ন্যায়বিচার

বিস্মৃত মানুষ আর মিথ্যা প্রতিশ্রুতি: আসামের নদীভাঙ্গনের গল্প

'স্লো ডিজাস্টার: পলিটিক্যাল ইকোলজি অব হ্যাজার্ডস অ্যান্ড এভরিডে লাইফ ইন দ্য ব্রক্ষ্মপুত্র ভ্যালি, আসাম' বইটিতে লেখা একটি অংশে নদীর উপরে জন্ম নেয়া বিশ্বের সবচেয়ে দ্বীপটিতে (যা চর নামেও পরিচিত) বসবাসরত জনগোষ্ঠী নানা সমস্যার বিষয়গুলো অত্যন্ত চমৎকারভাবে উঠে এসেছে ।
বাংলা
<p>ছবিটিতে দেখা যাচ্ছে ২০১৩ সালের সেপ্টেম্বর মাসে ব্রক্ষ্মপুত্রে সৃষ্ট বন্যার পানিতে নদী তীরবর্তী মাজুলির এই গ্রামটি  একবারেই তলিয়ে গিয়েছিল। গ্রামের ছবি। (ছবি: মিতুল বড়ুয়া)</p>

ছবিটিতে দেখা যাচ্ছে ২০১৩ সালের সেপ্টেম্বর মাসে ব্রক্ষ্মপুত্রে সৃষ্ট বন্যার পানিতে নদী তীরবর্তী মাজুলির এই গ্রামটি  একবারেই তলিয়ে গিয়েছিল। গ্রামের ছবি। (ছবি: মিতুল বড়ুয়া)

উল্লখিত বইটি থেকে নেয়া নিচের এই অংশটিতে আসামে ব্রহ্মপুত্র বিধৌত অঞ্চলে ঘটা নানা ধরনের দুর্যোগের ফলে সৃষ্ট সামাজিক এবংপরিবেশগত প্রভাবগুলোর একটি টিত্র ফুটে উঠেছে। এই অঞ্চলে সৃষ্ট নানা দুর্যোগের কারনগুলোকে চিহ্নিত করার পাশাপাশী এই দুর্যোগের ফলে স্থানীয়ভাবে বসবাসকারী জনগোষ্ঠীর জীবন, জীবিকা এবং প্রতিবেশের উপরে নিত্য-নতুন যে ধরনের প্রভাব পরিলক্ষিত হচ্ছে,  তার একটি বিশ্লেষন তুলে ধরার প্রয়াস চালানো হয়েছে এই লেখাটির মধ্য দিয়ে।

উত্তর-পূর্ব ভারতের অন্যতম রাজ্য আসাম, যা ভারতের অন্যান্য সব রাজ্যগুলোর মধ্যে বন্যা এবং ভাঙ্গনের দিক থেকে সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় রয়েছে। বিংশ শতাব্দীর শেষ অর্ধের পুরো সময়টা জুড়েই ফি বছর বন্যা আর নদীভাঙ্গনের ফলে এই রাজ্যের মোট ভূমির ৭.৫ শতাংশেরও বেশি হারিয়ে গেছে যার আনুমানিক পরিমান প্রায় ৪ বর্গ । এই সময়ের মধ্যে, ২,৫০০-টিরও বেশি গ্রাম ও ১৮টি শহরসহ সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের সাথে যুক্ত এমন অনেক স্থান একেবারেই হারিয়ে গেছে। ফলে ঘরবাড়ি হারিয়ে নিতান্তই বাস্তুহীন হয়ে পড়েছে এখানে যুগ যুগ ধরে বসবাস করে আসা প্রায় লক্ষ লক্ষ অধিবাসী।

এই বইটিতে ব্রহ্মপুত্র নদীর মাঝখানে অবস্থিত বিশ্বের বৃহত্তম চরে পরিচালিত মাঠপর্যায়ের গবেষনার বিভিন্ন দিক তুলে ধরা হয়েছে। ধীরগতির ক্রমবর্ধমান দুর্যোগ, যেমন বন্যা এবং নদী ভাঙ্গনের ফলে এই বিংশ শতাব্দীতে মাজুলির মোট জমির পরিমাণ ১,২৫৫ বর্গ কিমি থেকে প্রায় ৪২১ বর্গ কিলোমিটারে এসে পৌছেছে। এতে প্রায় ১০,০০০ এরও বেশি পরিবার বারংবার গৃহহীন হয়েছে আবার আরো হাজার হাজার মানুষ বেঁচে থাকার তাগিদে আসামের অন্যান্য স্থানে চলে যেতে বাধ্য হয়েছে। মাজুলি, এবং আসামের অন্যান্য স্থানে যে সঙ্কটগুলি দেখা যায় তা মূলত ব্রহ্মপুত্র নদীর চরম অস্থিরতারই বহি:প্রকাশ – বলতে গেলে নদীটির গতিশীলতা এবং দক্ষিন এশিয়ার বর্ষা মৌসুম এবং প্রাকৃতিক অন্যান্য অবস্থার কারনেই  এ ধরনের সংকটগুলাে তৈরি হয়।  কিন্তু সেখানকার সংকটের কারন বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই এই নদীর প্রভাবের চেয়েও মূলত ভারতীয় এই রাজ্যের ভূমিকা প্রনিধানযোগ্য। এই বইটি সংকটের রাজনৈতিক পরিবেশগত প্রক্রিয়ার বিষয়গুলো অত্যন্ত সহজভাবে তুলে ধরেছে।

২০১৩ সালের জানুয়ারীর প্রথম দিকে এখানকার স্থানীয় প্রত্রিক  দৈনিক জন্মভূমিতে  প্রকাশিত একটি নিবন্ধ পড়ার সময় আমি প্রথম মানিক হাজারিকার নাম জানতে পারি। লেখাটিতে মাজুলিতে চলমান নদীভাঙনের প্রভাবে ক্ষতিগ্রস্ত কয়েকটি পরিবারের কথা তুলে ধরা হয় যাদের মধ্যে সালমোড়ার বাসিন্দা মানিক হাজারিকা একজন।

লেখাটি পড়ার পরই আমি পুরো বিষয়টি জানার ব্যাপারে বেশ আগ্রহী হয়ে উঠি। আমার কাছে তখন মনে হয়েছিল ঠিক সেই সময়টিতে কোনোভাবেই নদী ভাঙ্গনের ঘটনা ঘটার কথঅ নয়। তাই পরদিন সকালেই রওনা হলাম দ্বীপের দক্ষিণ প্রান্তে ব্রহ্মপুত্রের তীরে অবস্থিত গ্রাম সালমোরার উদ্দেশ্যে। সেদিন ছিল প্রচণ্ড ঠাণ্ডা, শীতের দিন, পুরো দ্বীপটি ঘন কুয়াশার চাঁদরে ঢাকা। বেড়িবাঁধে দুই ঘন্টা মোটরসাইকেলে যাত্রার পর,পৌছে গেলাম সালমোরা। সেখান পৌছে সোজা চলে গেলাম গাঁওবুড়ার (গ্রাম প্রধান) বাড়িতে। তিনি আমাকে কয়েক কাপ ধোঁয়া ওঠা লাল চা (লাল-সাহ) খাওয়ানোর পাশাপাশি তাদের এলাকার নদী ভাঙ্গনের কথা বলছিলেন। এরপরই আমরা নদীর তীরের দিকে রওনা হলাম।

A ferryboat on a riverbank, whose soil is filled with deep cracks, a sign of erosion
ছবিটি ২০২১ সালের ডিসেম্বরে তোলা। মাজুলির সালমোরার একটি ফেরি ঘাট। সেখানে দেখা যাচ্ছে মাটিতে ফাটলের চিত্র যা আসলে আসন্ন ভা্ঙহনের লক্ষন। (ছবি: মিতুল বড়ুয়া)

আমরা এরপর মানিক হাজারিকার বাড়িতে গেলাম। প্রায় ৮০ বছরের বৃদ্ধ একজন দুর্বল মানুষ হাজারিকা। নিজের বাড়ির বারান্দায় বসে তিনি তাকিয়ে ছিলেন প্রমত্তা ব্রহ্মপুত্রের দিকে।  তার তিন ছেলে বাড়ির পাশেই পারিবারিক খামারে কাজ করত, যা আসলে তাদের বাড়ি ও নদীর মাঝামাঝি একটি বাফারের মতো কাজ করত।

গ্রামের বয়োজ্যেষ্ঠ ওই বৃদ্ধ (গাঁওবুড়া) চলে গেল,দিনের বাকিটা সময় আমি হাজারিকা ও তার ছেলেদের সাথে তাদের গল্প শুনে কাটিয়ে দিলাম। তারা আমাকে বন্যা, নদী ভাঙ্গন, বাস্তুচ্যুতি এবং কীভাবে এই প্রক্রিয়াগুলি ক্রমাগত সালমোরাকে দিন দিন আরো বিপদের মুখে ঠেলে দিচ্ছে সে সম্পর্কে বলছিলেন। পরিবারটি ১১ বছর ধরে কাঠের পাটাতন, টিনের ছাদ এবং বাঁশের দেয়ালে তৈরি মাটির ঘরে বসবাস করেন। কিন্তু এখন তাদের বাড়ির এত কাছে নদী চলে এসেছে যে, যখন তখন তাদের এই বাড়িটি নদী ভাঙ্গনের শিকার হয়ে এই পরিবারটিকে একটি ভয়ংকর অনিশ্চয়তার মুখে ঠেলে দিতে পারে। বৃদ্ধ হতাশায় বলেন, “আমরা কেবল এক একটি দিন পার করছি।”

ঠিক কয়েক সপ্তাহ পর, ফেব্রুয়ারির মাঝামাঝি সময়ে আমি আবার পরিবারের সাথে দেখা করতে যাই আর তখন দেখতে পাই যে তাদের বাড়ি আর চাষের জায়গাটুকু নদী ভাঙ্গনে হারিয়ে গেছে। পাশেই একটি অস্থায়ী তাবু গেড়ে তারা বসবাস করছিল। এর ঠিক এক মাস পর আবারো পরিরবারটি স্থানান্তরিত হয়। এবার তারা আশ্রয় নেয় বাঁধের কাছে – যা কিছুটা উঁচু যায়গা হওয়াতে বাস্তুহারা লোকজন তাকে নিরাপদ মনে করে আশ্রয় নেয়।  পরবর্তী কয়েক মাসের মধ্যে তারা আরও একবার তাদের বাড়ি তৈরি করার চেষ্টা করেছিল। যখন তারা প্রথম এই নতুন জায়গায় আসে তখন সেখানে মাত্র তিন বা চারটি পরিবার বসবাস করত। কিন্তু এক বছরের ব্যবধানে, নদীভাঙনের প্রক্রিয়া অব্যাহত থাকায় সেখানে এখন কয়েক ডজন পরিবার বসবাস করতে শুরু করে।

A muddy river runs past an area of eroded riverbank, with lush forest behind
২০২২ সালের জুলাই মাসে মাজুলির সালমোরায় নদী ভাঙ্গনের চিত্র।  নদী ভাঙ্গন ঠেকাতে সরকারের তৈরি করা যে স্থাপনাটি ছিল সেটিও ক্ষতিগ্রস্ত (ছবি: মিতুল বড়ুয়া)

কথার এক ফাঁকে হাজারিকা বলেন, “আমরা আসলে সবসময়ই যেন অঘোরীদের (যাযাবর) মতো।”  তিনি বলেন,  “আমাদের স্থায়ী বাড়ি নেই, সবসময় এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় চলে যেতে হয়। সরকার আমাদের কথা চিন্তা করে না। আমরা বলতে গেলে একটি বিস্মৃত জনগোষ্ঠী।” তার জীবদ্দশায় হাজারিকা পরিবারকে নিয়ে কমপক্ষে ১২ বার নিজ বাড়ি ছেড়ে স্থানান্তরিত হন। কিন্তু সরকারের কাছ থেকে এনিয়ে কখনও কোনো সহায়তা পেয়েছেন বলে মনে করতে পারেননি হাজারিকা। প্রতিবার বাস্তুচ্যুত হবার সাথে সাথে এই ধরনের পরবারগুলো নিজেদের সম্পদ হারায়, হারায় নিজেদের সামান্য জমির মালিকানা। আর এভাবেই তারা দিনের পর দিন আরো দারিদ্রের দিকে ধাবিত হয়।

আমার সাথে দেখা হবার প্রায় দু্ই বছর পর একদিন রাতে স্ত্রী  ছেলেদের সাথে মাছ ও ভাত দিয়ে রাতের খাবার খেয়ে পরলোক গমন করেন হাজারিক। রাতে খেয়ে বিছানায় ঘুমিয়ে পড়েছিলেন সেদিন হাজারিকা। সেই ঘুম আর তার ভাঙ্গেনি কখনো। তার ছোট ছেলে পরের দিন সকালে আমাকে বলেন,  “দেউতা ঢুকাল” (বাবা মারা গেছেন)। মনে মনে বললাম, ‘হয়তো এখন থেকে তাকে আর অঘোরি হতে হবে না।

সালমোড়া থেকে কয়েক কিলোমিটার পশ্চিমে সুমোইমারী গ্রাম। সেখানেও মানুষের একই গল্প। রবিরাম কুটুম সত্তরের মাঝামাঝি বয়স। একসময় তার ২০০টিরও বেশি গবাদি পশু ছিল এবং তিনি একটি বড় খামারের মালিক ছিলেন। ১৯৮৭ সালে ভয়াবহ এক বন্যা কুটুমের জীবন চিরতরে বদলে দেয়। তার মেয়ে রুমি সেদিনের ঘটনা বর্ণনা করতে গিয়ে বলেন, “সেই রাতে একটি আকস্মিক বন্যা হয়েছিল, তাদের গোয়ালঘরটি তাত্ক্ষণিকভাবে ডুবে যায়। আটকে না রাখা ছোটো বাছুরগুলো বন্যার পানিতে ভেসে যায়, আর অল্প কিছু যারা অলৌকিকভাবে বেঁচে যায় তারা শেষ পর্যন্ত বাঁধের উপর তাদের অস্থায়ী শিবিরে অনাহারে মারা যায়।

Two men cycle through floodwater past pigs, while a man looks at the camera in the background
২০১৩ সালের সেপ্টেম্বরে মাজুলির একটি প্লাবিত গ্রামের বাসিন্দাদের দৈনন্দিন জীবন যাপনের চিত্র (ছবি: মিতুল বড়ুয়া)

রুমি বলেন, “১৯৮৭ সালের বন্যার পর আমার বাবা স্বাভাবিক আচরণ করা বন্ধ করে দেন। তিনি বলেন, “সেই বন্যার স্মৃতি  তাকে সবসময় কাঁদায়। আমি মনে করি তিনি ১৯৮৭ বন্যার ফলে যে মানসিক আঘাত পেয়েছিলেন তা থেকে এখনও সেরে উঠতে পারেননি। তিনি কথা বলা বন্ধ করেছেন এবং এখন আর বাইরে যান না, এমনকি প্রতিবেশীর বাড়িতেও যান না। তার চোখের সামনে অনেক গবাদি পশু খুটির সাথে বাঁধা অবস্থায় ডুবে যাওয়ার দৃশ্য এখনও তাকে তাড়া করে।

রুমি আরও বলেন, ১৯৮৭ থেকে ২০১৩ সালের মধ্যে নদীভাঙনের কারণে তাদের পরিবার চারবার এক স্থান থেকে অন্য স্থানে চলে যেতে বাধ্য হয়। অনেকটা রাগতস্বরে তিনি বলেন,

“আমরা এখনও সরকারের কাছ থেকে কোনো ক্ষতিপূরণ পাইনি – না বন্যার ক্ষতির জন্য, না বারবার বাস্তুচ্যুত হবার জন্য। নির্বাচনের সময় সরকার অনেক প্রতিশ্রুতি দেয়, কিন্তু এগুলি মিথ্যা প্রতিশ্রুতি, এমন সব প্রতিশ্রুতি যা কখনও পূরণ করা হয় না।”

বন্যা এবং নদীভাঙনের কারণে মানিক হাজারিকা এবং রবিরাম কুটুমের পরিবারই যে ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছে তা নয়, সালমোরা এবং সুমইমারী মাজুলির একমাত্র ঝুঁকিপূর্ণ গ্রাম নয়। বরং, তাদের বিষয়গুলো সামগ্রিকভাবে এই দ্বীপ এবং বিশেষ করে নদীতীরবর্তী গ্রামগুলির যে ভয়াবহ সংকটের মুখে রয়েছে তারই একটি উদাহরণ।

‘স্লো ডিজাস্টার: পলিটিক্যাল ইকোলজি অব হ্যাজার্ডস অ্যান্ড এভরিডে লঅইফ ইন দ্য ব্রক্ষ্মপুত্র ভ্যালি, আসাম” মিতুল বড়ুয়া প্রকাশিত এই রিপোর্ট এখানে পাওয়া যাবে।

Privacy Overview

This website uses cookies so that we can provide you with the best user experience possible. Cookie information is stored in your browser and performs functions such as recognising you when you return to our website and helping our team to understand which sections of the website you find most interesting and useful.

Strictly Necessary Cookies

Strictly Necessary Cookie should be enabled at all times so that we can save your preferences for cookie settings.

Analytics

This website uses Google Analytics to collect anonymous information such as the number of visitors to the site, and the most popular pages.

Keeping this cookie enabled helps us to improve our website.

Marketing

This website uses the following additional cookies:

(List the cookies that you are using on the website here.)