জার্মানিতে বিশ্বব্যাপী জলবায়ু সম্মেলনের সর্বশেষ রাউন্ডে অগ্রগতি বর্ণনা করতে গিয়ে পর্যবেক্ষকরা পুরো বিষয়টি নিয়ে ক্ষোভ জানাতে গিয়ে “কিকিং দ্য ক্যান (ইচ্ছাকৃতভাবে কর্ম সম্পাদন না করে অন্যের প্রতি দায় চাপিয়ে দেয়া), “পয়েন্টিং ফিঙ্গার্স” (আঙ্গুলের ইশারায় অভিযোগ) এবং “ডিভোর্সড ফ্রম ক্লাইমেট ইম্প্যাক্ট”-এর (জলবায়ু প্রভাব থেকে বিচ্ছেদ) মতো শব্দ ব্যবহার করেন।
বন জলবায়ু আলোচনা বিষয়টি আরো জোরদারের পথে একটি পরিবর্তন চিহ্নিত করেছে। গত বছরের কপ-২৬ জলবায়ু সম্মেলনে “প্যারিস রুলবুক”, যার দ্বারা প্যারিস চুক্তিতে নির্ধারিত ব্যবস্থাগুলি কীভাবে বাস্তবে কাজ করবে তা নির্ধারিত হয়েছিল, চূড়ান্ত হওয়ার পরে, সবার নজর এখন তা বাস্তবায়নের দিকে স্থানান্তরিত হয়েছে।
তবে গ্লাসগো বৈঠকের পর থেকে কয়েক মাসে, ইউক্রেনে রাশিয়ার আক্রমণ এবং জ্বালানি ও খাদ্য অনিরাপত্তার আশংকায় ভূ-রাজনীতি আরও জটিল আকার ধারণ করেছে। জাতিসংঘের বিদায়ী জলবায়ু প্রধান প্যাট্রিসিয়া এস্পিনোসা সম্প্রতি বলেছেন যে এই তাৎক্ষণিকভাবে সৃষ্ট সমস্যাগুলি রাজনীতিবিদদের বিভ্রান্ত করছে।
কার্বন ব্রিফকে দেয়া এক সাক্ষাতকারে তিরি বলেন, “আমি মনে করি যে এই বিষয়গুলোই জলবায়ু পরিবর্তন বিষয়ক আলোচনা থেকে আমাদের অনেক দুরে সরিয়ে নিয়ে যেতে পারে, বিশেষ করে বিষয়গুলো যদি জ্বালানি এবং খাদ্য নিরাপত্তার মতো ইস্যুগুলোর সাথে খুব বেশি যুক্ত হয়।”
জলবায়ু ক্ষতিপূরণ
বন আলোচনায় একটি প্রধান আলোচ্য বিষয় ছিল লস অ্যান্ড ড্যামেজ। এটি জলবায়ু পরিবর্তনের যে প্রভাবগুলোকে বোঝায় সেগুলাে হচ্ছে এমন জলবায়ুগত সমস্যা যার অভিযোজন অসম্ভব, চরম আবহাওয়া থেকে দ্রুত এবং ধীরগতির ক্ষয়ক্ষতি যেমন কৃষি জমির ক্ষতি এবং সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধির মতো ঘটনাগুলো। এই মুহুর্তে লস অ্যান্ড ড্যামেজের মতো বিষয়গুলো আলোচনার মূল এজেন্ডায় উঠে এসেছে কারণ জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব দিনকে দিন আরও গুরুতর হয়ে উঠেছে এবং দরিদ্র দেশগুলিকে এটি সবচেয়ে বেশি পর্যুদস্ত করে তুলেছে।
উন্নত দেশগুলি লস অ্যান্ড ড্যামেজের জন্য নির্দিষ্ট অর্থ নির্ধারণে পিছিয়ে যাবার প্রবনতা দেখাচ্ছে, তারা মূলত ঐতিহাসিকভাবে নিজেদের দায়ের কারনে “ক্ষতিপূরণ” প্রদানের আলোচনার দরজা খুলে যেতে পারে, সে ব্যাপারে বেশ উদ্বিগ্ন। জি-৭৭ জোটভূক্ত উন্নয়ণশীল দেশগুলোর সাথে চীন গ্লাসগো আলোচনা ত্যাগ করে কারণ ধনী দেশগুলো লস অ্যান্ড ড্যামেজ কাটিয়ে উঠতে প্রতিশ্রুত আর্থিক সুবিধার জন্য তাদের দাবিতে সম্মত হতে ব্যর্থ হয়েছে। তারই একটি সমঝোতা হিসাবে, “গ্লাসগো সংলাপ” স্থাপন করা হয়েছিল, যার অধীনে সমস্যাটি আলোচনা করা হবে, যেটি বন থেকে শুরু হয়।
কিন্তু উন্নত দেশগুলো “উদোর পিন্ডি বুধোর ঘাড়ে” চাপিয়ে দেয়ার পথে চলেছে বলে মন্তব্য করেন দাতব্য ক্রিশ্চিয়ান এইডের ক্লাইমেট জাস্টিসের প্রধান মেরি ফ্রিয়েল। লস অ্যান্ড ড্যামেজের বিষয়টি কপ-২৭ এ আসন্ন জাতিসংঘের জলবায়ু সম্মেলনের আনুষ্ঠানিক আলোচনার এজেন্ডায় যোগ করা হয়নি । এই সম্মেলন চলতি বছর নভেম্বরে মিশরের শারম আল-শেখ শহরে অনুষ্ঠিত হবে। তবে লস অ্যান্ড ড্যামেজ নিয়ে নিউজিল্যান্ড স্কটল্যান্ডের সাথে হাত মিলিয়েছে এবং এ ব্যাপারে গ্লাসগো সম্মেলনে ১.২ মিলিয়ন মার্কিন ডলার সহায়তার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। কিছু দেশ এই বিষয়ে আলােচনা চালিয়ে যেতে জলবায়ু পরিবর্তন সংক্রান্ত আন্তঃসরকারি প্যানেলের (আইপিসিসি) বিজ্ঞানীদের একটি প্রতিবেদন লেখার জন্য আহ্বান জানিয়েছে।
প্রশমন উচ্চাকাঙ্ক্ষা
“প্রশমন কার্যক্রম” নামে আলোচনার একটি নতুন ধারা বনে শুরু হয়েছে। আলোচনায় থাকা দেশগুলো কপ২৬ -এ প্রোগ্রামটি শুরু করতে সম্মত হয়েছে, বর্তমান প্রশমন পরিকল্পনার উচ্চাকাঙ্ক্ষা এবং গ্লাসগোতে করা প্রতিশ্রুতিগুলিকে জরুরীভাবে বৃদ্ধি করার প্রয়োজনীয়তার প্রতিফলন করার জন্য, যা বিশ্বব্যাপী গড় তাপমাত্রা বৃদ্ধিকে ২.৪ সেন্টিগ্রেডের কাছাকাছি ঠেলে দেওয়ার জন্য অনুমান করা হয়েছে যেটি ২০১৫ সালে প্যারিসে সম্মত হয়েছিল।
বনে এনিয়ে আলোচনা বেশিদূর এগোয়নি, কারণ এ সংক্রান্ত বিবাদের বেশ বড় বড় কিছু বিষয় এখন যুক্ত হয়েছে। এতে যে ভাষা ব্যবহার করা হয়েছে তাতে “প্রধান নির্গমানকার্র” শব্দটি অন্তর্ভুক্ত ছিল, যা চীনের মতো দেশগুলোর ক্ষেত্রে ব্যবহারের জন্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র জোর দাবী করছে। তবে চীন, ভারত এবং সৌদি আরবের এর তীব্র বিরোধিতা করছে কারণ তাদের মতে জলবায়ু পরিবর্তনের জন্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের দায় ঐতিহাসিকভাবে অনেক বেশি।
মূল জিনিস যা আমরা দেখছি না তা হল একটি বোধ যে একটি সহযোগিতামূলক পদ্ধতির প্রয়োজন
টম ইভান্স, E3G এর গবেষক
এছাড়াও এবারের কর্মসূচিতে আরেকটি বিভক্তি বেশ তাৎপর্যপূর্ণভাবে উঠে এসেছে। কেউ কেউ এই ধারণাটির সাথে সহমত প্রকাশ করে যে এটি ২০৩০ সাল পর্যন্ত চলিয়ে নেয়া যেতে পারে, আবার চীনসহ অনেক দেশ মনে করছে যে এটি কেবল এক বছরের জন্য স্থায়ী হতে পারে। তবে অ্যালায়েন্স অব স্মল আইল্যান্ড স্টেটস (এওএসআইএস), এটিকে কোনো নির্দিষ্ট সময়ের বিধিনিষেধের মধ্যে আটকে না রেখে অনির্দিষ্ট রাখার প্রতি আহ্বান জানায় কারন তাদের মতে প্রতিশ্রুতি এবং কর্মের মধ্যে এতদিনে বিশাল ব্যবধান সৃষ্টি হয়।
দেশগুলি অর্থনীতির পৃথক সেক্টরগুলির নির্দিষ্ট জলবায়ু লক্ষ্যমাত্রা থাকা উচিত কিনা তাও আলোচনা করেছে, একটি ধারণা ইইউ দ্বারা সমর্থিত। কিন্তু ভারতসহ উন্নয়নশীল দেশগুলো এর বিরোধিতা করেছে। থিঙ্কট্যাঙ্ক ইথ্রিজি – এর গবেষক টম ইভান্স বলেন, এই মতবিরোধ ছিল যে প্রোগ্রামের আলোচনা থেকে সৃষ্ট চূড়ান্ত পাঠ্যটি কপ২৭ -এ আলোচনার জন্য এগিয়ে নেওয়া যেতে পারে না।
আলোচনায় একটি বিশেষ বিষয় পাশ কাটিয়ে গেছে বলে সংবাদ সম্মলনে উল্লেখ করেন ইভান্স। “এটি কেমন হওয়া উচিত, তার গুণাবলী এবং ডিজাইনের সুবিধা এবং অসুবিধাগুলি নিয়ে দীর্ঘ আলোচনা-সমালোচনা করা যেতে পারে। মূল জিনিস যা আমরা দেখছি না তা হল একটি বোধ যে একটি সহযোগিতামূলক পদ্ধতির প্রয়োজন। কে কি করবে তা নিয়ে তর্ক বাদ দিতে হবে।”
তিনি আরো বলেন, জলবায়ু সংকটের সমাধান হবে না যদি প্রক্রিয়াটি “শুধু একে অপরের দিকে আঙুল তোলার জন্য” ব্যবহার করা হয়।”
রাজনৈতিক গতি
বন সম্মলনের অন্যান্য প্রযুক্তিগত আলোচনাগুলোর মধ্যে আরেকটি বিষয় ছিল “গ্লোবাল স্টকটেক” যার অধীনে দেশগুলি প্যারিসে সম্মত হওয়া তাপমাত্রা বৃদ্ধির মধ্যে রাখতে সমষ্টিগতভাবে পর্যাপ্ত পদক্ষেপ নিচ্ছে কিনা তা মূল্যায়ন করবে। স্টকটেকের ফলাফল ২০১৫ সালে পরবর্তী এই জাতীয় জলবায়ু পরিকল্পনাগুলির আপডেটসহ জাতীয়ভাবে নির্ধারিত অবদানের (NDCs) পরবর্তী রাউন্ডকে অবহিত করবে।
আলোচনায় থাকা দেশগুলি ২০২৫ সালের পরে কতটা জলবায়ু অর্থ প্রদান করা উচিত তা নিয়েও আলোচনা করেছে, দীর্ঘস্থায়ী ১০০ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের বার্ষিক জলবায়ু অর্থায়ন লক্ষ্য অনুসরণ করে – যা এখনও পূরণ করা হয়নি। ২০২৫ সালের মধ্যে অভিযোজন অর্থায়ন দ্বিগুণ করার জন্য উন্নত দেশগুলির কপ২৬ প্রতিশ্রুতি অনুসরণ করে অভিযোজনের জন্য অর্থও এই সম্মেলনের আলোচনার একটি বিষয় ছিল।
অভিযোজন সংক্রান্ত বৈশ্বিক লক্ষ্যমাত্রা যেটি ব্যাপকভাবে জলবায়ু প্রভাবের সাথে খাপ খাইয়ে নেয়ার জন্য দেশগুলির সক্ষমতা বাড়ানোর লক্ষ্য রাখে, প্যারিস চুক্তিতে অন্তর্ভুক্ত হওয়ার সাত বছর পরেও এটি অনির্ধারিতই রয়ে গেছে। এটি কপ২৭-এ আনুষ্ঠানিক আলোচনার জন্য এগিয়ে নেওয়া হবে।
ইথ্রিজি-এর জলবায়ু কূটনীতি এবং ভূ-রাজনীতি প্রোগ্রামের প্রধান অ্যালেক্স স্কটের মতে, মিশরের শীর্ষ সম্মেলন শুরু হতে মাত্র চার মাসেরও বেশি সময় বাকি থাকতে বন আলোচনার মূল বিষয় “জলবায়ুর প্রভাব থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে” যার প্রভাব এরইমধ্যে আমাদের আঘাত করছে। “
গ্লাসগোতে যে ফ্রেমওয়ার্কগুলোতে দেশগুলো সম্মত হয়েছিল সেগুলোকে রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গির বাস্তবে পরিণত করা যেমন অভিযোজন এবং লস অ্যান্ড ড্যামেজের বিষয়ে, বন সম্মেলনে কোনো অগ্রগতি হয়নি। সব মিলিয়ে এটি দেখতে “প্রায় ফাঁকা পৃষ্ঠার” মতোই মনে হচ্ছে বলে তিনি মত দেন।
লস অ্যান্ড ড্যামেজের সমাধানের আহ্বান জানানোর দাবী কেবল বাড়ছেডেভিড ওয়াসকো , ওয়ার্ল্ড রিসোর্সেস ইন্সটিটিউট
“মনে হচ্ছে আলোচনাকারীরা এখানে রাজনৈতিকভাবে ইতিবাচক সিদ্ধান্ত ছাড়াই এখানে এসেছেন সামনের পথগুলি কী হওয়া দরকার তা নিয়ে কাজ করতে এবং আমরা কীভাবে সেই রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি দ্রুত উপলব্ধি করতে যাচ্ছি তার একটি বাস্তব বোধের সাথে আমরা কপ২৭ এ পৌঁছেছি তা নিশ্চিত করতে”, স্কট বলেন।
তিনি যোগ করেন, কপ২৭ এর সভাপতি মিশরের সামনে জলবায়ু নিয়ে আলোচনার জন্য “বিশাল এজেন্ডা” থাকছে তবে এই এজেন্ডা এগিয়ে নিতে অন্যান্য রাজনৈতিক নেতাদের সমর্থনের অভাব রয়েছে।
বন আলোচনা ছিল কপ২৭ এর আগে ইউএন ফ্রেমওয়ার্ক কনভেনশন অন ক্লাইমেট চেঞ্জ (UNFCCC) এর অধীনে সর্বশেষ একটি সম্মেলন। তবে এর আগে রাজনীতিবিদদের জলবায়ু নিয়ে আলোচনা করার অন্যান্য সুযোগ রয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে জার্মানিতে জি৭ শীর্ষ সম্মেলন, পিটার্সবার্গ জলবায়ু সংলাপ – যেটি কর্মকৌশল নিয়ে আলোচনা করার জন্য মন্ত্রীদের একটি বার্ষিক ফোরাম – এবং সেপ্টেম্বরে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদ৷ এটি ক্লিন এনার্জি মিনিস্ট্রিয়ালের দ্বারা অনুসরণ করা হবে, যেখানে জ্বালানি ও পরিবহন উদ্যোগের পাশাপাশি অক্টোবরে আন্তর্জাতিক মুদ্রা ফোরাম (আইএমএফ) এবং বিশ্বব্যাংকের বৈঠকগুলোতেও আলোচনা করা হবে।
ওয়ার্ল্ড রিসোর্সেস ইনস্টিটিউটের আন্তর্জাতিক জলবায়ু উদ্যোগের পরিচালক ডেভিড ওয়াসকো বলেন, কপ২৭-এর আগে রাজনৈতিক গতি বাড়ানোর জন্য এইগুলি মূল সুযোগ ।
তিনি বলেন, “সম্ভবত বন আলোচনার সবচেয়ে নির্ণায়ক ফলাফল হল যে উন্নত দেশগুলি এখন বুঝতে পেরেছে যে লস অ্যান্ড ড্যামেজর সমাধানের আহ্বান জানানোর দাবী কেবল বাড়ছে এবং এই সমস্যাটির সমাধান করা মিশরে জাতিসংঘের জলবায়ু সম্মেলনের সাফল্যের একটি কেন্দ্রীয় পরিমাপ।”
তিনি আরো বলেন, “এখন নেতাদের চাপ দেওয়া হচ্ছে শিথিলতা তুলে নেওয়ার জন্য এবং আসন্ন কূটনৈতিক সমাবেশগুলিকে কপ২৭ -এর আগে প্রয়োজনীয় রাজনৈতিক গতি প্রদানে ব্যবহার করার জন্য।”
এই নিবন্ধটি প্রথম চায়না ডায়লগে প্রকাশিত হয়েছিল।