অভিযোগ রয়েছে বাংলাদেশে চীনের সহায়তায় একটি কয়লা-নির্ভর বিদ্যুত কেন্দ্র স্থাপন করতে গিয়ে নিজেদের জমি থেকে উচ্ছেদ করা হচ্ছে স্থানীয় অধিবাসীদের। আর সেই সঙ্গে দেদারসে দখল করা হচ্ছে নদী। বিদ্যুত কেন্দ্রটি নির্মানের বিরুদ্ধে স্থানীয় জনগণসহ সরকারের নিজস্ব সংস্থা জাতীয় নদী রক্ষা কমিশনের রয়েছে প্রবল আপত্তি। কমিশন এরই মধ্যে স্থানীয় প্রশাসনকে নির্মাণাধীন বিদ্যুত কেন্দ্রটি যেই প্লটে নির্মিত হচ্ছে সেখান থেকে অন্যত্র সরিয়ে দেয়ার নির্দেশ দিয়েছে। অথচ এর কোনো কিছুই তোয়াক্কা না করে চলছে এর নির্মান কাজ।
বাংলাদেশের উপকূলীয় জেলা বরগুনার তালতলী উপজেলার খোট্টার চরে বরিশাল ইলেকট্রিক পাওয়ার কোম্পানী লিমিটেড (বিইপিসিএল) ২০১৭ সালে একটি ৩০৭ মেগাওয়াট উৎপাদন ক্ষমতাসম্পন্ন বিদ্যুত কেন্দ্র নির্মানের কাজ শুরু করে। বিইপিসিএল হচ্ছে চীনের রাষ্ট্রায়ত্ব কোম্পানী পাওয়ার চায়না এবং বাংলাদেশের আইএসও টেক ইলেকট্রিক কোম্পানী লিমিটেড-এর একটি যৌথ উদ্যোগ যার ৯৬ শতাংশ শেয়ারের মালিক পাওয়ার চায়না।
বিদ্যুত কেন্দ্রটি নির্মান করা হচ্ছে একেবারে পায়রা নদীর পাড়ে। এই নদীটি বাংলাদেশের জাতীয় মাছ ইলিশের একটি গুরুত্বপূর্ণ বিচরণ ক্ষেত্র। নির্মাণাধীন বিদ্যুত কেন্দ্রের খুব কাছেই রয়েছে ইলিশের একটি অভয়াশ্রম। ভূয়া দলিলপত্র দেখিয়ে নিজেদের বসতভিটা উৎখাত করা হয়েছে বলে ২০১৭ সাল থেকে সেখানকার উল্লেখযোগ্য সংখ্যক কিছু বাসিন্দা অভিযোগ জানিয়ে আসছেন।
২০২০ সালের ২৮ সেপ্টেম্বর জাতীয় নদী রক্ষা কমিশনের চেয়ারম্যান মোহাম্মদ মুজিবুর রহমান হাওলাদার জেলা প্রশাসনের সর্বোচ্চ দায়িত্বশীল কর্মকর্তাকে নদীর পাড়ে যেখানে বিদ্যুত কেন্দ্রটি নির্মান করা হচ্ছে সেখান থেকে অবিলম্বে অন্যত্র সরিয়ে নেয়ার আদেশ দেন। সংবাদ মাধ্যমের খবর অনুযায়ী এই আদেশের কারন অবৈধভাবে নদীর জায়গা দখল করে বিদ্যুত কেন্দ্র নির্মাণ।
কমিশনের চেয়ারম্যান মুজিবুর রহমান হাওয়লাদার একইসাথে জমির ব্যক্তিগত মালিকানা নিয়েও নির্দেশনা দিয়েছেন। ওই কোম্পানীর নামে জমির মালিকানা থাকলে তিনি তা বাতিলের আদেশ দেন। এমনকি নদীর জমি কারো ব্যক্তিগত সম্পত্তি হিসেবে নথিভূক্ত আছে কিনা তা যাচাই এবং বাতিলের জন্যেও জেলা প্রশসানকে নির্দেশনা প্রদান করেন কমিশন চেয়ারম্যান।
বাংলাদেশ পরিবেশ সংরক্ষণ অ্যাক্ট ২০১০ (সংশোধনী) অনুযায়ী নদী দখল বা জায়গা ভরাট করে নদীর পানির প্রবাহ বন্ধ করে কোনো ভাবেই কোনো ধরনের অবকাঠামো নির্মান করা যাবে না। বরগুনায় যে স্থানে বিদ্যুত কেন্দ্রটি নির্মাণ করা হচ্ছে তা একেবারেই একটি উপকূলীয় এলাকা, যেখানে পায়রাসহ অন্যান্য কয়েকটি নদী জোয়ারের সময় প্রসারিত হয়।
জমি দখলের অভিযোগ
বিদ্যুত কেন্দ্রটি সম্পূর্ণরুপে চালু করতে প্রয়োজন ১২৫ হেক্টর জমি যার মধ্যে এখন পর্যন্ত ৬৩ হেক্টর জমি অধিগ্রহন করা হয়েছে। সংবাদ মাধ্যমের তথ্য অনুযায়ী অধিগ্রহনকৃত জমির বাসিন্দাদের কোনো রকম আগাম নোটিশ বা ক্ষতিপূরণ ছাড়াই সেখান থেকে উচ্ছেদ করা হয়। উচ্ছেদকৃত বাসিন্দাদের মধ্যে রয়েছে বাংলাদেশের আদিবাসী রাখাইন সম্প্রদায়ের একটি অংশ।
বাংলাদেশ ওয়ার্কিং গ্রুপ অন এক্সটার্নাল ডেব্ট (বিডব্লিউজিইডি) নামে একটি বেসরকারী সংস্থা পরিচালিত গবেষনায় বলা হয়েছে ওই বিদ্যুত কেন্দ্র নির্মানের ফলে ১৫৩টি পরিবার সরাসরি ক্ষতিগ্রস্থ্য হয়েছে। এদের মধ্যে ১৪২টি পরিবারকে জোরপূর্বক উচ্ছেদ করা হয়।
উচ্ছেদকৃতদের মধ্যে তেমনই একজন বাবিন্দার নাম জসিম খলিফা (৩৮)। বিদ্যুত কেন্দ্র যেখানে নির্মান করা হচ্ছে সেখানে তার এক একর জমি ছিল। ওই জমিতে তিনি পরিবার নিয়ে বসবাস করার পাশাপাশি সব্জির চাষ করতেন। দ্য থার্ড পোলকে তিনি বলেন, ক্ষতিপূরণ হিসেবে আইএসও টেক আমাকে ১৫০,০০০ টাকা দিয়েছে। কিন্তু আমার কাছ থেকে অধিগ্রহন করা সম্পত্তির মূল্যের তুলনায় এই অর্থ একেবারেই নগন্য। জসিম খলিফা এখন মাছ ধরে কোনো রকমে জীবিকা নির্বাহ করেন।
একই ধরনের অভিযোগ করেন উচ্ছেদ হওয়া আরো অনেকেই। ।
বরগুনা জেলা প্রশাসক হাবিবুর রহমান বলেন, আসলে বাসিন্দাদের কাছ থেকে জমি কিনে নিয়ে সেই জমিতে বিদ্যুত কেন্দ্রটি নির্মাণ করা হচ্ছে। সেই কারনে আমরা উচ্ছেদ হওয়া বাসিন্দাদের ক্ষতিপূরনের বিষয়ে খুব একটা কিছু করতে পারছি না। এটি যদি সরকারীভাবে অধিকৃত জমি হতো (সরকার বিভিন্ন প্রকল্প বাস্তায়নের জন্য যে প্রক্রিয়ায় জমি অধিগ্রহন করে থাকে), তাহলে আমরা জোর ব্যবস্থা গ্রহন করতে পারতাম।
নদী রক্ষা কমিশনের নির্দেশনার ব্যাপারে জানতে চাইলে এমন কোনো নির্দেশনা পাননি বলে জানান জেলা প্রশাসক । তিনি বলেন, আমরা এনআরসিসির কাছ থেকে কোনো ধরনের নির্দেশনা পাইনি। নির্দেশনা পেলে অবশ্যই আমরা তা বাস্তবায়ন করতাম।
দ্য থার্ড পোলের এই প্রতিনিধি বিষয়গুলো নিয়ে কথা বলার জন্য টেলিফোনে একাধিকবার আইএসও টেক এবং পাওয়ারচায়না প্রতিষ্ঠান দুটির কার্যালয়ে যোগাযোগ করেন। তবে এ ব্যাপারে কথা বলার জন্য প্রতিষ্ঠান দুটির কাউকেই পাওয়া যায়নি। প্রতিষ্ঠান দুটির ঢাকাস্থ্য কার্যালয়ে উপস্থিত হয়ে কথা বলতে চাইলে দায়িত্বরত সিকিউরিটি গার্ড এই প্রতিনিধিকে কার্যালয়ে প্রবেশে বাঁধা প্রদান করে। সবশেষে স্থানীয় অধিবাসীদের অভিযোগ, এনআরসিসির নির্দেশনা এবং বিডব্লিউজিইডির গবেষণার বিষয়গুলো নিয়ে জানতে এই প্রতিনিধি গত ৮ এপ্রিল প্রতিষ্ঠান দুটির ওয়েবসাইটে দেয়া ঠিকানায় একটি ই-মেইল পাঠায়। এই প্রতিবেদন প্রকাশ হওয়ার সময় পর্যন্ত সেই ই-মেইলের কোনো জবাব পাওয়া যায়নি। ইমেইলের জবাব পাওয়ার পর এই প্রতিবেদনটিতে তা সংযুক্ত করা হবে।
কয়লা-নির্ভর বিদ্যুত উৎপাদনের প্রক্রিয়া বন্ধ হচ্ছে?
পাওয়ার চায়না রিসোর্সেস লিমিটেড এর তথ্য অনুযায়ি এই প্রকল্পটি চীনের অর্থায়নে বাংলাদেশে প্রথম স্বাধীন একটি কয়লা নির্ভর বিদ্যুত কেন্দ্র (সরকারী মালিকানাধীন নয়)। তাদের তথ্য অনুযায়ী এই প্রকল্পটি বাস্তবায়ন সম্পন্ন হলে বাংলাদেশে বিদ্যুত ঘাটতি পূরণ করা সম্ভব হবে।
বাংলাদেশ সরকারের পাওয়ার ডিভিশনের তথ্য অনুযায়ী দেশের ৯৪ শতাংশ মানুষ এখন বিদ্যুত সংযোগের আওতায় রয়েছে। দেশে এখন দৈনিক ১০,০০০ মেগাওয়াট বিদ্যুত উৎপন্ন হচ্ছে। এরই মধ্যে দেশে বেশ কয়েকটি কয়লা-নির্ভর বিদ্যুত কেন্দ্র বন্ধ করা হয়েছে। নির্মাণ কাজ শুরু হয়ে যাওয়ায় মাত্র পাঁচটি কেন্দ্র স্থাপনের অনুমতি দেয়া হয়েছে। এদের মধ্যে একটি হচ্ছে বিইপিসিএল।
চীনের অর্থায়নে নির্মিত আরো একটি বিদ্যুত প্রকল্প নিয়ে সাম্প্রতিক সময়ে দেশে সমালোচনার ঝড় সৃষ্টি হয়। গত ১৭ এপ্রিল চট্টগ্রামে নির্মাণাধীন ওই প্রকল্পে ব্যাপক সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম নগরী চট্টগ্রামের ওই বিদ্যুত প্রকল্পে সেদিন মজুরী দিতে দেরী হওয়া এবং শ্রম অধিকার পুরোপুরি বাস্তাবায়ন না করায় শ্রমিকরা বিক্ষোভ পালন করছিল।
সংবাদ মাধ্যমের খবর অনুযায়ী সংঘর্ষের সময় পুলিশের গুলিতে কমপক্ষে পাঁচ জন শ্রমিক নিহত হয়। কর্তৃপক্ষের দাবী এসময় শ্রমিকরা বিদ্যুত কেন্দ্রের একটি অংশে আগুন জ্বালিয়ে দেয়। এর আগে বিদ্যুত কেন্দ্রটি নির্মানের শুরুর দিকেও অপর এক বিক্ষোভের সময় চার শ্রমিক নিহত হয়।
কয়লা-নির্ভর বিদ্যুত কেন্দ্র ও পরিবেশের ক্ষতির আশংকা
বিডব্লিউজিইডি-এর গবেষণা অনুযায়ী তালতলীতে বিইপিসিএল বিদ্যুত কেন্দ্রটি পুরোপুরি চালু হলে এর থেকে প্রতিদিন ৭,০৮১ টন কার্বন নির্গমন হবে। এর ফলে পার্শ¦বর্তী বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ প্রতিবেশ মারাত্বক হুমকির মধ্যে পড়বে বলে মনে করা হচ্ছে। এর মধ্যে রয়েছে টেংরাগিরি বন্যপ্রানী অভ্যয়ারণ্য, সোনাকাটা ইকো পার্ক, লালদিয়া ম্যানগ্রোভ বনাঞ্চল এবং ফাঁতরার চর ম্যানগ্রোভ বনাঞ্চল।
গবেষণায় উদ্বেগ প্রকাশ করে বলা হয় বিদ্যুত কেন্দ্রটি চালুর পরে সেখান থেকে উৎপন্ন উত্তপ্ত পানি পায়রা নদীতে ফেলা হলে ইলিশের উৎপাদন মারাত্বকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে। এছাড়া এই কেন্দ্রের জন্য প্রয়োজনীয় কয়লা বার্জের মাধ্যমে আনা নেয়া করা হবে যা কেন্দ্রের পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া নদীর মধ্য দিয়েই চলাচল করবে। এর মাধ্যমে ইলিশের বিচরণ মারাত্বকভাবে বিঘিœত হবে।
বাংলাদেশীদের কাছে ইলিশ মাছ কেবল সুস্বাদু মাছই নয়, এটি দেশের অর্থনীতির জন্যও একটি বড় নিয়ামক। প্রতিবছর ইলিশ বিদেশে রপ্তানীর মাধ্যমে বাংলাদেশ প্রচুর পরিমানে বৈদেশিক মুদ্রা আয় করে থাকে। প্রায় দশ লক্ষ মৎসজীবির জীবন-জীবিকা এই ইলিশ মাছের আহরণের উপরে নির্ভর করে।
বাংলাদেশ এনভায়রণমেন্টাল লয়ার্স অ্যাসোসিয়েশন এর প্রধান নির্বাহী সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান বলেন, দেশের প্রচলিত আইন অনুযায়ী কেবলমাত্র রাষ্ট্রীয় বিশেষ প্রয়োজন ব্যতিরেকে মাটি বা অন্য কিছুর মাধ্যমে ভরাট করে কোনো ভাবেই জলাশয় বা জলাধারের স্বাভাবিক পরিবেশ পরিবর্তন করা যাবেনা। তিনি বলেন, আমরা সরকারী তথ্যসহ আরো অনেক সূত্রে জানতে পেরেছি যে বর্তমানে সরকারের বিদ্যুত উৎপাদন পরিকল্পনা অনুযায়ী খুব অল্প সময়ের ভিতরে দেশে সার্বিক চাহিদা পূরনের পরেও অতিরিক্ত থাকবে বিদ্যুত উৎপাদন। যদি তাই হয়ে থাকে তবে দেশের ভূমির ধরণ পরির্বতন করে কোনো বিদ্যুত কেন্দ্র চালুর কোনো প্রয়োজনই নেই, একথা সহজেই বলা যায়।