ব্যাপক ছাত্র আন্দোলনের মধ্য দিয়ে ২০২৪ সালের ৫ আগষ্ট শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন সরকারের ক্ষমতাচ্যুতির তিন দিন পর নোবেল বিজয়ী ড. ইউনূসের নেতৃত্বে বাংলাদেশে একটি অন্তবর্তীকালীন সরকার দায়িত্ব গ্রহন করে। বিশিষ্ট পরিবেশ আইনজীবি সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান অন্তর্বতী এই সরকারের পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত উপদেষ্টা শপথ গ্রহন করেন।
পেশাগত জীবনে একজন আইনজীবী সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান ১৯৯৩ সাল থেকে বাংলাদেশ এনভায়রনমেন্টাল লয়ার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বেলা) সাথে যুক্ত। তিনি ১৯৯৭ সালে সংস্থাটির প্রধান নির্বাহী হিসাবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন। বাংলাদেশের পরিবেশ সুরক্ষায় জনস্বার্থে বহু মামলা করার ক্ষেত্রে বেলা একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে আসছে। একজন সুপরিচিত পরিবেশ আইনজীবী হিসেবে সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান ঢাকা ও তার আশেপাশে জলাভূমির সুরক্ষা থেকে শুরু করে কৃষিক্ষেত্রে চিংড়ি চাষের ক্ষতিকর প্রভাব এবং বনভূমি ধ্বংসের বিষয়গুলো নিয়ে নিবীড়ভাবে কাজ করেছেন। এসব কাজের জন্য তিনি বিশ্বব্যাপী বহুবার প্রশংসিত হয়েছেন। ২০০৯ সালে কাজের স্বীকৃতি হিসেবে তিনি গোল্ডম্যান এনভায়রনমেন্টাল পুরষ্কার অর্জন করার পাশাপাশি একই বছর টাইম ম্যাগাজিন কর্তৃক বিশ্বের ৪০ জন ‘এনভায়রনমেন্টাল হিরোর’ একজন হিসাবে স্বীকৃতি পান এবং ২০১২ সালে রামোন ম্যাগসেসে পুরস্কার লাভ করেন।
আওয়ামী লীগ সরকারের ১৫ বছরের শাসন থেকে বেরিয়ে বাংলাদেশে নতুন একটি অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব গ্রহন করেছে। এর মধ্য দিয়ে দেশটির শাসনব্যবস্থায় সংস্কারের সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। নতুন এই সরকারের পরিবেশ মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা হিসেবে দাযিত্ব গ্রহনের পর সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান তার অগ্রাধিকারভিত্তিক কর্মসূচি এবং অন্যান্য পরিকল্পনা নিয়ে ডায়ালগ আর্থের সাথে বিস্তারিত আলাপ করেন।
সাক্ষাতকারটি সংক্ষেপে তুলে ধরা হলো:
ডায়ালগ আর্থ: অন্তর্বর্তী সরকারে পরিবেশ উপদেষ্টা হিসেবে আপনার সামনের দিনগুলিতে অগ্রাধিকারে কী কী রয়েছে?
রিজওয়ানা হাসান: পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন বিষয়ক মন্ত্রণালয়ে এর আগে সাবের হোসেন চৌধুরীর মন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। তিনি তার কাজের জন্য দেশে এবং দেশের বাইরে অত্যন্ত সুপরিচিত। তার দায়িত্বের মেয়াদকালে তিনি সুশীল সমাজের প্রতিনিধিদের সাথে পরামর্শ করে মন্ত্রণালয়ের জন্য বেশ কিছু অগ্রাধিকারমূলক কর্মসূচি নির্ধারণ করে গেছেন। আমার প্রথম কাজ হচ্ছে তার সেই কর্মপরিকল্পনাগুলো বাস্তবায়ন নিশ্চিত করা।
এর বাইরে আমার লক্ষ্য হচ্ছে পরিবেশগত ব্যবস্থাপনায় জনগণের আস্থা পুনরুদ্ধার করা। আমি আমলাতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার মধ্যে থেকে [সাম্প্রতিক] বিপ্লবের চেতনাকে আরো সম্প্রসারিত করতে চাই, যাতে জনগণের অভিযোগের সমাধান করা হয় এবং তারা মন্ত্রণালয়ের কার্যক্রম সম্পর্কে অবহিত হয়। প্লাস্টিকের ব্যাগ থেকে দূষণ মোকাবেলা বা শব্দ ও নদী দূষণ মোকাবেলা করার মতো নির্দিষ্ট পদক্ষেপগুলি এখনও চূড়ান্ত করা হচ্ছে, কারণ আমি এখনও সংশ্লিষ্ট স্টেকহোল্ডারদের সাথে পরামর্শ করার প্রক্রিয়ার মধ্যে আছি।
যেমন ধরুন আমরা পরিবেশ দূষণের ক্ষেত্রে প্লাস্টিক ব্যাগ এবং অন্যান্য একক-ব্যবহারের প্লাস্টিক আইটেম ব্যবহারের বিরুদ্ধে নিয়মিত অভিযান চালানোর পরিকল্পনা করেছি। আমরা একটি সময়সীমা নির্ধারণ করে প্লাষ্টিক ব্যবহার থেকে বেরিয়ে আসার পরিকল্পনা তৈরি করেছি, প্রাথমিকভাবে যেমন একক-ব্যবহারের প্লাস্টিক পন্য বন্ধ করার কাজটি উপকূলীয় এলাকাগুলোতে শুরু করা যেতে পারে। [বাংলাদেশে টেকসই প্লাস্টিক ব্যবস্থাপনার জন্য মাল্টি-সেক্টরাল অ্যাকশন প্ল্যান ২০২৫ এর মধ্য দিয়ে ৫০ শতাংশ প্লাস্টিক পুনর্ব্যবহারের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে এবং ২০২৬ সালের মধ্যে একক-ব্যবহারের ৯০% প্লাস্টিক পুনর্ব্যবহার করার লক্ষ্য নির্ধারিত আছে]
বায়ু, জল এবং শব্দ দূষণের ক্ষেত্রে আমাদের একটি শক্তিশালী পর্যবেক্ষণ ব্যবস্থা চালু করতে হবে যাতে একটি এলোমেলোভাবে ডেটা সংগ্রহ করা না হয়। এছাড়াও দূষণ পর্যবেক্ষণের ক্ষেত্রে আমাদের অবশ্যই স্থানীয় জনগণকে সম্পৃক্ত করতে হবে।
এছাড়াও [বনভূমি ও নদীতে] দখলদারদের একটি তালিকাও প্রস্তুত করা হয়েছে। তাদের অবিলম্বে উচ্ছেদ করা হবে। আমাদের এখনও চিন্তা করছি যে আসলে তাদের বিরুদ্ধে কি দেশব্যাপী অভিযান পরিচালনা করব, নাকি একটি নির্দিষ্ট এলাকাকে লক্ষ্য করে একটি নজির স্থাপন করব। সরকারকে অবশ্যই সব দখলকৃত জমি পুনরুদ্ধার করতে হবে, তবে আমি একটি নজির স্থাপনকে অগ্রাধিকার দেব [নির্দিষ্ট এলাকা থেকে বনভূমি এবং নদী পুনরুদ্ধার করার মাধ্যমে]।
ডায়ালগ আর্থ: পরিবেশ রক্ষার জন্য কোন আইনি সংস্কার প্রয়োজন?
রিজওয়ানা হাসান: বন আইন ১৯২৭ এবং বাংলাদেশ পরিবেশ আদালত ২০১০ এর সংস্কার প্রয়োজন। আমার কাছে সংবিধান সংশোধন করার কোনো সুযোগ তৈরি হয় তাহলে আমি রাষ্ট্রীয় নীতির একটি মৌলিক নীতির পরিবর্তে পরিবেশকে একটি মৌলিক অধিকার হিসাবে স্বীকৃত প্রদানের লক্ষ্যে কাজ করব, কারন এটি কেবল প্রয়োগযোগ্য নয়। নির্বিচারে বৃক্ষ নিধন নিয়ন্ত্রণের জন্য আমাদের একটি আইনও দরকার।
ডায়ালগ আর্থ: আন্তঃসীমান্ত নদী ব্যবস্থাপনার জন্য সরকারের দৃষ্টিভঙ্গি কী হওয়া উচিত?
রিজওয়ানা হাসান: যদিও নদী ব্যবস্থাপনা প্রাথমিকভাবে পররাষ্ট্র মন্ত্রনালয় এবং পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের অধীনে পড়লেও আমি নদীর উপর আন্তঃসীমান্ত কর্মকান্ডের ফলে যেসব নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে সে সম্পর্কে সব ধরনের তথ্য এবং উপাত্ত প্রদান করে তাদের কার্যক্রমকে সহযোগিতা করব৷
ডায়ালগ আর্থ: বাংলাদেশে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবেলায় সরকারের অগ্রাধিকার কী হওয়া উচিত?
রিজওয়ানা হাসান: জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবেলায় জাতীয় ও আন্তর্জাতিক উভয় ক্ষেত্রেই পদক্ষেপ গ্রহনের প্রয়োজনীয়তা রয়েছে। জাতীয় পর্যায়ে আমাদের জলবায়ু পরিবর্তন ট্রাস্ট ফান্ড আছে। আমার লক্ষ্য হবে এই তহবিলের অর্থ যাদের জন্য সৃষ্টি করা হয়েছে যেন তাদের কাছেই পৌছায় এবং এক্ষেত্রে যাতে জলবায়ু মেকাবেলায় দীর্ঘমেয়াদী সমাধানের জন্য তা ব্যবহৃত হয় এবং এর অপব্যবহার যেন বন্ধ করা যায়।
এছাড়া আন্তর্জাতিক পর্যায়ে আমাদের পর্যাপ্ত তহবিলের জন্য তৎপরতা অব্যাহত রেখে একটি শূন্য-কার্বন নীতির জন্য চাপ প্রয়োগ করতে হবে, যা আমাদের অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টার মূল এজেন্ডারও অংশ [“শূন্য দারিদ্র্য, শূন্য বেকারত্ব এবং শূন্য নেট কার্বন নির্গমন”]।
ডায়ালগ আর্থ: অন্তর্বর্তীকালীন এই সরকার শীঘ্রই একটি নির্বাচিত রাজনৈতিক দলের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করবে, এই অল্প সময়ের মধ্যে আপনি কী অর্জন করবেন বলে আশা করেন?
রিজওয়ানা হাসান: বাংলাদেশি জনগণকে যাতে দূষিত বাতাসে শ্বাস নিতে না হয় সেটা নিশ্চিত করা আমার অন্যতম একটি লক্ষ্য। আমার মেয়াদ শেষ হওয়ার আগে, আমি এমন একটি ব্যবস্থা চালু করতে চাই যা আমাদের নদীগুলির স্বাস্থ্য পুনরুদ্ধার করবে যাতে নদীগুলো অবাধে প্রবাহিত হতে পারে। আমি আরো চাই যে, আমি চলে যাওয়ার পর, এই প্রজন্মের কাউকে একক-ব্যবহারের পলিথিন ব্যাগ ব্যবহার করতে না হয় – এক্ষেত্রে তানজানিয়া যা অর্জন করেছে মতোই একটি পরিবর্তন আনতে চাই। আর সব শেষে আমি বাংলাদেশকে একটি সবুজ এবং আরও টেকসই দেশ হিসেবে রেখে যেতে চাই।