত্র দেশ যেটি প্রাক-শিল্প স্তরের উপরে বৈশ্বিক তাপমাত্রা দুই ডিগ্রি সেলসিয়াসের মধ্যে বজায় রাখার ক্ষেত্রে প্রদেয় প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়নে সঠিক পথে অগ্রসর হচ্ছে। প্রশমন প্রতিশ্রুতির অংশ হিসেবে প্রতি ইউনিট উৎপাদনে কার্বন নির্গমনের তীব্রতা হ্রাসের চেয়ে বরং কার্বন নির্গমনের হার কমিয়ে আনার যে কৌশল ভারত গ্রহন করেছে তা বেশ ভালো ফল দিচ্ছে। তবে বলা বাহুল্য যে শিল্প ক্ষেত্রে অধিকতর দক্ষতা উন্নয়নের কৌশল ও ব্যবস্থাপনা ভারতকে আসলে সে পথেই এগিয়ে নিয়ে চলেছে।

জাভেদকার এ প্রসঙ্গে আরো যেই যুক্তি উপস্থাপন করেন তা হচ্ছে বড় দেশগুলোর মধ্যে ভারতই একমাত্র দেশ যেটি সাম্প্রতিক বছরগুলোতে  সবুজায়ন আরো সুবৃদ্ধির প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। তবে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে সবুজায়ন প্রক্রিয়াটি বনায়নের বদলে বৃক্ষরোপনের মধ্যেই সীমাবদ্ধ, যা আসলে জীববৈচিত্র্য সুরক্ষা বা উন্নয়নে তেমন কোনো ভুমিকা রাখে না।

সরকারের মন্ত্রী আর কর্মকর্তারা মোদী সরকারের চালু করা দুইটি উদ্যোগকে নতুন ধরনের পদক্ষেপ হিসেবে উল্লেখ করে থাকেন: এর একটি হচ্ছে ২০১৫ সালে গঠিত আন্তর্জাতিক সৌর জোট বা ইন্টারন্যাশনাল সোলার অ্যালায়েন্স (আইএসএ) এবং দুর্যোগ সহনীয় অবকাঠামো সংক্রান্ত জোট বা কোয়ালিশন ফর ডিজাস্টার রেসিলিয়েন্ট ইনফ্রাস্ট্রাকচার (সিডিআরআই) যেটি গঠিত হয় ২০১৯ সালে। প্রাথমিক তোড়জোড়ের পরে আইএসএ মাঠ পর্যায়ে কিছু কাজ করতে শুরু করে – বিশেষ করে তারা সৌর বিদ্যুত বা সৌর শক্তি সংক্রান্ত অবকাঠামো স্থাপন ও ব্যবস্থাপনা বিষয়ে অন্যান্য উন্নয়নশীল দেশে সংশ্লিষ্ট পর্যায়ে দক্ষ জনশক্তি তৈরিতে প্রশিক্ষণ প্রদানের কাজ শুরু করে। সিডিআরআই জোটভূক্ত বেশিরভাগ দেশের কাছ থেকে সহযোগিতা পেলেও এখনও পর্যন্ত উল্লেখ করার মতো কোনো কিছুই করতে পারেনি।

জার্মানওয়াচ নামে আন্তর্জাতিক একটি নব্য জলবায়ু ইন্সটিটিউট এবং জলবায়ু অ্যকশন নেটওয়ার্ক তাদের সাম্প্রতিক এক প্রতিবেদনে জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবেলায় বিশে^র বিভিন্ন দেশের কার্যক্রমের একটি তুলনামূলক বিশ্লেষণ তুলে ধরে। সংস্থাটি বৈশি^ক জলবায়ু পরিবর্তন পরিস্থিতি নিয়ে নানা ধরনের গবেষণা ও বিশ্লেষণ পরিচালনা করে। জার্মানওয়াচের ওই বিশ্লেষনে বিশ্বের অন্যান্য দেশের চেয়ে জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবেলায় প্রদত্ত প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়নে ভারতের অবস্থান যথেষ্ট উচ্চতায় রয়েছে বলে উল্লেখ করা হয়। প্রতিবেদনটিতে প্যারিস চুক্তিতে সম্মত রাষ্ট্রগুলোর বিভিন্ন প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়নের অগ্রগতির পর্যালোচনা করে সংশ্লিষ্ট ক্ষেত্রে তাদের অবস্থান নির্ণয় করা হয়। এটি করতে গিয়ে তারা বিশ্বের ৬১টি বড় অর্থনীতির দেশকে বেছে নেয়। তাতে দেখা যায়, এই ৬১টি দেশের মধ্যে প্যারিস প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়নে ভারতের অবস্থান ১০ম। অন্য দিকে এই মানদণ্ডে চীনের অবস্থান ৩৩তম এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান সর্বনিম্নে অর্থাৎ ৬১তম।

প্যারিস প্রতিশ্রুতির বাস্তবায়ন

সম্প্রতি ভারত প্যারিস চুক্তি বাস্তবায়নে একটি উচ্চ পর্যায়ের কমিটি গঠন করেছে যার নাম হচ্ছে এপেক্স কমিটি ফর ইমপ্লিমেন্টেশন অব প্যারিস এগ্রিমেন্ট (এআইপিএ)। পরিবেশ মন্ত্রণালয়ের নেতৃত্বে এই কমিটিতে সবমিলিয়ে ১৪টি মন্ত্রণালয়ের প্রতিনিধি রয়েছে। কমিটির মূল কাজ হচ্ছে দেশের জলবায়ু নীতির সমন্বয়, কার্বন বাজার নিয়ন্ত্রণ এবং বেসরকারী কোম্পানীগুলো সংশ্লিষ্ট ক্ষেত্রে কীভাবে কার্যক্রম পরিচালনা করছে তা পর্যবেক্ষণ করা। এআইপিএ-র সাথে কাজ করা অন্যান্য মন্ত্রণালয়গুলো হচ্ছে অর্থ মন্ত্রণালয়, কৃষি মন্ত্রণালয়, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়, আধুনীক ও নবায়নযোগ্য শক্তি সংক্রান্ত মন্ত্রণালয়, পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়, বিদ্যুত মন্ত্রণালয়, ভূ-বিজ্ঞান মন্ত্রণালয়, স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়, গৃহায়ন ও নগর বিষয়ক মন্ত্রণালয়, গ্রামীন উন্নয়ন মন্ত্রণালয়, বৈদেশিক সম্পর্ক বিষয়ক মন্ত্রণালয় এবং বাণিজ্য ও শিল্প মন্ত্রণালয়।

যেহেতু প্যারিস চুক্তিতে সম্মত প্রতিশ্রুতিগুলো বাস্তবায়নের প্রথম পর্যায় শুরু হচ্ছে ২০২১ সালে, তাই কমিটির এই মুহুর্তে একটি বিষয় নিশ্চিত করা অত্যন্ত জরুরী এবং গুরুত্বপূর্ণ। তা হচ্ছে, চুক্তির আলোকে করা তিনটি প্রতিশ্রুতিতে ভারত সরকারকে অটল রাখা। এই তিনটি প্রতিশ্রুতি হচ্ছে – আগামী ২০৩০ সালের মধ্যে ২০০৫ সালের মাত্রার চেয়ে নির্গমন তীব্রতার হার কমপক্ষে ৩৩ – ৩৫ শতাংশ পর্যন্ত হ্রাস করা, ২০৩০ সালের মধ্যে দেশের মোট উৎপাদিত বিদ্যুতের ৪০ শতাংশ কেবল অ-জীবাশ্ম জ্বালানী ব্যবহারের মাধ্যমে উৎপাদন নিশ্চিত করা; এবং বৃক্ষরোপন কর্মসূচির মাধ্যমে বায়ুমণ্ডলের ২.৫ থেকে ৩ বিলিয়ন টন কার্বন ডাই অক্সাইড সমপরিমান গ্রিন হাউজ গ্যাস (জিএইচজি) অপসারণ।

এআইপিএ এ সংক্রান্ত যাবতীয় অগ্রগতি তথ্য জাতিসংঘের জলবায়ু পরিবর্তন সংক্রান্ত ফ্রেমওয়ার্ক কনভেনশনের (ইউএনএফসিসিসি) কাছে তুলে ধরতে ভারত সরকারের পক্ষ থেকে দায়িত্বপ্রাপ্ত।

কয়লা সমাচার

যদিও এই পদক্ষেপগুলোর মধ্যে একটির ক্ষেত্রেও কোনো ধরনের ব্যত্যয় ঘটানোর অবকাশ নেই, তারপরেও কয়লা-নির্ভর বিদ্যুত কেন্দ্র গড়ে তোলার ক্ষেত্রে ভারতের চলমান প্রচেষ্টা বন্ধে কোনো পদক্ষেপ নেই। বরং এ বিষয়ে যাবতীয় প্রশ্নের বিপরীতে ভারত সরকারের অবস্থান অত্যন্ত আত্মরক্ষামূলক। জিএইচজি নির্গমনের ক্ষেত্রে কয়লা-নির্ভর বিদ্যুত কেন্দ্রগুলো সবচেয়ে বড় দূষণকারীই কেবল নয়, আজকের দিনে নবায়নযোগ্য জ্বালানীর চেয়ে এই ধরনের প্রযুক্তি যথেষ্ট ব্যয়বহুল। এতকিছুর পরেও দেখা যাচ্ছে মহামারীতে ক্ষতিগ্রস্থ্য অর্থনীতি পুনরুদ্ধারে সরকারের প্রনোদনা প্যাকেজে বরং নতুন নতুন কয়লা খনি উত্তোলন আরো বেড়েছে।

কয়লা শিল্পের ইতিবাচকতা নিয়ে একমাত্র যে দোহাই দেয়া হয় তা হচ্ছে এই শিল্প লক্ষ লক্ষ মানুষের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করে থাকে। অথচ এই লক্ষ লক্ষ মানুষকে বিকল্প কর্মসংস্থানে আগ্রহী করে তুলতে কোনো পদক্ষেপই কিন্তু আসলে নেয়া হয়নি। বিশ্বের অন্যান্য অনেক কয়লা-নির্ভর অর্থনীতির দেশ যেমন  –  পোল্যান্ড এরই মধ্যে একটি ন্যায়ভিত্তিক রুপান্তরের পথ গ্রহন করেছে।

পরবর্তী জলবায়ু সম্মেলনের আয়োজনকারী দেশ হিসেবে যুক্তরাজ্যের সরকার এনার্জি ট্রানজিশন কাউন্সিল (শক্তি রুপান্তর পরিষদ) নামে একটি পরিষদ গঠন করতে যাচ্ছে। এই পরিষদের কাজ হবে জ্বালানী বা বিদ্যুত খাতে রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও প্রযুক্তিগত দিক থেকে বিশ্বে নেতৃত্ব প্রদানকারী দেশ ও সংস্থাগুলোকে এক কাতারে নিয়ে আসা। পাশাপাশি এমন একটি পথে পরিচালিত করার প্রয়াস অব্যাহত রাখা যাতে করে যেসব দেশ ক্ষতিকর জ্বালানীর ব্যবহার থেকে পরিবেশবান্ধব জ্বালানী/বিদ্যুত উৎপাদনের বিষয়টি সক্রিয়ভাবে বিবেচনা করছে তারা যেন যথাযথ সহায়তা পেতে পারে।

কিন্তু লক্ষ্য করার মতো বিষয়টি হচ্ছে ভারতের নীতিনির্ধারকদের মধ্যে এই খাতে পরিবর্তন বা রুপান্তর নিয়ে দৃশ্যত কোনো আলোচনা চোখে পড়ছে না। কিছু কিছু বেসরকারী সংস্থা এনিয়ে কথা বলতে শুরু করেছে তবে সংখ্যায় তারা অত্যন্ত নগন্য এবং খুব সাম্প্রতিক কালেই তাদের এনিয়ে কথা বলতে দেখা গেছে।

বহুমাত্রিক সুশাসনে ক্ষেত্রে ব্যাপক সমস্যা

একটি বিষয় অত্যন্ত পরিস্কার যে জলবায়ু পরিবর্তন এবং এর প্রভাব নিয়ে ভারতে কোনো ধরনের সংশয় নেই। অতিতের যে কোনো সময়ের চেয়ে ঘন ঘন এবং অধিক ক্ষতিকর খরা, বন্যা, ঝড়,দাবানল, পঙ্গপালের আক্রমন ছাড়াও আরো অনেক প্রাকৃতিক ঘটনাবলী এই ধারণাকে আরো সুসংহত করেছে।

অথচ এতকিছুর পরেও দেশের পরিবেশগত নিরাপত্তা সংক্রান্ত আইনকানুনগুলোর ক্ষেত্রে ব্যাপক শিথীলতার যে পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছে তা প্রতিহত করতে সরকারের কার্যকর কোনো ভূমিকাই নেই। জি-২০ সম্মেলনে ভারতের প্রধানমন্ত্রী বলেছিলেন, আমরা একটি সার্কুলার অর্থনীতি গড়ার কাজ করছি (সার্কুলার অর্থনীতি হচ্ছে এমন একটি অর্থনৈতিক অবস্থা যেখানে বর্জ্য উৎপাদন শুণ্যের কোঠায় নামিয়ে এনে সম্পদের বহুব্যবহার অনুশীলন করা হয়)। অথচ পরিতাপের বিষয় হচ্ছে সরকার দেশের এক সময়কার সংরক্ষিত বনাঞ্চলে খননের মাধ্যমে তেল ও কয়লা উত্তোলনকে অনুমোদন দিচ্ছে! কোভিড-পরবর্তী অর্থনীতি পুনরুদ্ধারের তাড়াহুড়োয় সরকার অতীতের যে কোনো সময়ের চেয়ে পরিবেশবান্ধব ব্যবস্থাপনাগুলোকে একপ্রকার অবহেলা করছে।

জলবায়ু পরিবর্তনের এই সময় এমন দূর্বল ব্যবস্থাপনার সার্বিক প্রভাব আরো মারাত্বক ফল বয়ে আনছে। । প্রশমন পদক্ষেপ হিসেবে গ্রিন হাউজ গ্যাস বা জিএইচজি নির্গমন মাত্রা কমিয়ে এনে ভারত হয়ত প্যারিস প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়নে নিজেদের কার্যক্রমকে সঠিক পথে পরিচালিত করছে বলে প্রমান করতে পারবে, কিন্তু প্রাকৃতিক সম্পদের অব্যবস্থাপনার কারনে ভারতীয় জনগণের অবশ্যই জলবায়ু পরিবর্তনের ক্ষতিকর প্রভাব কাটিয়ে উঠতে সহনশীলতা (রেজিলিয়েন্স) অর্জনের সক্ষমতা বৃদ্ধির হার অবশ্যই হ্রাস পাবে বা বাঁধাগ্রস্থ্য হবে। একারনে অভিযোজনের মূল্য দিতে হচ্ছে বহুগুন,  আর তাই ক্ষয়ক্ষতি বেড়ে গিয়ে দিন শেষে ভারত অভাবনীয়ভাবে ভূগতে শুরু করেছে।

দূর্বল ব্যবস্থাপনার পরিণতি কী হতে পারে তা সংশ্লিষ্ট সকলের কাছেই পরিস্কার। গত বছর অনুষ্ঠিত জলবায়ু পরিবর্তন বিষয়ক আন্ত:রাষ্ট্রীয় প্যানেলের (ইন্টার গর্ভণমেন্টাল প্যানেল অন ক্লাইমেট চেঞ্জ) বৈঠকে ভূমি অবক্ষয়ের সাথে জলবায়ু পরিবর্তনের সম্পর্ক শীর্ষক এক বিশেষ প্রতিবেদন প্রকাশের মধ্য দিয়ে দূর্বল ব্যবস্থাপনাসৃষ্ট ক্ষতিকর প্রভাবের বিষয়গুলোর পুনরাবৃত্তি করা হয়।

উল্লেখিত প্রতিবেদনটির প্রকাশের পরেই মরুকরণ প্রতিরোধ সংক্রান্ত জাতিসংঘ কনভেনশনের (ইউএন কনভেনশন টু কমব্যাট ডেজার্টিফিকেশন) সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। সম্মেলনের আয়োজন ও সভাপতিত্ব করে ভারত। ওই সম্মেলনের মূল উপসংহারই ছিল জলবায়ু পরিবর্তনের সাথে লড়াইয়ে টিকতে হলে অবশ্যই ভূমি সুরক্ষা করতে হবে। ভারত কিন্তু ঠিক তার উল্টোপথেই হাঁটছে।

জলবায়ু শীর্ষ সম্মলনের পরিবর্তে

কোভিড-১৯ এর কারনে জাতিসংঘের জলবায়ু শীর্ষ সম্মেলন স্থগিত হওয়ায় সাম্প্রতিক সময়ে একটি ভার্চুয়াল জলবায়ু সংলাপ অনুষ্ঠিত হয়। যেটি দিয়ে ১২ ডিসেম্বরে অর্থাৎ প্যারিস চুক্তির বার্ষিকীতে একটি জলবায়ু লক্ষ্যমাত্রা সম্মেলন (ক্লাইমেট অ্যাম্বিশন সামিট) পর্যন্ত এগিয়ে যায়।

উক্ত সম্মেলনে বক্তারা একটি বিষয় বেশ জোরালো ভাবে তুলে ধরেন। আর তা হচ্ছে বিশ্বের সকল দেশের সরকার অতিদ্রুত জোর পদক্ষেপ নিতে ব্যর্থ হলে জলবায়ু পরিবর্তনের ভয়াবহ প্রভাব কেবল বাড়তেই থাকবে। একই সভায় ইউএনএফসিসির সভাপতিত্বে একটি সেশনে বিজ্ঞানীরা হুশিয়ারী উচ্চারণ করে বলেন, প্যারিস চুক্তিতে সই করা দেশগুলো নির্গমনের যে লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছিল প্রকৃতপক্ষে সেই সব দেশেই নির্গমনের মাত্রা চুক্তিতে সম্মত লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে বহুগুন বেশি। এ মুহুর্তে সংশ্লিষ্ট সকল দেশগুলোকে এই ঘাটতি পূরনে জোর পদক্ষেপ গ্রহন করতে হবে এবং সেই সাথে নিজেদের প্রতিশ্রুতিগুলো আরো শক্তিশালী করতে হবে। বর্তমানে নির্গমন হ্রাসে দেশগুলো যে প্রতিশ্রুতি দিয়েছে তাতে প্রাক-শিল্প সময়ে বিশ্বের তাপমাত্রা বৃদ্ধি পেয়ে ২.৭ থেকে ৩.৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস পর্যন্ত পৌঁছতে পারে। অথচ পৃথিবী এরই মধ্যে ১.২ ডিগ্রি বেশি উত্তপ্ত।

 অনুবাদআরিক গিফার