পাকিস্তান এবং ভারত ১৪ এবং ১৫ আগস্ট তাদের নিজ নিজ দেশের স্বাধীনতা দিবস উদযাপন করে। স্বাধীনতা উদযাপনের এই সময়ে অবধারিতভাবে মনে পড়ে দূ:সহ সহিংসতার ঘটনা যা ঘটে ভাগের সময়ে। স্বাধীনতার পরপরই সংঘটিত সেই ভয়াবহ সহিসংতায় মৃত্যু হয় লাখো মানুষের এবং বাস্তুচ্যুত হয় আরো লক্ষ লক্ষ নীরিহ মানুষ। সেদিনের সেই বিভাজনের জের আজও আমরা দেখতে পাই দক্ষিণ এশিয়ায় ভূমি ও সম্পদের বিভাজন ও ব্যবস্থাপনায়।
ভারতীয় উপমহাদেশের বিভাজনে সৃষ্টি হয় নতুন নতুন দেশ, আর সেই সঙ্গে সৃষ্টি হয় সীমান্ত। অথচ এখানকার প্রাকৃতিক সম্পদ যার মধ্যে সবেচেয়ে বড় আর প্রয়াজনীয় অংশ হচ্ছে এখানকার নদী যা বিভাজিত হয়ে যায় সীমানার আড়ালে। অবিচ্ছিন্ন আর অভিন্ন এই নদী আর তার জীববৈচিত্র্য বাঁচাতে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোকে নিছক সীমানা ব্যবস্থাপনার পরিবর্তে এখন জৈবঅঞ্চল ভিত্তিক ব্যবস্থাপনা নিয়ে ভাবার সময় এসেছে।
দেশভাগের সময় জন্ম নেয়া সেই বিভাজনের মনোভাব সিন্ধু নদীর পানি চুক্তিতেও দেখা যায়। এটি নিয়ে ১৯৪৮ সালের পর এক দশকেরও বেশি সময় ধরে দু’পক্ষের মধ্যে পারস্পরিক দীর্ঘ এবং দূ:সহ আলোচনা চলে। এক পর্যায়ে তৎকালীন ভারতীয় পাঞ্জাবের প্রকৌশলীরা পশ্চিম পাকিস্তানে পানি প্রবাহ বন্ধ করে দেয়। অপরদিকে গঙ্গার পানি বণ্টন চুক্তি এবং তিস্তা নদীর উপর আরো একটি চুক্তি নিয়েও চলমান অচলাবস্থার মধ্যে আমরা কিন্তু সেই বিভাজনের নেতিবাচক মনোভাবের আভাস পাই।
মজার বিষয় হচ্ছে এই সমস্যাগুলো আংশিকভাবে বিভাজনের সময় ছড়িয়ে পড়া “আলাদা” হবার যে মনোভাব তার সাথে যুক্ত: অর্থাৎ সেই বিভাজন প্রক্রিয়ায় এখানকার জনগণের মধ্য থেকে “বিশেষ ধরনের মানুষ” চিহ্নিত করে তাদের জন্য “বিশেষ প্রশাসনিক অঙ্গ তৈরি করা হয়েছিল। বিভাজন এবং এর পরবর্তী ঘটনা নিয়ে আলোচনা করার সময়, বেশিরভাগ লেখাতেই মূলত “বিভক্ত” বিষয়টি নিয়েই আলোকপাত করা হয় কারন আপাতদৃষ্টিতে দেখা যায় যে সেই দিনগুলোতে হিন্দু ও মুসলিম সম্প্রদায়ের মধ্যে ব্যাপক হারে সহিংসতা বৃদ্ধি পাচ্ছিল। কিন্তু মনে রাখতে হবে, বিভাজন কেবল গল্পের ক্ষুদ্র একটি অংশ মাত্র। অথচ ভাগাভাগির প্রভাব নিয়ে কথা বলতে গেলে বিভিন্ন ক্ষেত্রে অব্যবস্থাপনা এবং এখানকার দেশগুলোর মধ্যে একে অপরের সাথে সহযোগিতার ক্ষেত্রে নেতিবাচক মনোভাবের বিষয়গুলোই হয়ত সবচেয়ে বেশী প্রাধান্য পেতে পারতো।
পরিকল্পনাহীন এক বিভাজন
প্যাট্রিক ফ্রেঞ্চের লিবার্টি অর ডেথ ট্রান্সফার অব পাওয়ার পেপারের উপর ভিত্তি করে হরমাসজি মানেকজি সার্ভাই-এর ভারত বিভাজন: কিংবদন্তি এবং বাস্তবতা বৃত্তির দুটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। প্যাট্রিক ফ্রেঞ্চের লিবার্টি অ্যান্ড ডেথ ডিক্ল্যাসিফাইড ইন্টেলিজেন্স ব্যুরো ফাইলের উপর অনেক বেশি নির্ভর করে এবং ভারত ভাগ: কিংবদন্তি এবং বাস্তবতা সেই সিদ্ধান্তগুলিকে প্রকাশ করে যা জনসংখ্যা বিভাজনের ইতিহাসে সবচেয়ে বড় অব্যবস্থাপনার দিকে পরিচালিত করে। উভয় ক্ষেত্রই ভারতের শেষ ভাইসরয়, লুই মাউন্টব্যাটেন এবং তার সিদ্ধান্তগুলো অনেকবার যাচাই-বাছাই করে। তারা দুটি প্রধান কেন্দ্রবিন্দু চিহ্নিত করে যার ভিত্তিতে দেশ বিভাগের ইতিহাস রচিত হয়।
প্রথমেই স্বাধীনতা দিবসের তারিখ নির্ধারণ করা হয় যার ক্ষেত্রে কোনো পরিকল্পনা বা গবেষনা লেশ ছিল না। তবে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে অক্ষশক্তির বিরুদ্ধে অ্যালাইসের বিজয়ের দুই বছর পরে এটি বেছে নেয়া হয়েছিল। সার্ভাই উল্লেখ করেছেন, মাউন্টব্যাটেনের পূর্বসূরি আর্কিবল্ড ওয়াভেল ভারতীয় উপমহাদেশ থেকে ব্রিটিশদের প্রত্যাহারের জন্য একটি পরিকল্পনা করেছিলেন সতর্কতার সাথে। তবে মাউন্টব্যাটেনের এমন কোনো পরিকল্পনা ছিল না।
এক্ষেত্রে আরো সবচেয়ে হতাশার যে বিষয়টি ছিল তা হচ্ছে যে তিনি ক্ষমতা হস্তান্তর না হওয়া পর্যন্ত দেশভাগের পরিকল্পনার খবর গোপন রাখার সিদ্ধান্ত নেন। এটি গুরুত্বপূর্ণ কারণ উপমহাদেশের বৃহত্তম প্রশাসনিক ইউনিট, সেনাবাহিনীকেও দুটি ভাগে বিভক্ত করা হয়েছিল, যেমনটি পুলিশ এবং অন্যান্য প্রশাসনিক ক্ষমতাগুলিকে বিভক্ত করা হয়। এমনিতেই লক্ষ লক্ষ মানুষের স্থানান্তর একটি বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাড়িয়েছিল। কিন্তু কোনো ধরনের কার্যকর সরকারী একিট কাঠামো ছাড়াই তা একটি রক্তাক্ত নৃশংসতার ধারাবাহিকতায় পরিণত হয়।
ব্যবস্থাপনার ইতিহাস বুঝতে পারাটা কেন গুরুত্বপূর্ণ নদীর সুরক্ষাতে
দেশভাগের প্রেক্ষাপট আমাদের জন্য অনুধাবন করা বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ কারণ এর মধ্য দিয়েই দক্ষিণ এশিয়ার ভবিষ্যতের একটি ধারণা পাওয়া যেতে পারে। ১০৪৭ সালের আগস্টের পর দক্ষিণ এশিয়া যা শিখেছে তা হল বিভাজন সর্বদাই সহিংসতার পথে পরিচালিত হয়। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশ পাকিস্তান থেকে বিচ্ছিন্ন হবার সময় সেই শিক্ষার পূনরাবৃত্তি ঘটে।
ভারতীয় উপমহাদেশের এই তিন দেশের ইতিহাসের পথপরিক্রমায় একটি ধারণা আমাদের মধ্যে আরো জোরদার হয়েছে যা আমাদের এখন ভাবতে শিখিয়েছে যে পারস্পরিক সহযোগিতা ছাড়া শাসনব্যবস্থা বা অন্যান্য সংশ্লিষ্ট ব্যবস্থাপনা এক পর্যায়ে ভেঙ্গে পড়ে, ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়।
বর্তমানে চলমান ব্যবস্থাপনার কারনে সম্পদের বন্টন হয় বহুজনে, এবং প্রায়ই পারস্পরিক প্রতিকূল, আইনি এবং প্রশাসনিক ইউনিটগুলির মধ্যে ব্যবস্থাপনার বিষয়ে সিদ্ধান্তের ভিন্নতা এবং মতবিরোধ বিভক্ত হিসাবে দেখে। এই অঞ্চলে নদীগুলো কীভাবে পরিচালনা করা হয় তাও ব্যবস্থাপনার এই দৃষ্টিকোণ থেকেই লক্ষ্য করা যায়। ভারতে, উদাহরণস্বরূপ, আমরা কাবেরী নদী দেখেছি। এটি আজ পর্যন্ত একটি বিতর্কিত নদী হিসেবেই থেকে গেছে। কর্ণাটক ও তামিলনাড়ু রাজ্য দু’টি এর পানির ভাগাভাগি নিয়ে দ্বন্দ্বে জর্জরিত দিনের পর দিন। পাঞ্জাব ও হরিয়ানায়ও পানির অধিকারের লড়াই চলছে।
২০১৭ সালের মার্চে উত্তরাখণ্ড হাইকোর্ট নদীকে একটি আইনি অধিকার দেয়ার পরে, উত্তরাখণ্ড রাজ্য সরকার সুপ্রিম কোর্টে একটি বিশেষ ছুটির আবেদন দাখিল করে, যা এটিকে অবাস্তব করে তুলেছিল। উত্তরাখণ্ডের মুখ্য সচিব – রাজ্যের সর্বোচ্চ প্রশাসনিক আধিকারিক – গঙ্গা ও যমুনার ‘আইনি অভিভাবক’ হতে অপারগতা প্রকাশ করে কারণ এই নদীগুলো বিভিন্ন রাজ্যের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হয়।
তবে কেবল সীমানার ভিত্তিতে নদী ও জৈব অঞ্চলের বিভাজন শুধু যে ভারতেই ঘটেছে তা নয়। ১৯৯১ সালের মার্চ মাসে, পাকিস্তানের পাঞ্জাব, সিন্ধু, খাইবার পাখতুনখোয়া এবং বেলুচিস্তান মিলে পানি বন্টনের ক্ষেত্রে পানির ঐতিহাসিক ব্যবহারের উপর ভিত্তি করে একটি চুক্তি স্বাক্ষর করে। তবে সবচেয়ে নেতিবাচক বিষয়টি হচ্ছে নদী বা পানি নিয়ে সৃষ্ট সমস্যার সুষ্ঠূ সমাধানের পথে না হেঁটে রাজ্যগুলো পানির মালিকানা আর বন্টন নিয়ে বিরোধ চালিয়েই যাচ্ছে। সিন্ধু অববাহিকা ইতিমধ্যেই চীন, ভারত, পাকিস্তান ও আফগানিস্তানের মধ্যে বিভক্ত। এই নদীর দেখাশুনার দায়িত্ব যেমন কেউ নেয় না, তেমনি নদীটির ব্যবস্থাপনাসহ এর স্বাস্থ্য সুরক্ষারও দায় যেন কারো নয়।
জৈব অঞ্চলের ধারণাকে পাশ কাটিয়ে কেবল সীমানাভিত্তিক ব্যবস্থাপনার ফলে এখানকার সামগ্রীক জীববৈচিত্র্য দূর্বল থেকে আরো দূর্বলতর হতে থাকবে
আসলে এই অঞ্চলের পূর্ব দিকেও একই ধরনের নেতিবাচক চিত্রই বর্তমান। প্রতি বছর জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে এই সমগ্র অঞ্চলে বন্যার প্রকোপ ও শক্তি আর এখানকার দেশগুলো যেমন নেপাল, ভারত, বাংলাদেশ এমনকি ভুটানও নিজেদের ক্ষয়ক্ষতির কারনে এক ধরনের অন্যকে দায়ী করার প্রবনতায় মেতে উঠেছে। আর মধ্যে পুরোটা সময় তারা চীনের দিকে তাকিয়ে থাকে যেখানে ব্রহ্মপুত্র (বা ইয়ারলুং সাংপো) জন্ম নিয়েছে। অথচ দেশটি থেকে দক্ষিণের প্রতিবেশীদের কাছে নিতান্ত সামান্য তথ্য পাওয়া যায়।
সীমান্ত নয়, জৈব অঞ্চল
বায়ো-জোন ধারণার পরিবর্তে কেবল সীমান্ত ভিত্তিক ব্যবস্থাপনার ফলে এখানকার জীববৈচিত্র্যের সুরক্ষার বিষয়টি চাপা পড়ে যাচ্ছে ক্রমাগত। ইলিশ মাছ পাকিস্তান এবং ভারতের বেশিরভাগ অংশ থেকেই এখন বিলুপ্ত হয়ে গেছে কারণ বিশেষ এই মাছটি নদীতে যে ধরনের জীববৈচিত্র্যের উপর নির্ভল করে তা ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে গেছে। বিশেষ এই মাছটি এখন শুধু বলতে গেলে বাংলাদেশের মধ্যেই সীমাবদ্ধ। ভারত ও নেপাল একটি স্লোথ বিয়ারের (ভালুক) জাতীয়তা নিয়ে যেসময় একে অন্যের সাথে টাগ অব ওয়ারে লীপ্ত, আর অন্যদিকে সুস্থ ইয়াকের জনসংখ্যা এখন শুধুমাত্র তিব্বতেই পাওয়া যাচ্ছে।
মূলত, যে দেশগুলো ভবিষ্যত হিন্দুকুশ হিমালয় অঞ্চল এবং সেখানে উৎপন্ন আন্তঃসীমান্ত নদীগুলির সাথে আবদ্ধ তারা পাহাড়ে কী ঘটছে সে সম্পর্কে খুব বেশি কিছু জানে না। উত্তর ও দক্ষিণ মেরুর পরে বরফের সর্বাধিক ঘনত্বের সাথে, বিশ্বের ছাদ হিসাবে পরিচিত এই অঞ্চলটি বিতর্কিত সীমানা দ্বারা ঘেরা, এমনকি সিয়াচেনের মতো হিমবাহে সৈন্য মোতায়েন রয়েছে (যেখানে সেনাবাহিনী বেশি জলবায়ু-সহনশীল) তাদের শত্রুদের চেয়ে) বেশি প্রাণ হারিয়েছে)। জলবায়ু পরিবর্তন সংক্রান্ত আন্তঃসরকার প্যানেলের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, জাতীয় নিরাপত্তার আবরণ হিমালয় অঞ্চলকে ‘হোয়াইট হোল’ বানিয়েছে।
দেশভাগের ভয়াবহতা দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোকে বিপর্যয়ের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ পাঠ শেখাতে ব্যর্থ হয়েছে তা হচ্ছে পারস্পরিক সহযোগিতাই এখানকার দূর্দশা এড়ানোর একমাত্র উপায়। জলবায়ু সংকট এখন দক্ষিণ এশিয়ায় ক্রমবর্ধমান হওয়ার সাথে সাথে – বন্যা, খরা, পঙ্গপালের প্লেগ, হারিকেন এবং অন্যান্য বিপর্যয় – বর্তমানে দক্ষিণ এশিয়ায় পারস্পরিক সহযোগিতার খুব একটা প্রমাণ নেই যা সীমান্তের ওপারের মানুষকে নদী এবং বাস্তুতন্ত্র রক্ষা করতে সহায়তা করতে পারে। আমরা সবাই এই নদী এবং তাদের বাস্তুতন্ত্রের উপর নির্ভরশীল।शेयर