জলবায়ু

দাবানল কীভাবে হিমালয়ে আকস্মিক বন্যা পরিস্থিতিকে আরও নাজুক করে তুলছে?

দাবানলের তীব্রতা দিন দিন বফলে দক্ষিণ এশিয়ার পার্বত্যাঞ্চলে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতির মুখোমুখি হচ্ছে সেখানকার বিস্তির্ন বনভূমিগুলো উপরিভাগের মাটি, যা এই সমগ্র অঞ্চলে আকষ্মিক বন্যার মাত্রা বাড়িয়ে তুলছে
<p>ইলাষ্ট্রেশন: নিউট্রন টি/ দ্য থার্ড পোল</p>

ইলাষ্ট্রেশন: নিউট্রন টি/ দ্য থার্ড পোল

হিমালয়ে জলবায়ু পরিবর্তনের সবচেয়ে দৃশ্যমান লক্ষণগুলির মধ্যে একটি হচ্ছে দাবানল, আর অন্যটি হলো আকস্মিক বন্যা।

এই দুটি প্রাকৃতিক ঘটনার মধ্যে পারম্পরিক যে যোগসূত্র রয়েছে তা বলতে গেলে আমাদের প্রথাগত ধারনার চাইতেও অনেক বেশি। বিশেষজ্ঞরা মনে করেন গত ২০ বছরে হিমালয় পার্বত্য অঞ্চলে আকস্মিক বন্যা বৃদ্ধির পিছনে অন্যতম প্রাকৃতিক যে ঘটনাগুলো দায়ি তার মধ্যে অন্যতম হচ্ছে  দাবানল। এই দুই ধরনের প্রাকৃতিক ঘটনাগুলোর মধ্যে যে যোগসূত্র রয়েছে, বিশেষজ্ঞরা তাকে একটি ‘দুষ্ট চক্র’ হিসেবেই উল্লেখ করছেন। এই নিবন্ধটির মধ্য দিয়ে আমরা এই যোগসূত্র সম্পর্কটিকে আরো সহজভাবে ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করেছি, পাশপাশি এই ‘দৃষ্ট চক্র’টিকে মোকাবেলায় সম্ভাব্য কিছু সমাধান নিয়েও কিছুটা আলোাচনা করার চেষ্টা করা হয়েছে।

দাবানল এখন হিমালয়ের বনাঞ্চলের একটি স্বাভাবিক চিত্র 

গ্লোবাল ফরেস্ট ওয়াচের তথ্য অনুসারে, ২০০১ থেকে ২০২১ সালের মধ্যে  দাবানলে কারনে হিমালয় পার্বত্যাঞ্চলের প্রায় ৩৫,০০০ হেক্টরের বেশি বনভূমিতে সবুজ গাছের আচ্ছাদন নষ্ট হয়ে গেছে। (এই পরিসংখ্যানটি মূলত নেপাল, ভুটান এবং ভারত ও পাকিস্তানে হিমালয় অঞ্চলে বনভূমিতে সৃষ্ট দাবানলের তথ্যকে উপস্থাপন করছে)। এই তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায় যে ২০১১ থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত, দাবানলের কারণে পুড়ে যাওয়া বনের ক্ষতিগ্রস্তের পরিমান আগের দশকের তুলনায় ১.৪ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে। ২০১১ থেকে ২০২০ সালের মধ্যে ক্ষতিগ্রস্ত এমন বনভূমির পরিমান ৭,৩০০,০০০ হেক্টরে বৃদ্ধি পায় যা আগের দশকে ৭,২০০,০০০ হেক্টরে সীমাবদ্ধ ছিল।

যদিও বিস্তারিত পরিসংখ্যান পাওয়া কঠিন, তবে সাম্প্রতিক বছরগুলিতে হিমালয়ের কিছু অংশে দাবানলের ঘটনা বেড়েছে বলে স্পষ্ট ইঙ্গিত রয়েছে। নেপালের কর্মকর্তারা বলছেন যদি ২০১২ থেকে তথ্য বিশ্লেষন করা হয় তাহলে দেখা যাবে যে নভেম্বর ২০২০ থেকে মার্চ ২০২১ সময়কাল ছিল দাবানলের জন্য সবচেয়ে খারাপ মৌসুম। একইভাবে, পাকিস্তানের কর্মকর্তারা বলেছেন যে গত বছর উত্তর পাকিস্তানের বিভিন্ন বনে যে পরিমাণ অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে তা আগে কখনও দেখা যায়নি।

ডিসেম্বর ২০২১ এবং মে ২০২২-এর মধ্যে বনে আগুনের সতর্কতা। হিমালয় অঞ্চলে দাবানল/আগুনের মৌসুম সাধারণত নভেম্বর থেকে জুন পর্যন্ত বিস্তৃত থাকে। এর মধ্যে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে মার্চ এবং এপ্রিল মাসে এই ধরনের ঘটনা সবচেয়ে বেশি পরিমানে ঘটে থাকে। (সূত্র: গ্লোবাল ফরেস্ট ওয়াচ)

গ্লোবাল ফরেস্ট ওয়াচের গবেষণা বিশ্লেষক জেমস ম্যাকার্থি বলেন, “আমরা বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চলের তথ্য বিশ্লেষন করে দেখেছি যে জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে উষ্ণ এবং শুষ্ক আবহাওয়া মূলত বনভূমিগুলো এই ধরনের দাবানলের প্রতি আরও ঝুঁকিপূর্ণ করে তুলে। যেহেতু পশ্চিম হিমালয়ের উচ্চতায় দাবানল বেশি বিস্তৃত হবার প্রবনতা বেশি, তাই সেই অঞ্চলে দাবানলের মাত্রা আরও ব্যাপক হতে পারে, এক্ষেত্রে প্রাপ্ত তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষন করে এই চিত্রই পাওয়া যাচ্ছে।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বনে অগ্নিকাণ্ডের অনেক ঘটনার পেছনে একটি বড় কারণ হলো জলবায়ু পরিবর্তন এবং বন ব্যবস্থাপনা।

গঙ্গা আহ্বান আন্দোলনের আহ্বায়ক হেমন্ত ধিয়ানি বলেন, [দাবানলের] সবচেয়ে বড় কারণ হল বৃষ্টিপাতের ধরণে আমূল পরিবর্তন। গঙ্হা আহ্বান আন্দোলন মূলত গঙ্গা এবং হিমালয়ে নদী রক্ষা ও সংরক্ষণের জন্য কাজ করে। তিনি ব্যাখ্যা করে বলেন, শীতকালে এখন বৃষ্টিপাত কমে গেছে। ফলে শুকিয়ে যাচ্ছে মাটি। আগে যে আগুন শুধু এক হেক্টরে ছড়িয়ে পড়ত তা এখন ৫ থেকে ১০ হেক্টর জমিতে ছড়িয়ে পড়ছে। এর অন্যতম একটি কারণ হচ্ছে মাটিতে আর্দ্রতার অভাব যার ফলে আগুন দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে।

আগে যে আগুন এক হেক্টরে ছড়িয়ে পড়ত তা এখন ৫ থেকে ১০ হেক্টর পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়ছে।
হেমন্ত ধানী, গঙ্গা আহ্বান আন্দোলন

ঘন ঘন তাপপ্রবাহও এর জন্য আংশিকভাবে দায়ী বলে মনে করেন  হিমালয় এনভায়রনমেন্টাল স্টাডিজ অ্যান্ড কনজারভেশন অর্গানাইজেশনের প্রতিষ্ঠাতা অনিল প্রকাশ জোশী। এটি একটি বেসরকারী সংস্থা যেটি হিমালয়ের কৃষকদের প্রযুক্তিগত সহায়তা প্রদান করে থাকে। তিনি বলেন, তাপপ্রবাহ যে শুধুমাত্র একটি উত্তপ্ত এবং শুষ্ক জলবায়ু পরিস্থিতি তৈরি করে তা নয়, বরং এটি দাবানলের সম্ভাবনা বাড়িয়ে দেয় এবং সবুজ গাছপালার জন্য আরও ক্ষয়ের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। এটি বলতে গেলে ‘আগুনের ঘি ঢালার মতো’ কাজ করে যার ফলে খুব দ্রুত আগুনের তীব্রতা বেড়ে তা ছড়িয়ে পড়ে আশেপাশে।

উত্তরাখণ্ডের দেরাদুনে বেসরকারী সংস্থা পিপলস সায়েন্স ইনস্টিটিউটের প্রতিষ্ঠাতা পরিচালক রবি চোপড়ার মতে, দূর্বল বন শাসন বা বন ব্যবস্থাপনা দাবানলের আরো একটি বড় কারন।

দূর্বল বন পঞ্চায়েত ব্যবস্থার কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, আজকাল স্থানীয় সম্প্রদায় বা গোষ্ঠীগুলো বন থেকে ক্রমশ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ছে। ২০ শতকের সময় থেকে ভারতে এই গ্রাম বন পরিষদগুলি তাদের নিজ নিজ গ্রামের আশেপাশের বনাঞ্চলকে নিয়ন্ত্রণে স্থানীয় সম্প্রদায়গুলোকে অন্তভূক্ত করে।  তবে গত ১০০ বছরে বেশ কয়েকটি আইনী ব্যবস্থায় বেশ কিছু পরিবর্তন এই ব্যবস্থাটিকে দুর্বল করে তুলেছে, আর বন ব্যবস্থাপনার বিষয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণের  ক্ষমতা ধীরে ধীরে বন বিভাগের কর্মকর্তাদের হাতে ন্যস্ত হয়েছে।

“বর্তমান সময়ে যখনই বনে আগুন লাগে, গ্রামবাসীরা মনে করে যে এটি নিয়ন্ত্রণে আনা কবেল সরকারেরই কাজ… তারা বনের সাথে কোনও মালিকানা বা অন্য কোনো ধরনের সম্পর্ক অনুভব করে না। গ্রামবাসীরা আগুন নেভানোর জন্য বালতি জল নিয়ে ছুটে আসার সেই পুরনো দৃশ্য এখন আর বলতে গেলে চোখেই পড়ে না,” দ্য থার্ড পোলকে বলেন রবি চোপড়া।

আরও তীব্র আর ক্ষতিকর হয়ে উঠছে আকস্মিক বন্যা

S১৯৬৮ সাল থেকে ভারতীয় হিমালয়ে ১৭টি বড় আকস্মিক বন্যার ঘটনা ঘটেছে। আন্তর্জাতিক বিপর্যয়ের তথ্যসম্ভার ইএম – ডিএটি‘র তথ্য অনুসারে ,এর মধ্যে এ ধরনের  ১৩টি বন্যার ঘটনা ২০০০ সালের পরেই ঘটেছে। ২০০০ সাল থেকে ভারতীয় হিমালয়ে আকস্মিক বন্যায় ২০০০ জনেরও বেশি মানুষ নিহত হয় এবং আর আহত হয় আরও হাজার হাজার মানুষ।

সম্প্রতি লক্ষ্য করে দেখা যাচ্ছে যে পাকিস্তানের উত্তরাঞ্চলীয় প্রদেশ খাইবার পাখতুনখাওয়া প্রায়ই বন্যার কবলে পড়ছে। ২০২২ সালে, পাকিস্তান এক দশকের মধ্যে সবচেয়ে ভয়াবহ বন্যার শিকার হয়। খাইবার পাখতুনখোয়ায় সর্বশেষ সংঘঠিত আকস্মিক বন্যায় ১৮৫ জনের মৃত্যু হয়। গত বছর রাজ্যে বন্যায় ২০ জনের মৃত্যুর ঘটনা ঘটে যেখানে ২০২০ সালের বন্যায় মাত্র ৪৬ জনের প্রানহানী ঘটে।

বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, জলবায়ু পরিবর্তন এবং দূর্বলভাবে উন্নয়ন পরিকল্পনার বাস্তবায়নের মতো এই দুটি গুরুত্বপূর্ণ কারনে হিমালয়ে আকস্মিক আকষ্মিক বন্যার ঘটনার পরিমান এবং বাড়ছে। ভারতীয় হিমালয় অংশে, যখন শীতকালীন বৃষ্টিপাতের পরিমান কমে গেলে কমে গেছে, অপরদিকে মেঘ বিস্ফোরণ (ক্লাউড বার্ষ্ট) এবং চরম বৃষ্টিপাতের ঘটনাগু অনেক ওয়াইল্ড লাইফ ট্রাস্ট অফ ইন্ডিয়ার প্রধান সমীর কুমার সিনহা।

সিনহা বলেন, “আগে এক মাসে বৃষ্টি হতো, এখন ১০ দিনে একবার বৃষ্টি হয়।”

ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অফ টেকনোলজি (IIT), দিল্লির হাইড্রোসেন্স ল্যাব দ্বারা সংকলিত একটি প্রতিবেদন যা দ্য থার্ড পোলকেও হস্তান্তর করা হয় । এতে বলা হয় ২০০১ থেকে ২০১৬ সালের মধ্যে, ভারতীয় হিমালয়ে ১৭টি মেঘ বিস্ফোরণ (ক্লাউড বার্ষ্ট) এর ঘটনা ঘটে যার ফলে ৭,০০০ টিরও বেশি মৃত্যু হয়। বিপরীতে, ১৯৭০ থেকে ২০০০ পর্যন্ত তিন দশকে মাত্র ১৩টি মেঘ বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটে যাতে ৯০১ জন মানুষের প্রানহানী ঘটে।

Bতবে দ্য থার্ড পোলের সাথে কথা বলার সময় প্রায় সব বিশেষজ্ঞই উল্লেখ করেন যে হিমালয়ে আকস্মিক বন্যার মাত্রা এবং পরিমান বৃদ্ধির জন্য আরেকটি ঘটনা রয়েছে, আর তা হচ্ছে দাবানল।

আগুন এবং বন্যার সাথে মাটির সংযুক্ততা কোথায়

একটি স্বাস্থ্যকর  বনে তার মাটিতে গাছপালা এবং মৃত উদ্ভিদের ধ্বংসাবশেষ ছড়িয়ে থাকে। কৃমির মতো ছোট ছোট প্রাণী জঙ্গলের এই ভূমির উপরের স্তরটিকে অনেকটা ভূমি কর্ষনের কাজ করে তাকে পানি শোষণ করতে সক্ষম করে তোলে। সিনহা বলেন, “মেঘ বিস্ফোরণ এবং চরম বৃষ্টিপাতের সময়, বনের মাটিতে জৈব পদার্থ স্পঞ্জ হিসাবে কাজ করে এবং পানি শোষণ করে। এভাবে পানি প্রবাহিত হওয়ার পরিবর্তে মাটিতে প্রবেশ করে।”

প্রবল বাতাস বা ভারী বৃষ্টিপাত হলে উদ্ভিদের শিকড় এবং জৈব পদার্থ মাটিকে আঁকড়ে ধরে রাখে।

Before wildfires
After wildfires
দাবানলের আগে এবং পরে মাটির তুলনামূলক চিত্র, এই দুটি ছবির প্রথমটি দেখলে  বুঝা যাচ্ছে যে একটি স্বাস্থ্যকর বনের ভূমির উপরিভাগ কিভাবে পানি শুষে রাখতে পারে আর অন্যটিতে দেখা যাচ্ছে আগুনের পরে মাটি একটি কঠিন ভূত্বকে পরিনত হয়েছে যাতে পানি আটকে থাকা সম্ভব নয় (ছবি: নিউট্রন টি / থার্ড পোল)

এসব জৈবপদার্থ বনের আগুন বা দাবানলের তীব্র উত্তাপে ধ্বংস হয়ে যায়। “যখনই বনে আগুন লাগে, এটি মাটির উপরের স্তরকে ধ্বংস করে দেয়, যা পুষ্টিতে সমৃদ্ধ এবং এটি তৈরি হতে সাধারণত ২০০ থেকে ৩০০ বছর সময় লাগে,” রবি চোপড়া বলেন৷

মাটিতে আগুনের সবচেয়ে বড় প্রভাব হল তারা এটিকে কম ভেদযোগ্য করে তোলে। সিনহা ব্যাখ্যা করে বলেন, একটি তীব্র বনের আগুন মাটির উপরের স্তরকে পুড়িয়ে ফেলে, “যা মাটির গঠন এবং এতে থাকা ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ফাঁকা অংশ (একটি কঠিন পদার্থের কণার মধ্যে স্থান, যেমন শিলা বা মাটি) পরিবর্তন করে।”

এ বিষয়ে বিশদভাবে ব্যাখ্যা করতে গিয়ে তিনি বলেন, মাটির কণাগুলো আরও ঘনিষ্ঠভাবে এবং ঘনভাবে একত্রে আবদ্ধ অবস্থায় থাকে যা মাটির উপরের স্তরকে পানি প্রতিরোধী করে তোলে। এটি বাঁধাগ্রস্ত হলে পানির মাটির উপরিস্থল থেকে নিচে যেতে বাঁধা পায়। এর ফলে ভাঙনের মতো পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। ফলস্বরূপ, মাটির স্বাভাবিক পানি শোষণ করার ক্ষমতা হ্রাস পায়।

তাপ কীটপতঙ্গের মতো প্রাণীকেও মেরে ফেলে, যার ফলে প্রকৃতির স্বাভাবিক এই পরিস্থিতির পরিবর্তন হয়ে যায় যেটি স্বভাবতই সহজে আবার আগের অবস্থায় ফিরে যেতে পারেনা।

মাটির উপরের উর্বর স্তরটি তৈরি হতে সাধারণত ২০০ থেকে ৩০০ বছর পর্যন্ত সময় লাগে
রবি চোপড়া, পিপলস সায়েন্স ইনস্টিটিউট

সমির কুমার সিনহা বলেন, এর পরিবর্তে পাহাড়ের কোনো বনে যদি দাবানলের পর সেখানে বৃষ্টি ধারা পাহাড়ের ঢালে মাটির উপরিভাগ দিয়ে প্রবাহিত হয়ে সরাসির আশেপাশের নদী বা জলধারায় গিয়ে পতিত হয়। এই পানি ভূমির উপরের মাটি (টপ সয়েল) ধুয়ে ভাসিয়ে নিয়ে যায় শেষ পর্যন্ত মূল ভূমি থেকে আলগা হয়ে যায়। সিনহা আরও বলেন, যে [আগুনের পরে] মাটিকে একত্রে ধরে রাখার মতো কোনও গাছপালা না থাকায়, মেঘ বিস্ফোরণের মতো ঘটনার সময় এটি ক্ষয়-সদৃশ পরিস্থিতির জন্য ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে পড়ে।

রবি চোপড়া বলেন, অতিরিক্ত পানি এবং ধ্বংসাবশেষের এই মিশ্রণ নদীগুলোর মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হয়ে নদীর তলদেশের উচ্চতা বৃদ্ধি করে। ফলে অতিরিক্ত বৃষ্টির পর নদীর পক্ষে অতিরিক্ত পানি বয়ে নিয়ে যেতে সম্ভব হয়। যার কারনে নদী উপচে পড়ে তীরে মাটি ক্ষয়ে ভাঙ্গন সৃষ্টি হয় এবং আশপাশের এলাকা আক্রান্ত হয় আকস্মিক বন্যায়।

একই সময়ে, আগুন এবং মেঘ বিস্ফোরণের ঘটনা এত বেশি ঘটতে থাকে যে হারানো মাটি পুনরুদ্ধারের জন্য প্রয়োজনীয় সময় পায় না, যা এই ‘দুষ্ট চক্র’কে আরো স্থায়ী করে তোলে।

এই চক্র ভাঙ্গতে তবে করণীয় কী?

২০২২ সালের আগস্টে, ভারতীয় গবেষকদের একটি দল বনের আগুনের উপর একটি গবেষনা প্রকাশ করে। সেখানে মূলত তিনটি প্রধান সুপারিশ তুলে ধরা হয়:

১. দাবানল প্রতিহত বা ক্ষয়ক্ষতি কমিয়ে আনতে অধিকতর উন্নত প্রস্তুতি এবং মেকাবেলা ব্যবস্থা উন্নত করতে হবে  (উদাহরণস্বরূপ, দাবানলের পর কর্ম পরিকল্পনায় সংশ্লিষ্ট সব ধরনের অংশীদারদের দায়িত্ব সুনির্দিষ্ট করা; বন বিভাগকে অর্থায়ন করা এবং বনরক্ষী এবং অন্যান্য সম্মুখসারির কর্মকর্তাদের জন্য সরঞ্জাম সরবরাহ করা; অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা কমাতে যুব গোষ্ঠী তৈরি করা);

২. ভারতের ন্যাশনাল ডিজাস্টার রেসপন্স ফোর্স (NDRF)-এর অধীনে একটি ফরেস্ট ফায়ার উইং গঠন করা যা আধুনিক অগ্নিনির্বাপক কৌশল সম্পর্কে সার্বিকভাবে প্রশিক্ষিত এবং বনরক্ষীদের সহযোগিতায় কাজ করতে সক্ষম হবে;

৩. নীতি নির্ধারকদের সাহায্য করার জন্য বনের আগুনের কারণ এবং প্রভাব সম্পর্কে আরও গবেষণা পরিচালনা এবং উৎসাহিত করা।

অন্যান্য ব্যবহারিক কিছু ব্যবস্থা গ্রহনের মধ্য দিয়ে এই সমস্যা সমাধানে কিছুটা স্বস্তি আসতে পারে বলে মনে করেন হেমন্ত ধিয়ানি। তিনি বলেন, আগুন এবং বন্যার এই দুষ্টচক্রটি ভাঙার ক্ষেত্রে সবেচেয় গ্রহনযোগ্য সমাধান হতে পারে তৃণমূল সামাজিক আন্দোলনকে বেগবান করে তোলার মধ্য দিয়ে। এর ফলে স্থানীয় সম্প্রদায়গুলো আরো শক্তিশালী হয়ে উঠবে। তিনি বলেন, পুরানো বন পঞ্চায়েত ব্যবস্থা পুনরুদ্ধারের মধ্য দিয়ে গ্রামবাসীদের মধ্যে দায়িত্ববোধ এবং অনুপ্রেরনা জাগিয়ে তোলা সম্ভব আগুন লাগা বা দাবানলের হাত থেকে বনকে রক্ষা করতে তাদের উৎসাহিত করবে।

হেমন্ত ধিয়ানি আরো বলেন, এক্ষেত্রে আরেকটি সম্ভাবনাময় উদ্যোগ হল পাইন নিডেল বায়োগ্যাস প্ল্যান্ট স্থাপন করা। তিনি বলেন,  হিমালয়ের বনের আগুন লাগার ক্ষেত্রে অন্যতম একটি কারন হচ্ছে এই পাইন নিডল। স্থানীয় গ্রামবাসীরা এগুলো সংগ্রহ করে সরকারের কাছে বিক্রি করতে পারে। এর মূল্য হতে পারে মাত্র ৫ থেকে ৬ টাকা কেজি প্রতি। এতে শুধু বনের দাবানলের সংখ্যা ও তীব্রতাই কমবে না বরং মানুষের কর্মসংস্থানও হবে।

ভুটানের বন বিজ্ঞানী ফুন্টশো নামগ্যাল, হিমালয়ে বনের আগুনের বিস্তার রোধ করার জন্য একটি বনের নিবিড়তা হ্রাসের একটি কৌশল নিয়ে কাজ করছেন। ভুটানের প্রায় ৮৪  শতাংশ অঞ্চল বনভূমি দ্বারা আচ্ছাদিত। এ ব্যাপারে নামগ্যাল বলেন, এই বনগুলিতে প্রচুর গাছ রয়েছে, তাই তারা বনের আগুনের ক্ষেত্রে ব্যাপকভাবে ধ্বংসাত্মক এবং ঝুঁকিপূর্ণ। বনের নিবিড়তা হ্রাস করে এবং নিয়ন্ত্রিত পোড়ানো পদ্ধতি চালুর মধ্য দিয়ে এ ধরনের  বিপদ কমিয়ে আনা যেতে পারে। ভুটানের সংবাদপত্র কুয়েনসেলে প্রকাশিত এক নিবন্ধে নামগিয়াল এই মত তুলে ধরেন।

গবেষকরা জঙ্গলে পশু চারনেরও পরামর্শ দিয়েছেন কারণ এটি “সম্ভাব্য জ্বালানীকে নির্মূল করে যা আগুন জ্বালাতে পারে এবং বনের পথ তৈরি করে যা অগ্নি নির্বাপক হিসাবেও ব্যবহার করা যেতে পারে।”

এদিকে, সাউথ এশিয়া নেটওয়ার্ক অন ড্যামস, রিভারস অ্যান্ড পিপল (SANDRP) এর সমন্বয়কারী হিমাংশু ঠক্কর, দ্য থার্ড পোলকে বলেন, আকস্মিক বন্যার মাত্রা এবং তীব্রতা কমাতে হিমালয়ে অবকাঠামোগত উন্নয়নে যে নীতি রয়েছে তার পরিবর্তন প্রয়োজন। তিনি বলেন, পাহাড়ি এলাকায় রাস্তা, টানেল, জলবিদ্যুৎ কেন্দ্র এবং অন্যান্য প্রকল্প নির্মাণের ফলে মাটি ক্ষয় হয় এবং পাহাড় ধ্বংসের মুখে এগিয়ে যায়।

হিমাংশু মনে করেন, দাবানল এবং বন্যার সমস্যাগুলিকে ব্যাপকভাবে মোকাবেলা করার জন্য  আরও কাঠামোগত  পরিবর্তন প্রয়োজন৷ আর এসব পরিবর্তন সরকারি পর্যায়ে হওয়া উচিত। মূলত বনের ব্যবস্থাপনা ও পরিচালনার পদ্ধতিতে একটি কার্যোপেযাগী এবং সময়োপযোগী পরিবর্তন আনা আবশ্যক।

মূল লেখকের পাশাপাশি এই নিবন্ধটিকে প্রকাশের ক্ষেত্রে অতিরিক্ত তথ্য, লেখা এবং গবেষনালদ্ধ যুক্তি অন্তর্ভূক্ত করে সহায়তা করেছেন নাতালি টেইলর।

-->
Privacy Overview

This website uses cookies so that we can provide you with the best user experience possible. Cookie information is stored in your browser and performs functions such as recognising you when you return to our website and helping our team to understand which sections of the website you find most interesting and useful.

Strictly Necessary Cookies

Strictly Necessary Cookie should be enabled at all times so that we can save your preferences for cookie settings.

3rd Party Cookies

This website uses Google Analytics to collect anonymous information such as the number of visitors to the site, and the most popular pages.

Keeping this cookie enabled helps us to improve our website.

Additional Cookies

This website uses the following additional cookies:

(List the cookies that you are using on the website here.)