গঙ্গার পানি বণ্টন চুক্তিটি ১৯৯৬ সালে ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে স্বাক্ষরিত হয়। ৩০ বছর মেয়াদী এই চুক্তিটি ছিল কয়েক দশকের আলোচনার চূড়ান্ত পরিণতি, যা ভাটির প্রতিবেশী দেশ বাংলাদেশের সাথে ভারতের মধ্যে শুষ্ক মৌসুমে অর্থাৎ জানুয়ারি থেকে মে পর্যন্ত ভাগ করা পানি প্রবাহের ন্যূনতম স্তর নির্দিষ্ট করে। গঙ্গা থেকে পানি সরিয়ে এনে কলকাতার বন্দরের নাব্যতা টিকিয়ে রাখার উদ্দেশ্য ১৯৬২ সালে ভারত ফারাক্কা বাঁধের (ব্যারাজ) কাজ শুরু করে যা ১৯৭৫ সালে চালু হয়। সে সময় থেকেই হয় গঙ্গা পানি বন্টন চুক্তিটি বাংলাদেশের (তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান) একটি প্রধান দাবি ছিল।
মালিক ফিদা এ খান বাংলাদেশ সরকারের একটি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর এনভায়রনমেন্টাল অ্যান্ড জিওগ্রাফিক ইনফরমেশন সার্ভিসেস (সিইজিআইএস) এর নির্বাহী পরিচালক। তিনি নৌপরিবহন মন্ত্রনালেয়র অধীন রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান জাতীয় নদী সংরক্ষণ কমিশনের (এনআরসিসি) সদস্য এবং ভারত-বাংলাদেশের মধ্যে বন্ধুত্ব, সহযোগিতা ও শান্তি সুরক্ষায় ১৯৭২ সালের স্বাক্ষরিত ইন্দো-বাংলা চুক্তির ফলে প্রতিষ্ঠিত যৌথ নদী কমিশনের (জয়েন্ট রিভার কমিশন – জেআরসি) একজন সদস্য। ।
তিনি গঙ্গা পানি বন্টন চুক্তি নিয়ে বাংলাদেশের অভিজ্ঞতা এবং ভবিষ্যতে ভারতের সাথে পানি বিষয়ক সহযোগিতার সম্ভাবনা নিয়ে দ্য থার্ড পোলের সাথে কথা বলেন। দীর্ঘ এই সাক্ষাতকারটি স্পষ্টতার জন্য কিছুটা সম্পাদনা করা হয়েছে।
বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে স্বাক্ষরিত ৩০ বছর মেয়াদী গঙ্গা পানি বন্টন চুক্তির মেয়াদ ২০২৬ সালে শেষ হতে চলেছে। সংশ্লিষ্ট এই বিষয়ে আপনার অভিজ্ঞতার সাপেক্ষে এই চুক্তির কার্যকারীতা নিয়ে আপনার মূল্যায়ন কী?
আমি জোর দিয়ে বলতে চাই যে দুই দেশের মধ্যে স্বাক্ষরিত এই চুক্তিটি একটি মোটামুটি সফল চুক্তি কারণ এর মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ প্রথম নদীর [পানির] উপর আমাদের যে অধিকার রয়েছে তা প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হয়েছে। আমাদের বুঝতে হবে একবার অধিকার স্বীকৃত হলে, আমরা সহযোগিতা এবং পরিচালনার জন্য অন্যান্য উপায়গুলো খুঁজে পেতে পারি।
সূদীর্ঘ ৩০ বছরের তথ্যের ভিত্তিতে ১৯৯৬ সালে গঙ্গা পানি বন্টন চুক্তিটি স্বাক্ষরিত হয়েছিল। এর মাধ্যমে উভয় দেশই শুষ্ক মৌসুমে (জানুয়ারি-মে) ফারাক্কা পয়েন্টে ন্যূনতম পানির প্রবাহ নিশ্চিত করতে সম্মত হয়। কিন্তু এই চুক্তির ভিত্তি ছিল পানির ‘কোয়ান্টাম’ বা পরিমান। এখন সময় এসেছে নদী ব্যবস্থাপনার অন্যান্য দিক যেমন নদী বেঁচে থাকার জন্য প্রয়োজনীয় পানির প্রবাহ (এনভায়রনমেন্টাল ফ্লো), জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব, নৌ চলাচল, অর্থনীতি এবং সামাজিক অন্যান্য দিকগুলো বিবেচনা করার। ২৬ বছর আগে, এগুলো আসলে আমাদের আলোচনায় আসেনি, কারণ কারণ পানির ওপর অধিকার প্রতিষ্ঠাই ছিল তখন বাংলাদেশের লক্ষ্য।
সমালোচনা রয়েছে যে চুক্তি অনুযায়ি বাংলাদেশ শুষ্ক মৌসুমে যে পরিমান পানি পাওয়ার কথা তা পায় না। আপনি কী মনে করেন?
দেখুন, আমার জানা মতে, আমরা গঙ্গা পানি বন্টন চুক্তি অনুযায়ী ফারাক্কা পয়েন্ট থেকে বরাবরই পানি পেয়েছি। আপনি যদি যৌথ নদী কমিশনের ওয়েবসাইটে যান তবে আপনি এ সম্পর্কিত সব ধরনের তথ্য খুঁজে পেতে পারেন। আমরা যদি বিগত ২৪ বছরের তথ্য দেখি, আমরা দেখতে পাব যে চুক্তির সংযুক্তি – ২ অনুসারে আমাদের যে পরিমান পানি পাওয়ার কথা, আমরা বেশিরভাগ সময়েই তা পেয়েছি।
গঙ্গা পানি বন্টন চুক্তির মেয়াদ শেষ হচ্ছে ২০২৬ সালে।এরপর কী হবে?
দুটি জিনিস আমাদের বুঝতে হবে। সীমান্তের দুই পাড়েই পানির চাহিদা বাড়লেও নদীর সার্বিক পানির প্রাপ্যতা কমে গেছে। এর জন্য অনেক কারণ থাকতে পারে যেমন নদীরপানি প্রত্যাহার, বা উজানের পানির অপসারণ। একটি নদীপ্রধান ভাটির দেশ হিসাবে, আমাদের যা করতে হবে তা হল প্রাসঙ্গিক আন্তর্জাতিক আইন এবং চুক্তিগুলি আগে অধ্যয়ন করা। এই মুহুর্তে বাংলাদেশ ও ভারত উভয় দেশের জন্যই এই বিষয়গুলো নিয়ে অনেক হোমওয়ার্ক করতে হবে এবং বিশেষজ্ঞ পর্যায়ে একে অপরের সাথে গবেষণার ফলাফল বিনিময় করা জরুরি। যেমন ধরুন এই মুহুর্তে উভয় দেশই পানির ভবিষ্যতের চাহিদা নিয়ে কাজ করতে পারে। আমরা সবাই জানি যে নদীতে পানির প্রাপ্যতার চেয়ে চাহিদা অনেক বেশি। সেজন্য আমাদের সবসময় কেবল একটি ‘উইন-উইন’ পরিস্থিতির কথা বিবেচনা করলে হবে না। এই পরিস্থিতি উভয়ের জন্য না-ও হতে পারে।
চুক্তিটি শুধুমাত্র ‘পানির পরিমান’ এবং কৃষি উৎপাদনশীলতার উপর ভিত্তি করে হওয়া উচিত নয়। উভয় দেশের উচিত কীভাবে গঙ্গার যৌথ ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে লবণাক্ততার বিষয়টি মেকাবেলা করা যায় তা নিয়ে কাজ করা।
দ্বিতীয় বিষয় হলো, চুক্তির পরবর্তী পর্যায় নিয়ে পরিকল্পনা করার সময় উভয় দেশেরই নদীর পরিবেশগত প্রবাহের (এনভায়রণমেন্টাল ফ্লো) বিষয়টি বিবেচনা করা উচিত । আমাদের মনে রাখতে হবে যে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব শুধু বাংলাদেশের নদী ব্যবস্থাকেই প্রভাবিত করবে না। ভারতের হুগলি আমাদের গড়াই এবং মেঘনা নদী ব্যবস্থার পরিবেশগত প্রবাহ বিবেচনা না করলে, ভারত ও বাংলাদেশ উভয়ই আগামী দিনে চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হবে।
বাংলাদেশ থেকে আমরা আমাদের ভারতীয় বন্ধুদের বলেছি যে আমরা (বাংলাদেশ) যদি আমাদের প্রয়োজনের চেয়ে বেশি পানি পাই, তাহলে হয়তো ভবিষ্যতে আমরা তাদের দেশে যে সুন্দরবনের যে অংশ রয়েছে তা বাঁচাতে পানির প্রবাহ ভারতের দিকে নিয়ে যেতে পারি। চুক্তিটি শুধুমাত্র ‘পানির পরিমাণ’ এবং কৃষি উৎপাদনশীলতার উপর ভিত্তি করে হওয়া উচিত নয়। উভয় দেশের উচিত কীভাবে গঙ্গার যৌথ ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে লবণাক্ততার বিষয়টি মেকাবেলা করা যায় তা নিয়ে কাজ করা।
তার মানে আপনি কি বলতে চাইছেন যে প্রতিবেশী এই দুই দেশের মধ্যে এনিয়ে আরও যৌথ গবেষণা এবং কারিগরি পর্যায়ে আরও আলোচনা হওয়া উচিত?
আমরা কিন্তু কারিগরি পর্যায়ে ভারতের সঙ্গে বরাবরই আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছি। ২০১১ সালে উভয় দেশের রাষ্ট্রপ্রধানদের দ্বারা স্বাক্ষরিত সমঝোতা স্মারকের (এমওইউ) , উভয় দেশই যৌথ নদীগুলির অববাহিকা-ভিক্তিক ব্যবস্থাপনার জন্য কাজ করতে সম্মত হয়েছিল। কিন্তু আমরা এখনও অববাহিকা-ভিত্তিক ব্যবস্থাপনার জন্য একসাথে কাজ শুরু করতে পারিনি কারণ কিছু প্রাথমিক বিষয় নিয়ে এখনও কাজ চলছে।
স্বাক্ষরিত সমঝোতা স্মারকের অংশ হিসেবে, বাংলাদেশ কীভাবে পানির সর্বোত্তম ব্যবহার নিশ্চিত করতে পারে তা মূল্যায়নের জন্য উভয় দেশ একটি কারিগরি কমিটি গঠন করেছে, আমি যেটির একজন সদস্য। আমরা ইতিমধ্যেই একটি যৌথ গবেষণা করার জন্য টার্মস অব রেফারেন্সের (শর্তাবলী) প্রস্তুত করেছি। শুরুতেই আমরা আমাদের সীমান্তের নদীগুলোতে যৌথ ড্রেজিং শুরু করার কথা ভাবছি। আমরা যদি তা করতে পারি, আমি মনে করি আমরা ভাটির দিকে পানির প্রবাহ বাড়াতে পারব। বলে রাখা ভালো যে উভয় দেশই যৌথ গবেষণার পরিকল্পনা করেছে, কিন্তু কোভিড পরিস্থিতি কিছু বিলম্বের কারণ হয়েছে। আমি মনে করি পরিস্থিতির উন্নতি হয়েছে; আমরা এখন পরিকল্পনা করতে পারি।
ফারাক্কা ব্যারাজ নিয়ে আপনার মন্তব্য কী? আপনি কি মনে করেন এটা ভেঙে ফেলা উচিত?
একথা মনে রাখতে হবে যে নদীর গতিপথে আড়াআড়িভাবে যে কােনা ধরনের স্থাপনা নদী এবং এর জীববৈচিত্র্যের জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর। তবুও, আমরা নদীগুলিতে অনেক স্থাপনা নির্মানের মাধ্যমে নদীর স্বাভাবিক প্রবাহে হস্তক্ষেপ করি। ফারাক্কা বাঁধের (ব্যারাজ) নির্মানের প্রধান কারণ ছিল কলকাতা বন্দরকে নৌ চলাচলের উপযোগী রাখা এবং পশ্চিমবঙ্গের ভাঁটি অঞ্চলে লবণাক্ততার সমস্যার সমাধান। বছরের শুষ্ক মৌসুমে (জানুয়ারি-মে) কলকাতা বন্দর সচল রাখার জন্য পানি অপসরানোর জন্যও এই ব্যারাজটি নির্মান করা হয়। ভারত একটি ফিডার ক্যানেলের মাধ্যমে হুগলিতে প্রতি সেকেন্ডে ৪০,০০০ ঘনফুট পানি অপসারনের জন্য ফারাক্কা ব্যারাজ নির্মাণ করেছিল।
নদীতে এই ধরনের যেকোনো স্থাপনার জন্য অত্যন্ত শক্তিশালী ও কার্যকরী ব্যবস্থাপনা প্রয়োজন। ব্যারেজের গেটগুলি পরিচালনা করার সময় অবক্ষেপণ [ হতে পারে], সৃষ্টি হতে পারে পরিচালনাগত সমস্যা। যদি নদী ব্যবস্থায় পানির তীব্র ঘাটতি হয়, তাহলে বাংলাদেশ ও পশ্চিমবঙ্গের ভাটির জন্য পানি ছাড়ার পদ্ধতি কী হবে? যৌথ ব্যবস্থাপনার প্রয়োজনীয়তাটা এখানেই।
ব্যারেজটি ১৯৭৫ সালে চালু হয়, কিন্তু আপনি কি মনে করেন যে এর নির্মানগত পরিস্থিতি এখনও একই রয়ে গেছে? অন্য যে জিনিসটি আমাদের চিন্তা করা উচিত তা হল ব্যারাজের কর্মক্ষমতা মূল্যায়ন করা – এটি অর্থনীতি এবং বাস্তুসংস্থানে কতটা অবদান রাখছে সেটি এখন আমাদের বুঝতে হবে। আমরা এই সমস্ত প্রশ্নের সঠিক উত্তর না পেলে এই ধরনের প্রযুক্তিগত হস্তক্ষেপ নিয়ে সমালোচনা হতেই পারে। আর অন্য কথা হলো এসব বিষয়ে বুঝতে যে ধরনের গবেষণা হয়ে থাকে তার ফলাফল জনগনের সামনে তুলে ধরতে হবে। আমরা যদি এই ধরনের গবেষণা এবং মূল্যায়ন করতে পারি এবং জনগণকে এই সমস্ত জিনিসগুলি জানাতে পারি, আমি মনে করি অনেক উদ্বেগ মোকাবেলা করা হবে।
তিস্তা প্রসঙ্গে আসা যাক। আপনি কি মনে করেন বাংলাদেশ ও ভারত তিস্তা চুক্তি সই করতে সক্ষম হবে?
গঙ্গা এবং তিস্তা সংক্রান্ত বিষয়গুলো ভারতের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের সাথে সম্পর্কিত। আমাদের মনে রাখতে হবে পশ্চিমবঙ্গের তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসু গঙ্গা চুক্তিকে সমর্থন করেছিলেন, আর সেই কারণেই আমরা গঙ্গা পানি বন্টন চুক্তিটি স্বাক্ষর করতে পেরেছি। ভারতের কেন্দ্রীয় সরকার সবসময়ই এই ধরনের চুক্তি বা চুক্তির পক্ষে, তবে তাদের অবশ্যই রাজ্য সরকারের মতামতকে মূল্য দিতে হবে। পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য সরকারের ভূমিকা, বিশেষ করে রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ভূমিকা এক্ষেত্রে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। আমাদের সংলাপ এবং কারিগরি পর্যায়ের আলোচনায় তাকে অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। তিস্তা চুক্তি স্বাক্ষরের গুরুত্ব রাজ্যের মূখ্যমন্ত্রী হিসেবে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে অনুধাবন করতে হবে। এক্ষেত্রে রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে তিস্তাকে ঘিরে আলোচনায় মূখ্যমন্ত্রীর উপদেষ্টাদের যুক্ত করা দরকার।
১৯৪৭ সালে দেশ ভাগের পর নদীগুলোর ব্যবস্থাপনা বিভক্ত হয়, কিন্তু নদীর প্রাকৃতিক প্রবাহ কিন্তু একই রয়ে গেছে
উদাহরণস্বরূপ, আমরা যদি অধ্যাপক কল্যাণ রুদ্রের মতো বিশিষ্ট পানি বিশেষজ্ঞদের সাথে আলােচনায় বসতে পারি তবে এটি সত্যিই ভাল হবে। আমাদের মনে রাখতে হবে ১৯৪৭ সালে দেশ ভাগের পর নদীগুলোর ব্যবস্থাপনা বিভক্ত হয়, কিন্তু নদীর প্রাকৃতিক প্রবাহ কিন্তু একই রয়ে গেছে।
ভারতের কেন্দ্রীয় সরকারের উচিত তিস্তাসহ অন্যান্য যৌথ নদী নিয়ে দ্বিপাক্ষিক আলোচনায় পশ্চিমবঙ্গের বিশেষজ্ঞদের আমন্ত্রণ জানানো। তা না হলে কেন্দ্রীয় স্তরে পানি/নদী ব্যবস্থাপনা ঘিরে কী ঘটছে তা রাজ্য সরকার জানতে পারবে না। তিস্তা নিয়ে যৌথ নদী কমিশন স্তরে এবং দেশের সর্বোচ্চ রাজনৈতিক পর্যায়ে উভয় সরকারই চুক্তির প্রয়োজনীয়তার বিষয়ে একমত, তবে একটি ঐক্যমতে পৌঁছানোর জন্য আমাদের পশ্চিমবঙ্গকে এই প্রক্রিয়ায় সম্পৃক্ত করা অত্যন্ত জরুরী।
ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে ৫৪টি যৌথ নদী রয়েছে। তবে কেবলমাত্র একটি নদী নিয়ে চুক্তি করা গেছে। এসব যৌথ নদী ব্যবস্থাপনার জন্য বাংলাদেশের এই মুহুর্তে লক্ষ্য কী হওয়া উচিত?
এটা ভাবার কোনো অবকাশ নেই যে আমরা যে যৌথ নদী ব্যবস্থাপনা নিয়ে আমাদের মধ্যে যৌথ প্রচেষ্টা এবং সমন্বয়ের ঘাটতি রয়েছে। আমরা যখনই জেআরসি পর্যায়ে বৈঠক করি, তখন সবসময়ই ২০১১ সালের সমঝোতা স্মারকের নির্দেশাবলী মাথায় রেখে আলোচনা পরিচালিত করি। আমাদের উদ্দেশ্যই থাকে অববাহিকা-ভিত্তিক ব্যবস্থাপনা। ৫৪টি নদীর প্রতিটির জন্য চুক্তি করা বাস্তবসম্মত নয়, সেটি করতে হলে আমাদের বহু বছর অপেক্ষা করতে হবে। তাই আমরা জেআরসি-তে সিদ্ধান্ত নিয়েছি প্রাথমিকভাবে আমরা বেশকিছু নদীকে নিয়ে অববাহিকা-ভিত্তিক ব্যবস্থাপনাকে বিবেচনা করব। এর মধ্যে রয়েছে তিস্তা, মহানন্দা, দুধকুমার, ধরলা, ফেনী, মনু ও খোয়াই।
দ্বিপাক্ষিক আলোচনায় আমাদের নৌ চলাচল, পানির গুণগত মান, জলবায়ু পরিবর্তন, বন্যা ব্যবস্থাপনা এবং জলবায়ু পরিবর্তনের সাথে খাপ খাইয়ে নেয়ার প্রক্রিয়াগুলো কী হতে পারে তার উপর আমাদের মনোযোগ দেওয়ার এখনই উপযুক্ত সময়
আমাদের যৌথ গবেষণা পরিচালনা করা উচিত, তবে তা অবশ্যই পানির পরিমান বা কোয়ান্টাম কেন্দ্রীক হলে চলবে না। আমরা যদি শুধুমাত্র পানির পরিমাণের উপর লক্ষ্য রেখে আলােচনা চালিয়ে যাই তাহলে আমাদের পানি ব্যবস্থাপনার সমস্যা সমাধানের জন্য বহু বছর অপেক্ষা করতে হবে। কিন্তু যদি আমরা যৌথ নদীগুলাের অন্যান্য সুবিধাগুলি বিবেচনা করি, তাহলে আমরা অনেক বিতর্কিত সমস্যা সমাধান করতে সক্ষম হব।
দ্বিপাক্ষিক আলোচনায় আমাদের নৌ চলাচল, পানির গুণগত মান, জলবায়ু পরিবর্তন, বন্যা ব্যবস্থাপনা এবং জলবায়ু পরিবর্তনের সাথে খাপ খাইয়ে নেয়ার প্রক্রিয়াগুলো কী হতে পারে তার উপর আমাদের মনোযোগ দেওয়ার এখনই উপযুক্ত সময়। আমরা যদি শুধু শুষ্ক মৌসুমের কেবল পাঁচ মাস উজানে কতটা পানি সরানো বা প্রত্যাহার করা হয় তা নিয়ে চিন্তা করতে থাকি তাহলে কোনো ইতিবাচক সমাধানের পথে এগিয়ে যাওয়া অনেক কঠিন হবে।
আর সবশেষে বলতে চাই বেশ কিছু নদীকে নতুন করে যৌথ নদী হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে, কিন্তু সেই নদীগুলোকে তালিকাভুক্ত করা হয়নি। আমরা যদি নদীর বাস্তুতন্ত্রের উপর গুরুত্ব বিবেচনা করে কৌশলগত নদীগুলির ব্যবস্থাপনায় কাজ শুরু করতে পারি, তাহলে আমরা অববাহিকা-ভিত্তিক ব্যবস্থাপনার উদাহরণ সৃষ্টি করতে পারবো।
যেহেতু অববাহিকা-ভিত্তিক ব্যবস্থাপনার কথা এলো, আপনারা কি চীনকে আলোচনায় আনার চেষ্টা করছেন?
দেখুন, বাংলাদেশ সব সময়ই এসব বিষয়ে বহুপাক্ষিক পর্যায়ে আলোচনা করতে ইচ্ছুক। কিন্তু যখন আমরা চীনের কাছে প্রস্তাব দিয়েছিলাম যে আমাদের অববাহিকা-ভিত্তিক নদী ব্যবস্থাপনার বিষয়ে আলোচনা করতে আগ্রহী, তারা এনিয়ে বহুপাক্ষিক পর্যায়ে আলোচনায় সম্মতি দেয়নি। এখন পর্যন্ত আমরা ট্র্যাক-১ [সর্বোচ্চ আন্তঃসরকারি পর্যায়] পর্যায়ে বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করতে পারিনি। তবে ট্র্যাক – ২ [বিশেষজ্ঞ] বা ট্র্যাক – ৩ [সুশীল সমাজ] স্তরে বেশ কয়েকটি সংলাপ এবং আলোচনা করতে পেরেছি।
আমি মনে করি বহুপক্ষীয় পর্যায়ে বিশেষ করে ট্র্যাক -১ স্তরে আলোচনা করার জন্য সব পক্ষকে নিয়ে কাজ করার অনেক সুযোগ রয়েছে। একটি আঞ্চলিক সম্মেলন বা সংলাপের আয়োজন করা যেতে পারে যেখানে চীন, ভারত, বাংলাদেশ এবং নেপালের নীতিনির্ধারকদের নদী অববাহিকার বহুপাক্ষিক ব্যবস্থাপনা নিয়ে আলোচনার জন্য আমন্ত্রণ জানানো যেতে পারে।
তবে এতে প্রধান প্রতিবন্ধকতা হচ্ছে চীন ও ভারতের নীতিগত অবস্থান। তারা এ সংক্রান্ত বিষয়ে শুধু দ্বিপাক্ষিক পর্যায়ে আলোচনা করতে আগ্রহী। বাংলাদেশ ও নেপাল যে কোনো বহুপাক্ষিক পর্যায়ে অংশগ্রহণের জন্য উন্মুক্ত। এমনকি ভুটানও একটি বহুপাক্ষিক ফোরামে যেকোনো বিতর্কিত সমস্যার সমাধান করতে ইচ্ছুক।
অনুবাদ: মোর্শেদা আক্তার পরী