গত বছর পহেলা মার্চ পায়রা বিদ্যুত কেন্দ্রের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করার সময় বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দেশের শতভাগ জনগণকে বিদ্যুতের আওতায় নিয়ে আসার ঘোষণা দেন। বিদ্যুত ক্ষেত্রে বাংলাদেশের এই অর্জন তখন দক্ষিণ এশিয়ার অন্যান্য সব দেশকে ছাড়িয়ে গিয়েছিল। তবে সেসময় কোনোভাবেই ধারনা করা যায়নি যে ঠিক ১৭ মাস পরে কয়লার ঘাটতির কারণে কারখানাটি সাময়িকভাবে বন্ধ করতে হবে। দেশটিতে এখন চলছে প্রচণ্ড জ্বালানি সংকট। উচ্চমূল্যের কারনে জীবাশ্ম জ্বালানি, বিশেষ করে প্রাকৃতিক গ্যাস ও কয়লা আমদানি করতে গিয়ে বাংলাদেশকে এখন হিমশিম খেতে হচ্ছে।
দক্ষিণ এশিয়ার অন্যতম উদীয়মান অর্থনীতির দেশ বাংলাদেশের সাম্প্রতিক জ্বালানি সংকটের প্রাথমিক কারন হিসেবে যদিও ইউক্রেনে রাশিয়ার সামরিক আগ্রাসনকে মনে করা হচ্ছে তবে শিকড় আরও গভীরে। বাংলাদেশের উন্নয়নের মূলে রয়েছে উল্লেখ করার মতো বিদ্যুৎ সরবরাহ সম্প্রসারণ। তবে দেশের সামগ্রিক বিদ্যুত ব্যবস্থার শক্ত ভিত্তির উপর দাড়িয়েছে আমদানিকৃত জীবাশ্ম জ্বালানির উপর। ১৯৯১ সালে দেশের ১৪ শতাংশ বিদ্যুতের আওতায় ছিল। আর ২০২০ সালে মোট জনসংখ্যার ৯৬ শতাংশই বিদ্যুত সংযোগের আওতায় চলে আসে। আর এই সময়ের ব্যবধানে দেশের মাথাপিছু আয়ের পরিমান ২৮৩ মার্কিন ডলার থেকে বেড়ে দাঁড়ায় ২,২৩৩ মার্কিন ডলারে।
বিদ্যুৎ উৎপাদনে বাংলাদেশ বরাবরই প্রাকৃতিক গ্যাসকে প্রধান জ্বালানি উৎস হিসেবে ব্যবহার করে আসছে। রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন তেল ও গ্যাস সরবরাহকারী সংস্থা পেট্রােবাংলা ২০১৪ সালে তাদের বার্ষিক প্রতিবেদনে দেশে গ্যাসের ঘাটতির কথা উল্লেখ করে। প্রতিবেদনে বলা হয় দেশে গ্যাসের চাহিদা এরইমধ্যে দৈনিক প্রায় ৩,২০০ মিলিয়ন ঘনফুট ছাড়িয়ে গেছে। অথচ গ্যাসের গড় সরবরাহ প্রায় ২,৭০০ মিলিয়ন ঘনফুট, অর্থাৎ প্রায় ৫০০ মিলিয়ন ঘনফুটের ঘাটতি রয়েছে। আর ঘাটতির পরিমান বাড়তে থাকে যখন থেকে সরকার কয়লা এবং আমদানিকৃত প্রাকৃতিক গ্যাসের নির্ভরশীলতা বাড়াতে শুরু করে।
২০২১ সাল থেকেই বাংলাদেশে প্রাকৃতিক গ্যাসের দাম বাড়তে থাকে, পাশাপাশি বাড়তে শুরু করে আমদানিকৃত গ্যাসের পরিমান। একই বছর, আমদানি বাড়ে ২২.২% যা এশিয়ার যে কোনো দেশের মধ্যে সবচেয়ে বেশি। এরপর ২০২২ সালের ফেব্রুয়ারিতে রাশিয়া ইউক্রেন আক্রমণ করার পর এর মূল্য চরমভাবে বাড়তে শুরু করে যা পরবর্তীতে দেশের অর্থনীতিতে ব্যাপক চাপ সৃষ্টি করে। ২০২২ সালের এপ্রিল মাসে সরকার ১০ দিনের জন্য শিল্পকারখানায় দৈনিক চার ঘন্টা করে গ্যাস রেশনিং চালু করে। সেসময় ব্যবসায়ীদের প্রতিবাদ সত্বেও সরকার সার কারখানা এবং বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলিতে গ্যাস সরবরাহ বন্ধ করে দেয়। গ্যাস ও বিদ্যুতের দাম বেড়ে যাওয়ায় বিদ্যুৎকেন্দ্র, শিল্প, গৃহস্থালি, কম্প্রেসড ন্যাচারাল গ্যাস (সিএনজি) ফিলিং স্টেশন এবং বাণিজ্যিক ভোক্তাদের ভোগান্তি বাড়তে থাকে। ঘন ঘন লোডশেডিংয়ের ফলে শিল্পকারখানায় চাপ সৃষ্টি হয় যার প্রভাব গিয়ে পড়ে কর্মীদের মজুরী থেকে শুরু করে উৎপাদিত পন্যের উপর।
বাংলাদেশের অনাবিষ্কৃত গ্যাসের মজুদ
বিশেষজ্ঞদের মধ্যে অনেকেরই প্রশ্ন, কেন বাংলাদেশে নিজস্ব গ্যাসক্ষেত্র গড়ে উঠছে না। সরকারের হাইড্রোকার্বন ইউনিট, এনার্জি অ্যান্ড মিনারেল রিসোর্স ডিভিশন থেকে প্রকাশিত “বাংলাদেশের জ্বালানী দৃশ্যকল্প ২০২১-২২” অনুযায়ী, দেশে ট্রিলিয়ন ঘনফুট (টিসিএফ) প্রাকৃতিক গ্যাসের পুনরুদ্ধারযোগ্য মজুদ রয়েছে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূতত্ত্ব বিভাগের অধ্যাপক বদরুল ইমাম দ্য থার্ড পোলকে বলেন, “আমরা দেশের পূর্বাঞ্চলে গ্যাসক্ষেত্র আবিষ্কার করেছি যা বাংলাদেশের এক তৃতীয়াংশ জুড়ে বিস্তৃত। অথচ দেশের উপকূলীয় এবং সমুদ্র অঞ্চলে গ্যাসের সন্ধান না করেই এলএনজি আমদানি করে যাচ্ছি।” একই ধারনা পোষণ করেন বাংলাদেশ প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) পেট্রোলিয়াম এবং খনিজ সম্পদ প্রকৌশল বিভাগের অধ্যাপক এম তামিম। তাঁর মতে এসব সম্পদ অনুসন্ধানের প্রয়োজন কারণ বর্তমানে পুনরুদ্ধারযোগ্য গ্যাসের যে মজুদ রয়েছে আগামী দশকের মধ্যে তা শেষ হয়ে যেতে পারে।
অনুসন্ধান চালানোর জন্য আন্তর্জাতিক তেল কর্পোরেশনগুলিকে আকৃষ্ট করা ছাড়া বিকল্প নেইঅধ্যাপক এম তামিম, বাংলাদেশ প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট)
এম তামিম বলেন, “আমাদের অফশোর ব্লকে সম্ভাব্য গ্যাসের মজুদ রয়েছে। সেগুলোকে উত্তোলন করার জন্য, সেসব স্থানে অনুসন্ধান চালানোর জন্য আন্তর্জাতিক তেল কর্পোরেশনগুলো সাথে কথা বলা ছাড়া আর কোনো বিকল্প নেই।”
২০১২ সালে মিয়ানমারের সাথে এবং ২০১৪ সালে ভারতের সাথে সমুদ্রসীমা বিরোধ নিষ্পত্তির বঙ্গোপসাগরে হাইড্রোকার্বন সম্পদ অন্বেষণের সুযোগ তৈরি হয় বাংলাদেশে। এম ইমামের মতে, বঙ্গোপসাগরে সম্ভাব্য মজুদ আবিষ্কারে পর্যাপ্ত বিনিয়োগের ব্যর্থতাই সরকারকে বিদেশে থেকে গ্যাস আমদানির ওপর আরো নির্ভরশীল করে তোলে।
২০১৭ সালের গ্যাস সেক্টর মাস্টার প্ল্যানে ব্যয়বহুল এলএনজি আমদানিতে অর্থ ব্যয় না করে দেশীয় গ্যাস অনুসন্ধান করার জন্য সরকারের প্রতি সুপারিশ জানানো হয়। এই মহাপরিকল্পনায় বলা হয় ২০৩০ সালের মধ্যে এলএনজি আমদানিতে বাংলাদেশের ব্যয় হবে ৩ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। অন্যদিকে দেশীয় গ্যাস সম্পদের অনুসন্ধানের ব্যয় এর চেয়ে অনেক বেশি সাশ্রয়ী হবে।
২০০৮ এবং ২০১২ সালে অফশোর ব্লকের নিলাম অনুষ্ঠিত হয়। কিন্তু সেসময় সরকার মাত্র কয়েকটি কোম্পানির সাথে চুক্তি সই করতে সক্ষম হয়। এর মধ্যে একটি কনোকোফিলিপস। মার্কিন এই ফার্মটি অবশ্য পরে দেশ ছেড়ে চলে যায় কারন তাদের মতে এই অনুসন্ধান বাণিজ্যিকভাবে কার্যকর নয়। পাশাপাশি তারা সরকারের সাথে একটি কার্যকর চুক্তিতে পৌছাতেও ব্যর্থ হয়।
চেষ্টা এখন নবায়নযোগ্য জ্বালানিতে স্থানান্তর?
নতুন করে গ্যাস অনুসন্ধানের সিদ্ধান্ত নেয়া হবে কিনা এব্যাপারে এখনও সরকারের দিক থেকে কোনো ইঙ্গিত নেই।
প্রধানমন্ত্রীর জ্বালানি উপদেষ্টা তৌফিক-ই-এলাহী চৌধুরী গত বছর সেপ্টেম্বরে একটি ওয়েবিনারে বলেছিলেন যে আমদানিকৃত তরল প্রাকৃতিক গ্যাসের (এলএনজি) উপর নির্ভরতা অব্যাহত থাকবে কারণ বাংলাদেশের উপকূলীয় অঞ্চলে গ্যাস অনুসন্ধানের অবিলম্বে কোন সম্ভাবনা নেই।
এর পরিবর্তে সরকার দেশের জ্বালানি ব্যবহারে আরো বৈচিত্র্য আনতে এবং জ্বালানি নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে আরো কী কী করা যায় সে বিষয়ে গবেষণা বৃদ্ধি করবে।
বাংলাদেশ সরকারের নতুন সমন্বিত বিদ্যুৎ ও জ্বালানি মাস্টার প্ল্যান অনুযায়ি ২০৫০ সালের মধ্যে নবায়নযোগ্য শক্তি থেকে ৪০% বিদ্যুৎ উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। যদিও অভ্যন্তরীণ গ্যাসের উৎপাদন দ্রুত বাড়ার কোনাে সম্ভাবনা নেই। তবে পরিকল্পনা অনুযায়ি বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য গ্যাসের ব্যবহার ১৬০ – ৩৬০ শতাংশ বৃদ্ধি পাবে কারণ ২০৫০ সালের মধ্যে বিদ্যুত উৎপাদনে গ্যাসের ব্যবহার ৩০ শতাংশ বাড়বে। অবশ্য সরকার সবুজ হাইড্রোজেন এবং অ্যামোনিয়া থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদন, জ্বালানি দক্ষতা বৃদ্ধি এবং প্রতিবেশী দেশগুলি থেকে বিদ্যুত আমদানির বিষয়গুলো সক্রিয়ভাবে বিবেচনা করছে।
দেশের মোট উৎপাদনক্ষমতার ২৫,২৮৬ মেগাওয়াটের মধ্যে মাত্র ১,১৭৯ মেগাওয়াট বিদ্যুত নবায়নেযাগ্য খাত থেকে আসে যার ৮০ শতাংশই সৌরবিদ্যুত। এছাড়াও বাংলাদেশ নেপাল এবং ভুটান থেকে জলবিদ্যুৎ আমদানি করে থাকে।
২০৩০ সালের মধ্যে দেশে মোট বিদ্যুত উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে ৪০,০০০ মেগাওয়াট। আর ২০৪০ সালের মধ্যে এটি ৬০,০০০ মেগাওয়াটে উন্নীত করার পরিকল্পনা সরকারের। বাংলাদেশ সরকারের মুজিব জলবায়ু সমৃদ্ধি পরিকল্পনা অনুযায়ি ২০৩০ সালের মধ্যে মোট বিদ্যুত উৎপাদনের ৩০ শতাংশ এবং ২০৪০ সালের মধ্যে ৪০ শতাংশ বিদ্যুত নবায়নযোগ্য জ্বালানি খাত উৎপাদিত হবে বলে আশা করা হচ্ছে।
অবশেষে সৌরবিদ্যুতের গুরুত্ব?
ইউনাইটেড ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির সেন্টার ফর এনার্জি রিসার্চের পরিচালক শাহরিয়ার আহমেদ চৌধুরী দ্য থার্ড পোলকে বলেন, “আমাদের জ্বালানি ও বিদ্যুত সংকট মোকাবেলায় কার্যকরী কর্মকৌশল প্রনয়ন করা উচিত। দেশে বাড়ির ছাদ এবং অন্যান্য স্থানে সৌর শক্তি স্থাপন করে প্রায় ১২,০০০ মেগাওয়াট নবায়ণযোগ্য বিদ্যুৎ উৎপাদনের যথেষ্ট সুযোগ রয়েছে।” তিনি বলেন, সৌরবিদ্যুত একটি পরীক্ষিত প্রযুক্তি এবং এখন এই প্রযুক্তির উপরই আমাদের নজর দেয়া উচিত।
ইনফ্রাস্ট্রাকচার ডেভেলপমেন্ট কোম্পানি লিমিটেড (আইডিসিওএল) এর মতে, বাংলাদেশ টেক্সটাইল মিলস অ্যাসোসিয়েশনের ১,৫০০ সদস্যের কাছ প্রায় ৪২ মিলিয়ন বর্গফুট ছাদের জায়গা পাওয়া যেতে পারে। এখানে সোলার ফটোভোলটাইক সিস্টেম ইনস্টল করে মোট ৪০০ মেগাওয়াট ক্ষমতাসম্পন্ন বিদ্যুত উৎপাদন সম্ভব। এছাড়াও বস্ত্র কারখানা ও অন্যান্য শিল্পের ছাদে সোলার প্যানেল বসিয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদন করা যেতে পারে।
তবে অনুরূপ ধারণা আগেও প্রস্তাব করা হয়েছিল। তবে তা কার্যকর হয়নি। বিজনেস ইনিশিয়েটিভ লিডিং ডেভেলপমেন্ট-এর সিইও ফেরদৌস আরা বেগম ২০১৯ সালে তার এক লেখায় বিল্ডিংয়ের ছাদে সৌরবিদ্যুতের পক্ষে যুক্তি দেন। কিন্তু সরকার সেসব বিষয়ে তেমন জোর না দিয়ে পায়রার মতো কয়লা কারখানায় মনোনিবেশ করে।
আশার কথা হচ্ছে ২০১২ সালের জুলাই মাসে সরকার সৌরশক্তির দিকে মনোনিবেশ শুরু করে। সেসময় রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন নর্থ-ওয়েস্ট পাওয়ার জেনারেশন কোম্পানি লিমিটেড সৌর ও বায়ুচালিত প্লান্ট স্থাপনের মাধ্যমে ৫০০ মেগাওয়াট নবায়নযোগ্য জ্বালানি ভিত্তিক বিদ্যুত উৎপাদনে চায়না ন্যাশনাল মেশিনারি ইমপোর্ট অ্যান্ড এক্সপোর্ট কর্পোরেশনের সাথে একটি সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষর করে।
এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট ব্যাংকের টেকসই জ্বালানি বিশেষজ্ঞ সিদ্দিক জোবায়ের দ্য থার্ড পোলকে বলেন, “চীন, বর্তমানে বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় বাণিজ্য অংশীদার। এই দেশের অধিকাংশ নবায়নযোগ্য প্রকল্পে তারা বিনিয়োগ করছে।” তিনি বলেন, “পাইপলাইনে থাকা প্রকল্পগুলোর প্রায় ৯০ শতাংশই চীনের অর্থায়নে বাস্তবায়ন করা হবে এবং যদি তারা [চীন] তাদের বড় কয়লা বিদ্যুৎ প্রকল্পগুলিকে নবায়নযোগ্য বিদ্যুত উৎপাদন কেন্দ্রে পরিণত করে কেবল তখনই আমরা ২০৪১ সালের লক্ষ্য অর্জনে এগিয়ে যেতে পারি।”
এই প্রতিবেদনটিতে লেখকের পাশাপাশি ওমের আহমদের ইনপুট রয়েছে