সম্প্রতি এক গবেষণা প্রতিবেদনে এই আশংকার কথা বলা হয়। এতে বলা হয় জলবায়ু পরিবর্তনের কারনে সৃষ্ট একের পর এক প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারনে দক্ষিণ এশিয়ার সবগুলো দেশেই লাখ লাখ মানুষকে বাস্তুচ্যুত হতে হচ্ছে কিংবা দুর্যোগের হাত থেকে বাঁচতে বসতবাড়ি ছেড়ে অন্যত্র অভিবাসনে বাধ্য হচ্ছে। বলা হচ্ছে বৈশি^ক উঞ্চতা বৃদ্ধির কারনে সৃষ্ট ঘনঘন প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবেলায় এখানকার দেশগুলো অনতিবিলম্বে শক্তিশালী ও কার্যকর পদক্ষেপ নিতে ব্যর্থ হলে আগামী ৩০ বছরের মধ্যে এখানে জলবায়ু শরণার্থীর সংখ্যা বর্তমান সময়ের চেয়ে তিন গুন বৃদ্ধি পেতে পারে।
কষ্ট অব ক্লাইমেট ইনঅ্যাকশন: ডিসপ্লেসমেন্ট অ্যান্ড ডিস্ট্রেস মাইগ্রেশন (জলবায়ু নিষ্ক্রিয়তার ব্যয়: স্থানচ্যুতি ও দুর্যোগ অভিবাসন) শীর্ষক ওই প্রতিবেদনের তথ্য মতে, আগামী ২০৫০ সালের মধ্যে জলবায়ু পরিবর্তনসৃষ্ট প্রাকৃতিক দুর্যোগের প্রভাবে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোতে ৬২.৯ মিলিয়ন মানুষ বলপূর্বক অভিবাসনের শিকার হয়ে বাস্তুচ্যুত হতে বাধ্য হবে। ঝুঁকির মধ্যে থাকা এই বিপুল পরিমান জনসংখ্যা (৬২.৯ মিলিয়ন) ইউরোপের ইতালির মতো একটি দেশের মোট জনসংখ্যার চেয়েও অনেক বেশি।
প্রতিবেদনটি আজ ১৮ ডিসেম্বর, জাতিসংঘ ঘোষিত আন্তর্জাতিক অভিবাসন দিবসকে সামনে রেখে প্রকাশ করা হয়।
ব্রায়ন জোনস, , সহকারী অধ্যাপক, সিটি ইউনিভার্সিটি অব নিউইয়র্কের বারুক কলেজ
পরিবেশগতভাবে সংবেদনশীল জীবিকায়ন, জনসংখ্যা বৃদ্ধি এবং ক্রমবর্ধমান নগরায়নের ফলে দক্ষিণ এশিয়া পৃথিবীর মধ্যে জলবায়ুসৃষ্ট অভিবাসনের ক্ষেত্রে সর্বাধিক সক্রিয় অঞ্চল হিসাবে পরিণত হবে।
প্রতিবেদনটিতে বলা হয়, ২০১৫ প্যারিস জলবায়ু চুক্তি অনুসারে বৈশ্বিক উষ্ণায়নকে ২ ডিগ্রি সেলসিয়াসের নীচে সীমাবদ্ধ রাখার সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নে ব্যর্থ হওয়ায় কেবল ২০২০ সালেই দক্ষিণ এশিয়ার প্রায় ১৮ মিলিয়ন মানুষ নানা প্রাকৃতিক দুর্যোগের শিকার হয়ে নিজ বসত ছাড়তে বাধ্য হয় এবং প্রকারান্তরে পরিনত হয় জলবায়ু উদ্বাস্তুতে। এই অঞ্চলে দুর্যোগ হুমকির মধ্যে থাকা জনগোষ্ঠীর একটি বিশাল অংশ বাস্তুচ্যুত হয়ে অভিবাসনে বাধ্য হওয়ার প্রবনতা বাড়তেই থাকবে। প্রতিবেদনটির একটি রক্ষণশীল বিশ্লেষনে বলা হয়েছে জোরপূর্বক বাস্তুচ্যুত মানুষের সংখ্যা অচিরেই বর্তমান সময়ের চেয়ে তিনগুন বৃদ্ধি পাবে। আর এই পরিস্থিতির পিছনে অন্যতমভাবে দায়ি হচ্ছে জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে সৃষ্ট ক্রমবর্ধমান প্রাকৃতিক দুর্যোগ যেমন – প্রবল বন্যা, খরা ও ঘুর্নিঝড়।
বেসরকারী অলাভজনক সংস্থা একশনএইড ইন্টারন্যাশনাল এবং ক্লাইমেট একশন নেটওয়ার্ক সাউথ এশিয়া (কানসা) পরিচালিত এই প্রতিবেদনটিতে বিশ^ব্যাংকের সাম্প্রতিক সময়ে পরিচালিত আরেকটি সমীক্ষার তথ্য-উপাত্ত নিয়ে নতুন করে বিশ্লেষণ করা হয়। ২০১৮ সালে প্রকাশিত গ্রাউন্ডসওয়েল: প্রিপেয়ারিং ফর ইন্টারনাল ক্লাইমেট মাইগ্রেশন শীর্ষক বিশ^ব্যাংকের ওই সমীক্ষায় বলা হয়েছিল ২০৫০ সালের মধ্যে দক্ষিণ এশিয়ার প্রায় ৪০ মিলিয়ন মানুষ জলবায়ু উদ্বাস্তুতে পরিনত হবে।
সিটি ইউনিভার্সিটি অব নিউইয়র্কের বারুক কলেজের সহকারী অধ্যাপক ব্রায়ন জোনস বলেন, পরিবেশগতভাবে সংবেদনশীল জীবিকায়ন, জনসংখ্যা বৃদ্ধি এবং ক্রমবর্ধমান নগরায়নের ফলে দক্ষিণ এশিয়া পৃথিবীর মধ্যে জলবায়ুসৃষ্ট অভিবাসনের ক্ষেত্রে সর্বাধিক সক্রিয় অঞ্চল হিসাবে পরিণত হবে। এছাড়াও উপমহাদেশের এই দেশগুলোতে গুরুত্বপূর্ণ শহর ও বৃহৎ নগরকেন্দ্রগুলো গড়ে উঠেছে জলবায়ু পরিবর্তনের ক্ষতির আশংকায় থাকা উপকূলীয় অঞ্চলগুলোতে। এটি বেশ আশংকার কথা। এসব এলাকায় তাই অভিবাসীদের আগমনের হার বাড়তেই থাকবে। এক্ষেত্রে সম্ভাব্য জলবায়ু অভিবাসীদের বিষয়টিকে মাথায় রেখে অবিলম্বে নীতিনির্ধারকদের উচিত উপযুক্ত ব্যবস্থা গ্রহন করা।
২০১৮ সালে প্রকাশিত বিশ্বব্যাংকের গ্রাউন্ডসওয়েল প্রতিবেদনের অন্যতম একজন সহ-লেখক ছিলেন ব্রায়ান জোনস। আজ প্রকাশিত একশনএইড ইন্টারন্যাশনাল ও কানসা’র এই গবেষণাটিও তিনি পরিচালনা করেন। গবেষণায় বিশেষভাবে উল্লেখ করা হয় জলবায়ু পরিবর্তন প্রত্যক্ষভাবে মানুষকে বাস্তুচ্যুত হতে বাধ্য করে কিংবা এর প্রভাবে সবচেয়ে পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠী জীবন-জীবিকার ক্ষেত্রে এতটাই নিদারুণ সংকটে পতিত হয় যার ফলে তাদেও অবধারিতভাবেই বাস্তুচ্যুত হয়ে অভিবাসীর ভাগ্য বরণ করতে হয়।
ধীরগতির দীর্ঘমেয়াদী প্রভাব
বাংলাদেশ, ভারত, শ্রীলংকা, নেপাল এবং পাকিস্তানে জলবায়ু পরিবর্তনের কারনে সৃষ্ট ধীর গতির দীর্ঘমেয়াদী যে প্রভাব লক্ষ্য করা যায় তার মধ্যে অন্যতম হচ্ছে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি, ফষল ফলন হ্রাস, বাস্তুতন্ত্র ও জীববৈচিত্র্যের ক্ষতি এবং খরা। প্রকাশিত গবেষণায় বলা হয়েছে এই দেশগুলো প্যারিস চুক্তির সময় জলবায়ু সংকট মোকাবেলায় যেসব কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহনে প্রতিশ্রুতি প্রদান করেছিল তা পালনে যথাযথ পদক্ষেপ নিতে ব্যর্থ হলে আগামী ২০৩০ সালের মধ্যে দেশগুলোতে বছরপ্রতি অভিবাসীর সংখ্যা ৩৭.৪ মিলিয়ন ছাড়িয়ে যেতে পারে। ২০৫০ সালের মধ্যে এই সংখ্যা বছর প্রতি ৬২.৯ মিলিয়নে গিয়ে পর্যন্ত পৌছতে পারে বলে মনে করা হচ্ছে। বর্তমানে ১৯৫টি দেশের সরকার প্রদত্ত প্রতিশ্রুতি অনুযায়ি বিশ^ব্যাপী গড় তাপমাত্রা ৩.২ ডিগ্রি সেলসিয়াস বৃদ্ধি পাবে যা কিনা প্রতিশ্রুত দুই ডিগ্রি মাত্রার চেয়ে অনেক বেশি।
সদ্য প্রকাশিত গবেষণা দেখানো হয়েছে যে সরকারগুলো খুব সহজেই জলবায়ু অভিবাসীর সংখ্যা ২০৩০ সালের মধ্যে ২২.৫ মিলিয়ন এবং ২০৫০ সালের মধ্যে ৩৪.৪ মিলিয়নের নিচে নামিয়ে আনতে সক্ষম। তবে এজন্য রাষ্ট্রগুলোকে কঠোরভাবে তাপমাত্রা বৃদ্ধির ক্ষেত্রে তাদের প্রতিশ্রুত লক্ষ্যমাত্রা বাস্তবায়ন করতে হবে। জলবায়ু সংকট হ্রাসে সকারগুলো বৈশি^ক তাপমাত্রা বৃদ্ধি সর্বোচ্চ ২.২ ডিগ্রির মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছিল।
উপরে প্রদর্শিত সংখ্যার ক্ষেত্রে জলবায়ু পরিবর্তন সৃষ্ট আকষ্মিক প্রাকৃতিক দুর্যোগ যেমন বন্যা, ঘূর্ণিঝড়ের মতো ঘটনার শিকার হয়ে যারা বাস্তুচ্যুত হয়ে অভিবাসীতে পরিণত হচ্ছে তাদের বিবেচনায় আনা হয়নি। অর্থাৎ এই ধরনের ঘটনায় যারা অভিবাসী হয়ে থাকে উপরের টেবিলে প্রদর্শিত সংখ্যায় তাদের হিসেব করা হয়নি। আর এটি বলাই বাহুল্য যে এই ধরনের আকষ্মিক প্রাকৃতিক দুর্যোগ দক্ষিণ এশিয়ার এই দেশগুলোতে একেবারেই নৈমিত্তিক ঘটনা। এই বিপুল পরিমান মানুষের জলবায়ু উদ্বাস্তু হয়ে পড়ার প্রবনতা ঠেকাতে আসলে যত দ্রুত সম্ভব দেশগুলোকে তাদের নিজ নিজ প্রতিশ্রুতির বাস্তাবায়ন ও লক্ষ্যমাত্রা পূরনে কার্যকর পদক্ষেপ নেয়ার কোনো বিকল্প নেই।
২০২০ সালের অভ্যন্তরীন অভিবাসন শীর্ষক প্রতিবেদনে (গ্লোবাল রিপোর্ট অন ইন্টারনাল ডিসপ্লেসমেন্ট) এই সংকটের ক্রমর্ধমান ভয়াবহতা লক্ষ্য করা যায়। এতে বলা হয় নানা রকম প্রাকৃতিক দুর্যোগের ফলে দক্ষিণ এশিয়ায় ২০১৯ সালে ৯.৫ মিলিয়ন মানুষ নতুনভাবে ডিসপ্লেসমেন্ট বা স্থানচ্যুতির শিকার হয়েছে। ২০১২ সালের পর থেকে এই সংখ্যা সর্বোচ্চ। গত বছর মৌসুমী বৃষ্টিপাতের কারনে ভারত ও বাংলাদেশে সংগঠিত বন্যা এবং ঘূর্ণিঝড় ফানি ও বুলবুলের ফলে সবচেয়ে বেশি সংখ্যক মানুষ তাদের ঘরবাড়ি হারিয়ে নি:স্ব হয়ে উদ্বাস্তুতে পরিনত হয়েছে।
একশনএইড ইন্টারন্যাশনাল কর্তৃক প্রকাশিত ক্লাইমেট মাইগ্রেন্টস পুশড টু দ্য ব্রিংক শীর্ষক একটি পলিসি ব্রিফে (নির্দিষ্ট কোনো ইস্যুতে নীতিনির্ধারক ও অন্যান্যদের প্রভাবিত করতে সম্ভাব্য বিকল্পের সংক্ষিপ্তসার) বলা হয়েছে তৃনমূল পর্যায়ে সংকট মোকাবেলার প্রচলিত পদ্ধতিগুলো যখন ব্যর্থ হয় তখন কেবল কোনোরকমে টিকে থাকতে নিজ বাস্তুভিটা ছেড়ে অন্যত্র চলে যেতে বাধ্য হয় এবং পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে পরিবারের অন্ন সংস্থানের লক্ষ্যে বিকল্প জীবিকা গ্রহন করে।
একশনএইড এর গ্লোবাল ক্লাইমেট লিড হারজিৎ সিং বলেন, জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে ক্রমবর্ধমান প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারনে ক্ষতিগ্রস্থ্য মানুষ দিনের পর দিন একটু নিরাপদে বেঁচে থাকার আশায় নিজ এলাকা ছেড়ে নতুন কোনো এলাকায় স্থানান্তরিত হচ্ছে। এই স্থানচ্যুতির শিকার পরিবারগুলো জীবন ধারনের লক্ষ্যে নিত্যনতুন জীবিকার পহ্না গ্রহন করছে।
নতুন এই প্রতিবেদনে বিশ্বের উন্নত দেশগুলোর প্রতি বেশ কয়েকটি বিষয়ে জোরালো দাবী উপস্থাপন করা হয়েছে। এতে বলা হয়েছে উন্নত দেশগুলোকে অবশ্যই কার্বন নিগর্মন হ্রাসে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহন করতে হবে। পাশাপাশি জলবায়ু পরিবর্তনের সাথে খাইয়ে নিতে ও এর ফলে সৃষ্ট দুর্যোগের ক্ষতি কাটিয়ে উঠতে উন্নয়নশীল দেশগুলোর প্রতি অধিক সহায়তা প্রদানে উন্নত দেশগুলোকে এখনই এগিয়ে আসতে হবে। এতে আরো বেশ কয়েকটি সুপারিশের কথা তুলে ধরা হয়েছে। এসব সুপারিশের মাধ্যমে উন্নয়নশীল দেশগুলোকে সহায়তার জন্য বিশে^র উন্নত দেশগুলোকে একটি সামগ্রিক পদ্ধতি গ্রহনে আহ্বান জানানো হয়েছে। একই সাথে জলবায়ু পরিবর্তনের ক্ষতির শিকার জনগোষ্ঠিকে সুরক্ষা প্রদানে নিজ নিজ ক্ষেত্রে যাবতীয় কর্মকা- বিস্তৃত করতে উন্নয়ন দেশের সরকারের প্রতি আহ্বান জানানো হয়েছে।
কানসার পরিচালক সঞ্জয় ভাসিত বলেন, জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে বাস্তুচ্যুত অভিবাসীদের নিরাপত্তা প্রদানে দক্ষিণ এশিয়ার নেতৃবৃন্দকে অবশ্যই জোর প্রচেষ্টার মধ্য দিয়ে এই সংকট মোকাবেলায় কার্যকর পরিকল্পনা প্রনয়নে কাজ করতে হবে। একটি কার্যকর সার্বজনীন সামাজিক সুরক্ষা পদ্ধতি প্রনয়ন, বিপদাপন্ন জনগোষ্ঠীর জলবায়ু সহনশীলতা সক্ষমতা বৃদ্ধি পরিকল্পনা প্রনয়ন ও বাস্তবায়ন এবং পরিবেশবান্ধব অবকাঠামো বিনির্মানের মধ্য দিয়ে এই অঞ্চলের সরকারগুলোকে জলবায়ু সংকট মোকাবেলা ও এই সংকটের ফলে জোরপূর্বক স্থানচ্যুতির শিকার জনগণকে সহায়তা প্রদান করতে হবে। আর এজন্য এই দেশগুলোকে অবশ্যই আর্থিক বরাদ্দ বৃদ্ধির মাধ্যমে উল্লেখিত কার্যক্রমের পরিধি আরো বিস্তুৃত করতে হবে।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের থিংক ট্যাংক উইলসন সেন্টারের বক্তব্য অনুযায়ি দক্ষিণ এশিয়ার ক্রমবর্ধমান জলবায়ুসৃষ্ট অভিবাসন সংকট কেবল একটি মানবিক দুর্যোগই নয় বরং ্এর মধ্য দিয়ে আঞ্চলিক স্থিতিশীলতাও দিনকে দিন হুমকির মধ্যে পড়ছে। দক্ষিণ এশিয়ার বড় শহরগুলো এমনিতেই অত্যন্ত জনবহুল। বেঁচে থাকার জন্য যেভাবে গ্রাম ছেড়ে শহরে মানুষ আসছে তাতে অতিরিক্ত জনগনের খাদ্য, বাসস্থান ও জীবিকার চাহিদা মেটাতে এই শহরগুলোর চলমান সংকটগুলোর সাথে যুক্ত হবে আরো বাড়তি বোঁঝা।
অনুবাদ: আরিক গিফার