কপ ২৮ বা ইউএন ফ্রেমওয়ার্ক কনভেনশনের 2৮তম জলবায়ু পরিবর্তন সংক্রান্ত শীর্ষ সম্মেলন এই বছরের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ একটি সম্মেলন। এবারের এই সম্মেলনে বরাবরের মতো এই করভেনশনে স্বাক্ষর করা ১৯৮টি দেশের শীর্ষ নেতারা একত্র হয়ে জলবায়ু পরিবর্তনের ক্ষতিকর প্রভাবগুলোকে মোকাবেলা করতে ঐক্যবদ্ধ সিদ্ধান্ত নেয়ার উদ্দেশ্যে কথা বলবেন। জাতিসংঘের সকল সদস্য রাষ্ট্র এবং ইউরোপীয় ইউনিয়ন এই কনভেনশনের অংশ হিসেবে বরাবরই এই সম্মেলনে মিলিত হয়ে থাকে।
২০১৫ সালে প্যারিস চুক্তি স্বাক্ষরের পর থেকে, জলবায়ু সম্মেলনগুলো বৈশ্বিক উষ্ণতাকে “২ ডিগ্রি সেলসিয়াসের নীচে” সীমাবদ্ধ করার লক্ষ্যে এর বাস্তবায়ন এবং অগ্রগতির দিকে মনোনিবেশ করে আসছে এবং “তাপমাত্রা বৃদ্ধি প্রাক-শিল্প স্তরের চেয়ে ১.৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসে সীমাবদ্ধ রাখার বিষয়ে কাজ করে যাচ্ছে।”
কবে এবং কোথায় কপ ২৮ অনুষ্ঠিত হবে?
কপ ২৮ এর সভাপতি কে?
কপ ২৮-এ কোন বিষয়গুলো নিয়ে আলোচনা হতে পারে?
এবারের কপ২৮ কেন বিতর্কিত?
কপ ২৮ থেকে ভারত এবং দক্ষিণ এশিয়ার অন্যান্য দেশগুলোর প্রত্যাশা?
কবে এবং কোথায় কপ ২৮ অনুষ্ঠিত হবে?
এবছর ৩০ নভেম্বর থেকে ১২ ডিসেম্বর পর্যন্ত সংযুক্ত আরব আমিরাতের দুবাইতে অনুষ্ঠিত হবে এবারের জলবায়ু শীর্ষ সম্মেলন বা কপ ২৮। এই শীর্ষ সম্মেলনটি দুবাইয়ের এক্সপো সিটিতে অনুষ্ঠিত হবে যা শহরের দক্ষিণে অবস্থিত। ২০২০ সালে ওয়ার্ল্ড ফেয়ার এক্সপো-এর জন্য এটি তৈরি করা হয়েছিল।
কপ ২৮ এর সভাপতি কে?
গত জানুয়ারিতে যে ঘোষণা দেয়া হয় তা অনুসারে এবারের সম্মেলনের সভাপতি হচ্ছেন সুলতান আহমেদ আল জাবের যিনি সংযুক্ত আরব আমিরাতের শিল্প ও উন্নত প্রযুক্তি মন্ত্রী এবং একইসাথে আবুধাবি জাতীয় তেল কোম্পানির সিইও। এই ঘোষণাটি পরিবেশবাদী সংগঠনগুলোর ব্যাপক সমালোচনার মুখে পড়ে। তাদের অনেকের মতে এটি জলবায়ু পরিবর্তনের ইতিবাচক সিদ্ধান্তগুলোর সাথে সাংঘর্ষিক।
কপ ২৮-এ কোন বিষয়গুলো নিয়ে আলোচনা হতে পারে?
কপ ২৮-এ প্রথমবারের মতো গ্লোবাল স্টকটেক নিয়েই মূল আলোচনার হতে যাচ্ছে যা এবাররে দুবাইয়ে শীর্ষ সম্মেলনের মধ্য দিয়ে শেষ হবে। দুই বছরের এই প্রক্রিয়ায়র মাধ্যমে সদস্য দেশগুলো নিজেদের ক্ষেত্রে জলবায়ু সংক্রান্ত কী ধরনের পদক্ষেপ গ্রহন করেছে তা নিয়ে তথ্য সংগ্রহ করা হয় এবং সামগ্রীক কর্মকাণ্ডে কী ধরনের প্রতিবন্ধকতা রয়েছে সেগুলো চিহ্নিত করা হয়। এর মাধ্যমে প্যারিস চুক্তির সামগ্রিক বাস্তবায়ন কতটুকু সম্ভব হলো তা মূল্যায়ন করা যাবে। কপ ২৮ সম্মেলনে এই স্টকটেকের সাম্রগীক পরিস্থিতি কী এবং জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মেকাবেলায় কতটুকু কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহন করা হয়েছে সে সম্পর্কে একটি রেসোলিউশন গ্রহন করা হবে। এতে রাষ্ট্রগুলোর পক্ষ থেকে নতুন অঙ্গীকার অন্তর্ভুক্ত করা যাবে বলে আশা করা হচ্ছে।
সেপ্টেম্বরে প্রকাশিত গ্লোবাল স্টকটেক প্রতিবেদন অনুযায়ি প্যারিস চুক্তির লক্ষ্য পূরণের ক্ষেত্রে বিশ্বের কোনো দেশই প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়নের পথে পিছিয়ে আছে। এবছর অক্টোবরের শুরুতে, ইউএনএফসিসি সচিবালয়ের পক্ষ থেকেও প্রথম গ্লোবাল স্টকটেকের উপরে একটি সার-সংক্ষেপ প্রকাশ করা হয়।
এবছর জুলাই মাসে কপ ২৮ এর সভাপতি এক ঘোষণায় বলেন এবারের শীর্ষ সম্মেলনে মূলত চারটি “বিশেষ পরিবর্তন” এর উপর দৃষ্টি নিবদ্ধ করা হবে:
• জীবাশ্ম জ্বালানি থেকে বেরিয়ে আসার কার্যক্রম আরো ত্বরান্বিত করা;
• জলবায়ু অর্থ ব্যবস্থার রূপান্তর;
• জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবেলায় জনগণএবং প্রকৃতির ভূমিকা;
• এবং নারী, আদিবাসী, স্থানীয় সম্প্রদায়, তরুনদের শীর্ষ সম্মেলনে অন্তর্ভুক্তি নিশ্চিত করা।
তবে কীভাবে এই লক্ষ্যগুলো এমন একটি রাষ্ট্রের নেতৃত্ব দ্বারা নিশ্চিত করা যাবে যেটি জীবাশ্ম জ্বালানীতে প্রচুর পরিমাণে বিনিয়োগ করে এবং যে দেশে বাক ও সমাবেশের স্বাধীনতার উপরে রয়েছে কঠোর বিধিনিষেধ। এবারেরর সম্মেলনে এই বিষয়টিকেই সবচেয়ে বেশি বিতর্কিত একটি বিষয় হিসেবে দেখা হচ্ছে।
সম্মেলনে লস অ্যান্ড ড্যামেজের বিষয়টি সবার মনোযোগের কেন্দ্রবিন্দুতে থাকবে বলে ধারনা করা হচ্ছে। বিশেষ করে এ সংক্রান্ত তহবিলের অগ্রগতি কী উন্নয়নশীল দেশগুলো তা জানতে চাইবে, কারন জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে সৃষ্ট অপরিবর্তনীয় ক্ষতি মোকাবেলায় উন্নয়নশীল দেশগুলোকে সহায়তার জন্য উন্নত দেশগুলো এই অর্থ প্রদানের প্রতিশ্রুতি করে। এই তহবিলটি প্রতিষ্ঠার বিষয় গত বছরের মিশরের শার্ম এল-শেখ-এ অনুষ্ঠিত কপ ২৭ শীর্ষ সম্মেলনে উন্নয়নশীল দেশগুলো উন্নত দেশগুলোর সঙ্গে কঠিন লড়াইয়ের মধ্য দিয়ে একটি চু্ক্তিতে উপনীত হয়, যা একটি বিরাট সাফল্য। তবে এই চুক্তির কার্যকারিতা নির্ভর করবে এটি কীভাবে কাজ করে এবং এটি কত অর্থ আকর্ষণ করতে পারে তার উপর। কপ ২৭-এ দুই বছরের মধ্যে লস অ্যান্ড ড্যামেজ তহবিল প্রতিষ্ঠা করার বিষয়ে সিদ্ধান্ত হয়। যেহেতু এখনো এই সময়সীমা বাকি রয়েছে তাই এটি এবারের আলোচনায় মূখ্য সূচিতে নাও থাকতে পারে। তবে সুশীল সমাজ এবং উন্নয়নশীল দেশগুলো এই তহবিল প্রতিষ্ঠার অগ্রগতি যে আশাব্যঞ্জক নয় এবং এটি জরুরীভিত্তিতে বাস্তবায়ন করার প্রয়োজনীয়তা নিয়ে জোর চাপ সৃষ্ট করতে পারে বলে অনেকেই মনে করেন।
এবারের কপ ২৮ কেন বিতর্কিত?
অনেক পরিবেশবাদী সংগঠন এবং বিশেষজ্ঞ এই নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন যে কপ ২৮ আয়োজন করা হচ্ছে সংযুক্ত আরব আমিরাতে যা জীবাশ্ম জ্বালানী উৎপাদনকারী দেশগুলোর মধ্যে অন্যতম। আর তাই এই সম্মলনের ফলাফল যথেষ্ট জোরদার নাও হতে পারে। কারন মনে রাখতে হবে যে বৈশ্বিক উঞ্চতা ২ সে এর মধ্যে সিমাবদ্ধ রাখতে হলে জীবাশ্ম জ্বালানীর ব্যবহার রোধ করার প্রচেষ্টাকে তীব্রতর করা উচিত।
কপ ২৮ এর সভাপতি হিসেবে সুলতান আল জাবেরের নিয়োগ নিয়ে ব্যাপক সমালোচনা হচ্ছে কারন তিনি বিশ্বের অন্যতম বৃহত্তম তেল কোম্পানির সিইও এবং জীবাশ্ম জ্বালানি উত্তোলনে ব্যাপকভাবে বিনিয়োগ করে চলেছেন। গ্রিনপিস বলেছে যে এই নিয়োগে তারা “গভীরভাবে উদ্বিগ্ন।” তারা বলেন, “বিশ্বব্যাপী জলবায়ু আলোচনায় জীবাশ্ম জ্বালানী শিল্পের জন্য কোন স্থান নেই।” ক্রিশ্চিয়ান এইড বলেছে যে এখানে “স্বার্থের সংঘাত সুস্পষ্ট।”
আল জাবের নিজেকে এমন একজন ব্যক্তিত্ব হিসাবে তুলে ধরছেন যিনি জীবাশ্ম জ্বালানী সংস্থাগুলিকে তেল এবং গ্যাসের ব্যবহারে “ফেজ ডাউন” নিয়ে আলোচনার টেবিলে রাখতে পারেন বলে দাবী করছেন। অথচ তার এই অবস্থান বিতর্কিত – অনেক দেশই “জীবাশ্ম জ্বালানী ব্যবহার বন্ধে” সময়সীমা আরো সংক্ষিপ্ত করার জন্য চাপ দিয়ে যাচ্ছে।
এছাড়া প্রতিবাদ এবং মত প্রকাশের স্বাধীনতাকে ঘিরে সংযুক্ত আরব আমিরাতের বিধিনিষেধমূলক আইন নিয়েও উদ্বেগ প্রকাশ করেছে বিশ্বজুড়ে সুশীল সমাজের নেতৃবৃন্দ। সাধারণত জলবায়ু সম্মেলনের সময় স্বাগতিক দেশে বড় বড় বিক্ষোভ অনুষ্ঠিত হয়। অক্টোবরের শুরুতে, যুক্তরাজ্য জাতিসংঘে সংযুক্ত আরব আমিরাতের কাছ থেকে আশ্বাস চেয়েছিল যে কীভাবে শীর্ষ সম্মেলনের আয়োজক হিসেবে সংযুক্ত আর আমিরাত মত প্রকাশের স্বাধীনতা এবং জমায়েত নিশ্চিত করবে।
কপ ২৮ থেকে ভারত এবং দক্ষিণ এশিয়ার অন্যান্য দেশগুলোর প্রত্যাশা?
ভারত এবং দক্ষিণ এশিয়ার অন্যান্য দেশগুলোর পাশাপাশি বিশ্বের উন্নয়নশীল দেশগুলি, কপ ২৮-এ প্রধানত একটি জিনিসের দিকে তাকিয়ে থাকবে: প্রচুর পরিমানে জলবায়ু তহবিল।
জলবায়ু পরিবর্তনের জন্য সবচেয়ে বেশি দায়ী বিশ্বের উন্নত দেশগুলোর কাছ থেকে ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলো আর্থিক সহায়তার দাবী জানিয়ে আসছে। অথচ প্রায় দুই দশক ধরেই বিশ্বের উন্নত দেশগুলো এই দাবীর বিপক্ষে বাঁধা দিয়ে আসছে। উন্নয়নশীল দেশগুলিতে জলবায়ু সংক্রান্ত কর্মকাণ্ডকে সমর্থন করার জন্য প্রতি বছর ১০০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার জলবায়ু অর্থ প্রদানের জন্য ২০০৯ সালে করা প্রতিশ্রুতি পূরণ করতে উন্নত দেশগুলি ধারাবাহিকভাবে ব্যর্থ হয়েছে – এবং এমনকি দরিদ্র দেশগুলিকে তাদের অর্থনীতিকে ডিকার্বনাইজ করতে হবে এবং মানিয়ে নিতে হবে। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব, এখন অনুমান করা হয়েছে প্রতি বছর ট্রিলিয়ন ডলারে।
২০২৩ সালের জুনে প্যারিসে অনুষ্ঠিত নিউ গ্লোবাল ফাইন্যান্সিং প্যাক্টের শীর্ষ সম্মেলনে উন্নয়নশীল দেশগুলো জলবায়ু অর্থায়ন হিসাবে প্রাপ্তির চেয়ে তাদের ঋণ প্রদানের জন্য বেশি অর্থ প্রদানের মতো বিষয়গুলিকে সামনে নিয়ে আসে। আরও ছাড় এবং অনুদান-ভিত্তিক অর্থায়ন এবং স্বল্পোন্নত দেশগুলোর জন্য ঋণ বাতিলের জন্য উন্নয়নশীল দেশগুলো বিশ্বব্যাংক ও এর সহযোগী সংস্থাগুলোর পুনর্গঠন দাবি জানায়। এই বিষয়গুলো এবারের কপ ২৮ সম্মেলনে অবধারিতভাবে আসবে বলে ধারনা করা হচ্ছে।