এই বছরের বর্ষা মৌসুমে পাকিস্তানে ঘটে যাওয়া বন্যার কারনে সৃষ্ট ধ্বংসযজ্ঞ সৃষ্টি হয়েছে তাতে ১,৭০০ জনেরও বেশি মৃত্যু বরণ করার পাশাপাশি কমপক্ষে ৩৩ মিলিয়নেরও বেশি মানুষ মারাত্বকভাবে ক্ষতিগ্রস্থ্য হয় এবং প্রায় ১৫ বিলিয়নের মতো মার্কিন ডলারের ক্ষতি হয়। পাকিস্তানের জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রী শেরি রেহমান এই “জলবায়ু বিপর্যয়ের” বর্ণনা করতে গিয়ে বলেনম এই বন্যা সংঘটিত হয় দক্ষিণ এশিয়ায় বয়ে যাওয়া একটি মারাত্মক তাপপ্রবাহের পরপরই, যা ছিল এই অঞ্চলের কিছু অংশে ১২২ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ তাপমাত্রা।
এই চরম আবহাওয়া ঘটনাগুলো একটি দ্রুত পরিবর্তনশীল জলবায়ুর ইঙ্গিত দেয় এবং এর সাথে খাপ খাইয়ে নেয়া এবং অভিযোজন ব্যবস্থা গড়ে তুলতে আঞ্চলিক সহযোগিতার প্রয়োজনিয়তাকেই তুলে ধরে। জলবায়ু পরিবর্তনের মানবিক ও অর্থনৈতিক ব্যয় দক্ষিণ এশিয়ায় অত্যন্ত বেশি। শুধুমাত্র বন্যার কারণে ২০৩০ সালের মধ্যে প্রতি বছর এই অঞ্চলে ২১৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলার ব্যয় হতে পারে এবং ২০৫০ সালের মধ্যে এই অঞ্চলে জলবায়ু অভিবাসীদের সংখ্যা ৪০ মিলিয়ন পর্যন্ত হতে পারে। এটি একটি বিস্ময়কর অর্থনৈতিক পরিস্থিতি এবং একটি অঞ্চলের জন্য একটি বিশাল চ্যালেঞ্জ যা এখনও মহামারীর কঠিন চ্যালেঞ্জ থেকে বেরিয়ে আসার চেষ্টা করছে এবং টেকসই এবং ন্যায়সঙ্গত প্রবৃদ্ধিতে বিনিয়োগ চালিয়ে যাচ্ছে।
আবহাওয়া এবং জলবায়ুর সংকট একটি জাতীয় সীমানায় বন্দী নয়, এবং কোনও দেশই তাদের নিজস্ব চ্যালেঞ্জের মাত্রা একা মোকাবেলা করতে পারে না
দক্ষিণ এশীয় দেশগুলোর জন্য, জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব একটি সম্মিলিত উদ্বেগের বিষয়, কারণ এখানকার দেশগুলোর রয়েছে অভিন্ন নদী, বাস্তুতন্ত্র এবং এই সবকিছুই আবহাওয়া ব্যবস্থার সাথে যুক্ত। এই উপমহাদেশে রয়েছে হিমালয়, কারাকোরাম এবং হিন্দুকুশ পর্বতমালা, যা এখানকার দেশগুলোর মধ্যে ছড়িয়ে আছে। আটটি দেশের মধ্যে পাঁচটি দেশেই সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি পাচ্ছে। আসলে আবহাওয়া এবং জলবায়ুর সংকট একটি জাতীয় সীমানায় বন্দী নয়, এবং কোনও দেশই তাদের নিজস্ব চ্যালেঞ্জের মাত্রা একা মোকাবেলা করতে পারে না।
দক্ষিণ এশিয়ার ৮০০ মিলিয়নেরও বেশি মানুষ জলবায়ু ঝুঁকিপূর্ণ হটস্পটগুলোতে বসবাস করে – যে অঞ্চলগুলি ২০৫০ সালের মধ্যে ক্রমবর্ধমান তাপমাত্রা এবং চরম আবহাওয়ার ঘটনা দ্বারা প্রভাবিত হবে, যদি তীব্র কার্বন নিঃসরণ অব্যাহত থাকে। এই অঞ্চলে আন্তঃদেশীয় সহযোগিতা জলবায়ু অভিযোজন ব্যবস্থাকে জোরদার করার জন্য প্রয়োজনীয় আর্থিক, প্রযুক্তিগত এবং মানব সম্পদের আরও দক্ষ এবং কার্যকর ব্যবহার করার পরিস্থিতিতে ত্বরান্বিত করতে পারে। এখানে কয়েকটি ক্ষেত্র রয়েছে যেখানে যৌথ প্রচেষ্টা এই ধরনের প্রভাবকে কাটিয়ে নিতে একটি অনুঘটক হিসেবে কাজ করতে পারে।
আবহাওয়া পরিষেবা এবং আগাম পূর্বাভাসের ক্ষেত্রে সম্ভাব্য সহযোগিতা
আগাম প্রস্তুতি এবং প্রশমনের মাধ্যমে ঝুঁকি হ্রাস করা এই অঞ্চলের জন্য সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ। পাশাপাশি কার্যকর আগাম সতর্কতা ব্যবস্থা স্থাপন একটি উপযুক্ত এবং আর্থিক ক্ষয়ক্ষতি হ্রাসের ক্ষেত্রে একটি সঠিক পরিমাপ হিসাবে প্রমাণিত হয়েছে। উচ্চমূল্যের আবহাওয়া, জলবায়ু এবং হাইড্রোলজিক্যাল পরিষেবাগুলি (বা হাইড্রোমেট পরিষেবাগুলি) হল কার্যকর আগাম সতর্কতা ব্যবস্থার ভিত্তি, আঘাত এবং ক্ষয়ক্ষতি কমাতে পর্যাপ্ত সময়ে কাজ করার জন্য বিপদের কারণে হুমকির মুখে থাকা ব্যক্তি ও সম্প্রদায়কে ক্ষমতায়ন করে৷ উদাহরণস্বরূপ এর মধ্যে থাকতে পারে সাগরে সম্ভাব্য বিপদ সম্পর্কে জেলেদের অবহিত করা, যাতে তারা দ্রুত তীরে ফিরে আসতে কিংবা যাত্রা পথ পরিবর্তন করার জন্য পর্যাপ্ত সময় পেতে পারে।
২০২০ সালে ভারতের ন্যাশনাল কাউন্সিল অব অ্যাপ্লায়েড ইকোনমিক রিসার্চ (এনসিএইআর) একটি সমীক্ষা প্রকাশ করে। এতে দেখা যায় জাতীয়ভাবে আবহাওয়া এবং বৃষ্টিপাত ও বন্যা সম্পর্কিত তথ্যের পরিষেবা কৃষক, গবাদি পশুর মালিক এবং জেলেদের কাছে প্রদানে ব্যয় করা প্রতি এক ডলারে বিনিয়োগে সার্বিকভাবে ৫০ মার্কিন ডলার পর্যন্ত অর্থনৈতিক সুবিধা পা ওয়া যেতে পারে।
কিন্তু দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলো আর্থিক, প্রযুক্তিগত এবং মানবসম্পদের চরম সীমাবদ্ধতার মধ্যে থাকে। আর এক্ষেত্রই উন্নত আবহাওয়া এবং জলবায়ু পরিষেবা বাস্তবায়নে সহযোগিতার দ্বার উন্মোচন করা যেতে পারে, যেমন: সক্ষমতা বৃদ্ধি করতে এখানকার দেশগুলে ডেটা বা তথ্য এবং বৈজ্ঞানিক জ্ঞান এবং দক্ষতা একে অন্যের সাথে বিনিময় করতে পারে। হাইড্রোমেট তথ্যের পরিকাঠামো নির্মানে যৌথ অর্থায়নের দিকে অগ্রসর হওয়ারও সুযোগ রয়েছে যা একে অন্যের সাথে ভাগাভাগি করে নিতে পারবে।
সাউথ এশিয়া হাইড্রোমেট ফোরামের মাধ্যমে এরইমধ্যে কিছু সহযোগিতা বিনিময়ের কাজ চলছে। ২০১৮ সালে বিশ্বব্যাংক সহায়তায় এই আঞ্চলিক উদ্যোগটি দক্ষিণ এশিয়ার আটটি দেশ এবং মিয়ানমার থেকে নয়টি পানিবিদ্যুৎ ও আবহাওয়া সংস্থাকে একত্রিত করে। ২০১৯ সালে এই ফোরামটি দক্ষিণ এশিয়ায় হাইড্রোমেট পরিষেবার আধুনিকীকরণ, তথ্য ভাগাভাগি এবং সক্ষমতা তৈরি এবং এই অঞ্চলকে বৈশ্বিক মানদণ্ডের সাথে সারিবদ্ধ করার জন্য প্রযুক্তিগত সহায়তা প্রদানে একটি আঞ্চলিক কৌশলে সম্মত হয়। এর মধ্য দিয়ে একটি জলবায়ু সহনশীল দক্ষিণ এশিয়া বিনির্মানের ক্ষেত্রে সহযোগিতার দ্বার উন্মোচিত হয়।
তথ্য বিনিময় এবং উপকূলীয় অভিযোজন ব্যবস্থার শক্তিশালীকরণ
দক্ষিণ এশীয়ার প্রধান শহরগুলো প্রায় ৮০% বন্যার সংস্পর্শে এসেছে কারণ এখানে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি পাচ্ছে, ফলে নিচু, ঘনবসতিপূর্ণ উপকূলীয় এলাকায় ঝুঁকি বাড়ছে প্রতিনিয়ত। ঘূর্ণিঝড় আশ্রয়কেন্দ্র, বাঁধ এবং বন্যা নিয়ন্ত্রণ কাঠামোর মতো গুরুত্বপূর্ণ প্রতিরক্ষামূলক অবকাঠামোতে বিনিয়োগ করে উপকূলীয় অভিযোজন ব্যবস্থার উন্নয়নের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ বিশ্বব্যাপী একটি রোল মডেল হয়ে উঠেছে। উপকূলীয় এলাকায় অভিযোজন ব্যবস্থার উন্নয়নের ফলে বাংলাদেশ ১৯৭১ সাল থেকে উপকূলীয় অঞ্চলে ঘূর্ণিঝড় ও বন্যায় মৃত্যু ১০০ ভাগ কমিয়ে আনতে সক্ষম হয়েছে।
বাংলাদেশের এই সাফল্য থেকে আশেপাশের অন্যান্য দেশের অনেক কিছু শেখার আছে।
দ্বিপক্ষীয় ক্ষেত্রে ভারত এবং বাংলাদেশে রয়েছে বিশ্বের সবচেয়ে বড় ম্যানগ্রোভ বনাঞ্চল। দুই দেশের মধ্যে প্রসারিত এই সুন্দরবনের বাস্তুতন্ত্র রক্ষার জন্য সহযোগিতা জোরদার করা যেতে পারে। এটি ঘূর্ণিঝড় এবং অন্যান্য ঝড়ের প্রভাব কমিয় আনতে একটি প্রাকৃতিক উপকূলীয় সুরক্ষা জোন হিসাবে কাজ করে। ২০১১ সালে একটি যৌথ ওয়ার্কিং গ্রুপ, উভয় সরকারের প্রতিনিধিত্বসহ একটি সমঝোতা স্মারক (এমওইউ) স্বাক্ষর করে যা এখানকার সমৃদ্ধ জীববৈচিত্র্যকে সুরক্ষা এবং সংরক্ষণের জন্য জরুরি প্রয়োজনের একটি রূপরেখা। এই সমঝোতা স্মারকটি সঠিকভাবে বাস্তবায়নের মাধ্যমে ম্যানগ্রোভ পুনরুদ্ধার, জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ এবং এলাকার ঝুঁকিপূর্ণ জনগোষ্ঠীর জীবন ও জীবিকা রক্ষা করা উচিত।
প্রয়োজন উদ্ভাবনী প্রযুক্তিকে প্রাতিষ্ঠানিক রুপ দেয়া
উদ্ভাবন এবং প্রযুক্তি আন্তঃসীমান্ত সহযোগিতার আরেকটি মাধ্যম। দক্ষিণ এশীয় দেশগুলো জলবায়ু অভিযোজনকে সমর্থন করে এমন সফল প্রযুক্তি ভাগাভাগি এবং উন্নতকরনের সময় উদ্ভাবন এখানকার জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবকে মোকাবেলার ক্ষেত্রে উৎসাহিত করতে পারে৷ বিশ্বব্যাংক-সমর্থিত কর্মসূচি প্রোগ্রাম টেক ইমার্জ এবং ক্লাইমেট ইনোভেশন চ্যালেঞ্জ জাতীয়, আঞ্চলিক এবং জেলা-স্তরের দুর্যোগ ঝুঁকি ব্যবস্থাপনায় যুক্ত সংস্থাগুলোকে বিশ্বব্যাপী উদ্ভাবকদের সাথে সংযোগ স্থাপন করতে সহায়তা করে যাতে সহজলভ্য এবং সাশ্রয়ী প্রযুক্তি চালু করা যায় যা দুর্যোগ এবং জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবগুলির জন্য আরও ভাল প্রস্তুতি এবং প্রতিক্রিয়া জানাতে সাহায্য করতে পারে। এক্ষেত্রে যেসব পাইলট প্রকল্পগুলো সফল হবে সেগুলো এক দেশ থেকে অন্য দেশে প্রযুক্তি স্থানান্তর করা যেতে পারে। এরই মধ্যে এই ধরনের বাস্তবায়িত কিছু প্রকল্পের মধ্যে রয়েছে । যেমন ভারতের উত্তরাখণ্ড রাজ্যের গ্রামগুলিতে এখন স্থানীয় ওয়াই-ফাই রেডিও চালু করা হয়েছে যা দুর্যোগপূর্ণ আবহা ওয়ার তথ্য প্রচার করে। অন্যদিকে মোবাইল-ভিত্তিক অ্যাপ্লিকেশনের মাধ্যমে মালদ্বীপে উপকূলীয় ক্ষয় এবং বন্যার তথ্য সংগ্রহ করে। আবার ভারতে দুর্যোগ প্রস্তুতিতে সহায়তা করার জন্য নজরদারি এবং ম্যাপিংয়ের জন্য ব্যবহার করা হচ্ছে ড্রোন প্রযুক্তি।
দক্ষিণ এশিয়ায় জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব ও দুর্যোগ মোকাবিলায় অবশ্য এখন সহযোগিতার কিছুটা পরিবেশ দেখা যাচ্ছে। তবে রাজনৈতিক ও জাতীয় বিবেচনা এক্ষেত্রে এখনও একটি ব্যাপক কর্মপরিকল্পনার পথে বাধা হয়ে দাড়াচ্ছে। দক্ষিণ এশীয় দেশগুলিকে জলবায়ু ঝুঁকি এবং জলবায়ু সহযোগিতার সুবিধাগুলোর বিষয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণের প্রক্রিয়ায়, কৌশল প্রণয়নের চেয়ে বাজেট তৈরির বিষয়ে মনোনিবেশ করা উচিত। পারস্পরিক সহযোগিতার পথে উন্নয়ন লাভ অত্যন্ত অপরিসীম, এবং চরম জলবায়ু ঘটনা এবং বড় দীর্ঘমেয়াদী ঝুঁকির মুখে অভিযোজনের জন্য প্রযুক্তি অনুসন্ধানের প্রক্রিয়া জাতীয় সীমান্তে আবদ্ধ থাকা উচিত নয়।
এই নিবন্ধটি বিশ্বব্যাংক, ICIMOD এবং মধ্যে একটি সহযোগী সম্পাদকীয় সিরিজের অংশ যা দক্ষিণ এশিয়ায় জলবায়ু অভিযোজনের জন্য আঞ্চলিক সহযোগিতা” বিষয়ে জলবায়ু বিশেষজ্ঞ এবং আঞ্চলিক বক্তব্যকে সমন্বয় করে থাকে। লেখকদের মতামত একান্তই তাদের নিজস্ব। এই সিরিজটি যুক্তরাজ্যের ফরেন, কমনওয়েলথ এবং ডেভেলপমেন্ট অফিসের মাধ্যমে অর্থায়ন করা হয়েছে যা বিশ্বব্যাংকের প্রোগ্রাম ফর এশিয়া রেজিলিয়েন্স টু ক্লাইমেট চেঞ্জ দ্বারা পরিচালিত একটি ট্রাস্ট ফান্ড।