বসতবাড়ি হারিয়ে ১০০ বর্গফুটের কম আকৃতির সরকারি আশ্রয়কেন্দ্রে বসবাসকারী আবদুস সাত্তারের কন্ঠে আক্ষেপ: ৩৫ বছর আগে না বুঝে কেন তিনি গ্রামের অন্যান্যদের সাথে সুর মিলিয়ে বড়পুকুরিয়া এলাকায় কয়লা খনি করতে সরকারের কাছে দাবি জানিয়েছিলেন!
তিনি দ্য থার্ড পোলকে বলেন, “এরশাদ [বাংলাদেশের সাবেক সৈরশাসক হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদ] হেলিকপ্টারে করে এখানে আসলো। সে আমাদের বলল, ‘তোমরা তোমাদের জমি চাও, নাকি কয়লা খনি চাও?’ আমরা সবাই একসাথে বললাম, ‘কয়লা খনি’। এরশাদ এক খোঁচায় কয়লা খনি করে ফেললো। আর আমাদের বাড়ি চলে গেল! আগে জানলে কখনও কয়লা খনি চাইতাম না।”
৭৫ বছর বয়সী তিন পুত্রের জনক আব্দুস সাত্তার বলেন, “আমরা ভেবেছিলাম কয়লা খনি আমাদের কাজের সুযোগ এনে দেবে। কিন্তু এই খনি কাজও দিলো না, আবার ঘরবাড়িও কেড়ে নিলো।”
২০০৫ সালে দিনাজপুর জেলার বড়পুকুরিয়া এলাকায় বাংলাদেশের একমাত্র কয়লা খনিটি বাণিজ্যিক উৎপাদনে গেলে শুরু হয় ভূকম্পন। খনি এলাকার আশেপাশে ভূমি দেবে জলাশয়ে পরিণত হয়েছে বেশ কিছু গ্রাম। এর মধ্যে সাত্তারের পাতিগ্রামও পানিতে তলিয়ে গেছে।
তিনি বলেন, “পাতিগ্রামে আমাদের বাড়িতে সবাই একসাথে থাকতাম। আশে পাশে কৃষিকাজ করতাম। ২০১৪ সাল থেকে পুরো গ্রামের বাড়ি ঘর কাঁপতে থাকে। ফাটল ধরে। আমরা বাড়ি ছাড়তে চাইনি। ২০১৫ সালে সরকার থেকে বললো বাড়ি না ছাড়লে পানিতে ডুবে যাবে। এরপর প্রাণ ভয়ে চলে এসেছি।“
সাত্তার বলেন, “এখন এই আবাসনে (প্রকল্পে) একটি ছোট ঘরের মধ্যে তিন ছেলে, ছেলের বৌ, নাতি, নাতনি নিয়ে থাকি। এখানে কোন কাজ নাই।“ তিনি বলেন, “সরকার দুই লাখ টাকার কিছু বেশি ক্ষতিপুরণ হিসেবে দিয়েছে। কিন্তু নগদ টাকা থাকে না। এখন সব শেষ।“
স্থানীয় জনগনের দাবী কয়লা খনি এবং সংলগ্ন কয়লা বিদ্যুৎ কেন্দ্রটি থেকে আশাপাশের এলাকার নদী এবং অন্যান্য জলাশয় দূষিত হচ্ছে। এর ফলে ভূগর্ভস্থ পানির ঘাটতি সৃষ্টি হচ্ছে এবং বিদ্যুত কেন্দ্রের শ্রমিক, এলাকার বাসিন্দা এবং কৃষি জমির ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হচ্ছে।
বড়পুকুরিয়া কয়লা খনি থেকে কৃষির উপর যে প্রভাব পড়েছে সেটি মাথায় রেখে নতুন করে কয়লা খনি চালুর বিষয়ে সরকার এখন নতুন করে ভাবতে শুরু করেছে।
বাংলাদেশে কয়লার ভবিষ্যৎ
এবছর পহেলা নভেম্বর বাংলাদেশের সংসদ সদস্য শিবলী সাদিক জাতীয় সংসদের প্রশ্নোত্তর পর্বে সরকারের জ্বালানী, বিদ্যুৎ ও খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদের কাছে জানতে চান বড়পুকুরিয়া কয়লা খনি সংলগ্ন তাঁর নির্বাচনী এলাকায় অবস্থিত দীঘিপাড়া কয়লা খনি থেকে সরকার কি কয়লা উত্তোলন করবে কি না।
জবাবে বড়পুকুরিয়ায় ভূগর্ভস্থ খনি থেকে কয়লা উত্তোলন কার্যক্রমের কারণে সৃষ্ট বিভিন্ন সমস্যার বর্ণনা দিয়ে নসরুল হামিদ বলেন, বড়পুকুরিয়া এলাকায় টানেল পদ্ধতিতে কয়লা উত্তোলনের ফলে সেখানকার ভূমি কিছুটা দেবে যাচ্ছে এবং সেখানে জলাশয় সৃষ্টি হয়েছে। এতে ফসলাদি, জমি নষ্ট হয়।
নসরুল হামিদ বলেন, মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আমাদেরকে বলেছেন, ভবিষ্যতে যদি এমন কোনো প্রযুক্তি আসে (যার ব্যবহারে) কৃষকের জমি নষ্ট হবে না, (সেক্ষেত্রে) পরিবেশকে মাথায় রেখেই কয়লা উত্তোলন করা যাবে।
নসরুল হামিদ বলেন, “ফুড সিকিউরিটি (খাদ্য নিরাপত্তা) সবার আগে।”
এই প্রশ্নোত্তর পর্ব চলার সময় সংসদে উপস্থিত ছিলেন এই প্রতিবেদক। জাতীয় সংসদে দেয়া প্রতিমন্ত্রীর সেই বক্তব্যের একটি ভিডিও রেকর্ডিং এখানে সংযুক্ত করা হলো।
তবে সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বড়পুকুরিয়া খনির কারণে সৃষ্ট সমস্যা সত্ত্বেও বাংলাদেশে কয়লা খনি থেকে কয়লা উত্তোলন এবং কয়লা বিদ্যুৎ কেন্দ্র বন্ধের আপাত সম্ভাবনা নেই।
সংসদে প্রতিমন্ত্রীর দেয়া উত্তরের পরে বড়পুকুরিয়া কোল মাইনিং কোম্পানি লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. সাইফুল ইসলাম সরকার দ্য থার্ড পোলকে জানান, চীনা কোম্পানি এক্সএমসি-সিএমসি এর সহয়তায় বড়পুকুরিয়া কয়লা খনি থেকে কয়লা উত্তোলন অব্যাহত থাকবে।
২০০৫ সাল থেকে বড়পুকুরিয়া কয়লা খনি চীনের কনসোর্টিয়াম এক্সএমসি-সিএমসি দ্বারা পরিচালিত হচ্ছে। ৫২৫-মেগাওয়াট-ক্ষমতার সম্পন্ন থার্মাল পাওয়ার প্ল্যান্টটি বর্তমানে বাংলাদেশের একমাত্র চলমান বিদ্যুৎ কেন্দ্র। এটি ইন্ডাস্ট্রিয়াল অ্যান্ড কমার্শিয়াল ব্যাংক অব চায়না’র (আইসিবিসি) আংশিক অর্থায়নে পরিচালিত হচ্ছে। এতে তাদের ঋনের পরিমান ২২৪ মিলিয়ন মার্কিন ডলার।
এবছর ডিসেম্বরের শুরু দিকে সাইফুল ইসলাম সরকার দ্য থার্ড পোলকে বলেন, সিএমসি-এক্সএমসি তাদের চুক্তি অনুযায়ি ২০২৭ সাল পর্যন্ত বড়পুকুরিয়ায় কয়লা উত্তোলন চালিয়ে যাবে।
জানতে চাইলে বাংলাদেশ জ্বালানী সংক্রান্ত সংস্থা পেট্রোবাংলার (বড়পুকুরিয়া কোল মাইনিং কোম্পানি লিমিটেড এই সংস্থার সহযোগী) চেয়ারম্যান নাজমুল আহসান ২০২২ সালের নভেম্বরের শেষের দিকে দ্য থার্ড পোলকে বলেন, বাংলাদেশের অন্যান্য কয়লা খনি থেকে কয়লা উত্তোলন শেষ হবে কিনা সে ব্যাপারে তিনি নিশ্চিত নন।
তিনি বলেন, “২০২৭ সালে বড়পুকুরিয়া কয়লা ক্ষেত্র থেকে কয়লা উত্তোলন শেষ হবে। ওখানে আমাদের একটি কয়লা ভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র রয়েছে। বড়পুকুরিয়া খনির কয়লার ওপর নির্ভরশীল এটি। কয়লা উত্তোলন করা না হলে ২০২৭ সালের পরে এই বিদ্যুৎ কেন্দ্রের কি হবে?”
তিনি বলেন, “আমরা [বড়পুকুরিয়ায়] জমি অধিগ্রহণ করেছি। জরিপ ও অন্যান্য প্রাথমিক কাজও পরিচালনা শেষ করেছি। সিদ্ধান্তের জন্য বিষয়টি সরকারের কাছে পাঠিয়েছি। এখন এটি সরকারের বিবেচনার বিষয়।”
বড়পুকুরিয়া কোল মাইনিং কোম্পানি লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. সাইফুল ইসলাম সরকার বলেন, বড়পুকুরিয়া খনি থেকে গড়ে প্রতিদিন ৩,৫০০ মেট্রিক টন কয়লা উৎপন্ন হয়, যার পুরোটাই বিদ্যুৎ কেন্দ্রে বিক্রি করা হয়। সরকারী পরিসংখ্যান অনুসারে, এখান থেকে ২০০৫ সালে থেকে ২০২০ সালের জুন মাস পর্যন্ত ১১.৫ মিলিয়ন মেট্রিক টন কয়লা উত্তোলন করা হয়।
মাটির নিচ থেকে কয়লা খনন করায় দেবে যাচ্ছে কৃষিজমি
বড়পুকুরিয়া এবং ফুলবাড়ির আশেপাশের এলাকাগুলো সমতল, এখানকার জমি অত্যন্ত উর্বর যেখানে প্রচুর পরিমাণে ধান জন্মে।
বড়পুকুরিয়ার একটি খনি বিরোধী প্রচারণা গ্রুপের নেতৃত্বদানকারী মো. মিনজাহুল হক বুলবুল বলেন, “কয়লা উত্তোলনের আগে পেট্রোবাংলা ও চীনা কোম্পানির কর্মকর্তারা স্থানীয় লোকজনের সঙ্গে দফায় দফায় বৈঠক করেন। তারা সেই সময় আমাদের আশ্বস্ত করেছিলেন যে আমাদের মূল্যবান কৃষি জমি এবং বসতবাড়ির কিছুই হবে না।তখন তারা বলেছিল যে তারা মাটির নিচ থেকে কয়লা উত্তোলনের পর বালি দিয়ে তা পূর্ণ করে দিবেন।”
তবে সরকারও এটি স্বীকার করেছে যে খনন শুরু হওয়ার এক বছর পরে ২০০৬ সাল থেকেই এখানকার ভূমিতে নেতিবাচক প্রক্রিয়া শুরু হতে দেখা যায়। তখন থেকেই শত শত হেক্টর জমিতে এর প্রভাব পরিস্কার হতে শুরু করে।
তার মতে, এই প্রকল্পের ফলে আশেপাশের ১৭টি গ্রামের অন্তত ১০,০০০ মানুষ নানাভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
দ্য থার্ড পোলের সাথে কথা বলা স্থানীয় বাসিন্দাদের মতে, কয়লা তোলার জন্য ঘন ঘন ভূগর্ভস্থ বিস্ফোরণের ফলে উপরে থাকা ঘরবাড়ি কেঁপে উঠে।
কয়লা খনি থেকে ৪০০ মিটারেরও কম দূরে অবস্থিত চরপাড়া গ্রামে বসবাসকারী ফেন্সি আরা বলেন, “আমরা অনেক সময় যখন মেঝেতে শুয়ে থাতি তখন মাটিতে কান পাতলে এক ধরনের গুম গুম শব্দ শুনতে পাই, আর তখনই বুঝতে যে মাটির নিচে কিছু একটা হচ্ছে।” চরপাড়াকে ‘নতুন মৌপুকুর’ নামেও উল্লেখ করা হয়, যেখানে একটি গ্রাম তলিয়ে গিয়েছিল।
তিনি বলেন, “আমরা দিনে কমপক্ষে ১০ বার মাটি কম্পন অনুভব করি, এবং কম্পনের কারনে, আমার বাড়িতে ফাটল দেখা দিয়েছে।”
চরপাড়ায় বসবাসকারী সোহানা বেগম বলেন, অন্তত দুই বছর ধরে কম্পন হচ্ছে। “যখন আমি আমার ছেলের সাথে রাতে ঘুমাই এবং মাটি কাঁপতে শুরু করে, অনেক সময় মনে হয় হয়ত আমরা পরের দিন সকালে দেখতে পাব না।”
সরকারের সাবেক জ্বালানী উপদেষ্টা মোহাম্মদ তামিম বলেন, “বাংলাদেশ একটি ব-দ্বীপ এবং এর ভূগর্ভস্থ গঠন [ভূগর্ভস্থ খনির জন্য] যথেষ্ট শক্ত নয়। আমরা একে অসংহত শিলা বলি। ভূগর্ভস্থ খনন যদি এই ধরনের অসংহত শিলার উপর করা হয়, তাহলে অবশ্যই ভূমি হ্রাস পাবে। এটা এড়ানোর কোনো উপায় নেই।
ভূমি হ্রাস এবং ভূমি কাঁপানোর বিষয়ে দ্য থার্ড পোলের এক প্রশ্নের জবাবে বড়পুকুরিয়া কোল মাইনিং কোম্পানি লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সাইফুল ইসলাম সরকার বলেন, এই প্রভাবগুলি আসলে “অনিবার্য” এবং “আমরা যদি কয়লা খনন করতে চাই তবে আমাদের এই ক্ষতিগুলি মেনে নিয়েই কাজ করতে হবে।”
কয়লা উত্তোলনের পর কর্তৃপক্ষ খনিটি বালি দিয়ে ভরাট করার যে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল বলে গ্রামবাসীরা উল্লেখ করছেন সে বিষয়ে তিনি বলেন, “এটা সম্ভব নয়… আমরা [এত] বালি কোথায় পাব?”
পানির অভাব আর দূষণের অভিযোগ গ্রামবাসীর
স্থানীয় কর্মী বুলবুল বলেন, কয়লা কেন্দ্রের উত্তর ও পশ্চিমে অন্তত নয়টি গ্রামে ভয়াবহ পানি সংকট দেখা দিয়েছে।
প্ল্যান্টের পশ্চিমে দুঘিপুকুর গ্রামের বাসিন্দা মোক্তার আলী দ্য থার্ড পোলকে বলেন, কয়লা খনি ও বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের আগে মানুষ প্রচলিত অগভীর নলকূপের মাধ্যমে পানি পেতে পারত, যেগুলো প্রায় ৬০ ফুট গভীর।
“এখন সব নলকূপই অকেজো হয়ে গেছে। এখন, আমাদের ১৫০ – ১৬০ ফুট গভীর থেকে পানি পেতে সাবমার্সিবল গভীর নলকূপ স্থাপন করতে হয়। সাবমার্সিবল পাম্পগুলি ব্যয়বহুল। সবাই এর ব্যয়ভার বহন করতে পারে না।”
আলী বলেন, “পুরো এলাকায় আমরা বিশাল পানি সংকটের সম্মুখীন হচ্ছি।
খনি এবং বিদ্যুৎ কেন্দ্র উভয়েরই কাজ করার জন্য প্রচুর পরিমাণে পানির প্রয়োজন হয়। সরকারের বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের মালিকানাধীন বিদ্যুৎ কেন্দ্রের আশেপাশে বিশটি গভীর নলকূপ স্থাপন করা হয়েছে।
তারপর খনি এবং বিদ্যুৎ কেন্দ্র উভয়ের দূষণের বিষয়টি রয়েছে।
“আমরা এই গ্রামের [ভূগর্ভস্থ] পানি পান করতে পারি না; এটা কেরোসিনের মতো গন্ধ,” চরপাড়ায় বসবাসকারী মঞ্জু আরা বলেন।
একইভাবে, ফুলবাড়ীর রামভদ্রপুর গ্রামের বাসিন্দা মোঃ মেলাই দ্য থার্ড পোলকে বলেন যে ২০০৬-এর পর – যখন বিদ্যুৎ কেন্দ্রটি বিদ্যুৎ উৎপাদন শুরু করে – তখন থেকে কাছের তিলাই নদীর মাছ এবং পানিতে কেরোসিনের গন্ধ পেতে শুরু করে।
বড়পুকুরিয়া কয়লা খনি থেকে এক ধরনের বর্জ্য তৈরি হয় যা পানি আর সেই বর্জ্যের মিশ্রণ। কিন্তু এটি পরিশোধন আর নিরাপদ করার মতো ব্যবস্থা এখানে নেই। সরেজমিনে এই এলাকা পরিদর্শনের সময় এই প্রতিবেদক প্ল্যান্ট থেকে কালো বর্জ্য বের হয়ে স্থানীয় জলাশয়ে গিয়ে মিশতে দেখেন।
সাবেক জ্বালানি উপদেষ্টা তামিম জানান যে বড়পুকুরিয়া কয়লা খনি থেকে কয়লা পলিযুক্ত পানি বের হবার বিষয়ে তিনি অবগত আছেন।
“কয়লায় বিভিন্ন ধরনের ভারী ধাতুর মিশ্রন রয়েছে। কয়লার বর্জ্য পানি আর পরিবেশে কী ধরনের দূষণ ঘটাচ্ছে তা দেখার জন্য আমাদের একটি গবেষণা করে দেখতে হবে। যদি পানি দীর্ঘ সময়ের জন্য চাষের জমিতে ফেলে দেয়া হয়, তাহলে ভারী ধাতুগুলি খাদ্য শৃঙ্খলে চলে যাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে,” দ্য থার্ড পোলের কাছে এ মন্তব্য করেন সাবেক জ্বালানী উপদেষ্টা তামিম।
“কয়লার বর্জ্য পানি, খাল, চাষের জমি এবং নদীতে যায়,” সাইফুল ইসলাম সরকার বলেন। “আমরা এটিকে পরিবেশে ছেড়ে দেওয়ার আগে, আংশিকভাবে ভূগর্ভস্থ বর্জ্য থেকে তরলকে আলাদা করি। কিন্তু কয়লার বর্জ্য বা পানি পরিবেশকে দূষিত করে না। এতে খুশি স্থানীয় মানুষজন। তারা কয়লার পলি সংগ্রহ করে জ্বালানি হিসেবে বিক্রি করতে পারে।”
তিনি আরও বলেন, “কয়লার বর্জ্য থেকে তরলকে পুরোপুরি পৃথক করা সম্ভব নয়, এর জন্য প্রয়োজন বিশাল বিনিয়োগ।”
কৃষি ও স্বাস্থ্যের ক্ষতি
একটি খাল বিদ্যুৎ কেন্দ্রটিকে তিলাই নদীর সাথে সংযুক্ত করেছে। এই খালটি মাহালিপাড়া গ্রামের কাছে নদীতে কালো পানি বয়ে নিয় যায়। নদীটি এলাকার ধান ক্ষেতে সেচের জন্য ব্যবহৃত হয়।
“তারা গত ৮ – ১০ বছর যাবত কালাে পানি ফেলছে। ধানের চাষ কমে গেছে, ফল ও সবজির উৎপাদন কমে গেছে,” মাহালিপাড়া গ্রামের সাঁওতাল আদিবাসী সম্প্রদায়ের সদস্য জাকার মারদি দ্য থার্ড পোলকে জানান। মারদি আরও বলেন, নদীতে বর্জ্য পানি প্রবাহিত হওয়ার কারণে প্রায় কোনো মাছই ধরা পড়ে না।
“নদীর উজানে আমরা মাছ পাই… আমরা স্নান করতে পারি এবং কাপড় ধুতে পারি। কিন্তু ভাটির দিকে পানিতে কেরোসিনের মতো গন্ধ পাওয়া যায়; মাঝে মাঝে আমরা মরা মাছও দেখি,” মারদি বলেন।
মাহালিপাড়ায় বসবাসকারী তার ৫০ বছর বয়সী বিধবা মার্টিনা সোরেন বলেন, “যেখান থেকে কালো পানি নদীর সঙ্গে মিশে যায় ঠিক সেখানে আমরা নদীতে গোসল করতে পারি না৷
এ ব্যাপারে সাবেক জ্বালানী উপদেষ্টা তামিম বলেন, থার্মাল প্ল্যান্ট থেকে দূষিত পানি ফেলায় তিনি বিস্মিত। “থার্মাল প্ল্যান্টের পানি মূলত বাষ্প তৈরি এবং শীতল করার জন্য ব্যবহৃত হয়। পানি পরিষ্কার হওয়া উচিত,” তিনি বলেছিলেন। তিনি বলেন, খনি থেকে কয়লার বর্জ্য বিদ্যুৎ কেন্দ্রের মাধ্যমে নদীতে প্রবাহিত হতে পারে।
চলছে বাংলাদেশের কয়লা নিয়ে বিতর্ক
বাংলাদেশে কয়লা খনির ভবিষ্যত নিয়ে নভেম্বরের যে সময়ে সংসদীয় আলোচনা হয় ঠিক তখন দেশটি বিদ্যুত ঘাটতিতে ভুগছিল। বড়পুকুরিয়া বাংলাদেশের পাঁচটি প্রধান চিহ্নিত কয়লাক্ষেত্রের মধ্যে একটি; মাত্র ৬ কিমি দূরে ফুলবাড়ী, একটি বৃহৎ প্রস্তাবিত খোলা-পিট খনির স্থান যেটি ২০২০ সাল থেকে অনেকটা অনিশ্চিত অবস্থায় রয়েছে। দেশে তিনটি নতুন কয়লা বিদ্যুৎ কেন্দ্রের কাজ শেষ হওয়ার পথে, এবং আমদানিকৃত কয়লার দাম বৃদ্ধি পাচ্ছে – এই বাস্তবতায় নসরুল হামিদের কয়লা খনি ব্যবহার নিয়ে সাম্প্রতিক যে বক্তব্য রয়েছে তার সঙ্গে কিছুটা সাংঘর্ষিক হয়ে যাচ্ছে কি না তা নিয়ে ভাবছেন অনেকেই।
গ্রামবাসীরা দ্য থার্ড পোলকে জানিয়েছে যে তারা জ্বালানি মন্ত্রীর বক্তব্যের সাথে অনেকটা একমত হতে পারছেন না। বক্তব্যটি ছিল অনেকটাই এরকম – কৃষি জমির ক্ষতি না করেই কেবল অন্যান্য কয়লা খনিতে কাজ করা যেতে পারে।
“সরকার তাদের প্রতিশ্রুতিগুলি বিভিন্ন সময়ে এতটাই লঙ্ঘন করেছে যে আমরা এখন বিষয়টি বিশ্বাস করতে পারছি না,” সঞ্জিত প্রসাদ গুপ্ত, কয়লা খনির বিরোধী দলের একজন সদস্য এ মন্তব্য করেন।
ইতিমধ্যে, বড়পুকুরিয়ায় কয়লা খনির কাজ অব্যাহত থাকবে ২০২৭ সাল পর্যন্ত। সেই সময় পর্যন্ত ৪.৫ মিলিয়ন মেট্রিক টন কয়লা উত্তোলনের লক্ষ্যমাত্রা রয়েছে সরকারের। সাইফুল ইসলাম সরকার এবছর ডিসেম্বরের মাঝামাঝি সময়ে দ্য থার্ড পোলের সাথে কথা বলার সময় এ তথ্য জানান।
“আমরা ২০২৭ সালের পরেও এখান থেকে আরো কয়লা খনন করা সম্ভব হবে কিনা সেটি আমরা ২০২৪ সাল নাগাদ জানতে পারব,” তিনি বলেন।
তবে একটি বিষয় খূব পরিস্কার: অন্য খনিগুলো থেকে উত্তোলনের ক্ষেত্রে জনসাধারণের নেতিবাচক অবস্থান অত্যন্ত শক্তিশালী হবে। ৭০ বছর বয়সী আবদুল খালেক প্রায় ১০ বছর ধরে বড়পুকুরিয়া খনি ও বিদ্যুৎ কেন্দ্রে কাজ করেন। তিনি জানান এখানে কাজ করতে গিয়ে ছাইয়ের সংস্পর্শে এসে তিনি অন্ধ হয়ে গেছেন এবং তিনি আর কাজ করতে পারবেন না। দ্য থার্ড পোলের প্রতিবেদক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের কাছের গ্রামগুলো পরিদর্শন করার সময় তাদের নিজের চোখেও এক ধরনের জ্বালা-পোড়া অনুভব করেন।
“এই কয়লা খনি এবং তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র আমার এবং এখানকার মানুষের জন্য তেমন কোন মঙ্গল বয়ে আনতে পারেনি। এগুলো মানুষ, কৃষি ও পরিবেশের জন্য ভালো নয়,” বলেন খালেক।